সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

ফেরারি : সোহানা স্বাতী


প্রকাশিত:
৮ জুলাই ২০২০ ২১:৫০

আপডেট:
৮ জুলাই ২০২০ ২২:৩৫

ছবিঃ সোহানা স্বাতী

 

বাবা মেয়ের মৌনযুদ্ধ চলছিল বেশ ক'দিন থেকেই, আজ রাতে মৌনতা ভাষা পেল, সেই সাথে রাগ ক্ষোভ অভিমানের প্রকাশ নিমিষেই। মেয়েটা বাংলা বলে না সহজে, বাবা মাকে বুঝিয়ে কোন কিছু আদায় করার সময় সে বাংলা বলে, এটা তার একটা কৌশল ছেলেবেলা থেকেই। এখানেই জন্ম, এখানেই বেড়ে ওঠা, সে অর্থে তার দেশ এটাই। আমরা মনে ধরে রাখি ছেড়ে আসা দেশকে, সেটাও ফিকে হতে হতে ছিন্নপ্রায় একটা সুতোয় এসে ঠেকেছে এখন। তবে বিশেষ বিশেষ সময় সেই সুতো জানান দেয় তার অস্তিত্ব, ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়া সুতোর মত প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় যেন কেটে ফেলতে চায় প্রতিপক্ষকে। আজ সেই সুতোয় টান পড়েছে আমার স্বামীর। এনাম কিছুতেই মানতে পারছে না ভিনদেশি ছেলে তার মেয়ের জীবনসঙ্গী হবে। দেশের ভিন্নতা নিয়ে যতটা আপত্তি তারচেয়েও ঘোর আপত্তি অন্য জায়গায়, সেটা আমি জানি। মায়াও তার বাবার এতদিনের চেনা মুখটা মেলাতে পারছে না কিছুতেই, প্রগতিশীল বাবার মুহূর্তেই বদলে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না সে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় আবৃত্তি শেখার সময় বাবার দরাজ কণ্ঠের শুদ্ধ উচ্চারণ, ' গাহি সাম্যের গান ...' মিলছে না তো কিছুতেই । বাবা মানুষকে ছোট করতে শেখায়নি কখনো। বাবার উদারতায় তার আস্থা ছিল। বিশ্বাস ছিল বাবা তার পছন্দের বিরোধিতা করবে না কখনো, আব্রাহামকে মেনে নেবে।

ক'দিন আগেই মায়া জানিয়েছিল ছেলেটার কথা।আগামী মাসে বিয়ে করতে চায় তারা , ওদের বোঝাপড়া হয়ে গেছে এখন শুধু আমাদের অনুমতির অপেক্ষা।আজ ডিনার টেবিলে কথাটা উঠতেই যেন সব ওলটপালট হয়ে গেল। মেয়ে বাবাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে বাংলায়, বাবা অনর্গল ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ কোন ছেলেকে তিনি পরিবারে আনার পক্ষপাতি না, সে ছেলে এতিম হোক আর মুসলিম হোক। এতো বছরের প্রবাস জীবনে তিনি অনেক কিছুর সাক্ষী, বর্ণবাদ আন্দোলনের বিরোধিতা করে না এনাম কিন্তু এদের উগ্রতা এবং হিংস্রতার প্রমাণ দেখেছে খুব কাছ থেকে। কদিন আগেই নাজমা খানম নামে প্রতিবেশী এক বয়স্ক মহিলা কালো এক যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হল। রাতে নিজস্ব দোকান বন্ধ করে হেঁটে বাসায় ফিরছিল, সামান্য কিছু টাকা সাথে ছিল তার, চাওয়া মাত্র টাকাটা দিতে অস্বীকৃতি জানানই ছিল অপরাধ। কৃষ্ণাঙ্গদের এমন হেইট ক্রাইম বেড়েই চলেছে এখানে। ওদের চোখে যে আক্রোশ দেখেছে সে এতদিনের প্রবাস জীবনে, তা থেকে নিজের মেয়ের জীবন সুরক্ষিত রাখতে চায় এনাম। আরও একটা কারণ আছে গলায় বিঁধে থাকা কাঁটার মত , পরবর্তী প্রজন্ম পৃথিবীর আলো দেখবে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়ে।নাহ, কিছুতেই এমন হতে দেবে না সে। আমরাও তো ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ণশঙ্কর জাতি, প্রায় কৃষ্ণবর্ণের জনগোষ্ঠী , শ্বেতাঙ্গ না। কাজেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মে কালোই প্রকট হবে।

আব্রাহামের শিক্ষা , রুচি , সততা , সবকিছুই অবহেলায় অগ্রাহ্য হল। 'সবার উপরে মানুষ সত্য' বাবার শেখানো নীতিকথাটা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকল মায়ার সামনে ডাইনিং টেবিলে পড়ে থাকা খাবারের মত। যুক্তি তর্কে মায়া অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও যখন সফল হল না, সে তখন শেষ চেষ্টা করল ইমোসন্যালি , সে জানাল আব্রাহাম ছেলেবেলা থেকে অরফানেজ হোমে মানুষ, অন্তত তাকে একটা ফ্যামিলি দিতে পারি আমরা। বাবার নীরবতা মায়াকে নিরাশ করল।

অমিমাংসিত বাকযুদ্ধে হেরে যাওয়া দুই যোদ্ধা যে যার ঘরে চলে যাবার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত ময়দানে একা থেকে গেলাম আমি। ডাইনিং টেবিলে পড়ে থাকা থালা , গ্লাস, পড়ে থাকা খাবারের পরিশিষ্ট সবকিছু গুছিয়ে শোবার ঘরে যেতে হবে। কিছুতেই হাত লাগাতে ইচ্ছে করছে না, হাতও ধোয়া হয়নি, গালে হাত দিয়ে বসে আছি আমি। রাত বেড়েছে অনেক, চারিদিকে বড় দিনের আগমনী প্রস্তুতি, ঝিরি ঝিরি তুষারের চাদরে ঢেকেছে পুরো শহর, শুধু মনের কষ্টগুলো ঢেকে দিতে পারেনি ঠিকঠাক। মনটা যেন বশে থাকছেনা আজ, কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে । আমার অবয়বটা শুধু পড়ে আছে এখানে, আমি চলে গেছি ২৬ বছর আগে, পদ্মা পারের সেই শহরে, মহিষবাথান কলোনির সেই পুরানো দোতলা বাড়িতে।

মায়ার মত আমি সেদিন বাবার সাথে যুক্তি তর্কে যেতেই পারিনি। ২২ বছরের আমার সব মুগ্ধতা কেড়ে নিয়েছিল সেই যুবকের মায়াবী চোখ। ওর চোখের দিকে তাকালেই আমি সবকিছু ভুলে যেতাম, কথা বলতে পারতাম না, ওর হাত দুটো ধরে বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোকেয়া হলের পেছনে, ক্লাস মিস হত, দুপুরের বাস মিস হত ,প্রতিদিন বাড়ি ফিরতাম ৫ টা ১০ এর বাসে। কোর্ট বাসে ছাত্রছাত্রী একসাথে ওঠা যেত, সে পৌঁছে দিয়ে যেত আমাকে।রাত পেরুলেই আবার ক্যাম্পাস , আবার ডুবে যাওয়া ওই চোখে। পৃথিবী যেন আনন্দ খনির দুয়ার খুলে দিয়েছিল আমায়।

বাসায় জানতে বেশী সময় লাগল না, আমার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অনার্সের ফরম ফিলাপের জন্য অনেক কষ্টে একটা দিন বের হওয়ার অনুমতি মিলল যখন, সোজা কাজী অফিস। পরনে ব্রাউন সালোয়ার কামিজ।লাল জর্জেট ওড়নাটাই মাথায় দিয়ে , ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধুকে সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়ে গেল কাগজে কলমে।আর কেউ বাধা হতে পারবে না আমাদের একসাথে পথ চলায়।সবে মাস্টার্স শেষ হয়েছে তার, সেদিন দুপুরেই সে চলে যায় ঢাকায় চাকরীর ভাইভা দিতে। যাবার সময় কপালে ছোট্ট লাল টিপ বরাবর চুমু খেয়ে বলে যায় খুব শীঘ্রই বউ নিতে আসবে সে। সেদিন দু'চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বাসায় ঢুকি আমি, কেউ জানতেও পারে না এ বাড়ির আদরের ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল আজ।তারপর আর বের হইনি, ক্যাম্পাসে যাইনি, ইচ্ছে করেই বন্দী করি নিজেকে শাসনের বেড়াজালে, আমার নিজের স্বপ্নজালে। এরপর সবকিছু ঘটে যায় খুব দ্রুত। স্বপ্নের জাল কেটে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে না মোটেও। আমি ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই একটা গল্পের ইতি কিন্তু আমি বুঝিনি উপরে বসে আছেন সব থেকে বড় গল্পকার, গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেবার সব আয়োজন করে রেখেছেন তিনি, গল্পের গতিপথ লিখতে নতুন করে কলম ধরেছেন লেখক।

বেশ কিছুদিন ধরেই বাবার শরীর ভালো যাচ্ছিল না, হঠাৎ বাবা বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লেন।দ্বিতীয় বারের স্ট্রোকে শরীরের একটা পাশ অবশ হয়ে গেল, বাবাকে ভর্তি করা হল ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে, আমাদের পরিবারে হঠাৎ যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। আমার বিয়ের জন্য বাবা বেশ জোর দিতে শুরু করলেন ভাই বোনদের। এই অবস্থায় দিশেহারা আমি জানিয়ে দিলাম বিয়ের কথা।ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেছে জানলে কেউ আর আমাদের আলাদা করতে পারবে না। একে বাবার অসুস্থতা তার উপর আমার গোপন বিয়ের খবরে আমাদের পরিবারে যেন ঝড় বয়ে গেল।

কাল বৈশাখীর পর যেমন শান্ত হয় সবকিছু, তেমনি বাবাও একসময় শান্ত হলেন, ছেলেকে ডেকে পাঠালেন মেনে নেবার প্রস্তুতি হিসেবে।ঢাকায় তার তখন নতুন চাকরী, সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, হাসপাতালে দেখা করে প্রয়োজনীয় কথা সেরে বিদায় নেবার সময় ছেলের হাত ধরে বাবা কিছু একটা বলতে যাবেন, ঠিক তখনই বিষয়টা চোখে পড়ে বাবার , হবু জামাতার হাত ছেড়ে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন বাবা। তার আঙ্গুলের সামান্য শ্বেতরোগ মোটেও চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি আমার পর্যবেক্ষক বাবার।

ঢাকার চিকিৎসা শেষে একসময় বাসায় ফিরলেন বাবা। সাবধানতা আর বিশ্রামই তার একমাত্র চিকিৎসা তখন।বাবা আমাকে ডেকে বাঁকা মুখের জড়িয়ে যাওয়া উচ্চারণে কষ্ট করে জানালেন,' মারে আমি এমনিতেই বেশিদিন বাঁচব না, একটু শান্তিতে মরতে চাই মা। শ্বেতী বংশগত রোগ, আমি আমার মেয়েকে জেনে শুনে এ রোগের সাথে বসবাস করতে দিতে পারব না।' আমার কাছে এই সাদা রোগ কোন সমস্যা না এই কথা আমি ভাই বোনদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু তারা কেউ বাবার কথা অগ্রাহ্য করার বা মৃত্যুপথযাত্রী বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতে রাজি হল না , সবাই উল্টা আমাকে বুঝাতে লাগল বিয়ে মানে শুধুমাত্র দুজনের বন্ধন না , বিয়ে মানে আগামী প্রজন্মেরও সুরক্ষা।

বাবার বেঁকে যাওয়া মুখের বারবার অনুরোধ, বোবা চাহনি আর চোখের জল উপেক্ষা করার মত শক্তি হলনা আমার। তার কথামত বাড়িতে আসা উকিলের কাগজে একটা স্বাক্ষর করে আমি মুক্ত হলাম কাগজের বৌ থেকে। জীবনের এতো বড় ঘটনা চাপা পড়ে গেল কাগজের ফাইলের আড়ালে।আমার জীবন সুরক্ষিত করে বাবা চলে গেলেন, বাবার মৃত্যুর পরই বড়ভাই আমাকে নিয়ে এলো, নিউইয়র্কে। দুঃসহ সময়টায় পালিয়ে এসে যেন বাঁচলাম আমি, বাই পোস্টে কাগজটা হাতে পেয়ে কেউ হয়ত এই ভেবে সান্ত্বনা খুঁজে নিল উন্নত দেশের হাতছানির কাছে হেরে গেল তার কাগজের বৌ।

দেশ থেকে চলে আসবার সময় তেমন কিছু সাথে আনিনি। সবকিছু ফেলে এলাম আমি, সাথে নিয়ে এলাম দীর্ঘশ্বাস। সব ফেলে এলেও একটা ছোট্ট ওয়াকম্যান আর মান্না দের একটা অডিও ক্যাসেট সুটকেসে তুলেছিলাম, হয়ত মনের অজান্তেই। এদেশে এসে বন্ধু বান্ধব আর কারও সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করিনি, তার সাথে তো নয়ই, সে মুখও ছিল না আমার। স্মৃতির জানালা কপাট বন্ধ করে দিলাম নিজ হাতে, তবুও সেই শীতের রাতগুলোতে যখন কাজ শেষে ট্রেনে একা একা ফিরতাম , কানে গোঁজা মান্নাদের সুর, ' তোমার নিঃশ্বাসে বিষ ছিল ...' মনে করিয়ে দিত আমার কাগজি জীবনের আদ্যোপান্ত।

আমাকে সময় দেওয়া হল নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার, সবকিছু ভুলে যাওয়ার। 
পরিবারের সহায়তায় একসময় সুনিপুণ অভিনয় শিখে গেলাম সবাইকে সুখী করার, এনাম কখনো জানতে পারল না আমার ফেলে আসা জীবনের কথা, আমার কাগজের বৌ হওয়ার গল্প, আমার হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হওয়ার উপাখ্যান।আজ এতো বছর পর বাবা মেয়ের এই জিদ যেন নতুন করে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাল ওদের অজান্তেই। রাত বেড়েছে অনেক, তুষারে ঢাকা শহরে নেমে এসেছে শ্বেত শুভ্রতা, এক রহস্যময় পবিত্রতা । কুয়াশায় স্বচ্ছতা হারিয়েছে জানালার কাঁচ, ঝাপসা হয়ে আসছে দূরের দৃষ্টি, ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ।

খাবার টেবিলে সবকিছু যেমন পড়ে আছে থাক। উঠতে হবে আমাকে, অনেক কাজকর্ম বাকী, মায়ার ব্যাগটা ঠিকমত গুছিয়ে দিতে হবে, ওর দরকারি জিনিসপত্র, সার্টিফিকেট কিছুই যেন বাদ না পড়ে । আরও একটা কাজ করতে হবে আমাকে, মেইন গেইটের চাবিটা এনামের ঘর থেকে এনে হাতের কাছে রাখতে হবে।একটা চিরকুটও লিখতে হবে, " জীবনটা তোমার, অন্য কারও নয়।" সারা বাড়ির বাতি নেভাতে হবে, মেয়ের মুখোমুখি হতে চাই না আমি। সে যেন দেখে না ফেলে মায়ের পলাতক চোখ। 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top