সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি, কালচার ও ধর্মঃ এডভোকেট দিদার আলম কল্লোল


প্রকাশিত:
২১ জুলাই ২০২০ ২২:২৯

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ২০:১৩

         
'সংস্কৃতি' বহুল উচ্চারিত একটি শব্দ। যাকে ইংরেজিতে কালচার বলে। তবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষরা যতটা না সংস্কৃতি বুঝে তার চেয়ে বেশি কালচার বুঝে। রিক্সাওয়ালারা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ইউনিভার্সিটি বেশি বুঝে। অনেকেই সভ্য ও সংস্কৃতি অর্থাৎ সিভিলাইজড ও কালচার শব্দগুলো গুলিয়ে ফেলেন, সমার্থক ভাবেন। যেমন কাউকে অসভ্য বুঝাতে গিয়ে আমরা প্রায়ই আনকালচার্ড বলি, আনসিভিলাইজড বলি না। এছাড়াও অনেকে কালচারকে স্বভাব, আচরণ ও অভ্যাসেরও সমার্থক ভেবে থাকেন।

কিন্তু আসলে কি তাই? আমরা কথায় কথায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, বাঙ্গালী সংস্কৃতি, মুসলিম সংস্কৃতি, হিন্দু সংস্কৃতি, ভীনদেশী সংস্কৃতি, নিজস্ব সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ঋন খেলাফি সংস্কৃতি, কালো টাকার সংস্কৃতি, মাল্টি কালচার, ভয়ের সংস্কৃতি ইত্যাদি শব্দগুলি প্রায়ই উচ্চারন করি। গুরুত্ব বিবেচনায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় ও আমাদের আছে। তবে আমার মনে হয় এটি শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নামে হলে ভালো হতো। এই যে সংস্কৃতি সংস্কৃতি বলতে আমরা মুখে ফেনা তুলে ফেলি সেই 'সংস্কৃতি' বলতে আসলে আমরা কি বুঝি? আমার মনে হয় অনেকের এ সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই। সাধারণত প্রাচীন ঐতিহ্য, প্রথা ও রেওয়াজ থেকে উৎসারিত প্রচলিত রীতি নীতি, আচার অনুষ্ঠান ও জীবনাচরনকেই আমরা সংস্কৃতি বা কালচার ভেবে থাকি।

কিন্তু না, বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিমান লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) সংস্কৃতি কে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর রচিত গ্ৰন্থের 'সংস্কৃতি কথা' নামক প্রবন্ধটি পড়লাম।

ছবিঃ মোতাহের হোসেন চৌধুরী 

এটি অবশ্য আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সিলেবাসে পাঠ্য। আমি মূলত বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় আগে এটি পড়ার সুযোগ হয়নি। লেখক উল্লেখিত এ প্রবন্ধে 'সংস্কৃতি'র ব্যাখা বিশ্লেষণসহ এর স্বরূপ উদঘাটন করে মানুষের যুক্তি, চিন্তা ও ভাবনার জগতে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে চেতনার বীজ রোপণ করেছিলেন তা কালে কালে পুস্প পল্লবে বিকশিত হয়ে আমাদের ঘুনেধরা দুর্নীতিগ্ৰস্থ সমাজে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, কতটা সুবাস ছড়াচ্ছে, তা একটু মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা কি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। এই অনুসন্ধিৎসা থেকে জ্ঞানের রাজ্যে উঁকি ঝুঁকি মেরেইতো চক্ষু চড়কগাছ। লেখকের 'সংস্কৃতি কথা' নামক প্রবন্ধটি প'ড়ে মনে হলো ইতিপূর্বে সংস্কৃতি শব্দটির এত গভীর থেকে গভীরে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি, এত ব্যাপকভাবে দ্ব্যার্থহীন ও বিশদভাবে সংস্কৃতিকে কেউ সংজ্ঞায়িত ও উপস্থাপন করতে পারেনি। ভাষার অপূর্ব শিল্পসম্মত দিক লেখাটির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। সত্যি বলতে কি এ প্রবন্ধটি প'ড়ে ও হ্নদয়ঙ্গম করতে আমাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে, আমার অনুর্বর মস্তিষ্কটি লাঠিমের মত ঘুরছে। অতি উচ্চমার্গের এ লেখাটিতে তিনি মানুষের শিক্ষা, ধর্ম, সঙ্গীত, প্রেম,আনন্দ, সৌন্দর্য,পঞ্চ ইন্দ্রীয়, নারী, প্রগতি, সভ্যতা, মতাদর্শ, আত্না, কাম, ক্রোধ, লোভ, মূর্খতা ও নিষ্ঠুরতার বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত, স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ এবং এসবের সাথে সংস্কৃতির সংশ্লেষ, যুগসূত্র,পার্থক্য এত নিখুঁত, সাবলীল, নির্দ্বিধায় ও বিস্ময়করভাবে চিত্রিত করেছেন, যা এক'শ বছর পরেও যে কতটা প্রাসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জ্ঞান পিপাসু, বোদ্ধা ও মুক্তচিন্তার মানুষ মাত্রেই এ প্রবন্ধটি প'ড়ে থাকবেন, তবে যারা এটি পড়েননি তাদের জন্য নুতন চিন্তা ও জ্ঞানের খোরাক জোগাতে পারে এ প্রবন্ধটি। বর্তমান বাস্তবতায় লেখাটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে আমি শুধু লেখাটির চুম্বক অংশগুলো এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, তবে কারো কোন কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে বা খটকা লাগলে তিনি সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি সংগ্ৰহ করে ভাল করে পড়ে নিতে পারেন।

দেখুন প্রবন্ধটির শুরুতেই তিনি দার্শনিকের মত  বলেছেন-'ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত ও মার্জিত লোকের ধর্ম'। কি বিস্ময়কর উক্তি! এর পর পরই তিনি লিখেছেন 'কালচার মানেই উন্নততর জীবন সম্মন্ধে চেতনা -- সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্মন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে, তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।'

ধর্ম ও সংস্কৃতি তথা কালচার বিষয়ে তাঁর সুগভীর উপলব্ধি বর্ননা করেন এভাবে-

'ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রন। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে। বাইরের আদেশ নয়, ভেতরের সূক্ষচেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের উপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষচেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষচেতনার অপর নাম আত্মা।'

কালচারের উদ্দেশ্য ও এর সাথে ধার্মিকতার সংশ্লেষ আরো খোলাসা করে মোতাহের হোসেন চৌধুরী লিখেন-

'শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত এগুলো সংস্কৃতির উদ্দেশ্য নয়- উপায়। উদ্দেশ্য নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যারা গ্ৰহন করে তারা আল্লাকে জীবনপ্রেরনা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। তাই শ'র উক্তি  ' Beware of the man whose God is in the skies'- আল্লা যার আকাশে তার সম্মন্ধে সাবধান। কেননা, তার দ্বারা যে কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আল্লাকে সে স্মরন করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করবার জন্যে আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সি্ট রিজার্ভ করার আগ্ৰহে- অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ।' এ প্রসঙ্গে তিনি আরো যোগ করেন-
'অপরদিকে কালচার্ড লোকেরা সব চেয়ে বেশী ঘৃনা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে, অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। .... তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কালচারের উদ্দেশ্য। যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই থাক কালচার নেই। কালচার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম। ব্যক্তির ভেতরের আমিকে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ।'

প্রবন্ধটির এক জায়গায় তিনি লিখেন-

'ধর্মের মত মতবাদ ও মনের জগতে লেফট-রাইট করতে শেখায়। ধার্মিকের জীবন নিয়ন্ত্রন করে ভয় আর পুরস্কারের লোভ। সংস্কৃতিবান মানুষের জীবনে ও-সবের বালাই নেই। তারা সবকিছু করে ভালবাসার তাগিদে। সত্যকে ভালবাসা, সৌন্দর্যকে ভালবাসা, ভালবাসাকে ভালবাসা- বিনা লাভের আশায় ভালবাসা, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে ভালবাসা- এরি নাম সংস্কৃতি। তাই ধার্মিকের পুরস্কারটি যেখানে বহুদুরে থাকে, সংস্কৃতিবান মানুষ সেখানে তার পুরস্কারটি পায় হাতে হাতে, কেননা, কাজটি তার ভালোবাসার অভিব্যক্তি বলে তার আনন্দ, আর আনন্দই তার পুরস্কার। সে তার নিজের স্বর্গটি নিজেই সৃষ্টি করে নেয়। বাইরের স্বর্গের জন্য তাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হয় না।'

সংস্কৃতির উদ্দেশ্য সম্মন্ধে তিনি আরেক জায়গায় লিখেন-

'পরম বেদনায়, অসংখ্য দুঃখের কাটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে সে অন্তরে যে গোলাপ ফুটিয়ে তোলে তাই তার স্বর্গ। সেই সৃষ্টি এবং তা অপরের সঙ্গে ভাগ করে ভোগ করা, কালচার্ড জীবনের উদ্দেশ্য। এই স্বর্গ যখন অন্তরে জাগে তখন বাইরেও তার প্রভাব উপলব্দ হয়। তখন স্বতঃই বলতে ইচ্ছে হয়ঃ
     “স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটির মায়ের কোলে
     বাতাসে সেই খবর ছোটে আনন্দ কল্লোলে”
        
ধর্ম সম্পর্কে তিনি তাঁর নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করে আরো পরিষ্কার করে লিখেন-   
   
'ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে, মানুষকে বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, বৃক্ষটিকে নিস্কন্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য। অপর পক্ষে কালচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ, পতন পাপ থেকে রক্ষা নয়‌। গোলাপের সঙ্গে যদি দু-একটা কাঁটা এসেই যায় তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে শুধু ফুল ফুটল কিনা- এ-ই কালচারের অভিমত। মনুষ্যত্বের বিকাশ সবচেয়ে বড় কথা, চলার পথে যে শ্খলন-পতন তা থেকে রক্ষা পাওয়াটাই বড় কথা নয়।

এ প্রসঙ্গে তিনি পঞ্চ ইন্দ্রীয়ের সাথে সংস্কৃতি ও এর উদ্দেশ্যের গাঁথুনি দেন এভাবে-

'বিকাশ কে বড় করে দেখে না বলে ধর্ম সাধারণতঃ ইন্দ্রীয় সাধনার পরিপন্থী। অথচ ইন্দ্রীয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবন সাধনারই অপর নাম কালচার। মন ও আত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত করে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের নবজন্মদানই কালচারের উদ্দেশ্য।.....চোখ ও কান 'আত্মার' জিহ্বা, এদের মারফতে সে তার খাদ্য চয়ন করে। অথচ, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, কোন কোন ধর্ম এই চোখ ও কানের সাধনারই পরিপন্থী, সেখানে তারা পতনের ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। তাই আমরা চোখ থাকতেও কানা, কান থাকতেও কালা। সুর বা ছবির সূক্ষতা আমাদের প্রানে দাগ কাটে না। চোখ ও কানের প্রতি বেখেয়াল থাকা যে আত্মার প্রতিই বেখেয়াল থাকা সংস্কৃতিবানরা তা বুঝলেও ধার্মিকের মাথায় তা সহজে ঢোকে না। তাই তারা শুধু ঈশ্বরের নাম নেয়, ঐশ্বর্য উপলব্ধি করে না।

সংস্কৃতির সাথে নারীর মেলবন্ধন তৈরি করে তিনি বর্ননা করেন এভাবে-

'ইন্দ্রীয়ের সাধনা বলে কালচারের কেন্দ্র নারী। নারীর চোখ মুখ, স্নেহ-প্রীতি, শ্রী ও হী নিয়েই কালচারের বাহন শিল্প-সাহিত্যের কারবার। জীবনের শক্তি, সাহস ও সাধনার প্রেরনা নারী থেকেই আসে। তাই কবির মুখে শুনতে পাওয়া যায়ঃ 'আমি হব না তাপস, হব না, হব না, যদি না পাই তপস্বিনী।' জীবনে তপস্যা করতে চায় বলে নারী-সঙ্গ কালচার্ড মানুষের এত কাম্য।'

প্রেম ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত-

'নিষিদ্ধ বস্তু সাধারণতঃ ভীতি ও অতিরিক্ত আকর্ষণ- এই দুই মনোবৃত্তির সংঘর্ষ বাধিয়ে জীবনে বিকৃতি ঘটায়। এখানেও তাই হল, যৌন ব্যাপার মন্দ, একথা না বলে যদি বলা হতঃ প্রেম ভাল, আনন্দ ভালো, প্রেমের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, তাহলে পৃথিবীর চেহারা হয়তো এত কদর্য হত না। প্রেমের দ্বারা কাম নিয়ন্ত্রিত হ'ত বলে ব্যভিচার ও বিরোধ উভয়ের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজ ও সুন্দর হতে পারত।
কিন্তু তা না বলে নীতিবিদরা মানুষকে সংযম শিক্ষা করতে বললেন, অথচ কোন্ বড় জিনিষের দিকে তাকিয়ে তা করতে হবে তা বাতলালেন না। কেবল স্বর্গের দিকে ইঙ্গিত করলেন। নীতিবিদদের জানা উচিত ছিল, সংযম বলে কোন স্বাস্থ্য- প্রদায়ী বস্তু নেই, আছে বড় জিনিষের জন্য প্রতিক্ষা আর সেই বড় জিনিষ হচ্ছে প্রেম। যে প্রেমে পড়েছে, অথবা প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করেছে সে-ই প্রতিক্ষা করতে শিখেছে, অর্থাৎ সে-ই সহজে সংযমী হতে শিখেছে, অপরের পক্ষে সংযম মানে পীড়ন আর পীড়ন নিষ্ঠুরতার জনয়িত্রী।

ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে অনুমিত সংঘাত ও সংশয় দূরীকরণে লেখক নিজে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিয়েছেন এবারে-

'প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ম আর কালচারকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হল তাতে মনে হচ্ছে নাকি ধার্মিক কখনো প্রকৃত অর্থে কালচার্ড হতে পারে না? কিন্তু কথাটি কি সত্য? ধার্মিকদের মধ্যেও তো অনেক কালচার্ড লোক দেখতে পাওয়া যায়।
উত্তরে বলবঃ তা বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে সেখানেও কালচারই কালচার্ড হওয়ার হেতু। অনুভূতি, কল্পনার সাধনা করেছেন বলেই তাঁরা কালচার্ড, অন্য কারনে নয়।'

মনুষ্যত্ব, মতবাদ ও মুল্যবোধ সম্মন্ধে তিনি উক্ত প্রবন্ধটির আরেক জায়গায় লিখেন-

সংস্কৃতি মানে জীবনের values সম্মন্ধে ধারনা। অতীতে ধর্ম ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করেছিল, বর্তমানে মতবাদ বা আদর্শ মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করতে পারে। লোকটা মোটের উপর ভালো কি মন্দ সেদিকে আমাদের নজর নেই, তার গায়ে কোন দলের মার্কা পড়েছে সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য। মার্কাটি নিজের দলের হলে তার সাতখুন মাফ, না হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার দোষ বের করা আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি না পেলে কালচার্ড হওয়া যায় না।... মতবাদী ধার্মিকের মত অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণ, ধার্মিকের মতোই দলবদ্ধতায় বিশ্বাসী, অধিকন্তু ধার্মিকের চেয়েও নিষ্ঠুর। ধার্মিকের নিষ্ঠুরতার সহায় ছিল ধর্মগ্ৰন্থের সমর্থন, মতবাদীর সহায় বিজ্ঞান। আমি আমার জন্যে নিষ্ঠুর হচ্ছি না, পৃথিবী-উন্নয়নের বিজ্ঞানসম্মত আদর্শের জন্যই নিষ্ঠুর হচ্ছি। অতএব এখানে আমার গৌরব নিহিত, কলঙ্ক নয়। নিষ্টুরতা- ব্যাপারে এই যুক্তিই মতবাদীর আত্মসমর্থনের উপায়। সৌভাগ্যের বিষয় সত্যিকার সংস্কৃতিকামীরা কখনো মতবাদী হতে চায় না, মতবাদকে তাঁরা যমের মত ভয় করে। কেননা তাদের কাজ বাইরের থেকে কোন দর্শন গ্ৰহন করা নয়, বহু বেদনায় নিজের ভিতর থেকে একটা জীবন দর্শনের জন্ম দেওয়া; এবং প্রতিদিন তাকে উন্নতির পথে চালনা করা।'

এ বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন-

তাই সংস্কৃতিবান মানুষটি একটা আলাদা মানুষ, স্বতন্ত্রসত্তা। তাঁর জীবনের একটি আলাদা স্বাদ, আলাদা ব্যঞ্জনা থাকে। সে মতবাদীর মত বুলি আওড়ায় না, তার প্রতি কথায় আত্মা স্পন্দিত হয়ে উঠে। প্রেমের ব্যাপারে সৌন্দর্যের ব্যাপারে এমনকি সাধারণতাধর্মী কল্যানের ব্যাপারেও তাঁর আত্মার ঝলকানি দেখতে পাওয়া যায়। সত্যিকার সংস্কৃতিকামীরা নিজেদের ছাঁচে ঢালাই করতে চায় না। নকল যীশু, নকল বুদ্ধ, নকল মার্কস বা নকল লেনিন হওয়া তাদের মনঃপুত নয়। ক্ষুদ্র হলেও তারা খাঁটি কিছু হতে চায়।'

সভ্যতা ও প্রগতি সম্মন্ধে তার অভিব্যক্তি নিন্মরূপ-

'সভ্যতা শুধু প্রগতি নয়, আরো কিছু। প্রগতির সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্মন্ধ, প্রেমের সম্মন্ধ স্থাপিত না হলে সভ্যতা হয় না। জীবনে সোনা ফলাতে হলে প্রগতিকে চলতে হবে সভ্যতার দিকে মুখ করে নইলে তার কাছ থেকে বড় কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আজকাল প্রগতি কথাটা যত্রতত্র শুনতে পাওয়া গেলেও সভ্যতা কথাটা একরকম নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। লোকেরা কেবল প্রগতি প্রগতি করে, সভ্যতার নামটিও কেউ মুখে আনে না।' তিনি অন্যত্র লিখেছেন-

'সংস্কার-মুক্তি ছাড়াও সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ ছাড়া সংস্কৃতি অসম্ভব। কামের চেয়ে প্রেম বড়, ভোগের চেয়ে উপভোগ, এ সংস্কার না জন্মালে সংস্কৃতি হয় না।'

মোতাহের হোসেন চৌধুরী লেখাটির পরিসমাপ্তি টানেন ঠিক এভাবে-

'সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মতো করে বলতে গেলে সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা; প্রকৃতি-সংসার ও মানব- সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিখড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা, কাব্য পাঠের মারফতে ফুলের ফোঁটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা, আকাশের নীলিমায় তৃনগুলের শ্যামলীমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে, মহতের জীবনদানে বাঁচা, গল্পকাহিনীর মারফতে, নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা, ভ্রমণ কাহিনীর মারফতে, বিচিত্র-দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা, ইতিহাসের মারফতে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা; জীবনকাহিনীর মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকারে বাঁচা। বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা! প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।'

সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি কি প্রয়োজন সে সম্পর্ক মূল্যবান কয়েকটি কথা বলে তিনি উপসংহার টানেন এভাবে-

'সংস্কৃতিসাধনা মানে ripe হওয়ার সাধনা। সেজন্য জ্ঞানের প্রয়োজন আছে, বিজ্ঞানের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রেমের। সংস্কৃতিবান হওয়ার মানে প্রেমবান হওয়া। প্রেমের তাগিদে বিচিত্র জীবনধারায় যে স্নাত হয়নি সে তো অসংস্কৃত। তাঁর গায়ে প্রকৃতজীবনের কটূগন্ধ লেগে রয়েছে, তা অসহ্য’। সবার পরশে-পবিত্র করা তীর্থ নীড়ে 'স্নাত না হলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না।'
                   

দিদার আলম কল্লোল
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top