সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

মহাদেব সাহা: ভিন্ন কণ্ঠস্বরের কবি : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
২৯ জুলাই ২০২০ ০০:১৯

আপডেট:
২৯ জুলাই ২০২০ ০০:২১

ছবিঃ কবি মহাদবে সাহা

 

‘কবির কী চাওয়ার আছে এই রুক্ষ/মরুর নিকট/কী আছে চাওয়ার তার অস্ত্র আর বারুদের কাছে।/নেকড়ের চোখের মতো হিংসা ও লোভের/কাছে কী তার চাওয়ার থাকতে পারে,/...কী সে চাইবে এই দুষিত নদীর কাছে,/নোনা জল, শূন্য মৌচাকের কাছে-/কী তার চাওয়ার আছে লোহার খাঁচার কাছে,/গরাদের কাছে?/কবির কী চাওয়ার আছে এই রক্তাক্ত হাতের কাছে/তীর, তরবারি আর জল্লাদের কাছে,/এই নখদন্তের নিকট কবির কী চাওয়ার/থাকতে পারে আর।’(কবির কী চাওয়ার আছে, এসো তুমি পুরাণের পাখি)

'এই গৃহ এই সন্নাস'(১৯৭২) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার পরপরই আলোচনায় আসেন কবি মহাদেব সাহা। স্বাধীনতা পরবর্তী এক কবিপ্রতিভার নাম তিনি। সমাজের আশেপাশের শব্দাবলির প্রয়োগ তাঁকে করেছে জনপ্রিয়। কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার তাঁকে আলাদা করা যায় সহজেই। জীবিত বাঙালি কবিদের মধ্যে তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় ভিন্নধরণের আমেজ। কবির কবিতায় ভিত্তি তৈরি করেছিলেন মূলত ষাট দশকেই। জল, নদী, বৃষ্টি, সমুদ্র, পাহাড়, বৃষ্টিধারাসহ শ্যামল বাংলার রূপের বিভিন্ন উপাদান নিয়েই কবিতার ডালি সাজিয়েছেন। নির্মাণ করছেন কবিতায় শক্ত ভিত। মহাদেব সাহা ১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট পাবনা জেলার ধানঘরা গ্রামে পৈতৃক বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বগদাধর সাহা এবং মাতা বিরাজমোহিনী।

বর্তমান সময় খুবই জটিল,কুটিলও। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যে ফাঁরাক নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে তা প্রয়োজনের খাতিরেই আছে। প্রয়োজন ফুরালে প্রেম-ভালোবাসা-বিশ্বাস ঠুনকো হয়ে যায়। কবির আশংকাও এমন। আমাদের মতো মহাদেবও প্রশ্ন ছুড়ে দেন এভাবে, কবিতায়। 'এ কী বৈরি যুগে এসে দাঁড়ালাম আমরা সকলে/সূর্য নিয়ত ঢাকা চিররাহ্নগ্রাসে, মানবিক/প্রশান্ত বাতাস এখন বয় না কোনোখানে/শুধু সর্বত্র বেড়ায় নেচে কবন্ধ-দানব;/ তাদের কদর্য বেড়ায় নেচে কবন্ধ-দানব;/তাদের কদর্য চিৎকারে ফেটে যায় কান,/চোখ হয়ে যায় কী ভীষণ রক্তজবা, সহসা/দিগন্ত জুটে নেমে আসে ঘোর সন্ধ্যার আঁধার।/... একোন ঘাতক-যুগে এসে দাঁড়ালাম আমরা সবাই,/তবে কি এ সব কিছু যদুবংশ ধ্বংসেরই আগের নিশানা।'-(যদুবংশ ধ্বংসের আগে)

প্রেম-বিরহ পাশাপাশিই চলে। যুদ্ধ-দামামার মধ্যেও প্রেয়সীর ¯পর্শ চায় মানুষ। কবির ক্ষেত্রে আরও বেশি। প্রথম প্রেমের কথা সবাই মনে করতে চায়। জানতে চায়। তেমনি মহাদেবের মানসপটেও এমন দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। এমনিতেই তিনি প্রেমের কবি, নান্দনিকতার কবি। ‘আমার কাছে কেউ কেউ জানতে চায়/পৃথিবীর কোন নারীকে আমি প্রথম ভালোবাসি,/...প্রথম অশ্রুবিন্দুর কথা কার মনে থাকে,/তারপর এতো বৃষ্টি এতো বর্ষা/মাটির শেটে প্রথম যে অক্ষর/ ...কবে কে আমার হাতে লুকিয়ে/একটি গোলাপ ফুল দিয়েছিল/বইয়ের ভাঁজে রেখে দিয়েছিল/একখানা লাজুক চিঠি,/কে বলেছিল কানের কাছে কোকিলের/মতো মাতাল করা একটি শব্দ!’-(সেসব কিছুই আর মনে নেই)

সব ঠিকঠাক থাকলেও কবিদের কাছে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে না। কবিদের অন্তরাত্মা বলে একটি জিনিস আছে। যেটা অন্যদের চেয়ে কবিদের কাছে অধিক ¯পর্শকাতর। তাই কবিদের চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে না। তাই, সুকান্তের মতো 'চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি' বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত' হলেও মহাদেব সাহা কি যেন শুন্যতা দেখতে পান। বহু কবিতায় 'ইতিবাচক' আবহের মধ্যে 'নেতিবাচক' বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। ‘হায় আমাদের দুঃখ আছে কতো রকম/বুকের ক্ষত, মনের বারো গাঢ় জখম/...হলো না ঠিক যেমনটি চাই দুঃখ করি/সবাই আমরা একটা কিছু দুঃখ করি/কেন যে ঠিক দুঃখ করি তাই জানি না/কেবল বুঝি বুকের নিচে সুনীল জখম।’(দুঃখ আছে কতো রকম, এই গৃহ এই সন্ন্যাস)

অথবা বলতে পারি-‘তোমার কালো চোখের মতো/পাল্টে গেছে বসতবাড়ি/উদোম চড়া, গাছগাছালি বট-বিরিক্ষ/ওলটপালট সারা বাড়ি একলা এখন,/বাড়ির মধ্যে কালো গাড়ি, এলোমেলো/ভাঙা চাঁদ ও শূলন্য তাঁবু,/শূন্য বাড়ির চিহ্ন, চিহ্ন।/তোমার কালো চোখের মতো পাল্টে গেছে শহরতলী/শহরবাড়ি চেনা যায় না, চেনা যায় না/দেয়ালগুলি বদলে গেছে মাটির নিচে/লাল কবরে/শহরতলীর মধ্যে মিশাল এবড়োখেবড়ো/কালো গাড়ি, লাশভরা ট্রাক,/চেনা যায় না বসতবাড়ি, শহরতলী/চেনা যায় না।’(বদলবাড়ি চেনা যায় না, মানব এসেছি কাছে)

স্বাধীনতাকে প্রেয়সীর মুখ হিসাবেই দেখেছেন মহাদেব সাহা। প্রেয়সী ও স্বাধীনতাকে পরিপূরক হিসাবেই দেখে লিখেছেন, '... তোমাকে ডাকবো আমি নির্লজ্জ গেঁয়োর মতো/সমবেত অগ্রজের মুখোমুখি বসে-/দীর্ঘদিন বলি না প্রেমিকা,/বলি না গোলাপ/... কতদিন তোমাকে আনি না মুখে প্রেম,/প্রিয় স্বাধীনতা, রম্য গোলাপ/যুদ্ধক্ষেত্রে গ্রেনেডের শব্দে, মাইনের মুখর সঙ্গীতে/... যেন প্রিয়ার হাতে রডোডেনড্রনচ্ছ/আজ এ বৎসরের শেষ রবিবারে, যুদ্ধ শেষে/তোমাকে ডাকার স্বাধীনতা/প্রিয়তমা প্রেমিকা আমার!'-(সংক্ষেপিত, তোমাকে ডাকার স্বাধীনতা)

হতাশাকে প্রেমের শক্তিতে রূপান্তর করার বড় কারিগর কবি মহাদেব সাহা। যুদ্ধও এনেছেন। সমাজের হতাশাজনক বিষয়গুলোশ এড়িয়ে যাননি। এসবই পাশাপাশি এনে কবিতার বুনন সাজিয়েছেন। ‘...একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে/বেড়ায়, কেউ জানে না/...মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে/কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ/মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস/...একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,/হায়, কেউ জানে না!’(মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, ধূলোমাটির মানুষ)

অথবা বলতে পারি-‘আজ যেখানেই কান পাতি শুনি সজকলে চাপা কণ্ঠস্বর,/খুব ধীরে কানের নিকটে মুখ এনে/কী যেন বলতে চায় এই ফালগুনের বিষণœ গোলাপ,/বসন্তের প্রথম কোকিল/মনে হয় কী যেন বলতে চায় প্রতিটি নিঃশব্দ মুখ;/কী যেন বলতে চায় মেঘমুক্ত ভোরের আকাশ গতরাতের কাহিনী/লাইটপোস্ট, আইল্যান্ডের নীরব দোয়েল আর/রমনার সবুজ চত্বর আমাকে দেখেই যেন ঠোঁট নাড়ে,/আমাকে দেখেই যেন জ্বলে ওঠে রাতজাগা ইউক্যালিপ্টাসের সারি/সামান্য দূরেই আরো একগুচ্ছ ¤¬ান স্বর্ণচাঁপা;/তাদের যে-কারো দিকে তাকালেই মনে হয়/কী যেন বলতে চায় তারা।...সবাই আমার কাছে কী যেন বলতে চায় এই গোলাপ, শালিক আর ব্যথিত মানুষ,কী যেন বলতে চায় ঝরাপাতা, মায়ের করুণ অশ্রু, বন্দী স্বদেশ!’ (কী যেন বলতে চায় বন্দী স্বদেশ, ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস)

জীবন-জীবিকা বড় ফ্যাক্টর। খাবারই সর্বোৎকৃষ্ট জিনিস। ভালোবাসা, ফুল সবকিছুই নিরর্থক ক্ষুধার কাছে। সুকান্তের মতে,'ক্ষুধার রাজ্য গদ্যময়/চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি'। কবি মহাদেব সাহাও মনে করেন শাদাভাতই অধিক সুন্দর। 'শাদাভাত' প্রতীকী। ক্ষুধা নিবারণের সাধারণ ধাপ/উপাদান। দুমুঠো শাদাভাত খেয়েই বেঁচে থাকতে চান অনেকেই। 'জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর' নামীয় কবিতায় বললেন এভাবে, ‘যে-কোনো বিষয় নিয়েই হয়তো এই কবিতাটি লেখা যেতো/পিকনিক, মর্নিং স্কুলের মিসট্রেস/কিংবা স্বর্নচাঁপার কাহিনী; হয়তো পাখির প্রসঙ্গ/...আমি তাই চোয়াল ভাঙা হারু শেখের দিকে তাকিয়ে/আন্তর্জাতিক শোষণের কথাই ভাবি,/পেটে খিদে এখন বুঝি কবিতার জন্য কি অপরিহার্য/জুঁইফুলের চেয়ে কবিতার বিষয় হিসেবে আমার কাছে/তাই শাদা ভাতই অধিক জীবন্ত- আর এই ধুলোমাটির মানুষ; ...’ (জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর, ধূলোমাটির মানুষ)

কবি মহাদেব সাহা ভালোবাসার চোখে স্বদেশ দেখার চেষ্টা করেছেন। কবি ২০১৬ সালে কানাডাপ্রবাসী হন। কিন্তু স্বদেশের কথা ভুলে যাননি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতার মতোই লিখলেন স্বদেশের কথা। তবে ভিন্নভাবে, প্রেমিকার আয়নায়। 'তোমার দূরত্ব' কবিতায় লিখলেন, ‘তোমার ভালোবাসার দূরত্বের চেয়ে এমন আর কি/দূরত্ব আছে আমার, এমন আর কি/মাইল মাইল দূরত্ব সে তো একখানি মাত্র টিকিটের ব্যবধান/...তুমি ফিরে তাকাতেই আমি দেখতে পাবো ঢাকা এয়ারপোর্টে/চক্কর দিচ্ছে আমার বিমান/হ্যালো বাংলাদেশ! আমার চিরসবুজ বাংলাদেশ!’ (তোমার দূরত্ব, ধূলোমাটির মানুষ)

স্বাধীনতা কথাটি আপেক্ষিক। আপেক্ষিক বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা। মানুষ স্বাধীন হলেও আদতে মানুষ স্বাধীন নয়। সবসময় শৃঙখলে আবদ্ধ। সবসময় স্বাধীনতা চায়, স্বাধীনতা চায় বলে অস্থির থাকে। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই। তবুও মানুষ চায়। এক্ষেত্রে মানুষ বড়ই অসহায়। কবি মহাদেব সাহাও তাই মনে করেন। উচ্চারণ করেন কবিতার ছত্রে। 'ফিরে দাও রাজবংশ' বা 'একেক সময় মানুষ এতো অসহায়' কবিতায় এমনই উচ্চারণ। ‘দূতাবাসে উড়ছে পতাকা/অর্থাৎ স্বাধীন আমরা এ-কথা মানতেই/হয়, রাষ্ট্রীয় সনদ আছে দেশে/দেশে আমরা স্বাধীন;/তবু মনে হয় এ যুগে কোথাও কোনো স্বাধীনতা/নেই, বরং এ যুগে মানুষ যেন/পোষমানা দুর্বল মহিষ, /...তাই কি আমরা এই প্রজাতন্ত্রে এমন বন্দী স্বাধীন?/তাহলে কি আমরা সবাই আজ বাস/করি পাথরের ঘরে... ’(ফিরে দাও রাজবংশ, এই গৃহ এই সন্ন্যাস)

আমাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রেরণার নাম। রবীন্দ্রশক্তি আমাদের দেহে প্রবাহিত করতে চাই। কবি মহাদেব সাহাও তা চান। বরং আরও যুককে চান রবীন্দ্রশক্তি ধারণ করে বাঙালির দিশা খুঁজতে চান। রবীন্দ্রনাথ এখন নেই। কিন্তু তাঁর চেতনা আছে। সে চেতনা নিয়ে দলছুট কিছু যুবা নিয়ে কাজ করতে চান। 'রবীন্দ্রোত্তর আমরা কজন যুবা' নামীয় কবিতায় তেমনই আহ্ববান,‘শুনুন রবীন্দ্রনাথ এ যুগে ভীষণ দায় বাঁচা, বড়ো অসহায়/...এখণ ভীষণ রুগ্ন আমরা, সারা গায়ে কালোশিরা, চোখ ভর্তি/নিঃশেব্দ আঁধার, যেখনে যাই আমরা কজন যুবা/যেন বড়ো বেশি ¤¬াম ফ্যাকাশে বৃদ্ধ, চোখমুখে/¯পষ্ট হয়ে লেগে থাকে যাবতীয় অনাচার, /...আমরা কতিপয় যুবা/তাই আর সব পরিচয় যখন ভুলে যাই এমনকি ভুলে/যাই নিজেদের নাম, তখনো মনে রাখি/রবীন্দ্রনাথ আমাদের আবহমান বাংলাদেশ/আমাদের প্রদীপ্ত বিপ্লব,/রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরদিন /একুশে ফেব্রুয়ারি।’(রবীন্দ্রোত্তর আমারা কজন যুবা, এই গৃহ এই সন্ন্যাস)

প্রকৃতিকে আমরা সবসময় অবহেলা করি। ধ্বংশ করছি। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী, প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। সেরকমই অবহেলিত প্রকৃতিও আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না। মহামারির মতো অদৃশ্যরূপে প্রতিশোধ নিবে। এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। অন্য কিছুর মাধ্যমেও প্রতিশোধ নিতে পারে। 'অতি বাড় বেড়ে গেলে' ক্ষমতার ভারসাম্যও আনতে প্রকৃতিই ব্যবস্থা করে। সমতাবিধানই প্রকৃতির উদ্দেশ্য। আমরা কিন্তু এসব ভুলেই যাই। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিই না।'নিসর্গের খুন' কবিতায় মহাদেব সাহা প্রকৃতির প্রতিশোধের স্বরূপ চিহ্নিত করলেন এভাবেই, ‘ভিতর থেকে হয়ে উঠছে তাকেই বলি প্রকৃতি।/ বাইরে মেঘবৃষ্টি ঝড়ো হাওয়া/...হয়তো তাদেরও ভিতরে কোথাও/ এই মানুষের মতো একটা মন আছে,/সেই মনটাই প্রকৃতি।/না হলে এই সবুজ ঘাস কেন জাজিমের মতো মনে হবে, /এইমেঘ মনে হবে মখমলের মতো/পাখির ভিতর যা পাখিত্ব নদীর ভিতর যা শুদ্ধতা/এর একটা পরিচ্ছন্ন রূপ আছে তাকেই বলি প্রকৃতি।/প্রকৃতি এই কাদামাটিতে গড়া, আঁতুড়ঘরের আবেশ মাখানো গন্ধ/...আমার হাতে মেঘ পেয়েছে মহিমা, জল পেয়েছে অবয়ব,/পাথর পেয়েছে পূর্ণতা/এতোদিন এই কাদামাটির সংসারে এই ঝড়ো হাওয়ায়/ভিতর থেকে হয়ে উঠছে এই কাদামাটিতে এই ভালোবাসায়/তাকেই বলি প্রকৃতি, এই বেদনাবিধুর!’ (তাকেই বলি প্রকৃতি, চাই বিষ অমরতা)

পার¯পারিক বিষয়াদি এখন ঠুনকো বিষয় হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ হিংসা-বিদ্বেষ, ঠক, প্রতারণা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট বিষয় নিয়ে মানুষ খুন করতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। তারপরেও মানুষই আশ্রয়স্থল। সবকিছু শেষ হলেও মানুষই টিকে থাকবে স্বমহিমায়। প্রবল প্রতিপাত্যের ডাইনোসর আজ বেঁচে নেই কিন্তু। তাই মানবতাবোধই আরাধ্য বিষয়। 'মানুষের সাথে থাকা' তাই কবির চাওয়া। ‘যতোই ব্যথিত হও মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ো না/মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে,/যতোই আঘাত পাও মানুষকে কিছুতে ছেড়ো না/...সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তোমার পাশে এসে মানুষই/দাঁড়াবে/ফুল যখন ফুটবে না, পাখি যখন গাইবে না/কেবল আকাশ-বাতাস মথিত করে আসবে ধ্বংস,/আসবে মৃত্যু/তখনো মানুষই তোমার একমাত্র সঙ্গী;...’(মানুষের সাথে থাকো, মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না)

প্রেম ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনায় একাকার করে দিলেন। সাম্প্রদায়িক নষ্ট করে সম্প্রীতি,শান্তির পরিবেশ। এ অপশক্তি দেশ-সমাজকে কিভাবেই না ধ্বংশ করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কবিরা এসব একেবারেই পছন্দ করেন না। কবি মহাদেব সাহাও ব্যতিক্রম নয়। বরং সবুজের মধ্যে টকটুকে রক্তজবার মতো উচ্চারণ তাঁর। তাঁর ঝাঁঝালো উচ্চারণ কবিতায়-‘তারা আমাদের কেউ নয় যারা মসজিদ ভাঙে/আর মন্দির পোড়ায়,/তাদের মুখের দিকে চেয়ে সমস্ত আবেগরাশি/হয়ে যাও বরফের নদী-/অনুভূতির সবুজ প্রান্তর তুমি হয়ে যাও উত্তপ্ত সাহারা।/তাদের পায়ের শব্দ শুনে রুদ্ধ হয়ে যাও তুমি/চঞ্চল উদ্দাম ঝর্ণাধারা,/মেঘ হও জলশূন্য, নীলিমা বিদীর্ণ/ধ্বংসস্তূপ।/তারা আমাদের কেউ নয়, কখনো ছিলো না,/...প্রেমিকার পবিত্র আবেগ,/মাদার তেরেসার অপারাহ্নের হাতখানি;/তাদের উদ্দেশ্যে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাও তুমি পাখিদের গান,/মোনাজাত, মীরার ভজন।’(সংক্ষেপিত,তারা আমাদের কেউ নয়, একা হয়ে যাও)

মহাদেব সাহার নব্বইয়ের বেশি গ্রন্থ। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: এই গৃহ এই সন্ন্যাস(১৯৭২), মানব এসেছি কাজে(১৯৭৩) চাই বিষ অমরতা(১৯৭৫) কী সুন্দর অন্ধ(১৯৭৮), তোমার পায়ের শব্দ(১৯৮২), ধুলোমাটির মানুষ(১৯৮২), ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস (১৯৮৪), লাজুক লিরিক(১৯৮৪), আমি ছিন্নভিন্ন(১৯৮৬), মানুষ বড় ক্রন্দন জানে না (১৯৮৯), প্রথম পয়ার(১৯৯০), কোথা সে প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ(১৯৯০), প্রেমের কবিতা(১৯৯১), মহাদেব সাহার রাজনৈতিক কবিতা(১৯৯১), অস্তমিত কালের গৌরব(১৯৯২), আমূল বদলে দাও আমার জীবন(১৯৯৩), কোথায় যাই কার কাছে যাই(১৯৯৪)। শিশুসাহিত্যেও মহাদেব সাহার অবদান আছে। উল্লেখযোগ্য কিছু শিশুসাহিত্য হচ্ছে টাপুর টুপুর মেঘের দুপুর, ছবি আঁকা পাখির পাখা,আকাশে ওড়া মাটিরঘোড়া, সরষে ফুলের নদী, আকাশে সোনার থালা, মহাদেব সাহার কিশোর কবিতা(সংকলন)। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থও রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু বই: গরিমাহীন গদ্য (২০০৯),আনন্দের মৃত্যু নেই(২০১১),মহাদেব সাহার কলাম,কবির দেশ ও অন্যান্য ভাবনা(২০১১), ভাবনার ভিন্নতা(২০১১), মহাদেব সাহার নির্বাচিত কলাম। মহাদেব সাহা তাঁর কাব্য প্রতিভার জন্য অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি ১৯৮৩ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মননার মধ্যে ১৯৯৫ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার, ২০০২ সালে খালেদদাদ চৌধূরী স্মৃতি পুরস্কার এবং ২০০৮ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার অন্যতম।

ষাট দশকের কবিরা চল্লিশের দেশভাগ-পরবর্তী বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে লিখেছেন। পঞ্চাশের ভাষা আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রভৃতি হয়েছে কবিতার অনুসঙ্গ। এসব থেকে এড়িয়ে যাননি কবি মহাদেব সাহা। তিনি সচেতনভাবে প্রেমিক ও দ্রোহী। তাঁর কবিতায় সামাজিক, রাজনৈতিক মানবিক মুখ্য বিষয় হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। কবির প্রতিটি কবিতা নতুন স্বর, বক্তব্য ও উপমার ওপর ভিত্তি করে রচিত। কোথাও কোথাও জীবনানন্দীয় গন্ধ পাওয়া যায়। তবে মহাদেব সাহা নতুন স্বর সৃষ্টি করতে পেরেছেন। কবিতার মধ্যে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ, ফুলের সৌরভ, মাটির ¯পর্শ লেগে থাকে। প্রেম, রাজনীতি, মানুষ ঘিরে তাঁর কবিতা আবর্তিত হয়েছে। নদী, মা, বৃক্ষ, পাখি, কল্লোলিত জীবন, জন্মগ্রাম, মৃত্তিকা, মানুষ তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। মেঘ-বৃষ্টি-পাহাড়-নদী নিয়ে উপভোগ করেছেন। এসবই তাঁর কবিতায় উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top