সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

দুঃসময়ের ঈদ : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
৩১ জুলাই ২০২০ ২২:৫৭

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৫৯

 

ঈদ অর্থ আনন্দ। ঈদ অর্থ খুশি। অথচ সেই আনন্দ, সেই ঈদ যদি আসে পৃথিবীময় দুঃসময়ে তখন তা আর আনন্দের বিষয় থাকে না। তা হয়ে যায় যে কোন একটি সাধারণ দিন বর্তমানের মতো। যেখানে সূর্য উঠলেই তাকে আমরা দিন বলতে পারি না, চাঁদ হাসলেই তাকে আমরা রাত বলতে পারি না। দিন যেখানে দিন নয়, রাত যেখানে রাত নয়, সময় যেখানে সময় নয়, আটকে আছে ঝিনুকের খোলের মধ্যে, সেখানে আর ঈদ কী? যেখানে আমাদের ঘুম ভাঙছে আতংক, দুঃসংবাদ আর মহামারীর মৃত্যূকে সাথে নিয়ে, যেখানে একটি দিন সুস্থ ভাবে যাপন করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। সেইখানে আবার ঈদের প্রসংগ কেন?

তারপরেও এই মহামারী, এই আতংক, এই মৃত্যূকে নিয়েই আমাদের দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, রাত নেমে আসছে পৃথিবীতে। আগামী পয়লা আগষ্ট সারাদেশে পবিত্র ঈদুল আযহা পালিত হবে। অন্যবারের মতো এবার আর মহাবিশ্বের আকাশে বাতাসে ঈদের আনন্দে মুখরিত হবে না, মুখরিত হবে না মন ও মননে। সকলেরই আত্মিক এবং মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। অবনতি ঘটেছে অর্থনৈতিক। অন্যসব বিগত দিনের মতো এবার হয়তো অনেকেই কুরবানী দেবার সামর্থে নেই। নেই হাসি আনন্দে।

এ বছর পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালনেও একই অবস্থা। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি ফরজ ইবাদত হজ্জ্ব। হজ্জ্বের শাব্দিক অর্থ ‘জিয়ারতের সংকল্প’। মহান আল্লাহ সান্নিধ্য পাবার আশায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা পবিত্র ক্বাবাশরীফ তাওয়াফ বা জিয়ারতের সংকল্প নিয়ে ছুটে আসে বলেই এর নাম ‘হজ্জ্ব’। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-
‘এতে রয়েছে মাকামে ইব্রাহীমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ্জ্ব করা হলো মানুষের ওপর মহান আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যারা অস্বীকার করবে (তাদের স্মরণ রাখা উচিত) মহান আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।’
আল কুরআন: ২: ৯৭

প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে মহান আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম আ. পবিত্র হজ্জ্বের প্রবর্তন করেন। মহান আল্লাহ হযরত জিব্রাইল আ. এর মারফত তাঁকে হজ্জ্বের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইব্রাহিম আ. তাঁর পুত্র ইসমাঈল আ. কে নিয়ে পবিত্র ক্বাবাঘর সাত বার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন পবিত্র হজ্জ্বের সব আহকাম। এরপর মহান আল্লাহর নির্দেশ এলো, বিশ্ববাসীকে হজ্জ্বের দাওয়াত পৌঁছে দেবার জন্য।
হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, ‘যখন ইব্রাহীমকে হজ্জ্ব ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি মহান আল্লাহর কাছে আরজ করেন- ‘এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে?’
মহান আল্লাহ তখন বললেন, ‘তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেওয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছনের দায়িত্ব আমার।’ একথা শুনে হযরত ইব্রাহীম আ. তখন মাকামে ইব্রাহীমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। মহান আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন।’ কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ে আরোহন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে, মহান আল্লাহ ইব্রাহিম আ. এর সেই আহ্বান জড়জগতের সীমা অতিক্রম করে রুহানি জগতে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং লাব্বাইক বলে যে সমস্ত রুহ সেই আহবানে সাড়া দিয়েছিল মহান আল্লাহ চান তো, কিয়ামত পর্যন্ত তারাই পর্যায়ক্রমে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হবে।’এর পর থেকে নবী রাসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ্জব্রত পালনের বিধান। হযরত মুহাম্মাদ সা. সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ্জ্ব অবশ্যপালনীয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আমাদের উচিত, হজ্জ্ব ফরজ হওয়ার সাথে সাথে তা পালন করা। বলা তো যায় না, ভবিষতের সময় আমাদের জন্য কিভাবে অপেক্ষা করছে। এ বছর আমার কলিগসহ বেশ কয়েকজন পরিচিত আত্মীয়জন পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালনের জন্য রেজিস্ট্রেশান করা সত্ত্বেও হজ্জ্বে যেতে পারলেন না।

প্রতি বছর পঁচিশ থেকে ত্রিশ লাখ হাজীর উপস্থিতিতে হজ্জ্বব্রত পালন হলেও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এবছর গ্লোবাল পেন্ডামিকের কারণে স্বল্প পরিসরে মাত্র দশ হাজার মুসল্লীকে নিয়ে শুরু হয়েছে হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিবছর বাসায় কোরবানী হয়। অনেক লোকজন আসে, কোরবানী করাসহ আনুসঙ্গিক কাজ করে তারা। তাদেরকে নিজহাতে রান্নাবান্না করে খাওয়াই। খুব ভালো লাগে, এক স্বর্গীয় আনন্দে মনটা ভরে থাকে। মেয়ে, জামাই, নাতি, দেবর, জাসহ সবাই আসে ঈদ করতে। কিন্তু সময় পাল্টেছে। গত ঈদুল ফিতরের মতো এবারও ঈদ আসবে কিন্তু ঈদের চাঁদ উঠবে না ঘরে। জানি না, কতদিন পৃথিবী এভাবে থমকে থাকবে। হে মহান আল্লাহ! তুমি সব ঠিক করে দাও, পৃথিবীকে সুস্থ করো আগের মতো। এরই মধ্যে আমরা অনেক আপনজনকে হারিয়েছি, অসুস্থ রয়েছে অনেকেই। প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বময়।
আশা করছি, খুব শীঘ্রই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, অফিস আদালত চলবে আগের মতো। নিকট অতীতেই কোভিড নাইনটিন এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে। দিন ফিরে পাবে তার কলহাস্য। হৈ- হুল্লোড়, আনন্দ-আমেজে ফিরে যাবে ঈদ তার আপন বৈশিষ্ট্যে।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top