সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

এইতো জীবন (রম্য গল্প) : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
১২ আগস্ট ২০২০ ২২:৩৭

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ১৫:০১

সত্যজিৎ বিশ্বাস

 

‘কী ব্যাপার, ফেসবুক দেখে মুচকি মুচকি হাসছো কেন? আমি অবাক হয়ে যাই, বিয়ের তিনটা বছর পার হতে পারলো না, এখনই এত বদলে গেলে? আগে তো আমার সাথে কথা বলার জন্য কত বাহানা খুঁজতে আর এখন! আমার সাথে যখন কথা বলো, তখন কই থাকে এই হাসি? ভ্রু কুঁচকে এমন একটা ভঙ্গি করো, আমি যেন সাক্ষাৎ করোনা। অথচ এই আমিই একদিন তোমার চোখে কারিনা ছিলাম। কই ফেসবুকে বসলে তো তোমার এই রূপ দেখি না? তখন তো তোমার বত্রিশটা দাঁত আর দুটো চোখ ঝিকমিক করে ওঠে’ অভিযোগের অনবরত তীর বর্ষণে থতমত খায় মামুন। কোনটা বাদ দিয়ে কোনটার জবাব দেবে ভাবতে গিয়ে তোতলাতে থাকে। তু-তু-তুমি বেশি বোঝ, না? ফেসবুক দেখে কই হাসি?
‘মিটিমিটি করে মিচকে হাসি হাসো না? এত বড় মিথ্যা বলতে পারলে? পলক না পড়া চোখ দুটো রসগোলার সাইজ করে কোন ঘোরে চলে যাও, সেই খেয়াল থাকে তোমার?’ তিসার আরো একটা তীব্র আক্রমণ কোনমতে সামলানোর চেষ্টা করে মামুন, ‘আরে বাবা, ফেসবুকে সবাই মজার মজার পোস্ট করে, কমেন্ট করে। সেটা পড়ে হাসতেও পারবো না? ঠিক আছে যাও, ফেসবুকও চালাবো না। এবার খুশি তো? রাগে ফেসবুক থেকে সাইন আউট হয়ে ল্যাপটপ রেখে বিছানায় শুয়ে একটা গল্পের বইয়ে মুখ ডোবায়।

বিয়ের আগে মেয়েদের তৃতীয় নয়ন থাকে না। বিয়েতে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এটা উপহার পায় তাঁরা। উল্টো দিকে তাকিয়েও ওয়ারড্রোবে কাপড় গোছাতে গোছাতে তিসা ঠিকই সব দেখতে পায়। অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে অব্যর্থ নিশানায় আবার কথার তীর ছোড়ে, ‘ঢং দেখে বাঁচি না, মুখ গোমড়া করে আবার গল্পের বই নিয়ে বসা হয়েছে। পড়ার স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে, যেন পুলিশ রিমান্ডে এনে জোর করে পড়ানো হচ্ছে’।
মামুন এবার লাফ দিয়ে উঠে বসে। তিসার বিষাক্ত তীর ঠেকাতে তোলে প্রতিরোধের ঢাল, ‘এর মানে কি? গল্পের বই কি ফান ম্যাগাজিন যে পড়তে পড়তে হেসে ভেঙ্গে পড়বো? তুমি আসলে চাওটা কি? আমার ভুলটা কি বলবে?’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে আলনা থেকে জামাটা হাতে নিয়ে আর দেরী না করে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে মামুন। তিসা কিছু বলতে গিয়েও বলে না। তৃতীয় নয়নধারীরা খুব ভালো করেই জানে মোলার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত আর জামাইদের দৌড় পাড়ার মোড়ের পুরি, সিঙ্গাড়ার দোকান পর্যন্ত।
গনক জ্যোতিষীদের অনুমান মিথ্যে হতে পারে, বউদের অনুমান মিথ্যা হয় না। রাগে গজগজ করতে করতে মোড়ের দোকানে বসে চা এর অর্ডার দেয় মামুন। এক চুমুক দিতে না দিতেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আমিন ভাই। আমিন ভাই হলো প্রাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতার জীবন্ত বিশ্বকোষ। জীবন সংসার নিয়ে তার অগাধ জ্ঞান। জুনিয়র, সিনিয়র নির্বিশেষে পাড়ার প্রায় সবাইকেই বিনামূল্যে সে জ্ঞান বিতরন করে থাকে। শুধু তাই না, যে কারো দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারে তাঁর মনের অবস্থা।
মামুনের মুখের দিকে তাকিয়ে আমিন ভাই যখন বলল ‘কী ব্যাপার মামুন, এখানে এসে চা খাচ্ছ কেন? ঘরে এক রাউন্ড বক্সিং হলো নাকি?’ মামুন খুব একটা অবাক হয় না। দোকানের পিচ্চিকে ইশারায় আরো এক কাপ চায়ের অর্ডার দেয়। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে আমিন ভাইয়ের দিকে তাকায়। ধুর, আর ভালো লাগেনা। সব ছেড়ে ছুঁড়ে শান্তিতে থাকা যায়, এমন একটা জায়গা থাকলে বলেন তো ভাই। আমিন ভাই উদাস ভঙ্গিতে বলে, ‘আরে পাগলা, সেই ঠিকানা জানা থাকলে কী আর আমি এখানে আসি দুনিয়ার সেরা বিস্বাদ এই চা গিলতে?’

সিগারেট ধরাতে ধরাতে মামুনের গভীর হতাশামাখা চেহারা দেখে পিঠে হাত রাখে আমিন ভাই। সিগারেটে আয়েশ করে একটা টান দিয়ে ধীরে ধীরে জ্ঞানলিনের (জ্ঞান মাখা যে বোরোলিন) কৌটা খোলে। শোনো ভাই, বউরা সব সময়ই মাঝামাঝি কিছু একটা চায়। কমও না, বেশীও না। লম্বাও না, বেঁটেও না। রোগাও না, মোটাও না। হিরোও না, জিরোও না। এমনকি বোকাও না, বুদ্ধিমানও না। কবিও না ছবিও না। লেখকও না, দেখকও না। সামাজিক ফেসবুকারও না, অসামাজিক ঘরকুনোও না। সব কিছুরই মাঝামাঝি কিছু একটা। মনে অভিমান পুষে না রেখে, সবকিছু মেনে নেয়ার নামই জীবন। ভালো থাকার এটাই একমাত্র উপায়।
মামুন অবাক হয়ে আমিন ভাইয়ের দিকে তাকায়। আমিন ভাই ধোঁয়ার একটা রিং বানিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার জ্ঞানলিনের কৌটায় ঝাঁকি দেয়। ‘মনে’ না নিলেও ক্ষতি নেই তবে বউয়ের সব কথাই ‘মেনে’ নিতে হবে। গল্প, সিনেমায় যেমন বলা হয়ে থাকে অবশেষে তাঁহারা সুখে, শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল, এটা শুধু গল্প, সিনেমাতেই সম্ভব। বাস্তব জীবনে কেউ কখনো একসাথে ‘সুখ’ আর ‘শান্তি’ দুটোতে বাস করতে পারে না। সুখের চিন্তা বাদ দিয়ে শান্তিতে থাকার উপায় একটাই, নিঃশর্তে আত্মসমর্পন। একটা কথা পেরেক মনে করে হাতুড়ি দিয়ে মনে গেঁথে রাখবে, বউ রূপালী পর্দার কোন হিরোকে যতটা পছন্দ করুক না কেন, ঘরে কিন্তু কোন হিরোকে চায় না।
তুমি ফেসবুক সেলিব্রেটি হয়ে কলার তুলে ঘুরবে, ইনবক্সে হাই/হ্যালো বলে একে, ওকে হেলাবে আর তোমার বউ তোমাকে কেলাবে না, তাই কখনও হয়? এখন আর দেরি না করে, যাও বাজারে যাও। বউয়ের পছন্দের শ্বাক,সবজি আর দেখে শুনে কয়েক জাতের তাজা ছোট মাছ কিনে, কাঁটিয়ে নিয়ে তারপর বাড়ি যাও। কাজ না হলে কাল আবার এখানে এসো।
আমিন ভাইয়ের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে মামুন। শুধু একটা বাড়তি কাজ করে। এদিক, ওদিক খেয়াল করে মোড়ের ফার্মেসীর দোকান থেকে একটা প্যাকেট কিনে তাড়াতাড়ি পকেটে ঢুকায়। মিস টাইমিং এর কারণে ক্রিকেট খেলায় যে কোনদিন সিক্স মারতে পারেনি, সে কখনও সুপার টাইমিং করে জীবন খেলায় সিক্স মারতে পারবে না, এমন কি কোন কথা আছে?
বাজারের ব্যাগ হাতে মামুন বাসার কলিং বেলে হাত রাখে। দরজার কি হোলে চোখ রেখে ত্রিনয়না তিসা মূহূর্তেই স্ক্যান করে ফেলে মামুনকে। মিটিমিটি হেসে দরজা খোলে।
ঠিক এমন সময় রিং টোন বেজে ওঠে মামুনের মোবাইলে। পকেট থেকে তাড়াহুড়া করে মোবাইল বের করতে গিয়ে ফার্মেসী থেকে কিনে আনা প্যাকেটটা কানে চেপে ধরে মামুন। ‘বলদ একটা’ বলে মামুনের হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে তিসা।
শহরের প্রায় সব মামুন তিসাদের জানালা দিয়ে প্রায় একই রকম দৃশ্য দেখে মুচকি হাসে চাঁদ। এইতো জীবন।
---

সত্যজিৎ বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
* রম্য বিভাগীয় সম্পাদক- কিশোর বাংলা
* নির্বাহী সম্পাদক- কিশোরকাল
* কন্ট্রিবিউটার – মাসিক স্যাটায়ার কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’, জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ‘বিচ্ছু’, দৈনিক ইত্তেফাক ‘ঠাট্টা’।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top