সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের গল্প : সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


প্রকাশিত:
১৮ আগস্ট ২০২০ ২২:৫৭

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৭:৪৩

 

শৈশবটা অনেক সুন্দর ছিল। পাহাড়ঘেরা চারপাশে ইচ্ছা মতো ঘোরাঘুরি করা যেত। জীবনটা ছিল ভীষণ দূরন্ত। তখন রাতের আকাশে মেঘের ফাঁকে চাঁদ-তারার লুকোচুরি খেলা দেখার অফুরন্ত সময় ছিল।

সেই অভিমানী কালো মেয়েটি, যে বারান্দায় বসে কাকদের কবিতা শোনাত, তার চোখে ছিল ভীষণ মায়া। কোনো এক অজানা অভিমানে সে-ও জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। হয়তো কাকগুলো জানত তার গোপন অভিমানের কথা, নয় তো কেন ওরা এত কা-কা করে চেঁচামেচি করেছিল।

তখন আমরা মুঠোফোন ব্যবহার করতাম না। কেউ কাউকে ডাকাডাকির দরকারই ছিল না। সবাই সময়মতো ঠিকই আড্ডায় চলে যেতাম। ঠিক সময়মতোই সেই প্রেমিক-প্রেমিকা রাস্তায় এসে লুকিয়ে দেখা করত। অপেক্ষা করতে তখন ওদের অনেক ভালো লাগত। এখন সব অপেক্ষা ফুরিয়ে গেছে; কিন্তু মনের অন্তরালে সেই ভালোবাসা আজও বেঁচে আছে। এ যেন- 'ফুল ফোটে, ফুল ঝরে, ভালোবাসা ঝরে পড়ে না।'

বৈশাখের নীল আকাশটা হঠাৎ করেই কালো মেঘে ঢেকে যেত। একসময় ঝড় এসে চারপাশের প্রকৃতিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দিত। মাঝেমধ্যে আকাশ ফাটিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠত। তখন বুকের ভেতর অনেক সাহস ছিল, দল বেঁধে সবাই বের হয়ে যেতাম। কে কতটা আম কুড়াতে পেরেছি, সেই আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরে মায়ের হাতে পিটুনি খেতাম। আহা আনমনে গেয়ে উঠি- 'আমি ফিরে পেতে চাই, সেই বৃষ্টিভেজা সুখ।'

ভ্যালেন্টাইনস ডে বলে তখন কিছুই বুঝতাম না; কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস এলে ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে কোনো কমতি ছিল না। বন্ধুরা সবাই মিলে দল বেঁধে ফুল চুরি করে তোড়া বানাতে কখনো ভুল হতো না। বাসায় ফিরে দেখতাম, নিজের গাছের ফুল অন্য কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। চোখের অশ্রু মুছে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম, আগামীকাল শহীদ মিনারে হাতেনাতে ফুলচোর ধরে উচিত শিক্ষা দেব। তারপর শহীদ মিনারে গিয়ে আর কিছু মনে থাকত না। সবাই মিলে মিশে গাইতাম- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...'

অদ্ভুত ছেলেটা গিটার বাজিয়ে বেসুরা গলায় গান গাইত আর তার পকেটে থাকত প্রিয় হারমনিকা। একমাত্র ওর প্রিয় বন্ধু আর একটা বোকা মেয়ে তার গানের মুগ্ধ শ্রোতা ছিল। হয়তো বা ওরা নিরুপায় হয়ে মুগ্ধ শ্রোতার মতো গান শুনে তারিফ করত। এতেই মনের খুশিতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অদ্ভুত ছেলেটি একের পর এক গান গাইত। - 'ও দরিয়ার পানিরে, কত দেশে যাস, বন্ধুর সাথে দেখা হলে তাকে জানাস...'

বিদেশি হাওয়ায় দেশীয় ফুলের বিবর্তন হয়েছে; কিন্তু মনের কি বিবর্তন হয়, প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়ার আগেই হৃদয় ভেঙে প্রিয় ফুল উত্তর জানিয়ে দিল। কিন্তু ফুলের মনেও যে অনেক কষ্ট লুকিয়ে ছিল। হয়তো সেই কষ্ট থেকে সে নিষ্ঠুর হতে শিখেছিল। পরাণের গহীনে কেউ যেন গায়- 'ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ...'

প্রযুক্তি যতই বিশ্বটাকে ছোট করে নাগালের ভেতরে নিয়ে আসছে, আমরা তখন সম্পর্ক ভাঙাগড়ার খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছি। অনেক কাছে এসেও আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারছি না। অনেক কাছাকাছি এসেও আমরা অপরিচিত থেকে যাই। অচেনা মানুষের মতো একদিন দূর থেকে বহু দূরে হারিয়ে যাই। গিটারের ঝংকারে বাজে- 'সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে...'

অদ্ভুত ছেলেটা বোকার মতো আর ফুলের মতো মেয়েটা আপন মনে যার যার ভাবনায় অনেক রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল। আজ রঙিন স্বপ্নগুলো ধূসর রঙে মনের আকাশে মেঘ হয়ে জমে আছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে চোখের আঙিনায়। আহ্ আজ কেন জানি সেই গানটা খুব বেশি মনে পড়ছে- 'আমার নানা রঙের দিনগুলি, রইল না মোর সোনার খাঁচায়।' কালবৈশাখীর তাণ্ডবের মতো সব কিছুই যেন এলোমেলো...

সময়ের স্রোতে টিকে থাকতে গিয়ে আমরা চলছি, চলতে হচ্ছে। বহমান নদীর মতোই জীবন বহমান, বাঁকে বাঁকে থাকে কিছু স্মৃতি। জীবনের এই চলার পথে কারো কারো মন, বিশেষ কারো জন্য ঠিকই থেমে যায় আনমনে। মনের অজান্তেই খুঁজে ফিরি হৃদয় সঙ্গোপনে। দিন শেষে হাজার হাজার মানুষের মাঝে আমরা সবাই নিজ নিজ পথে একেকজন নিঃসঙ্গ পথিক। সেই প্রিয় গানের মতোই- 'তবু জীবন যাচ্ছে কেটে, জীবনের নিয়মে।'

 

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top