সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ছাতার মাথা (রম্য গল্প) : স্বপন নাগ


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২০ ০০:৩৪

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৬:৪৫

স্বপন নাগ

 

মাথা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথার অন্ত নেই। তা সে জন্মলগ্ন থেকেই দেখুন। বাচ্চাটির মাথাটি যাতে সুগোল হয় তার জন্যে কম মাথা ঘামাতে হয় না মায়েদের। সর্ষের বালিশে সোজা রাখতে হবে মাথা, একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কাৎ হলেও চলবে না। তাতেও কারো মাথা বড় তো কারো মাথা লম্বা। কারোরটা শুকনো তো কারোরটা তেলা। বিধি এমনই, দিনেকালে সেই তেলা মাথাই তেল পায় বেশি।
ছেলেবেলায় বিদ্যাসাগরের মাথা বড় ছিল বলে প্রশ্রয়ের ঢঙে তাঁকে 'যশুরে কই' বলা হত। অথচ আমাদেরই এক বন্ধুর বড় মাথার জন্যে 'মাথামোটা' নামটা পারমানেন্টলি সেঁটে গেল।
খেলায়, দৌরাত্ম্যে যারা মাথা ফাটিয়ে থাকে, বিবেচনায় তারা সবাই যে মাথামোটা এমনটা কিন্তু প্রমাণিত হয়নি। আবার এই 'মাথাফাটা' শব্দটা নিয়েও সদ্য বিবাহিত মেয়েদের প্রতি একটি ইঙ্গিতবাহী স্থূল মজা করার রেওয়াজটাও বেশ কিছু বছর আগে খুব চলত।
ভাবতেও বিস্মিত হতে হয় যে, আজ থেকে কত শত বছর আগে মানুষ কল্পনায় দশানন আর গজাননের কথা ভেবেছে। তাও তো নির্ভেজাল মস্তিষ্কপ্রসূত, অর্থাৎ কিনা মাথা খাটানো !
খুব ছোটবেলায় মেজমামা একটা অঙ্ক জিজ্ঞেস করে চকিতে নির্ভুল উত্তর পেয়ে বলেছিল মাথাটা ভালো। অথচ আজ এই পরিণত বয়সে প্রায় রোজই বৌয়ের কাছে শুনতে হয় মাথা খারাপ। তার মাথা ভালোই হোক বা খারাপ, আমার সংসারটি নিপুণভাবে চালিয়ে যাবার কৃতিত্বে বৌ যে পাকা মাথার স্বীকৃতি পেয়েছে, তাতে তার শাসন প্রক্রিয়া কখনো সখনো তার নিজেরও মাথা ঘুরিয়ে দেয়। তখন সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।
ছেলে কখন পড়বে, কী পড়বে, কতটা পড়বে -- বেশ মাথা খেলিয়ে একটা রুটিন করেছে আমার বৌ। খেলার জন্য বরাদ্দ মাত্র চল্লিশ মিনিট। টিভি ? নৈব নৈব চ। এই টিভির নাচগানই কচি কচি বাচ্চাগুলোর মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে -- বৌয়ের স্থির বিশ্বাস। অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই দেখি প্রায় মাথা ফাটাফাটি কান্ড।
'মাথায় কি গোবর নাকি রে বাবা ! সেই সন্ধে থেকে বুঝিয়ে যাচ্ছি, কিছুতেই ঢুকছে না মাথায়।'
এ হেন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় আমার মাথার পোকা নড়ে ওঠে। বৌকে রাগিয়ে দেবার প্ল্যান মাথায় আসে। অস্ফুটে বলি, 'মাথা গরম করছ কেন ? বুঝিয়ে বলো। তোমার ছেলে তো, ঠিক বুঝে যাবে।'
ব্যাস্, যায় কোথায় ! মাথায় আগুন জ্বলল বৌয়ের। চিৎকারে সারা বাড়ি মাথায় তুলল, ' এই তুমিই আহ্লাদে মাথায় তুলেছ ছেলেকে। তুমি জানো, অঙ্কে কত পেয়েছে ও ?'

অনুত্তেজিত কন্ঠে আমার জিজ্ঞাসা, 'কত ?'
'কত আবার ! তিরিশ। মাথায় মাথায় পাশ !'
সান্ত্বনা দিই, 'আহ্ ! পাশ করেছে তো !'
'পাশ করেছে তো !' ভেংচে বলে -- 'পাশ ! কাউকে বলতেও মাথা হেঁট হয়ে যায়।'

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, এতে মাথা হেঁট হবার কী আছে ! হয় তো বা আছেও ! আসলে আমার মাথা ঠিক এতটা বোঝা নিতে অভ্যস্ত নয়। আমার বৌ কিন্তু প্রত্যেকটি কাজের অগ্রপশ্চাৎ নিয়ে খুব ভাবে, তারপর টানটান মশারির মত নির্দিষ্ট কাজের আগে মাথাটা খাটিয়ে নেয়।
যখন বুঝে গেলাম, এ সংসারের নেপথ্যে আমার মাথার কাজ বা অবদান নগণ্যমাত্র, তখন থেকেই সাংসারিক বিষয়ে বৌয়ের সিদ্ধান্তকেই মাথা পেতে নিতে শুরু করেছি। মা আড়ালে বলে, ছেলেটা আমার বৌয়ের কাছে মাথা বিকিয়ে বসে আছে।
এতদিন বাবা-ই আমাদের পরিবারের মাথা ছিল। বাবা যতদিন বেঁচে ছিল, সংসারের কোনো কিছুতেই মাথা গলানোর দরকার হত না। মাথার ওপর ছাতার মত নিশ্চিত এক আশ্রয় ছিল বাবা। বাবা মারা যাবার পর আমাদের পুরো পরিবারটাই এলোমেলো হয়ে গেল।

একদিন বৌ বলল, 'শোনো, মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করো। এ সংসারে আমি একসাথে থাকতে পারব না।'
মাথা চুলকোতে থাকি। বলি, 'মানে ?'
'মানে সোজা ! আলাদা বাড়ি কেনো।'
আমার তো মাথায় হাত ! আমার বেসামাল অবস্থা দেখেও বৌ একইরকম আগ্রাসিনী, 'এই মাথার দিব্যি রইল। সামনের মাসের মধ্যে যদি আলাদা না হও, আমি গলায় দড়ি দেব।'
জীবনে এই প্রথম মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম, 'আচ্ছা ! মাথায় রাখব !'

অগত্যা রাতে, পোষা বেড়ালের মত মিহি স্বরে বৌ বুঝিয়ে দিল আলাদা থাকার কী কী অ্যাডভান্টেজ ! জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকার পরিবর্তে আলাদা থাকলে মাথাপিছু সুযোগ ও সুবিধা বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। এই বোঝানোর সময় বৌ আবার সেই বছর দশেক আগের মুখুজ্যে বাড়ির সেই মেজ মেয়েটির মত জাদুকরী হয়ে উঠল। মাথায় বিলি কেটে আদর করতে করতে গ্যাস দিতে থাকে, এত বড় সরকারি চাকরি তোমার। এই তো সময়। মাথা তুলে দাঁড়াও। সমাজে মাথা উঁচু করে চলো।'মাথায় টুপি পরানোর কাজটি নিপুণ ভাবে করে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। তবু আদরে গলে গলে যাচ্ছি আর অন্ধকারে হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করছি, পাশের জন আমার সত্যিকারের বৌ না স্বামী বিবেকানন্দ !

আমিও গ্যাস খেয়ে হাওয়ায় ভাসতে থাকি এবং যথারীতি আমার মত বিশ্ব-আলসের শরীরেও মাথাচাড়া দেয় নতুন উদ্যম।

একটা বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট কিনতে চাই -- এই খবরটা কেমন করে যেন জানাজানি হয়ে গেল। পরের দিনই সকাল থেকে সন্ধে অব্দি তিনজন লোক ফ্ল্যাটের খোঁজ দিয়ে গেল। জানা গেল সকলেই একই ফ্ল্যাটের খবর দিচ্ছে। আমার তো মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।
বৌ বলল, 'একই দলের লোক ওরা। খোঁজ নাও, দলের মাথা কে ! দালালের পাল্লায় পড়লে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে কয়েক হাজার বেশি নিয়ে নেবে।'
মনে মনে বৌয়ের মাথার তারিফ করলাম, এমন মাথার দাম আছে বৈকি !
অবশেষে, ইছাপুর চৌমাথায় জুটল একটা ফ্ল্যাট। রাস্তারও এতগুলো মাথা যে মাথা ঠিক না রাখলে বিপথগামী হবার সম্ভাবনা প্রবল।

'ফ্ল্যাট বুক করে এসেছি' বাড়ি ফিরে খবরটা দিতেই বৌ এক গ্লাস ঠান্ডাজল হাতে নিয়ে বলল, 'বড্ড খাটনি গেছে, না গো ! বসো, এক্ষুনি চা এনে দিচ্ছি।' প্রসন্ন বৌ পরীর মত উড়ে রান্নাঘরে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ' তা হলে সত্যিই মাথার ওপর ছাদ হল, কী বলো !'

খুব ঘন হয়ে বসে আমার আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বৌ বলল, 'আমার আসল ছাদ তো তুমিই গো!'

গরম চায়ে ছ্যাঁকা লাগল ঠোঁটে। চোখের সামনে বৌ আমার আহ্লাদে গ'লে গ'লে গ'লে। আমি উপভোগ করছি। আমার সর্বাঙ্গে ভাবের উদয় হচ্ছে। কন্ঠে গুনগুনিয়ে উঠছে রবীন্দ্র সংগীত : আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার ...
হঠাৎ দার্শনিকের মত বললাম, 'বলো তো, ভাঙা মাথা আর মাথা ভাঙার কী তফাৎ ?'

কী বুঝলো কে জানে ! হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে আলতো করে টেবিলে রেখেই মুখ লুকোলো আমার বুকে। আহ্লাদে বলে উঠল, 'কী যে সব ছাতার মাথা বলো, তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝি না !'


স্বপন নাগ
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top