সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

সৃজন ও রোদন ভরা করোনা : প্রণব মজুমদার


প্রকাশিত:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৪৭

আপডেট:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৪৯

ছবিঃ প্রণব মজুমদার

 

করোনা আতংক আগের মতো নেই। ঘরের বাইরে জনগণের চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আগের চেহারায় ফিরতে শুরু করছে জীবনযাত্রা। সচেতনতা এসেছে মানুষের মধ্যে। ঝুঁকি এড়াতে চলাফেরায় অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করছে মুখে মাস্ক। অনেকেই বলছেন, মরণব্যাধি রোগের মতো জীবাণু রোগ করোনাও আমাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হলো। অপেক্ষা করোনা স্থায়ী প্রতিরোধে প্রতিষেধক টিকা প্রাপ্তি।
করোনার ছোবলে আমরা হারিয়েছি দেশ বিদেশের লেখক, সাংবাদিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, সচিব, মন্ত্রীসহ অসংখ্যক গুণীজনকে। মৃত্যু আতংকে গৃহে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মহীন হয়ে কাটাতে হয়েছে প্রায় সাড়ে চার মাস! এখনও আমার সংকট কাটেনি।
করোনার ক্রান্তিকালে আমার হয়েছে করুণ অভিজ্ঞতা। সংকটে পতিত মহানগরে পারিবারিকভাবে খাদ্য ও বাসস্থান ঠিক রাখতে গিয়ে বেড়েছে আমার ব্যক্তিগত বিপুল ঋণ! লকডাউনে উপার্জনহীন হয়ে গৃহবন্দি। যখন খাদ্য ও যাপিত জীবনের নানা উপকরণের সংকট তীব্র তখন নিজেকে বেশ অসহায় মনে হয়েছে! নিকটাত্মীয়রা খবর নিয়ে বলেওনি আমাদের কিসের কষ্ট এবং অভাব। যোগাযোগ করলে শুধু পেয়েছি জ্ঞান। আত্মসম্মান বোধের কারণে মধ্যবিত্তদের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে পারি না আমার যাপনের ব্যথা এবং সংকটের বাস্তবিক অবস্থা। এ যেন এ শ্রেণির মানুষের এক সামাজিক রোগ! যে যন্ত্রণায় আমি ছটফট করি প্রতিনিয়ত। বিপদে আবারও চিনতে পেরেছি নিকটাত্মীয়, ‘কাছের’ মানুষ এবং শুভাকাক্সক্ষী বলে স্বঘোষিত বন্ধুদের! জীবনের মধ্য গগণে নিভু নিভু আলোর অলিন্দে দাঁড়িয়ে ভাবি এই বুঝি শেষ হয়ে গেলো জাগতিক মমতা? না তা হয়নি বলেই এখনও বেঁচে আছি।
মে মাসে আর পারছিলাম না। পেশাজীবী তারকা একটি সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গেও আমি দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। করোনার মধ্যে সংকটে পড়া সদস্যদের অর্থ ও খাদ্য সহযোগিতা দেয়ার জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু হলো সে সংগঠনে। তহবিল যোগাড় হলো। প্রথমদিকে গুরুত্বপূর্ণ একজন সংগঠক ফেবু ম্যাসেঞ্জারে জানতে চাইলেন আমার অবস্থা। সংকোচ করলাম। লজ্জ্বাবোধ হলো। ভালো নেই, তবুও বলি -আছি বেশ! বললাম সাহায্য পাওয়ার অবস্থায় পড়লে জানাবো। বরং দু’জন অসহায় সদস্যকে সহযোগিতা করুন। তাদেরকে বিকাশে পাঠানো হলো ক্যাশ আউট খরচসহ পাঁচ হাজার করে দশ হাজার দু’শ টাকা। পরে যখন আমার প্রয়োজন হলো সহযোগিতার, তখন আমার ফোন সে সংগঠক দেখি ধরেন না। ১২ দিন পরে কনিষ্ঠ সে সাংবাদিক নেতা আমাকে শাসালেন! প্রশ্ন রেখে বললেন, তাকে কেন বিরক্ত করছি। তার ব্যবহারে বুকটা ভারী হয়ে এলো! অপমানে তার সঙ্গে আর কথা বলিনি। পরে সে সংগঠনের বিরুদ্ধে এলো চাঁদাবাজির অভিযোগ। পরিবারের সকলের চিন্তায় যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, এক পর্যায়ে তখন ভাবলাম প্রয়োজনে একবেলা খাবো! তবুও অপমান সইবো না! ক্রান্তিকালে ঘরবন্দি। কুমিল্লা থেকে ম্যাসেঞ্জারে খোঁজ নিচ্ছেন সরকারি ব্যাংক থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বোনের এক বান্ধবী। তিনি আমার ব্যাংক হিসাব নম্বর জোর করে নিলেন। দু’দিন পর আমার ব্যাংক হিসাবে পাঠালেন তিনি ১০ হাজার টাকা। ফোনে বললেন বাজার করার জন্য তিনি এ টাকা পাঠিয়েছেন? উত্তরে জানালাম আমার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে এ অর্থ ফেরত দেয়া হবে শর্তে তা গ্রহণ করছি। তিনি জবাবে বললেন- ‘তুই আমাকে বোন মনে করিস না।’
ছোটবেলার এক বন্ধু, যার কাছে মাঝে মাঝে ধার সহযোগিতা পাই। চাই কুড়ি হাজার টাকা কর্জ। তার বাসায় গিয়ে ব্যাংকের নগদ চেক ২৫ হাজার টাকা নিয়ে আসি। চলি কিছুদিন। পরে আবার অর্থ সংকট দেখা দেয়। কিছু টাকা ধার চাইলাম ৩ জন লেখকের কাছে। ক’দিন পর একজন বন্ধু ছড়াকার পাঠালেন বিকাশে খরচসহ ৩ হাজার টাকা। দান হিসেবে সামর্থ্যবান একজন লেখক বিকাশ করলেন ২ হাজার টাকা। বেশ ছোট মনে হলো আমার ! কর্জ ভেবে তার এ অর্থ পরিশোধ করলাম ক’দিন পরেই। দশ হাজার টাকা ঋণ চেয়ে অনেক যোগাযোগের পর বিত্তবান অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার লেখক বন্ধু থেকে পেলাম মাত্র ১ হাজার টাকা। তিনি অর্থপ্রাপ্তি সংবাদ না দেয়ায় আমার প্রতি বেশ নাখোশ হন। বললাম কী দরকার ছিলো কষ্ট করে এ টাকা এই ‘অপদার্থ’কে পাঠানোর?
করোনার লকডাউনের সময়ে দৈনিক সমকাল এর সাংবাদিকগণ তহবিল গঠন করে। যারা এ সময় হাত পাততে পারছে না তাদের জন্য এ উদ্যোগ। বিকাশ নম্বর দিয়ে আমার আবেদনে সাড়া দিলেন প্রধান উদ্যেক্তা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্য ও দৈনিকটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিজেই। একদিন দেখি বিকাশে ৩ হাজার টাকা প্রাপ্তির সংবাদ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করি। দুঃসময়ে ৪২ হাজার টাকা আমার জন্য বিশাল প্রাপ্তি। অনেকে বলেন সংকটের সময় ১ টাকা ১০০ টাকার সমান। আমিও তা এ সময় বুঝতে পেরেছি। বেকার ও জীবাণু করোনার কারণে বেতন বন্ধ অনেকদিন! সাংবাদিকদের সরকার প্রণোদনা দেবে এমন খবরে আমিও আনন্দিত। মহানগরের সাংবাদিকদের দু’টি বড় সংগঠনের কাছে আবেদনও করলাম। তহবিল সংগ্রহে সৃষ্ট জটিলতায় প্রাণের একটি সংগঠন থেকে সে প্রত্যাশা হলো গুড়েবালি! সরকারের বড় সহযোগিতায় তার চেয়ে বৃহৎ সংগঠন থেকে সাংবাদিকদের দেয়া প্রণোদনার কার্যক্রমে বিলম্ব হতে থাকলো। সে সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ একজন সাংবাদিক নেতা জানালেন, সদস্য যিনি আবেদন করবেন, তিনিই এককালীন ১০ হাজার টাকার প্রণোদনা চেক পাবেন। ব্যাংক হিসাব ও বিকাশ নম্বর উল্লেখ করে সকল তথ্য দিয়ে শুদ্ধ ও পরিষ্কারভাবে আবেদন করলাম। যোগাযোগও হয় দু’জন বড় নেতার সঙ্গে এ ব্যাপারে। একজন যিনি তাঁর সাংবাদিকতা রিপোর্টিংয়ের শুরুতে আমার অনেক সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি ফোনে প্রশ্ন করলেন, এ ক’টা টাকার আমার কেন প্রয়োজন? তার জানা উচিত ছিলো সিংহও কোন সময় বিপদে পড়ে! পরে সে সংগঠন অফিস সহকারীর মাধ্যমে জানা গেলো আমার আবেদন বাতিল করা হয়েছে। এখন শুনি অসদস্যও সাংবাদিকবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া এ প্রণোদনার দশ হাজার টাকা পেয়েছেন। করোনার ক্রান্তিকালে আমার চরম উপলব্ধি হলো, আমরা সাংবাদিকরাও নিজেরা নিজদের শত্রু। নেতা হই নিজের জন্য! এ বলয় থেকে আমাদের বের হতে হবে। কেননা, আজকাল সমাজে আমাদের গুরুত্ব কমে গেছে। আগের মতো জনগণ আমাদের সমীহ করে না।
সাংবাদিক হিসেবে এখনও আমি বেকার। জানি এ দুর্যোগ থাকবে না। বিবাহিত জীবনে ককর্টরোগে আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী সহধর্মিণীর দীর্ঘ সময়ের চিকিৎসা ধার দেনা করে হোক একাই যুদ্ধ করে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। স্ত্রী বিয়োগে জীবনে পরাজিত হয়েছি সত্যি। কিন্তু করোনার জীবনযুদ্ধে আমার সাহস বেড়েছে। সকলের আশীর্বাদ এবং দোয়ায় করোনায় আক্রান্ত না হলেও বেকারত্বের কষ্ট ও প্রভাব নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে আমাকে।
করোনার দুর্যোগের মধ্যে কিঞ্চিত আলোর রেখায় ক্রান্তিকালে গৃহকোণে পেয়েছি পরিবারের সুনিবিড় ভালোবাসা। মমতার বন্ধন এবং সহযোগিতায় অর্জিত হয়েছে মনোজগতের অনুরণনে সাজানো কিছু বর্ণমালা! শব্দসৃষ্টির এ আয়োজনে সাড়ে চার মাসে সৃজন হয়েছে গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, নিবন্ধ এবং নাটকের মোট ৯৭টি লেখা! সেসব সাহিত্য গ্রন্থাকারে সন্নিবেশন করা হলে কমপক্ষে ৮টি বইয়ের পাণ্ডুলিপি হবে ।
লেখাগুলোর কিছু সমকাল, সংবাদ, ইত্তেফাক, আমাদের সময়, ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ, জনতা, কিশোর বাংলা, সময়ের আলো, মানবকণ্ঠ, আলোকিত বাংলাদেশ খোলা কাগজ, শিশু ও দেশ-বিদেশের অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমানে গ্রন্থ পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ করছি। একজন লেখকের কাজ হওয়া উচিত লিখে যাওয়া। আরাধ্য কাজটি করা উচিত লেখা সংখ্যার চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ পাঠ নেয়া! লকডাউনে অনেক বই পুনরায় পাঠ নিয়েছিও! সমসাময়িক কালের প্রকাশিত লেখা পাঠ অব্যাহত আছে।
প্রায় সময় ভাবি আমার মৃত্যু যেন হয় লেখাসংশ্লিষ্ট কাজের মধ্যে। সাহিত্য থেকে সাংবাদিকতায়। দীর্ঘপথের পরিভ্রমণ আমার। যদি আর কিছু সময় বাঁচি, তবে আরও যুক্ত হবে জীবনের অভিজ্ঞতা। তবে করোনার দুঃসময়ের অভিজ্ঞতা এখন অবধি আমার জীবনের স্মরণীয়। তা করুণ! আবার প্রাপ্তিও আছে। আর সে অর্জন বা প্রাপ্তি হচ্ছে আমার লেখালেখির সৃজনী কাজ।


প্রণব মজুমদার
লেখক গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি ও কলাম লেখক
২৭ আগস্ট, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ
পুরানা পল্টন, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top