সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

সাক্ষী : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪৭

আপডেট:
৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:১০

 

আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকায় মোনালিসা, একঘর লোকের মধ্যে এমন কেউ কি নেই যে তাকে বিশ্বাস করবে, একজোড়া বিশ্বাসী চোখ! ঘরে গুঞ্জন ওঠে, দু একটা কথার তীব্র তীর বড্ড বুকে বাজে, গেঁথে থাকে, রক্ত ঝড়ায়, “এই মাইয়া কি কইব?”; “চেহারা দেখছ?”; “চুপ চুপ” এরকম আরো অনেক কিছু। মোনালিসা এখন আর কিছু শুনছে না, অন্ততঃ একজন মানুষ দরকার যে তাকে বিশ্বাস করবে।

জানুয়ারী মাস, সারা দেশে শৈত্য প্রবাহ চলছে, কিন্তু এই ছোট্ট রুমে বসে সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই।মোনালিসা ঘামছে, খানিক গরমে, খানিক অস্বস্তি আর ভয়ে। কোর্টে আসার পথে সে অন্যদের কথায় বুঝতে পেরেছে তার বাবা-মা কে থ্রেট দেয়া হচ্ছে। কি হবে মা –বাবার কোনো ক্ষতি হলে? সে কি আবার স্কুলে যেতে পারবে? সে পুরাপুরি সেরে উঠবে তো? এরকম নানা ভাবনা উঁকি দেয় তার মনের মধ্যে। যদিও এই ছোট বয়সেই মোনালিসা বুঝতে পেরেছে এত ভেবে কাজ নেই, বেশী ভাবলে ভাবনাটাই হয়, কাজ আর হয়না।

মোনালিসার মনে পড়ে দুজন লোক কথা বলছে,

- তাইলে তোমার রিক্সা ভাড়া আঠাইশ টাকা পাইলা ?

- ও

- নয়’শ বিরানব্বই টাকা হইছে না গো, তাইলে আঠাইশ টাকা রিক্সা ভাড়া পাইলা ? ও নতুন টাকা এইত্তা, না ?

- হ

তারপর জোড়ে দরজা আটকানোর শব্দ। কারা এরা ? মোনালিসা মনে করার চেষ্টা করে, পারেনা, মাথার ভিতরটাতে চিনচিনে ব্যাথা হয়।

পিছন থেকে কেউ একজন তাড়া দেয়, “সবাই চুপ করেন , এইবার উইটনেস যা জানে বলবে”।

কে? আনোয়ার ভাই না তো?

আনোয়ার ভাই মোনালিসার মেজ চাচীর বোনের ছেলে, পেশায় উকিল, তাকে মোনালিসার পক্ষ থেকে  কেস লড়ার জন্য ঠিক করা হয়েছে । মোনালিসা এখন যে ঘরটাতে দাঁড়িয়ে  আছে সেটা  একটা জেলা শহরের কোর্টের একটা ঘর। লোকজনের ঠাসাঠাসিতে তিল পরিমান জায়গা নেই, মাথার উপরে দুটো সিলেং ফ্যান, কিন্তু তাতে শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হচ্ছে বলে মনে হচ্ছেনা।

মোনালিসার মনে এখন সে উইটনেস এটা ছাড়া অন্য কিছু থাকার কথা না। মোনালিসা চোখের উপরে যেন ঐ দিনটিকে দেখতে পারছে । তার কানে একটা শব্দ আসছে, শব্দটা তার কানে অনবরত বাজছে, মনে হচ্ছে কাছেই কেউ একজন ডিম ফ্যাটাচ্ছে । মোনালিসার এখন কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না, তার এখন বেশী করে পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো কুচি, ধনে পাতা কুচি , খানিকটা  নতুন আলু কুচি আর অল্প নুন, চিনি দিয়ে ডিমের ওমলেট খেতে ইচ্ছা  করছে । আচ্ছা এখন ডিমের  ওমলেট পাওয়া যাবে? আনোয়ার ভাইকে ডিমের কথাটা বলা কি এখন ঠিক হবে? মোনালিসা ভাবতে থাকে।

আনোয়ার ভাইয়ের প্রশ্নে মোনালিসা ছোট রুমের ভীড়টাতে আবার ফিরে আসে, তার দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ গুলোর দিকে তাকায়, এক জোড়া বিশ্বাসী চোখ ? না হয়না । হসপিটাল থেকে সরাসরি তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, আসার আগে বাড়ির কারো সাথেই তার কথা হয়নি।

আবার প্রশ্ন ভেসে আসে, “মিস মোনালেসা  আপনি বলুন, যা যা হয়েছিল সেদিন, বলুন”

মোনালিসা ভাবে, ইস আনোয়ার ভাই নামটা ঠিক করে বলেন, কতদিন বলেছি মোনালেসা ডাকবেন না, আমি মোনালিসা, ভিঞ্চির মোনালিসা। আমার হাসিটা দেখেছেন ? সেটা দেখবেন কেন ?

“মোনালেসা বলুন?”

মোনালিসা ফিরে যায় ঘটনায়, হয়তো বলতে ও থাকে, -

দিনটা কেমন মেঘলা । দুপুর থেকেই থেমে থেমে ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।  স্কুল ছুটি হতে হতে সেই  বিকেল চারটা। শুধু ছুটি হলেই তো আর হলনা তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে, ভীড় ঠেলে গেট পার হতে আরো ও কমপক্ষে পনের -বিশ মিনিট। স্কুল থেকে বের হয়ে সামনের দোকান থেকে  দুটেো মুগপাক্কন পীঠা কেনে নাসরিন, আজ মোনালিসার কাছে টাকা নাই, সকালে মা ছোট ভাইটাকে নিয়ে মামার বাসায় গেছে স্কুলে আসবার আগ পর্যন্ত দেখা নাই । পাশের বাসার চাচীর কাছ থেকে দশ টাকা চেয়ে এনেছিলো সেটা টিফিনেই শেষ। নাসরিন মোনালিসাকে একটা পীঠা দিলে দুজনেই প্রায় একসময়েই পীঠায় কামড় বসায়। ‘এই দোকানের এই পীঠাটা  একনম্বর’ বলে নাসরিন্ । মোনালিসা  খেতে খেতে জবাব দেয় “হুম”। দোকান ছেড়ে বের হয়ে  বড় পুকুর পাড় ধরে আগালেই বড় রাস্তা। বড় রাস্তায় পা দিতেই বৃষ্টি । ওরা কেউ আজ ছাতা আনে নাই। দুজনে দৌড়ে খানিকটা পথ আগায়, কোনো গাছ পেলে তার নীচে দাঁড়ায়, গাছের পাতার ফাঁক গলে বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলেই ফের দৌড়। এবারে  কলেজ’ রোডের এক বাসার গেটের  সেডে এসে দাঁড়ায় । মোনালিসারা শুনতে পেল, বাসার ভিতর থেকে কেউ বলছেন, “নয়’শ নিরানব্বই টাকা হইছে না’গো ….”

বৃষ্টি যেন ধরছিল না কিছুতেই। একটু পরেই একটা লোক ছাতা মাথায় বাসার গেট ফুঁড়ে বের  হল, তীব্র দৃষ্টি হানল নাসরিন আর মোনালিসার  দিকে, কেমন শিরশিরে অনুভূতি হল মোনালিসার সারা শরীরে। এতক্ষনে মোনালিসা খেয়াল করলো বাসাটার গেইটের সাথে সাঁটা পিতলের নাম ফলকটা, বড় বড় অক্ষরে লেখা “পান্থ নীড়” হোল্ডিং নং -১৬২। বৃষ্টির জন্য রাস্তায় লোকজন ক্রমাগত কমতে লাগলো, আর খালি রিক্সাতো তখন স্বপ্ন! মোনালিসা ব্যাগের ভিতরে পলিথিনের ব্যাগ রাখে অনেক সময়, পলি ব্যাগ আছে কিনা, সে হাত চালিয়ে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তখনই নুসরাতের কনুইয়ের গুঁতায় বিরক্ত হয়ে বলল,

- কিরে ঠেলছিস কেন?

- এখান থেকে চল

- বৃষ্টি কমতেছে, আর একটু দাঁড়াই?

- না, ভিজেই চল; দেখছিস না শিষ দেয়

মোনালিসা খেয়াল করল দুটো ছেলে সাইকেলে করে দুইবার চক্কর দিয়ে গেল তাদের সামনে থেকে। মোনালিসার কাছে এটা নতুন নয়, মফস্বল এলাকায় একা বৃষ্টিতে আটকা পড়ে দাড়িয়ে আছে এমন মেয়ে দেখলে শিষ দেয়া ছেলেদের অভাব থাকেনা; কোথা থেকে যে এই হাভাতে গুলা আসে অল্লাহই জানে, মনে মনে ভাবে মোনালিসা।

দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করে, বৃষ্টির তেজ কমে গিয়ে এখন ঝিরিঝিরি, নুসরাত দ্রুত পায়ে হাঁটে । ওর সাথে তাল মিলাতে গিয়ে মোনালিসার বাম পায়ের স্যান্ডেলটা হঠাৎ ছিড়ে গেলে পিছিয়ে পড়ে। নুসরাত বলে

-কিরে দাড়াঁইলি কেন ?
-ইস স্যান্ডেলটা ছিড়ল!
-হাতে নে
-কি হইছে, এমন তাড়া দিচ্ছিস কেন ?
-ভিজতেছি, তার উপরে ঐ ইদ্রিস!
-ইদ্রিস কে?

সে প্রশ্নের আর উত্তর দেবার সময় পেলনা নাসরিন । নাসরিন আর মোনালিসার তীব্র চিৎকারে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই লোক জড়ো হল। মোনালিসা ঝাপসা চোখে দেখতে পেল একটা সাইকেল দ্রুত চলে গেল। তারপর টানা সাড়ে তিন মাস হাসপাতালে। ছত্রিশ দিনের মাথায় নাসরিন  আর কষ্ট সহ্য না করতে পেরে মরে গেল। এসিডে ওর দুটো চোখই  নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মোনালিসা নুয়ে ছেঁড়া স্যান্ডল হাতে তুলছিলো বলে বা’হাত সহ শরীরের বা’পাশ দগ্ধ হয়েছে।

মোনালিসার পুরো রুমটাতে চোখ বুলায়, রুমটাতে সারি সারি বেঞ্চ পাতা যেমনটি থাকে সাধারনতঃ কোর্টের রুম গুলোতে। তার নজর পড়ে তৃত্বীয় সাড়িতে মাঝামাঝি বসা একটা লোকের উপর। লোকটি একটা কাঠি দিয়ে পান খাওয়া লালচে দাঁত খোঁচাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো তার লোকটি  কে সেটা মনে করতে । ঠিক, এই লোকটাকেই সে পান্থনীড় বাসাটার গেইট  দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছিল।  মোনালিসার মনের কষ্ট শরীরে চেপে বসে, সে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারায়, চোখে অন্ধকার দেখে। “ধর ধর”, চেয়ার দাও, চেয়ার দাও”, “হুইল চেয়ার কই” শোরগোল পড়ে ছোট্ট  রুমটাতে, এতক্ষন থম মেরে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে চাঞ্চল্য তৈরী হয়। মোনালিসার দিকে পানি এগিয়ে দেয় মহিলা পুলিশ, ঢকঢক করে পানি গিলতে থাকে মোনালিসা। আজকের মত কোর্ট মুলতুবি, পরবর্তী শুনানীর তারিখ ধার্য হয়। হুইল চেয়ারের দিকে মুখ এগিয়ে আনোয়ার ভাই বলেন, “ভাইবো না, কেস আমাদের পক্ষে, ফাঁসির রায় নিয়া ছাড়ব, আমার ও ইজ্জতের মামলা…”। আনোয়ার ভাই কি বলতে চায় বুঝতে পারেনা মোনালিসা, কিসের ইজ্জত!

হুইল চেয়ার রুম থেকে বের হয়ে বারান্দা ধরে আগাতে  থাকে। পাশ থেকে কেউ বলে ওঠে, “মহিল্ সাক্ষী, নারে ব্যাটা, ফাঁসি হইব কেমনে? মহিলা সাক্ষীর দাম আছে কুনো? হেরপরো এ মাইয়া তো আবার কিছু মনে করতে কইলেই বেহুশ হইয়া পড়ে, হা…হা…” মোনালিসার মাথার মধ্যে কথাটা ঘুরতে থাকে, নিজেকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর মনে হয়, মাথাটা বড্ড ভারী মনে হয়; ব্যস্ত হয়ে চারদিকে তাকায়, একজোড়া বিশ্বাসী চোখ পাওয়া যায় কিনা…

 

সায়মা আরজু
লেখক, শিক্ষক, গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top