সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মাদার তেরেসা: ভালোবাসার ফেরিওয়ালা : সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


প্রকাশিত:
৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৫৯

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১১:০২

ছবিঃ মাদার তেরেসা

 

সুন্দর একটা পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ভালোবাসা। শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়েই সম্ভব হবে পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই বিশ্বাস থেকেই বিশ্ব মানবতার প্রতীক মহীয়সী নারী মাদার তেরেসা ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তিনি বলতেন, "পৃথিবীবাসীর গুলি আর বোমার দরকার নেই, দরকার ভালোবাসার।" এ ভালোবাসো দিয়েই তিনি বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করে অমরত্ব লাভ করেছেন। আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গেছেন। ভালোবাসা দিয়ে দরিদ্র, দুস্থ, অসহায় মানুষদের মায়ের মমতায় আগলে রেখেছেন। তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার স্রোতে যাদের বুক ভিজেছে, তাদের কাছে তিনি ‘মা’ হয়ে উঠেন। পৃথিবীবাসী ছিল তার কাছে সন্তানের মতো, মায়ের মমতা দিয়ে বিশ্ববাসীকে আগলে রাখতে চেয়েছেন। তিনি পৃথিবীর আনাচে কানাচে ঘুরে মানুষের কাছে ভালোবাসার বাণী পৌঁছে দিতেন। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা দিয়ে গেছেন। ভালোবাসার পরশ পাথর দিয়ে মানুষের সব দুঃখ, কষ্ট, হতাশা দূর করা যায়, সেটা তিনি নিজেই প্রমাণ করে গেছেন। শিশুদের কাছে তিনি ছিলেন আনন্দের ফোয়ারা। এই পৃথিবীর কাছে যারা ছিল অনাকাঙ্খিত, পরিবার যাদের ত্যাগ করেছিল, ভাগ্য ও জীবন যাদের অভিশাপ দিয়েছিলো আর সমাজ যাদের গ্রহণ করেনি কোন কালেই, সে সকল অনাশ্রিত, অসমর্থ, অসুস্থ, অবহেলিত, স্নেহবঞ্চিত মানুষদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সহানুভূতি, স্নেহ, সেবার অবিচল প্রতিশ্রুতির এক মূর্তরূপ। এমনকি সমাজ ও পরিবার থেকে বিতাড়িত, চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত কুষ্ঠরোগীদের তিনি শুধু আশ্রয়ই দেননি, প্রাণের মায়াকে তুচ্ছ করে নিজ হাতে তাদের সেবা করেছেন দিনের পর দিন। এভাবে ভালোবাসা বিলিয়ে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে হয়ে উঠেন বিশ্বমাতা। তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন, ভালোবাসার চেয়ে সহজ ও সার্বজনীন ভাষা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। 

 

আলবেনীয় বংশোদ্ভূত মাদার তেরেসার জন্ম ২৬ আগস্ট ১৯১০ মেসিডোনিয়ার স্কোপিতে। পরিবার প্রদত্ত নাম আগ্নেস বোইয়াক্সিউ এবং ডাক নাম গোস্কসা। গোস্কসা মূলত একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ 'কুসুমকলি'। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তাদের পরিবারটি ছিল অত্যন্ত সুখী। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, মাত্র ৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসাকে পিতৃহারা হতে হয়। শুধুমাত্র বাসস্থানটুকু ছাড়া সর্বস্ব হারিয়ে মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয় পরিবারটিকে। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের ফলে তেরেসার মা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন। সংসারের সব দায়দায়িত্ব এসে পড়ল তেরেসার বড় বোন অ্যাগের ওপর। কাপড় বিক্রি ও অ্যামব্রয়ডারির ব্যবসা দিয়ে তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হলো। জীবনের এই সংগ্রাম থেকে দারিদ্র ও প্রতিকূলতাকে সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রহণ করার তৎপরতা আবিষ্কার করেন মাদার তেরেসা। তেরেসার লেখালেখির হাত খুব ভালো ছিল। তাই অনেকেই ধারণা করেছিলেন, লেখালেখি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করবেন। কিন্তু তার আগ্রহ ছিল মানবসেবায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ঠিক করলেন সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার। তৎকালীন সময়ে ভারতে বাংলায় ধর্মীয় কাজ করতেন যুগোশ্লাভীয় ধর্মযাজকরা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, লরেটা সিস্টারদের মধ্যে যারা আইরিশ সম্প্রদায়ভুক্ত তারা যাবেন ভারতবর্ষের মতো এলাকায় কাজ করতে। অ্যাগনেস (মাদার তেরেসা) তাই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেন। কিন্তু এই কাজ পেতে হলে, তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরিক্ষাটি অনুষ্ঠিত হবে প্যারিসে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বিনয়ী, নম্র এবং পরোপকারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা, তাকে কি কোনো পরীক্ষায় পেছনে ফেলা যায়? আর যায় না বলেই হয়তো প্যারিসের সাক্ষাৎকারে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তেরেসা ও তার সঙ্গীকে পাঠানো হলো আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে তাদের সন্ন্যাস জীবনের প্রশিক্ষণ এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য। সেখানে মিশনারী মেয়েদের দল 'সিস্টার্স অব লোরেটো'তে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষ করে প্রায় ৬ সপ্তাহ শেষে ১৯২৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর দুই সন্ন্যাসিনী সুদূর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে পাড়ি দিলেন। ভারতে এসে দার্জিলিংয়ে নবদীক্ষিত নান হিসেবে কাজ শুরু করেন।

 

১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। তখন তিনি সাধু সেইন্ট তেরেসার নামানুসারে 'সিস্টার ম্যারি তেরেসা' নাম গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালের ১৪ মে পূর্ব কলকাতায় একটি লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে পড়ানোর সময় তিনি চূড়ান্ত শপথ গ্রহণ করেন। স্কুলে পড়াতে তার ভালো লাগলেও কলকাতার দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্টে তিনি উত্তরোত্তর উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন। তিনি সম্পূর্ণভাবে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার সংকল্পে লোরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন। তিনি যখন লোরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন তখন তার হাতে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। এ রকম নিঃস্ব অবস্থাতেই তিনি আশ্রয় নিলেন শিয়ালদহ রেলস্টেশন-সংলগ্ন এক পুরনো ভাঙা বাড়িতে। কলকাতার অলিগলি আর বস্তিতে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। ১৯৪৮ সালে দরিদ্রের মাঝে মিশনারি কাজ শুরু করেন। প্রথাগত লোরেটো অভ্যাস ত্যাগ করেন। পোশাক হিসেবে পরিধান করেন নীল পাড়ের একটি সাধারণ সাদা সুতির বস্ত্র। এ সময়ই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। প্রথমে একটি ছোট স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেন। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন 'মিশনারিজ অব চ্যারিটি'। যার শাখা বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালে এ চ্যারিটির অধীনেই গড়ে ওঠে 'নির্মল হৃদয়', কুষ্ঠ রোগীদের জন্য 'শান্তিনগর'। ১৯৫৫ সালে মাদার তেরেসা স্থাপন করেন 'নির্মল শিশুভবন'। ১৯৬৩ সালে গড়ে তোলা হয় 'মিশনারিজ অব চ্যারিটি'-এর ব্রাদার শাখা। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, সময়ের ব্যবধানে তা এখন কয়েক হাজারে পৌঁছেছে। ভারতের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের দুস্থ মানুষের সেবা করার জন্য ভারতের বাইরে প্রথমবারের মতো ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায় মিশনারি অব চ্যারিটির শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া এবং অস্ট্রিয়াতে শাখা খোলা হয়। ১৯৭০-এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েক ডজন দেশে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০-এর দশকের মধ্যেই সমাজসেবী এবং অনাথ ও আতুরজনের বন্ধু হিসেবে তার খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

 

জীবনে ত্যাগ স্বীকার করলে সেই কাজের স্বীকৃতি নিশ্চয়ই পেতে হবে। তারই প্রমাণ মাদার তেরেসা। তিনি জীবনে বিভিন্ন সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে বহু পুরস্কার পেলেও এই নিয়ে তার কোনো গর্ব ছিল না। বরং তিনি পুরস্কার হাতে নিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলতেন, 'আমি অতি ক্ষুদ্র। আমার শক্তি হচ্ছে আমার কর্মীবাহিনী আর জনগণের ভালোবাসা। এই পুরস্কার তো তাদের প্রাপ্য'। মাদার তেরেসা প্রথম পুরস্কার পান ১৯৬২ সালে। ভারত সরকার 'পদ্মশ্রী' উপাধিতে তাকে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে দুঃস্থ মানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পোপ জন শান্তি পুরস্কার, ১৯৭২ সালে জওহরলাল নেহরু এবং ভারতরত্ন পুরস্কার পান। তিনি ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মোট ৮৪টি পুরস্কার ও সাম্মানিক উপাধিতে ভূষিত হন। মাদার তেরেসাকে অমর করে রাখার সবচেয়ে বড় প্রয়াসটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে যারা দুই মুঠো অন্ন পৌঁছে দেন তাদের পক্ষে এই স্বীকৃতি হলো সেরেস মেডেল। এই মেডেলের এক পিঠে রয়েছে ভিক্ষাপাত্র হাতে অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশুর মূর্তি আর অপর পিঠে রয়েছে মাদার তেরেসার ছবি। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের সে সময়কার সেক্রেটারি জেনারেল পেরেজ দ্য কুয়েলার মাদার তেরেসা সম্পর্কে এক সভায় বলেছিলেন, পৃথীবির সবচেয়ে শক্তিশালী মানবী হচ্ছেন মাদার তেরেসা।

 

১৯৮৩ সালে পোপ জন পল-২ এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তিনি 'মিশনারিস অফ চ্যারিটি'র প্রধানের পদ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু চ্যারিটির নানরা গোপন ভোটগ্রহণের পর তেরেসাকে প্রধান থাকার অনুরোধ করে। অগত্যা তেরেসা চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মেঝেতে পড়ে গিয়ে কলার বোন ভেঙে ফেলেন। কিছু দিন পর আগস্টে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর পাশাপাশি তার বাম হৃৎপিণ্ডের নিলয় রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাড়ান। এ বছরেই ৫ সেপ্টেম্বর এই মহীয়সী নারী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চির বিদায় নেন। তার মৃত্যুতে সারা বিশ্ব জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুর সময় মাদার তেরেসার মিশনারিস অফ চ্যারিটিতে সিস্টারের সংখ্যা ছিল ৪,০০০ এবং ব্রাদারহুড সদস্য ৩০০ জন আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ১০০,০০০ এর উপর। পৃথিবীর ১২৩টি দেশে মোট ৬১০টি কেন্দ্রে ধর্মপ্রচারণার কাজ পরিচালিত হচ্ছিল। এসব কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ছিল এইডস, কুষ্ঠরোগ ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, সুপ কিচেন, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, এতিমখানা ও বিদ্যালয়। মাদার তেরেসা কখনোই জাত-ধর্ম-বর্ণের সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। আর্ত মানবতার সেবায় তিনি মাতৃ স্নেহে যেভাবে পৃথিবীর সকল জাত-ধর্ম-বর্ণের মানুষদের ভালোবাসার টানে আবদ্ধ করেছেন, তেমনি বিশ্ববাসী মাদার তেরেসাকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।

 

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top