সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:২২

আপডেট:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:২৭

ছবিঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘ তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নাই।’ আসলেই রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নাই। আমরা সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি তাঁকে। অবলোকন করি তাঁর রচনাসম্ভার। সাহিত্যের সবগুলো শাখায় পরিভ্রমণ করেছেন তিনি স্বচ্ছন্দে। স্বচ্ছন্দবিহারী তিনি সর্বাঙ্গনে ।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বহুধা বিস্তৃত তার চিন্তাশক্তি, তাঁর রচনার বিস্তার। তাঁর কবিতা-গান ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা হয় বেশি। তাঁর প্রবন্ধ-উপন্যাস, নাটক-ভ্রমণকাহিনী নিয়েও আলোচনা হয়। তবে কবির ‘চিত্রকর’ সত্তা আড়ালেই থেকে যায়। আলোচনা খুব কমই হয়।
কবিতার কাটাকুটি করতে গিয়ে আঁকা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪ থেকে ১৯৪১ সালে তাঁর মৃত্যু অবধি প্রায় আড়াই হাজার ছবি এঁকেছেন তিনি। এক বিস্ময়কর শিল্প প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি গভীরভাবে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ শুরু করেন ১৯২৮ সাল থেকে। তবে ছোটবেলা থেকেই আঁকা-আঁকি শেখেন তিনি। শান্তিÍ নিকেতনে চিত্রশিল্প শিক্ষা প্রচলন ছিল। এছাড়া অগ্রজ জ্যেতিরিন্দ্রনাথ, পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী চিত্রচর্চা করতেন। ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রশিল্পের পথিকৃৎ। কাজেই পারিবারিক প্রভাব তো ছিলই। এসব গুণীজনের সান্নিধ্য পেতেন নিয়মিত। চিত্রশিল্প নিয়ে তাঁদের সাথে সার্বক্ষণিক আলাপ-আলোচনা হতো। শিল্প পরিবেশের মধ্যেই ছিল তাঁর বসবাস। জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর পরিবারে প্রিন্স দ্বারকানাথের পুত্র গিরীন্দ্রনাথ এবং তাঁর পুত্র এবং রবীন্দ্রনাথের জ্ঞাতিভাই গুণেন্দ্রনাথ মূলত ছবিই আঁকতেন। গুণেন্দ্রনাথের তিন পুত্র গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ভারতের চিত্রকলা জগতে দিকপাল। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের দুই বোন বিনয়িনী ও সুনয়ানী দেবীও ।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ঊনবিংশ শতকের শেষদিকেও তখনকার রীতি অনুযায়ী দেয়াল জুড়ে সার সার পশ্চিমা ছবির প্রতিলিপি টানানো ছিল । এরপরে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিলিতি ছবি বাদ দিয়ে রবি বর্মার ছবিতে দেয়াল ভরে যায়। এতে বোঝা যায় যে, দেশি-বিদেশি চিত্রশিল্পের সঙ্গে চাক্ষুস পরিচয় রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালেই হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনে ছবি আঁকার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়ের আঁকা তাঁর কিছু কিছু ড্রয়িং দেখা যায়।
১৮৭৮-৮২ সময়কালে রবীন্দ্রনাথ ‘মালতী’ নামে একটি পুঁথির পাতায় ছবি আঁকতেন। ১৮৮৯ সালের দিকে তিনি একটি পকেটবুক রাখতেন। তাতে যখন যা মনে হত, তাই আঁকতেন ।
রক্তকরবী বা পূরবীর পান্ডুলিপি ঠিক করার সময় কাটাকাটি হতো। এসব করতে করতে অদ্ভুত প্রাণি আর পাখির ছবি তৈরি হতো । এসব প্রাণির বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিল না। গাঢ় কোন রঙের রেখাঙ্কনে এসব ছবিতে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন অদ্ভুত সব ফর্ম। প্রথমদিকে পেলিক্যান কালো কালির কলম দিয়ে রেখাগুলো সৃষ্টি করতেন। পরে রঙ তুলি দিয়ে পরিপূর্ণভাবে বিকাশিত করতেন। এ বিষয়ে তিনি খুবই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন খেয়ালী আর স্বাধীন। ছবিতে রঙ লাগানোর জন্য তিনি তুলি ছাড়াও আঙ্গুল তুলো, কাগজ, বøটিং পেপার, জামার হাতা ব্যবহার করতেন। বিদেশি রং ছাড়াও দেশী লতা-পাতা ফলের রস ছবিতে ব্যবহার করতেন।
চিত্রশিল্প সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, অশিক্ষিত আদিম মানুষের প্রথম সৃজনশীল কর্ম ছবি। মানুষ ভাষা শেখা ও লেখার আগেই গুহার গায়ে ছবি এঁকেছিল অন্তর্গত তাগিদে। সে ছবির মাধ্যমে প্রকাাশিত হয়েছিল তাদের চাহিদা। সেই ছবিই তখন বাক্সময় হয়ে উঠেছে, কথা বলেছে। আদিকাল থেকেই মানুষ এই নিঃশব্দ সৃষ্টি চালিয়ে আসছে। জীবনের প্রয়োজনেই চিত্রকলার সৃষ্টি। গুহামানব যা শুরু করেছিল গুহার গায়ে এঁকে, আজও তাই চলছে। সে উত্তরাধিকার এখন চলছে কাগজের রেখায়, ক্যানভাসে, কম্পিউটারে ।
সৃজনশীলতা প্রকাশের যতগুলো মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে চিত্রকর্ম অন্যতম মাধ্যম। এই মাধ্যমটি কাজে লাগিয়েছিলেন অসাধারণ সৃজনী ক্ষমতাধর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর মনে যে ভাবাবেগ,আবেগ,উদ্দীপনা, হৃদয়- বেদনা, শক্তির উপলব্ধি ও সৌন্দর্যবোধের উদয় হতো তা তাঁর চিত্রে প্রতিফলিত হতো। চিত্রকলায় তাঁর প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু তিনি চিত্র অঙ্কনে ছিলেন পরদর্শী। ‘পূরবী’ ছবিটি তাঁর আঁকা অন্যতম ছবি।
জীবনের শেষ পাদে এসে রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলায় নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন পুরোমাত্রায়। তখন তাঁর বয়স ৬৩ বছর। তিনি নিজেই বলতেন, ছবি তাঁর শেষ বয়সের প্রিয়া, যে তাঁকে নেশার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে ছবির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অধিক বয়সের তরুণী ভার্যা রূপে।
১৯১৩ সালে নোবেল প্রাপ্তির পর তাঁকে নিয়ে বিশ্ব জুড়ে আলোচনা শুরু হয়। আর্জেন্টিনায় ওকাম্পো, বোর্হেস, ফ্রান্সে আঁদ্রে জিদ, রঁমা রোঁলা জার্মানিতে ব্রেখাট, রাশিয়ার পাস্তারনাক, চিলিতে নেরুদা মেতে উঠলেন তাঁকে নিয়ে। অবশ্য টেগোরকে নিয়ে মাতামাতিতে অনেকেই বিরক্ত হয়েছিলন তখন । সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। সেসময় পেরুতে যাবার পথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনার একটা হোটেলে আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্রনাথ। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ওকাম্পো তাঁকে নিয়ে এলেন নিজের ভাড়া করা একটা বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের উপর ওকাম্পোর উল্লেযোগ্য প্রভাব ছিল। শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর অবদান কম নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর ভিত্তিটি গড়ে উঠেছিল ওকাম্পোর বাড়িতেই, ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ রচনার সময়। ওকাম্পো লিখেছেন,
‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়। বাংলা বলেই যখন-তখন খাতাটা খুলে দেখা আমার পক্ষে তেমন দোষের কিছু ছিল না। এই খাতা আমায় বিস্মিত করল, মুগ্ধ করল। লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতো নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল। সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা, এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’
ওকাম্পোর লিখেছেন এটা রবীন্দ্রনাথের সূচনা পর্ব। তবে এর আগেও রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন বিচ্ছিন্নভাবে। জোরালো তোড়জোড় এখান থকেই শুরু হয়।
রবীন্দ্রনাথের ছবিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন ১. নর-নারীর মুখের ছবি, ২. জীবজন্তু ও প্রতিকৃতি, ৩. প্রকৃতির পটভূমিকায় মানুষের রূপকচিত্র, ৪. অলঙ্কারিক চিত্র, ৫. প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি।
নিসর্গ, জন্তু, গাছপালা, রমণী, পুরুষ, আত্মপ্রতিকৃতি, মুখোশ, নানা মুদ্রায় নৃত্যরত রমণী, কিম্ভূতকিমাকার অদ্ভুত সব প্রাণি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। শেয়াল, কুকুর ইত্যাদি পরিচিত প্রাণির অবয়ব নিয়ে যেমন কাজ করেছেন তেমনি বাস্তবে দেখা যায় না এমন অনেক কল্পিত প্রাণির দেখা মেলে তাঁর চিত্রে।
‘শিয়াল’ শীর্ষক একটি ছবি অঙ্কন করেন রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালে । কলমের অজস্র চিকন রেখায় চিত্রটির জমিন তৈরি হয়েছে। এরই মাঝে একটি শিয়াল যেন কোনাকুনি দৌড়ে যাবার চেষ্টা করছে। তার চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে ধূর্ততা ।
‘মা ও ছেলে’ শীর্ষক একটি ছবিতে দেখা যায়, একজন মধ্যবয়সী মা তার শিশু ছেলেকে কোলে নিয়ে আসীন। মায়ের পরণে হালকা বাদামী শাড়ি। কোলের শিশুর পরিধানে কাপড় নেই। মা তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টিতে পরিস্ফুট দারিদ্র।
যুগল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিরীক্ষা করেছেন। তবে তাঁর যুগল সপ্রতিভ নয় । কিছুটা বিষন্ন। বিষণ্ণ কিন্তু সদূরপিয়াসী।
প্রাণি নিয়ে অনেক কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অঙ্কিত অদিম প্রাণির ফর্মগুলো প্রাণির বিবর্তন প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত করে। একইসাথে পারস্পরিক যুদ্ধাংদেহী অবস্থাও ফুটে উঠেছে ছবিতে। কাগজে নানা রংয়ের কালি দিয়ে এসব ছবি আঁকা হয়েছে। নানান রকম উদ্ভট আর অদ্ভুত ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। এসব ছবির অনেকগুলিই দেখতে কদাকার। দীর্ঘ ঠোঁটবিষ্টি একরকম কল্পিত পাখি এঁকেছেন তিনি।
কাইয়ূম চৌধুরী উল্লেখ করেছিলেন-
কিম্ভূত জানোয়ারদের ছবি দেখে মনে হতো এসব রবীন্দ্রনাথ পেলেন কোথায়? ছবি আঁকলেন একটা শেয়াল হাসছে। হাস্যমুখ শেয়াল দেখে আমাদেরই হাসি পায়।
প্রাণির মতো দেখতে এসব ছবি রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন অনুজ্জ্বল রং ব্যবহার করে। গাঢ় কালো, বাদামী, লাল আর হলুদাভ রংয়ের বিন্যাসে এসব ছবির সৃষ্টি। অঙ্কিত এসব ছবি অনেক সময়ই অর্থবাহী। রং এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে ছবিতে কখনো কখনো বিষাদ, ব্যঙ্গ, কৌতুক, আদিমতা আর রহস্যময়তার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর ছবিতে রংঙের প্রাচুর্য নেই। আর রংয়ের স্বল্পতার কারণে তাঁর ছবিতে প্রাণময়তার প্রকাশ তেমন ঘটেনি বরং বিষন্নতার প্রকাশ ঘটেছে।
নারীর মুখ রবীন্দ্রনাথের চিত্রপটে উল্লেখ্যযোগ্য স্থান দখল করেছে। অনুশীলন পর্বে মুখোশ আর মুখাবয়ব এঁকেই যেন তিনি আঁকার হাতটি পোক্ত করেছেন। নারীমুখ দিয়ে নানা রকম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন। নারীর অন্তর্নিহিত শক্তির উদ্ভাসও ঘটিয়েছেন রেখাচিত্রি। তিনি এঁকেছেন নানা ধরনের মুখাকৃতি, আবক্ষ মূর্তি, দেহাকৃতি এমন কি নানা ধরনের আত্মপ্রতিকৃতি। রবীন্দ্রনাথের আঁকা নর-নারীর মুখের ছবিতে তাদের মানসিকতা ও স্বভাবের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে।
বিশিষ্ট শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী রবিতীর্থে রবীন্দ্রনাথ-এ উল্লেখ করেছেন-
রবীন্দ্র চিত্রকলায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে তাঁর রমণী মুখাকৃতি, জলরঙে, কালি কলমে আঁকা বাঙালি রমণীর লালিত্য তাঁর ছবিতে আবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে ধরা পড়েছে। অন্য কোনো শিল্পীর কাজে এমনটা দেখা যায়নি। মুখাবয়বগুলো অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের আশপাশের পরিচিত জনেরই ছায়া। এমন শ্যামল সুন্দর ছবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের মতোই চিরকালীন।
নানা ধরনের নারীমুখ তিনি এঁকেছেন। কখনো লম্বাটে, কখনো ডিম্বাকৃতির, কখনো বা লম্বাটে- গোল করে। নারীর শুধু মুখাবয়ব নয়, বিভিন্ন আঙ্গিকের মুদ্রাও তিনি এঁকেছেন। কোনো কোনো নারীমুখে বা চোখে বৌঠান কাদম্বরী দেবীর ছায়া পাওয়া যায় । নৃত্যরতা, অবগুণ্ঠিতা সব ধরণের নারী স্থান পেয়েছে তাঁর ক্যানভাসে। তবে তাঁর আঁকা নারীর মাঝে লাবণ্য, লালিত্য, মোহনীয়তা বা লাস্যময়তা তেমন নেই। বরং আছে বিষন্নতা, দুঃখবোধ। সে দুঃখবোধ যেন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের নারী মূর্তিকে। কালো, বাদামী, হলুদ রং-এর ব্যবহারে দেহ সৌষ্ঠবে নারী অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উদ্ভাস তিনি তুলে এনেছেন নিপুণতায়।
‘নারী’ শীর্ষক একটি চিত্রে কাগজে কালি ব্যবহার করে সাদা, কালো আলোকচিত্রের মতো একটি চিত্রকর্ম করেছেন তিনি। সেখানে সুশ্রী নারীমুখে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা যায়। গাঢ় ঘন চুল দিয়ে নারীর দুটি গালই প্রায় আবৃত। মনে হয় যেন বাংলা চলচ্চিত্রের কোন সুশ্রী নায়িকার প্রতিমূর্তি এটি।
কখনো যোগাশনে, কখনো যুগলে, কখনো উপবেশনে নারী উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর ক্যানভাসে। উজ্জ্বল লাল রং, সাদা কালো, ধূসর, কালচে বাদামী রংয়ে নানা বৈচিত্রে নারী রবীন্দ্র চিত্রকলার উপজীব্য হয়েছে।
আত্মপ্রতিকৃতি রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন অনেক। শুধু মুখচ্ছবি বা মুখোশও তিনি এঁকেছেন অবিরাম। তাঁর মুখচ্ছবি বা প্রতিকৃতি বিভিন্ন বয়সের বিচিত্র সব অভিব্যক্তি ও আবেগের প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁর মনের মধ্যে যে ভাঙ্গাগড়া. উথাল পাথাল, অস্থিরতা এসবই উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর ছবিতে।
ন্যুড ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। সংখ্যা কম নয়।
আহমদ রফিক তাঁর রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প গ্রন্থে উল্লেখ করেন;
নিঃসন্দেহে ন্যুডচিত্র আঁকতে রবীন্দ্রনাথ সজীব মডেল ব্যবহার করেননি। স্বভাবতই সেক্ষেত্রে পুরোপুরি কল্পনার সাহায্য তাঁকে নিতে হয়েছে। হয়তো এজন্য অথবা অন্য কোন নিগূঢ় কারণে তাঁর আঁকা নগ্ননারীর ছবিতে দৈহিক এনাটমির প্রকাশ যথেষ্ট তীক্ষè বা স্পষ্ট নয়। বরং সেখানে অস্পষ্টতা ও রহস্যময়তাই প্রধান। পশ্চিমা চিত্রশিল্পীদের আঁকা ন্যুড ছুবিগুলোতে দৈহিক নগ্নতা যে শারীর সংস্থানগত স্পষ্টতা নিয়ে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথের নগ্ন নারীচিত্রে তা প্রায় নেই বললে চলে। হয়তো তাই তাঁর ন্যুড ছবিতে দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তুলনায় মুখাবয়বই প্রাধান্য পেয়েছে, কোন ক্ষেত্রে একমাত্র বিষয় হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ বিমূর্ততা নিয়েও নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর বিমূর্ত ছবিতেও আছে এক ধরনের ইতিবাচকতা । কোনো কোনো বিমূর্ত ছবিতেও অস্পষ্ট ফিগার, নানারকম অদ্ভুত জন্তুর অবয়ব দেখি আমরা। মনে হয় তিনি নতুন এক ধারার উন্মোচনে সচেষ্ট হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন তা তাঁর সাহিত্য কর্মের যে কোনো শাখা নিরীক্ষণ করলেই বোঝা যায়। চিত্রকলাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় তাঁর দ্বিশতাধিক ছবিতে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে তুলে ধরেছেন। ভূ-প্রকৃতি, সময়, ঋতু পরিবর্তনের চিত্রকল্প রচনা করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বপথিক। দেশে বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণকালে দেখা নৈসর্গের রূপময়তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি ছবিতে। চর, নদী, ফসলের ক্ষেত, গাছ গাছালি গ্রামীণ লোকালয়, বৃষ্টি, ঝড়, আকাশে রঙের খেলা কিছুই বাদ যায়নি তাঁর দৃষ্টি থেকে।
‘নিসর্গ’ নামে কাগজে কালি ও জলরং-এ করা তাঁর একটি ছবি আছে। ঘন আধাঁর, গাছপালা, গাছপালার মাঝে কুটিরের আভাস, বন বনানীর ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে সাদা আকাশ। অদ্ভুত এক মাদকতা আছে যেন ছবিটিতে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রাজনীতি সচেতন, সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ একজন মানুষ। এই মানুষটির আঁকা পোর্ট্রেটে যে কাঠিন্য ফুটে উঠছে, যে অলংকারহীন, নকশাহীন চিত্রলতাবিহীন জান্তব মুখাবয়বের সন্ধান আমরা পেয়েছি তার কারণ একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। আমাদের স্মরণ করা দরকার রবীন্দ্রনাথের সময়কাল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, অর্থনৈতিক বিভাজন, সাম্রাজ্যবাদ, দারিদ্র, শোষণে পৃথিবী ছিল উত্তাল। জীবনের প্রথমদিকে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। শেষ বয়সে যখন তিনি ছবি আঁকছেন পৃথিবী তখন ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে। কাজেই তাঁর ছবিতে এসবের প্রভাব তো পড়বেই।
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ প্যারিস যান। তখন তিনি নিজের আঁকা বাছাই করা কিছু ছবি সঙ্গে নিয়ে যান। প্যারিসের বোদ্ধা শিল্পীগণ তাঁকে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এসময় প্যারিসে ছিলেন । রবীন্দ্রনাথের সাথে এটি তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ । খুব কম সময়ের মধ্যে পিগ্যাল গ্যালারিতে রবিঠাকুরের ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি। শুধু তাইই নয়, তাঁর বন্ধু লেখিকা কঁতেস দ্য নোয়াইকে দিয়ে চিত্রসূচীর একটা ভূমিকাও লিখিয়ে নিলেন ওকাম্পো । ভূমিকায় নোয়াই লিখেছিলেন,
‘ টেগোরের মতো একজন মেধাবী স্বপ্নদ্রষ্টা কীভাবে যে তাঁর আশ্চর্য সব সৃষ্টির কাছে গিয়ে পৌঁছান! এই সব সৃষ্টি আমাদের দৃষ্টিকে নন্দিত করে, সেই সব দেশে আমাদের চক্ষুকে নিয়ে চলে যায়, যেখানে যা সম্ভাব্য তা বাস্তবের চেয়েও অধিক সত্য! শ্বেতকপোতের মতো রঙের অসামান্য সুন্দর হাত দিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেন, আর এক অনির্বচনীয় সুরার নেশায় আবিষ্ট হয়ে তিনি তার পান্ডুলিপির কিনারায় নিজেকে ছেড়ে দেন সূক্ষ্ণ, জটিল ও বুদ্ধিনির্ভর শিল্পসৃষ্টির আওতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তুলে নেন কল্পনার অনিয়ন্ত্রিত শক্তির কাছে। প্রথমে তিনি স্কেচ করতেন মাত্র; তার থেকে ক্রমশ তাঁর হাতে অজ্ঞাত সব দেশের অদ্ভুত সব সম্পদ এসে পৌঁছুতে শুরু করল। তিনি যেন মহাজাগতিক শিক্ষকের দ্বারা নির্দেশপ্রাপ্ত বাধ্য ছাত্রের মতো সেসব নির্দেশ লিপিবদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। তিনি পেয়েছিলেন অশ্রুর উপহার, কান্নার উপহার, যে ক্রন্দনের কারণ তিনি জানতেন না; ক্রমশ তাঁর মুখের উপর শিশির জমতে শুরু করল, তৈরি হতে আরম্ভ করল সূক্ষ্ণ তরল নকশার কাজ, দেবদূতেরা যেন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
পরীরা যেভাবে আমাদের তন্দ্রায় প্রবেশ করে, অস্পষ্ট স্বপ্নের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে, নিজেকে দেখাতে দেখাতেই নিজের সংজ্ঞা নির্মাণ করে তোলে, টেগরের আঁকা ছবিও আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে সেইভাবে; এই মহান সৃষ্টিকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়, কারণ এই মহত্ব তুচ্ছ ও বিশাল উভয়ের মধ্য দিয়ে সমভাবে প্রকাশিত হয়েছে ’।
রবীন্দ্রনাথের ছবিকে আদৌ ছবি মনে না করলেও এবং বুড়ো বয়সে ভীমরতি জ্ঞান করলেও তাঁর চিত্র প্রদর্শনীর ব্যাপারে বন্ধু রঁমা রোঁলাও এগিয়ে এসেছিলেন। তবে ওকাম্পো থাকতে কাউকেই কিছু করতে হয়নি। এ বিষয়ে রবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন-
‘আমরা এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, স্বল্প সময়ের নোটিসে এখানে এ ধরনের প্রদর্শনীর জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মোটামুটি মানের একটি হল পেতে অন্ততঃ বছর খানেক আগে বুকিং দিতে হয়। ওকাম্পো চলে এলেন এবং মনে হলো যেন অনায়াসেই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন, কয়েকদিনের মধ্যেই ‘দি তিয়াতেরে পিগালে’ নামক হল বুক করা আর প্রয়োজনীয় প্রচার চালানোসহ প্রদর্শনীর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেল। দারুণ সফল একটা আয়োজন ছিল এটা। আমাদের ফরাসী শুভানুধ্যায়ীরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে প্যারিসে এত দ্রুত এমন একটা প্রদর্শনী করা সম্ভব ।’
প্যারিসে ছবির প্রদর্শনী হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি ও সম্মান হলো অভাবিত। ১৯৩০ সালে প্যারিসের প্রদর্শনীর পর একে একে রবিঠাকুরের চিত্র-প্রদর্শনীর হল জুন মাসে বার্মিংহ্যাম ও ইন্ডিয়া সোসাইটি, লন্ডনে, জুলাই মাসে বার্লিন, ড্রেসডেন, মিউনিখে, আগস্ট মাসে কোপেনহেগেন ও জেনেভায়, সেপ্টেম্বরে মস্কোয়, অক্টোবরে আমেরিকার বোস্টনে এবং ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ায়।
জার্মানির চিত্রপ্রদর্শনী সফল হবার পর কবিগুরু শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে ‘গুণমুগ্ধা’ রানী মহলানবিশকে (ভারতের বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী যিনি নির্মলকুমারী নামে সমধিক পরিচিত) লিখলেন,
‘আজ আমার জার্মানির পালা সাঙ্গ হল, কাল যাব জেনিভায়। এ পত্র পাবার অনেক আগেই জানতে পেরেছ যে, জার্মানিতে আমার ছবির আদর যথেষ্ট হয়েছে। বার্লিন ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে। এই খবরটার দৌড় কতকটা আশা করি তোমরা বোঝো। ইন্দ্রদেব যদি হঠাৎ তাঁর উচ্চৈঃশ্রবাঃ ঘোড়া পাঠিয়ে দিতেন আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য তা হলে আমার নিজের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতুম’।
সর্বজনীন স্বীকৃতি ও সাফল্যের এই লগ্নে তিনি নন্দলালকে স্মরণ করে ইংল্যান্ড থেকে লেখেন:
কল্যাণীয়েষু,
নন্দলাল, আমার ছবিগুলি শান্তিনিকেতন চিত্রকলার আদর্শকে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এই খ্যাতির প্রধান অংশ তোমাদের প্রাপ্য। কেননা তোমরা নানা দিক থেকে তোমাদের আলেখ্যে উৎসবে আগ্রহে আনন্দে অন্তরে অন্তরে আমাকে উৎসাহিত করেছ। তোমরা রূপকলার প্রাণ নিকেতন ওখানে গড়ে তুললে- এ তো আর্ট স্কুল নয়- এ খাঁচা নয়। এ যে নীড়, তোমাদের জীবন দিয়ে এ রচিত। সেই জন্যে এই হাওয়াতে আমার বহুকালের অফলা একটা শাখায় হঠাৎ ফল ধরল।
অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যামিনী রায়ের মতো প্রথম সারির শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রশংসা করেছেন। তাঁরা ছাড়াও অর্ধেন্দু শেখর গাঙ্গলী বা বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো বিদগ্ধ শিল্পী সমালোচকেরাও তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করেছেন।
বড় বড় শিল্পী সমালোচকরা তাঁর চিত্রকলা নিয়ে কথা বলেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
রবীন্দ্র চিত্রকলা অভিনব, সৃষ্টি-অনন্য সাধারণ। তাঁর চিত্রকলা একান্তরূপে তাঁর নিজস্ব, তাঁর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত। এ চিত্রকলার হুবহু অনুকরণ কারো পক্ষেই যেমন সম্ভবপর নয়, তেমনি মনের মতো করে সমুচিত ব্যাখ্যা দেওয়াও অসম্ভব। কোনো কলা সমলোচক যে একে কোনো বিশিষ্ট কলারীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখাবেন কিংবা তাঁর নিজস্ব কোনো ধরাবাধা তত্তে¡র সঙ্গে মিলিয়ে এর ব্যাখ্যা দেবেন তারও কোনো সম্ভাবনা নেই।’
চিত্রশিল্পী যামিনী রায় বলেছিলেন,
রবীন্দ্রনাথের ছবিকে শ্রদ্ধা করি তাঁর শক্তির জন্য ছন্দের জন্য তার মধ্যে বৃহৎ রূপ বোধের যে আভাস পাই তার জন্য।
মুকুল দে বলেছেন,
‘কবি চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ অবিকল্পিত হস্তে সবল সতেজ দ্বিধাহীন কলম বা তুলির টানে বাস্তব জীবনের চিত্র-অঙ্কনে অভিনব পন্থা আবিষ্কার করেছেন। সত্তর বছর বয়সেও কবির আঙ্গুলে কাঁপন ধরেনি। তাঁর কালি ও কলমের আঁকা চিত্রগুলি সত্যই সেরা দরের। তুলির টানে তিনি যেসব ছবি এঁকেছেন, সেগুলি তাঁর গভীর ভাবোদ্দীপ্ত শিল্পকলার প্রাণবত্তার পরিচায়ক। তাঁর চিত্রাবলী চ ল গতির ছন্দে ছন্দিত। মানুষের প্রতিকৃতি তিনি যা এঁকেছেন সবই জীবনের ছন্দে ভরপুর।
‘রবীন্দ্রনাথের রহস্যময় চিত্রকলা’ গ্রন্থে রবিউল হুসাইন বলেছেন,
তাঁর ছবির আর একটা বৈশিষ্ট্যময় পরিচয় হলো শিল্পজ্ঞানহীন -নির্মল নির্দোষ মনোভঙ্গির শিল্প চিত্রময়তা। এটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক ও প্রকৃতিময়তার সাবলীল ও স্বাভাবিক রূপ।
অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছেন,
সেজন্যই মানুষের মুখোশের পেছনকার মুখ, বিদ্যমান মূল্যবোধের আড়ালের জান্তবতা তার প্রতীক ঐসব অলীক জন্তু জানোয়ারের প্রতিচ্ছবি, নিসর্গের সুন্দরের বদলে ধূসরতা সব বেরিয়ে এসেছে সামনে। সেজন্য তার কাজ অংশত বিষয়ভিত্তিক, তাঁর চারপাশের সর্বনাশ তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন, খুব সম্ভব ঐ স্বীকৃতি সাহায্য করেছে তাঁর বিষয়ভিত্তিক মনোভঙ্গী শক্তিশালী করে তুলতে। তাঁর এখন আর সাহিত্যের ছদ্মবেশ নেই, তিনি সম্মুখীন হয়েছেন নোংরা অদ্ভুত কিম্ভুতকিমাকার আকৃতির, চেহারার: তিনি সজ্ঞানে অস্বীকার করেছেন সাহিত্যের সুন্দর, মায়াবী জাল, মেলে ধরেছেন তার কাজে হাড়গোড়, ঔপনিবেশিক ফ্রেমের মধ্যকার জোড়াসাঁকোর বাড়ির, শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠানের কুৎসিত ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন, ছেঁড়াখোঁড়া এলোমেলো জীবন’।
একই প্রবন্ধে অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আরো বলেন,
‘এ যেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথ, ভয়ঙ্কর ও আদিম। সেজন্যই তার কাজে বারে বারে ফুটে উঠেছে রং-এর ঔজ্জ্বল্য সত্তে¡ও অসন্তোষ, রেখায় এসেছে তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা, ঐ সংঘাতের উৎস শ্বাসরুদ্ধকর পারিপার্শ্বিকতা। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের বাস্তব ভেঙে দিলেন, বেরিয়ে এলেন বিপর্যয়সঙ্কুল প্রাত্যহিকতায়, যখন দেশে চলেছে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অভিযান, জাপান আক্রমণ করেছে চীন, স্পেনে হত্যা করা হয়েছে গণতন্ত্র, ফ্যাসিজম লন্ডভন্ড করছে জার্মানি ও ইতালি, সর্বনাশ আসন্ন, দেশবিদেশ বিক্ষুব্ধ, বিচলিত : রবীন্দ্রনাথ কাজ করেছেন দেশ-বিদেশের এই পরিসরেই, এই চেতনাই ধূসর থেকে ধূসর হয়ে গেছে তার নানা কাজে : তাকে যেন গিলে নিয়েছে তাঁর সমস্ত অতীত’।
নিজের ছবি সৃষ্টির করণ কৌশল বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন- ‘ছবিতে আমার একটা বেশ মজা আছে। আমি তো ছবিতে একই বারে রং দেই না। আগে পেন্সিল দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে একটা রং তৈরি করে মানানসই করে, তারপরে তার উপরে রং চাপাই। তাতে করে হয় কি রংটা বেশ একটু জোরালো হয়। আমার ছবি যখন বেশ সুন্দর হয়, মানে সবাই যখন বলে বেশ সুন্দর হয়েছে তখন আমি তা নষ্ট করে দেই। খানিকটা কালি ঢেলে দেই বা এলোমেলো আঁচড় কাটি। যখন ছবিটা নষ্ট হয়ে যায় তখন তাকে আবার উদ্ধার করি। এমনি করে তার একটা রূপ বের হয়। আমি মানুষের জীবনটাও এমনি করেই দেখি। মানুষ যখন একবার ঘা খায় বা পড়ে যায় একটা কিছু সাংঘাতিক ঘটে তারপরে মানুষ যখন নিজেকে ঘিরে তৈরি করে তখনি তার একটা সত্যিকার রূপ হয়।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা কথাসাহিত্য, কবিতা, গান, প্রবন্ধ সম্পর্কে নিজের সক্ষমতা বিষয়ে সম্যক নিঃসংশয় থাকলেও চিত্রাবিদ্যায় কখনই সংশয় মুক্ত হতে পারেননি। তিনি বলতেন, তিনি নন্দলাল বা অবনীন্দ্রনাথের মতো কোনদিনই ছবি আঁকতে শেখেননি, সেই জন্যেই কখন কখন মনে হতো যে, “এ আমার কাজ নয়।” (প্রতিমা ঠাকুর, গুরুদেবের চিত্র, বিশ্বভারতী।)
রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে যামিনী রায় একবার উল্লেখ করেন-
“রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে একবার যে আলোচনা হয়েছিল, এখানে তা অবান্তর হবে না। তিনি বলেছিলেন আমার তো আর আর্ট স্কুলে পড়া বিদ্যে নেই, ছবি হয়ত সম্পূর্ণই হয় না। আমি বললুম এগার বছর স্কুলে পড়েও তো দেখি ছেলে অনেক সময়ই মুখ্যই রইল। এদিকে আবার কোনোদিন স্কুলের কাছ ঘেঁষেনি এমন ছেলের মুখেও জ্ঞানের কথা শুনি- ছবির বেলায় আপনারও হয়েছে তাই।
এ সংশয় রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগেও অতিক্রম করতে পারেননি। তাই অবাক হয়ে আমরা লক্ষ্য করি মৃত্যুর মাত্র ক’ মাস আগে শান্তিনিকেতনে উদয়নের বারান্দায় বসে রানী চন্দকে বলেছেন, ‘আমার ছবি সম্বন্ধে আমার বড় লজ্জা করে। লোকে যখন তার প্রশংসা করে লেখে, আমি তা পড়ে লজ্জিত হই।’
রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “আমি কোন বিষয় ভেবে আঁকিনে, দৈবক্রমে একটা অজ্ঞাতকুলশীল চেহারা চলতি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে।”
নিজের ছবি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যেমন নিসঃশয় ছিলেন না, তেমনই আবার নিজের ছবি সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্বচ্ছ ছিল। নিজের আঁকা ছবি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ঐগুলি কেবল রেখাই নয়, ঐগুলি তার থেকেও কিছু বেশি। আমার চিত্রাঙ্কিত স্বপ্ন এক কাব্যিক কল্পনার দর্শন।’
রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম সম্বন্ধে একটি প্রচলিত ধারণা চালু আছে যে, তাঁর চিত্রকর্মগুলো একেবারেই মৌলিক। একেবারেই তাঁর নিজস্ব। পৃথিবীর কোন শিল্পকর্মের সাথেই সেগুলো মেলেনা। অর্থাৎ তিনি নিজেই একটি নিজস্ব ধারা চালু করেছেন, যা আগে চিত্রশিল্পে ছিল না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ছবি অরিজিন্যাল। অবশ্য এই ‘অরিজিন্যালিটি’র ধারণা এখন প্রশ্নবিদ্ধ । গবেষক কেতকী কুশারী ডাইসন এবং শিল্পী সুশোভন অধিকারীর যুগ্ম প্রয়াসে বের হয় ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’-গ্রন্থটি । এ গ্রন্থে তারা দেখিয়েছেন রবীন্দ্র-চিত্রকলাকে সারা পৃথিবীব্যাপী তদানীন্তন চিত্রকর্মের ধারার বলয়ের বাইরে বলে যে ভাবা হয় তা ঠিক নয়। যেমন, ‘রঠ’ নামক তার স্বরচিত মনোগ্রাম। এতে উত্তর আমেরিকার ‘যধরফধ’ শিল্পকলার সরাসরি প্রভাব রয়েছে। দুটো ছবি পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছেন কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী।
রঠ মনোগ্রাম ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের আঁকা সে সময়কার বেশ কিছু ছবিতে আফ্রিকান, মালাঙ্গান, চৈনিক ( ব্রোঞ্জ), পেরুভিয়ান, হাইদা এবং তিলিঙ্গিত আর্টওয়ার্কের প্রভাব উজ্জ্বলভাবে লক্ষণীয়।
তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের কাজে ইউরোপের অনেক শিল্পীর কাজের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। খাপছাড়া ও সে বইয়ের ইলাস্ট্রেশনে পল ক্লিল কলমে করা ড্রয়িংয়ের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর ছবি প্রায় সম্পূর্ণভাবেই অভারতীয়, অবাঙালি, অহিন্দু; এদেশের প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস থেকে তিনি প্রায় কিছুই গ্রহণ করেননি। তাঁর চিত্রকলায় প্রভাব রয়েছে সমকালীন ইউরোপের । তাছাড়া এমিল নোল দের ছাপ ছাপ পাওয়া যায় জল রংয়ের অনেক অনেক কাজে। প্রতিকৃতি- অঙ্কনে জর্মন এক্সপ্রেসনিস্ট শিল্পীর কাঠ খোদাইয়ের ছায়া বিদ্যমান।
সত্যি কথা বলতে কি ,আদিম শিল্পীদের কাজ বাদ দিয়ে আর কোনো শিল্পকেই ঠিক পুরোপুরি অরিজ্যিনাল বলা চলে না। আর আধুনিক যুগে সেটা সম্ভবও নয়। এটা যেমন ছবির ক্ষেত্রে তেমনি সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সব শিল্পীকেই তাঁদের পূর্বসূরীদের কাজ থেকে কিছু না কিছু শিখতে হয়, গ্রহণ করতেই হয়।
সবশেষে রবীন্দ্রনাথের ছবির ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনেকেই জানেন না রবীন্দ্রনাথ খানিকটা বর্ণান্ধ ছিলেন। অর্থাৎ কিছুটা ‘রং-কানা’। তাঁর মূল অসুবিধা ছিল লাল রঙ নিয়ে। তিনি লাল রঙ ভাল করে দেখতে পেতেন না। লাল এবং সবুজকে অনেক সময়ই আলাদা করতে পারতেন না। এ বিশেষ অবস্থাকে বলে ‘ প্রোটানোপ’। ‘ প্রোটানোপিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এটা একটা বংশগত রোগ। রোগটির কোন চিকিৎসা নেই। এটি কোন শারীরিক সমস্যা করে না। কোন কোন রঙকে স্বাভাবিকের চেয়ে ঝাপসা দেখেন রোগীরা। কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী তাদের ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে বেশকিছু উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন এই রোগের ব্যাপারটা সঠিক হবার সম্ভাবনাই বেশি।
তবে কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী এ নিয়ে লেখার আগে থেকেই কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাপারটি জানতেন। ‘রবীন্দ্রনাথ বলতেন তিনি রং কানা, লাল আর সবুজ তিনি একইরকম দেখতেন। তথাপি তাঁর ছবিতে লাল এবং সবুজ পাশাপাশি এসেছে এবং মাত্রা বা ঘনত্ব আলাদা থেকেছে’ এটাই বিস্ময়ের ।
আমরা কবির বিখ্যাত ‘শ্যামলী’ কবিতার চরণগুলো স্মরণ করতে পারি,
‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর’,
সুন্দর হল সে’।
রবীন্দ্রনাথ যেন নিজেকে নিয়েই লিখেছিলেন কবিতাটি। তাই চুনি হয়ে ওঠে পান্না।
তবে বর্ণান্ধতার ব্যাপারটি তাঁর প্রতিভার স্ফুরণে কোন সীমাবদ্ধতা তৈরি করেনি। বরং একটি ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছে। বর্ণান্ধতার পরও তার এই অসাধারণ প্রতিভা আমাদের মনে করিয়ে দেয় লাডউইক ভ্যান বিথোফেনকে। যিনি জীবনের দীর্ঘ সময় কানে খাটো ছিলেন। কিন্তু তিনিই ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের শিরোমণি। বিথোফেনের বধিরতা তার সুরের মূর্ছনা তৈরিতে কোন প্রতিবন্ধকতা আনতে পারেনি। একই ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। বিথোফেনের সুরের মূর্ছনার মায়াজালের মতো রবীন্দ্রনাথের আঁকা স্বতন্ত্র ধারার প্রায় তিন হাজার ছবি আমাদের জন্য আজ অমূল্য সম্পদ।
লেখক: কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক
তথ্যসূত্র:
১. ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন, অভিজিৎ রায়
২. ঞধমড়ৎব বহ ষধং নধৎৎধহপধং ফব ঝধহ ওংরফৎড়, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, (অনুবাদ, শঙ্খ ঘোষ (ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ)
৩. রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, বুলবন ওসমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা একাডেমীর নিবেদন গ্রন্থে সংকলিত।
৪. রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে তর্কাতর্কি মুখায়ব ন্যুডিটি উত্তরাধুনিকতা আরো কিছু, দেবরাজ গোস্বামী ।
৫. পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৬. রবীন্দ্র-চিত্রকলা, মনোরঞ্জন গুপ্ত।
৭. রঙের রবীন্দ্রনাথ,কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারী।
৮. রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা , বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।
৯. আনন্দমেলায় কবির গল্প, নির্মলকুমারী মহলানবিশ।
১৯. ভূমিকা, আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ, রাণী চন্দ ।
১১. রবীন্দ্রে বিজ্ঞান, অভিজিৎ রায়, দৈনিক ভোরের কাগজ।
১২. রবীন্দ্রনাথের চিত্র শিল্প, আহমদ রফিক ।

 

আফরোজা পারভীন
কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top