সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ শামসুল হকের কর্কট বৃক্ষের কাব্য সৃজন : প্রণব মজুমদার


প্রকাশিত:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪৮

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ১৫:৪৩

ছবিঃ সৈয়দ শামসুল হক

 

মানুষ চলে যায়। চলে যাবার আগে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে। লালিত স্বপ্ন অনেকেরই অপূর্ণ থাকে! যারা স্বপ্ন কার্যকর করতে পারেন, তারা সত্যিই ভাগ্যবান। তবুও তাদের অতৃপ্তি থাকে। থেকে যায় ইচ্ছার তৃষ্ণা। অবারিত অতৃপ্তি থেকে সৃষ্টি সাধনায় নিজকে ব্যাপৃত রাখেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। সৃষ্টিই তাঁদের আনন্দ। প্রকাশ সৃজনীদের বিলাস। নিজের সৃজনে আনন্দ সে এক পরম প্রাপ্তি! এ চাওয়া মৃত্যুর ক’মুহূর্ত আগেও প্রত্যাশা করেন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিগণ। বিশেষ করে লেখকরা। শেষ মুহূর্তেও বাঁচার আকুতি সবার থাকে। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখা প্রশাখায় প্রবল প্রতাপে সক্রিয় ছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। দৃঢ় মনোবলের দেশপ্রেমিক মানুষটি মৃত্যুর শেষদিনেও সৃজনের আনন্দে ছিলেন। চার বছর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর শেষ দু’টি কাব্যগ্রন্থের নাম বলে গিয়েছিলেন। গ্রন্থ দু’টির নাম কর্কট বৃক্ষে সবুজ শাখায় এবং উৎকট তন্দ্রার নিচে।
ঢাকায় ফুসফুসে রোগ চিহ্নিত হয় ২০১৬ সালের এপ্রিলের শুরুতে। ১৫ এপ্রিল উপমহাদেশের বরেণ্য সব্যসাচী লেখক সস্ত্রীক উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। সেখানে রয়েল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রায় ৩ মাস চিকিৎসায় কোন সুরাহা হলো না। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন তাঁর জীবন আয়ু মাত্র ছ’ মাস অবশিষ্ট! মাটির টান ও স্বদেশ প্রেম তাঁকে নিয়ে এলো দেশে। সেপ্টেম্বরে ভর্তি হন রাজধানী গুলশানের স্বনামখ্যাত একটি হাসপাতালে। কর্কট রোগ শনাক্ত হবার পর দু’মাস লিখতে পারেননি। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কর্কট রোগ ভালো হবার নয়। সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত! লেখকের কাজ হচ্ছে লিখে যাওয়া। তিনিও সৃজনে নিমগ্ন থাকেন। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তিনি প্রায় ২০০ কবিতা লিখেছেন। যুক্তরাজ্যে লন্ডনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ জুন থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন হাতে-কলমে। এর আগে লিখতেন ল্যাপটপে। সর্বশেষ লেখাটি ছিলো কবিতা। তা লিখেন ঢাকায়, ২০১৬’র ১৩ সেপ্টেম্বর। এরপর তিনি মুখে বলেছেন সার্বক্ষণিক সঙ্গী সহধর্মিণী কথাশিল্পী ও কবি এবং দেশের বিশিষ্ট মনোরোগ চিকিৎসক আনোয়ারা সৈয়দ হককে। আনোয়ারা সৈয়দ হক তা কাগজে লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে কী লিখেছেন সব্যসাচী লেখক তা শুনতে চাননি। কবি চলে যাচ্ছেন অস্তাচলে! নিজের হাতে লেখার শক্তিটুকু রহিত হয়ে গেছে। তারপরও দৃঢ় মনোবলে অন্তিম শয্যায় মাত্র ন’দিনে ৩৩টি কবিতা মুখে মুখে রচনা করে গেছেন তিনি।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের যাপিত জীবন ছিলো নিরন্তর শব্দজগতে। কি কবিতা, ছড়ায়, গল্প উপন্যাসে, প্রবন্ধে, কলাম লেখায়, অনুবাদ সাহিত্যে, শিশু সাহিত্য, চলচ্চিত্র, কাব্যনাট্য, নাটক, চিত্রনাট্যে, গানে, উপস্থাপনা আবৃত্তিতে; কি সাংবাদিকতায়। জীবনময় সাহিত্যের আরাধনায় সৃষ্টিতে সৈয়দ শামসুল হক দেশকে ভরিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁর শেষ দিনগুলোতে শব্দ হয়ে উঠেছে দ্যুতিময়। শব্দের সাধনা করে গেছেন যন্ত্রণাকাতর শয্যায় থেকেও। অন্তিম সময়েও জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন তিনি। যতক্ষণ পেরেছেন ততক্ষণ শব্দ সৃজন ছিলো তাঁর ব্রত। বাংলার রাজপথ, শহর, নগর এবং গ্রাম বাংলার মেঠোপথের আজন্ম প্রেমিক বুদ্ধিদীপ্ত ও স্মার্ট বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কর্কট রোগ কবি সৈয়দ শামসুল হককে থামাতে পারেনি। জীবনবোধের আধুনিক বুদ্ধিদীপ্ত শব্দ দিয়ে কাব্য মালঞ্চ সাজিয়েছেন। তাঁর শব্দই চিকিৎসিত করে - কাব্যগ্রন্থের এমন সুনিশ্চিত ধারণাপ্রকাশকারী তেজী নামকরণ নিঃসন্দেহে অপূর্ব! চিকিৎসিত শব্দটির ব্যবহার আমরা কমই দেখেছি। অথচ হাসপাতালে শয্যায় থেকে তাঁর অপূর্ব শব্দবোধ গোটা কর্কট রোগের বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থার অসহায়ত্বকে ইঙ্গিত করে। সত্যিই তো এ ব্যাধির চিকিৎসার উপকরণ রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি আক্রান্ত রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসিত করতে ব্যর্থ!
৬২ বছরের সুদীর্ঘ সাহিত্য জীবন তাঁর। লেখালেখিতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের দু’টি স্থানে সাদৃশ্য রয়েছে। সাহিত্যের শাখা প্রশাখায় রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো সৃজনশীল কোন লেখককে সক্রিয়ভাবে আমরা পাইনি। কবিগুরুর মতো সৈয়দ শামসুল হকের আয়ুস্কাল ৮০!
মননকে উপযুক্ত ভাষা দেবার অনুকরণীয় ক্ষমতা তাঁর। চিরন্তন সত্য ও সুন্দরের মতো শব্দ দিয়ে মৃত্যুর পাশে শুয়ে আর কোন কবি আমাদের মুঠো মুঠো কবিতাতো দেননি। সেসব সৃজন যুগ দর্শন। জীবন মহাকাব্য! ব্যাধি শনাক্ত হওয়ার পর প্রথম যেদিন তিনি কলম তুলে নিলেন সেদিন কাগজে প্রকাশ হলো যাওয়ার প্রসঙ্গই। প্রথম পংক্তিই হলো - মৃত্যুপরে মৃত্তিকায় এই দেহ প্রোথিত যখন (কাব্যগ্রন্থ - শব্দই চিকিৎসিত করে)। ‘কাফনের চাদর ঢেকে দিতে চাইলো কবিতাকে, শব্দে ভরে উঠতে চাইলো লোবানের গন্ধ; নিঃশব্দে ধ্বনিত হলো কবর-সন্নিহিত ‘চল্লিশ কদম’।’ চিকিৎসার একাধিক ধাপ পেরিয়ে কবি স্বদেশে ফিরলে তাঁর কবিতায় উঠে আসে নানা রকমের ভালোবাসার কথা। তাঁর ভালোবাসা হলো স্বদেশ, সহধর্মিণী ও শব্দ-সহযাত্রী, মানে কবি। মাঝে-মাঝে কবিতায় আসলো কর্কট প্রসঙ্গ। কর্কটের বৃক্ষডালে কর্কশতার সুরে পাখির ডাক শোনা গেল। কর্কটের বিষবৃক্ষের ছায়ায় কবি লিখলেন - কর্কটের পুষ্পডালে সবুজ শব্দের আবার উত্থান দেখে আমিও উত্থিত প্রসন্ন এ ভোরে। এবার ঘুমোও তুমি শব্দফলে কর্কটের সবুজ শাখায়।
প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে সৈয়দ শামসুল হককে দেখতে যান ১০ সেপ্টেম্বর। তিনি জানান, সব্যসাচী লেখকের চিকিৎসার সব দায়িত্ব তাঁর। সুনির্দিষ্টভাবে নাম বা পরিচয় না থাকলেও ১২ সেপ্টেম্বরে লেখা কবিতায় আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দেখতে পাই। কবি লিখলেনÑ  ‘একজন আমার পাশে এসে বসলেন মুখে তাঁর অপরূপ বাংলার ছবি আমন ধানের গন্ধ ঝরে পড়ছিল...।’ তিনি বললেন, ‘এই সবুজ দেশ আপনার অপেক্ষায় আমার মায়ের কোলের ভেতরে এই বাংলার ভেতরে এই পৃথিবীর ভেতরে আপনাকে বিদায় নয়, স্বাগতম...।’ চিরপ্রস্থানের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর শেষ কবিতা লেখেন। নামÑ ‘আহা, আজ কি আনন্দ অপার।’ কবিতার প্রকরণ বিষয়ে শুদ্ধতাবাদী ছিলেন সৈয়দ হক এবং প্রচলিত ছন্দের বাইরে তিনি খুব বেশি হাঁটেননি। লন্ডনে লেখা কবিতায় চতুর্দশপদীর পাশাপাশি দীর্ঘ কবিতাও রয়েছে। সবই অক্ষরবৃত্তে রচিত।  
শেষ ন’দিনের তেত্রিশটি কবিতাকে আমরা একটি দীর্ঘ কবিতা মনে করি। সৃজনে কবির পূর্বসূরি ও সমকালীন অল্প ক’জন কবির বিষয় ঘুরে ফিরে আসে। স্বদেশের জননীরূপে নদীগুলো বয়ে চলে। নারীর ভালোবাসা জোছনা ও শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয় এখানে। শেষ যাত্রায় পথক্লেশে মৃত্যুদূতকে থামিয়ে দিয়ে এই যে ভালোবাসার জন্যে ও ভালোবেসে শব্দসৃষ্টি, সেটি শব্দঘোরগ্রস্ত মানুষের জন্য এক পরম আশ্রয়। কবিপতœীর ডাকনাম মঞ্জু। কবিতায় তাঁকে বলছেন, ‘তুমি হাত ধরে থাকলেই আমার বিশ্রাম।’ জাগতিক সংসারের কী মায়াবী প্রেমময় শব্দাবলি!
সারাক্ষণ সৃজনের আনন্দে মেতে থাকতে ভালো বাসতেন সৈয়দ হক। কর্কটের বিষবৃক্ষে তাঁর অনুপম সৃষ্টি যেমন ছিলো সবুজ তেমনি সজীব। লন্ডনের হাসপাতালে শেষ সময়গুলো কেটেছে সার্বক্ষণিক সঙ্গী মঞ্জুর সঙ্গে গল্প বলে, কবিতা লিখে। কুড়িগ্রামে তাঁর জন্মভিটায় ছেলেবেলার তারার মা ও সোনার মার গল্পও বাদ যায়নি। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতেন। এ যেন সাহিত্যের সৃজন। সৈয়দ হকের বড় আক্ষেপ ছিলো উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কালজয়ী নাটক হ্যামলেট অনুবাদ সময়মত করতে না পারা। এ জন্য তাগিদও ছিলো। লন্ডনে চিকিৎসাকালে ৩০ এপ্রিল সকালে নাট্যজন সারা যাকের ফোনে আনোয়ারা সৈয়দ হকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সৈয়দ হক অনুবাদ লিখতে বসছেন কিনা। অসুস্থতার ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে বসবেন বলে জানিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক। ঘাতক ব্যাধির শরীরে পরে সৈয়দ শামসুল হক হ্যামলেট অনুবাদ সম্পন্ন করেন।
বাংলা সাহিত্যে এমন লেখক নেই যিনি দুরারোগ্য কর্কট রোগ নিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণাকে পাশে রেখে অবিরাম লিখেছেন। তাও আবার শরীরের ভয়ানক আক্রান্ত স্থান ফুসফুস যন্ত্রণার ভেতর।
দৃঢ় এই মনোবলের কারণেই সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে দেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই লিখেছেন উপন্যাসÑ হেমিংওয়ের সঙ্গে। হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতে, সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন আপাদমস্তক লেখক, শয়নে-স্বপনে কেবল লেখার কথাই ভেবেছেন, এমন কি নিশ্চিত মৃত্যু এগিয়ে আসছে জেনেও নিদ্রাহীন রাতের গভীরে, জাগরণের মুহূর্তে লেখার তাগিদ অনুভব করেছেন, লিখে গিয়েছেন মরিয়া হয়ে মৃত্যুকে প্রতীক্ষায় রেখে, নিজের হাত অবশ হয়ে এলে সহধর্মিণীকে ব্যাগ্র কণ্ঠে বলেছেন, লেখো, আমি বলে যাই এমন দৃষ্টান্ত আর ক’জনের ক্ষেত্রে দেখা যায় ?
সাহিত্যের জন্য আজীবন স্ব-আরোপিত দায়ভার বহন আর সেই দায়মুক্তির জন্য আমৃত্যু জীবনের শেষ মুর্হূতগুলো আবেগবিহ্বল হয়ে লেখার জন্য নিবেদন করে সৈয়দ শামসুল হক স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে চিরকাল।
তাঁর বহুমুখী সাহিত্য রচনা আমাকে মুগ্ধ করেছে আরও অনেকের মতো। কিন্তু এ জন্যই আমি তাঁকে নিয়ে জীবনী উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ হতাম কি না, তা নিয়ে আমার নিজেরই সংশয় রয়েছে। রোগশয্যায় থেকে অবধারিতভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শারীরিকভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাওয়া দিনগুলোতে তিনি যেভাবে লেখায় সমর্পিত হয়েছেন, সেই বিষয় আমাকে এমন আলোড়িত করছে যে মনে হয়েছে তাঁকে নিয়ে উপন্যাস না লিখলেই নয় এবং তাঁর জীবন ও কর্মের উল্লেখে উপন্যাস লিখতে গিয়ে অচিরেই উপলব্ধি করি যে লেখা শুধু লেখকের নিজের ইচ্ছাতেই হয় না, কখনো কখনো বিষয়ও বাধ্য করে অমোঘ শক্তি নিয়ে।
আমিও মনে করি তাই। বাংলা সাহিত্যে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক নিঃসন্দেহে বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান এবং অকুতোভয় সৃজনী মানুষ। যিনি সারাজীবন রোগ, শোক, আনন্দ ও বেদনায় গ্রহণযোগ্য বাঙালী আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অবিরাম পথ চলেছেন লেখার মধ্য দিয়ে। সাহিত্য চর্চায় আমার সুদীর্ঘ ৪৩ বছরের যাত্রাপথে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা পঠনের পর মনে হয়েছে তাঁর সৃজন শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিদেশী সাহিত্যেও দীর্ঘকাল প্রতিনিধিত্ব করবে।

প্রণব মজুমদার
লেখক গল্পকারকবিপ্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
শান্তিনগরঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top