সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

অলভ্য!! : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:১৯

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১১:০২

 

এক
বস্তির খুপরি ঘরে বাস করে টোকাই রোকন ও তার বাবা মা আর বুড়ো দাদি ! উত্তর বঙ্গের এক অজ পাড়াগাঁ থেকে মঙ্গার সময় দুমুঠো খাবার এর তাগিদে রজব আলী মা আর বৌকে নিয়ে গ্রাম ছাড়া ! রোকন এর জন্ম এই বস্তি ঘরেই ! মা শুধু তাকে জন্মই দিয়েছে !

পেট থেকে বের হলেই দাদির হাতে চলে যায় রোকন ! একমাসের বাচ্চা রেখে সারাদিন ক্ষণ রোকন এর বাবা রিকশা চালায় আর মা বাসা বাড়ি ঠিক কাজ করে ! দিনান্তে যা আয় রোজগার হয় তাতে ভালোই চলে রোকনদের সংসার !

রোকন বেশ বড় হয়েছে ! দেখতেও বস্তির ছেলেদের মতো নয়! দাদি তাকে খুব পয়পরিষ্কার করে বড় করে তুলেছে ! বস্তির স্কুলে রোকন পড়তে যায় ! শিউলি ম্যাডাম কি সুন্দর কইরা জ্ঞানের কথা বলে ! রোকন মনে মনে বিড়বিড় করে আর স্বপ্ন দেখে সে লেখাপড়া করে বড় ডাক্তার হবে ! কেননা যে দাদি তাকে দিনরাত খেটেখুটে বড় করে তুলছে,সেই দাদি আজকাল খুব অসুস্থ থাকে ! খুব শ্বাসকস্ট !

মনে হয় এই বুঝি তার জানটা বের হয়ে যাবে!

রোকন দিনরাত দাদির কাছে বসে থাকে আর দাদিকে নানা কথা বলে সাহস যোগায় ! কিছুদিন হলো তাদের স্কুল ঠিকমতো হয়না!দেশে নাকি কি এক মহামারী আইতাছে! কি বোলে তার নাম ! করন্না না কি জানি! বড় ভয়ানক ! ম্যাডাম ঐদিন কৈছিলো, রোগডা নাকি ছুয়াচ্ছা!  

এমনি অবস্থায় দিন যেতে যেতে একদিন হটাৎ করে সেই দাদিটি তার টুপ্ করে মারা গেল! করনার প্রকোপ তখনও অতটা ছড়ায়নি ! স্বাভাবিকভাবেই দাফন কাফন এর কাজ শেষ হলো ! রোকন এর সমস্ত পৃথিবী যেন আচমকা থেমে গেল! বস্তির শেষ মাথায় কবর স্থান ! ভোর হলেই রোকন যায় দাদির কবরের পাশে! কিছুক্ষন কান্নাকাটি করে আবার ঘরে ফেরে!

বাবা রজব আলী আর মা ময়মুনা রোকন এমন অবস্থা দেখে খুব চিন্তায় পরে যায় ! পুলাডা দিন দিন দাদির শোকেতো পাগল হইয়া পড়তাছে ! রোকনরে বুকের মধ্যে নিয়ে রজব আলী আর ময়মুনা নানান কথা বুঝায়!

- সব মানুষরেই একদিন দুনিয়ার মায়া ছাইড়া বিদায় নিতে হইব বাজান !তুমার দাদিরতো মেলা বয়স হইছিল!এই দেখোনা গাছ গাছালিও বয়স হইলে মইরে যায় !

- দাদিতো আর গাছ গাছালি নয় মা !

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পাল্টা জবাব দেয় রোকন!

ময়মুনা বুঝতে পারে ছেলের কচি পরানডা দাদির পরানের সাথেই বাঁধা পইড়ে আছে ! থাকবোইনা বা ক্যান ! জন্মের পর নারী কাটার লগে লগেইতো দাদীর বগলে গেছে রোকন! ময়মুনার বুকের দুধ ও ভালমতো খাইতে পারে নাই রোকন!দুধ কেনার সামর্থ ও ছিলনা তাদের! দাদি ভাতের মাড়, সাগু, বার্লি খাওয়াইয়া রোকনরে বড় করছে ! অভাবের সংসারে রজব আলী আর ময়মুনা দাদির কাছে রেখে নিশ্চিন্তে কাজ কর্ম করেছে সারা দিনমান! সেই দাদি চলে যাবার পর আজ তারাও বিশাল শূন্যতা বুঝতে পারছে !

রাত গভীর হয়ে আসছে ! ঘুম আসেনা কারোরই! বস্তিও সুনসান! এর মধ্যেও হটাৎ হটাৎ লাগোয়া খুপরি ঘরগুলো থেকে নানা গুঞ্জন কানে আসে!

'- আইচ্ছা ,এই যে রোকন এত দাদি মারা গেল,আমরারতো পুরা সন্দেহ লাগে,ঐ বেডির ঐ মহামারী করনাই  হইছিলো নাহি!

- হইলে হইছিলো ,অহন ঘুমাওতো !বুড়া হইয়া মইরে গেছে সে !

- হ সেদিক দিয়া রোকন এর দাদিডা ভাইগ্যবানই কওন যায় !

রোকন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওদের সব কথা শোনে আর চোখের পানি মোছে!রাজীব আলী ও ময়মুনাও চোখ মোছে!

পরদিনই মাইকে পাড়ায় পাড়ায়,মহল্লায় মহল্লায় মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া হলো করনার ভয়াবহতার কথা ! সবার নিরাপত্তার জন্য সরকারি বিধি নিষেধ !

আজ থেকে কেউ ঘরের বাহির হইতে পারবোনা,পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ! বন্দি ঘরে বসে বসে  

ছোট্ট রোকন দিনরাত ভাবে এই করোননা রোগটা কেন আইলো দেশে!দাদির কবরডাও আর দেখা হচ্ছেনা তার !

 

দুই

দাদীর কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পরে রোকন! ঘুম ভেঙে যায় আজানের আওয়াজ শুনে ! আহারে! দাদি এই সুমায় উইঠা নামাজ পড়তো ! হেরপর কি সুন্দর কইরা কুরআন তিলাওয়াত যে করতো, আমার খালি

শুইনবার মন চাইতো! ও দাদি তুই কি গেলি আমারে ফালাইয়া ! দাদী, দাদীরে۔۔۔۔কাঁদতে কাঁদতে রোকন যায় দাদির কবরের পাশে! তখন আঁধার কাটে নাই !

কবরের পাশে কিছু ঝোপঝাড় আছে ! তার পাশ থেকে কার যেন গোঙানির আওয়াজ শোনা যায়! কিছুটা ভয় পায় রোকন! এতো বিয়ানবেলা কিয়ের গোঙানি!কান খাড়া করে রোকন!উ۔۔۔ইডাতো মিয়া  মাইনসের কান্দন ۔۔۔۔! রোকন আল্লাহর নাম নিয়ে ঝোপটার পাশে দৌড়ে যায় ! ইসরে, এই বুড়া মানুষডা ঠিক করোননার রুগী!কেউ ফালাইয়া দিয়া গেছে এইহানে!

ও বুড়ি তুমি কেডা ?

তুমার বাড়ি কোই?

বুড়ি নিস্তেজ পরে থাকে!

পরনের সুন্দর একটা শাড়ি!

গায়ে দামি শাল!কি সোন্দর চেহারা! ম্যালা বড়োলোক মুনে হইতাছে ! এমুন কামডা কেডায় করলো ?

অজ্ঞান হইয়া গেছে মুনে অয়!আহারে একবারে আমার দাদির মতন দ্যাখতে! রোকনের চক্ষের সামনে আবার ভেসে ওঠে দাদির মায়ামাখা মুখখানা!

দাদি ۔۔۔বলে জড়িয়ে ধরে অচেনা বুড়িটাকে!

ইতিমধ্যে আশপাশের অনেক লোক জমা হয়ে গেছে ওখানে! 

রোকনের মা, বাবাও এসেছে খবর পেয়ে !

সব্বাই চিৎকার করে ওঠে ۔۔۔۔রোকন, করোনার রুগী ! কেউ ফালাইয়া দিয়া গেছে! ধরিসনা, ধরিসনা!

রোকনের মা, বাবা টান মেরে সরিয়ে নেয় রোকনকে! রোকন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছুটিয়ে নেয় !

চিৎকার করে কাঁদতে থাকে অচেনা বুড়িকে জড়িয়ে ধরে দাদি দাদি বলে ۔۔۔আল্লা আমার দাদীরে ফিরায়া দিচ্ছে! আমি বাড়িত নিয়া যামু আমার দাদিরে ۔۔۔

ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে!

মায়ের কথা মনে পড়ে এবার আর স্থির থাকে পারেনা রোকনের বাবাও ! কারো কথা না শুনে অচেনা এই অসহায় মানুষটাকে তারা নিয়ে আসে বস্তির খুপরি ঘরে !

একসময় জ্ঞান ফেরে মানুষটার!

চোখ মেলে কাছে বসে থাকা অচেনা রোকনকে জিজ্ঞেস করে ۔۔۔۔তুমি কে সোনা!

সোনা ! এমুন কইরাতো দাদি আমারে ডাকতো !

রোকন খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকে ۔۔۔۔۔আমি তুমার রোকন্যা দাদি ! মা, বাজান۔۔۔۔এই দ্যাহো,আমি আমার দাদীরে ফিরা পাইছি!দাদীরে আমরা আইজক্যাই ডাক্তার দেহামু !

ঠিকই রোকন ও তার বাবা ডাক্তার দেখালো অচেনা, অসহায় এই মানুষটিকে!তার শরীরে করনার কোন আলামত পাওয়া যায় নাই!

বৃদ্ধ বয়সে ঠান্ডা জ্বরের ঝুঁকি সামলাতে পারেন নাই!

তাই তার এই করুন পরিণতি !

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!

চমকে যাওয়া করোনা মহামারী সব মানুষকেই অমানুষ করতে পারে নাই!

ছোট্ট শিশু রোকনের মধ্যে থেকেও এই মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধ কেড়ে নিতে পারেনি! আছে মায়া, মমতা,

ভালোবাসা, এই অবিনশ্বর পৃথিবীতে!থাকবে যুগে যুগে রোকনের মতো মিষ্টি, অলভ্য  ভালোবাসার নাতি, তার প্রিয় দাদীমার কোল জুড়ে!

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top