সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

গুরুবাবার দোয়া : ইসহাক খান


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৩৮

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ০১:৪২



বিয়ের দেড়দশক পর সন্তানের পিতা-মাতা হতে চলেছে নয়ন মিয়া আর রেহানা বেগম। সেই আনন্দে তারা আত্মহারা। নয়ন মিয়া আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে আচমকাই বেসুরো গলায় থেমে-থেমে গান গেয়ে উঠছে। কখনো কখনো এমন হচ্ছে গলা থেকে গান নামতেই চাচ্ছে না। এমনিতে সে গানের লোক না। গানের গলাও সুন্দর না। শখ করে মাঝে মাঝে একা একা গান গাইলেও লোক সম্মুখে তাকে কখনো গান গাইতে দেখা যায় নি। সন্তানের আগমন হেতু এখন সে লোকজনের মধ্যেও হঠাৎ-হঠাৎ গান গেয়ে উঠছে। রেহানা বেগম মজা করে বলে, ‘আপনের কি হইছে কনতো।’
‘কি আবার হবি? যা হওয়ার তাই হইছে। তুমি মা হতিছ আর আমি বাপ। এ কি যাতা কথা!’
‘বাপ-মা কি আর কেউ হয় না?’
‘হয়। অনেক মানুষ বাপ-মা হইছে। কিন্তু আমগো বিষয়টা আলাদা। আমগো বাপ-মা হতি ঘাম ছুইটে গেছে।’
রেহানা অভিমানী ঢংয়ে বলে, ‘হইছে। এহন বাজারে যান। চায়ের খদ্দের আসি বসি রইছে। কাম বাদ দিয়া খালি আমার ফুলা পেট দেখলে কি চলবি?’
‘কি কমুরে বউ। মন যে মানে না। মনে লয় বাড়িত বইয়া-বইয়া খালি তোর পেটের দিকত তাকায়া থাকি।’
‘আপনের শরম করে না?’ রেহানা খোঁচা দিয়ে বললেও নয়ন মিয়া হেসে কুটি কুটি হয়। ‘বুঝলিরে বউ, আমার লগে যারা বিয়া করিছে তাগো পোলা-মাইয়া আজ বিয়ার জো অই গেছে। আর আমরা এখনো পোলা মাইয়ার মুখই দেখতে পারলাম না। এ যে কত বড় কষ্টের কথা তোরে তা কেমনে বুঝাই। পোলাপান না অইলে মানুষ তারে আটখুরা কয়। আমারেও কইছে। কেউ কেউ হুনায়া-হুনায়া অন্তরে ঘা দিয়া কইছে। আবার কেউ আড়ালেও কইছে। হুইনা আমার বুকটা ভাঙ্গিচুরি খান খান হই গেছে।’
রেহানা বলে, ‘এখনতো আল্লাহ মুখ তুলি চাইছে। কষ্ট ভুইলা এখন কামে যান।’
‘বউরে, পোলা অইতে আর কয় মাস বাকি?’
‘আপনি কি সারাক্ষণ কাম-কাজ ফালাইয়া এই নিয়ে হেফজো করবেন?’ রেহানা কর গুণে বলে, ‘আমার হিসাব মতো তিনমাস। ডাক্তার বেটি বলিছে দুই মাস।’
‘ওই সব ডাক্তার বেটির কথা ফালাই থো। তাগো কথা আমার কাছে দু’পয়সা দাম নাই। তারা কয় একরকম হয় আরেক রকম। তোর হিসাবই পাকা। নয়ন মিয়া লম্বা করে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘তিন মাস সেতো মেলা দিন। সময় যাইতে চায়নারে বউ।’ নয়ন মিয়া যেতে যেতে গান ধরে।

বাজারে চা’র দোকানে বসেও আচমকা তার মুখে গানের কলি নেচে ওঠে। লোকজনের দিকে না তাকিয়ে আচমকা গেয়ে ওঠে, ‘আমারে সাজাইয়া দিও নওশারও সাজন।’ নয়ন মিয়ার মুখে হঠাৎ গানের শব্দে চা খেতে আসা খদ্দেররা অবাক হয়। কেউ আড়ালে মুখ টিপে হাসে। তামাশাও করে কেউ কেউ। হাসি ঠাট্টায় অনেকে বলে, ‘কি নয়ন মিয়া, মনে এত ফূর্তি ক্যা?’
পাশ থেকে আরেকজন রঙ্গ করে বলে, ‘বাজান হতিছে। মনে ফূর্তি লাগবি না? কতদিন বাদে সন্তানের বাপ হতিছে নয়ন মিয়া। আমিতো ভাবছিলাম, ‘নয়ন মিয়া আর বাপ হতি পারবি না। না, আল্লায় রহম করিছে।’
নয়ন মিয়া বলে, ‘একটা ছোয়ালের জন্য কম চেষ্টা করেছি। কোন্খানে যাই নাই কও। যে যেখানে যাইতে কইছে সেখানেই ছুইটা গেছি। তারপরও কতজন গুছি মাইরা কলো, ‘বারে বারে কলাম শাহজালালের মাজারে যাও। তা গায়েই তুললা না। সেই কই সিলেট শাহজালালের মাজার। সেকি আজকের পথ। সেখানেও গেছি। আবার গরম পীরের মাজারেও গেছি।’
‘গরম পীর হে আবার কেমন চিজা?’
‘না গেলে বুঝবা না। ওই মাজার ভীষণ গরম। কেউ ওই মাজারে গিয়া বেয়াদবি করলে সঙ্গে সঙ্গে এ্যাকশন। ওখানে গিয়া শুনি, একজন সিনেমার নায়ক, ওই মাজারে গিয়া বেয়াদবি করছিল। ফেরার পথে এ্যাকসিডেন্টে তার একটা ঠ্যাং কাটি ফেলতে হইছে। সবাই ওই মাজারে সাবধানে যায়। সেখানেও বাবার নামে মানত করছি। বাকি আছে হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতির মাজার। সেখানে যাওয়াতো কম কথা না। বিদেশ। পাসপোর্ট বানাও। ভিসা করো। মেলা হাঙ্গামা। অনেক টেকার ধাক্কা। দেশে যত পীর-দরবেশ আছে সব খানে গেছি। সব পীরের দরগায় ছিন্নি দিছি। কদম কোবরেজের বাড়িতে বউ নিয়া রাত-বিরাতে পইড়া থাকছি। হোমিওপ্যাথিক কও আর বানিয়াতি কও সব রকমের চিকিৎসা করছি। কাম হয় নাই। শেষপর্যন্ত আল্লাহ মুখ তুলি চাইছে।’

বাজারে চা’র দোকানের মালিক নয়ন মিয়া খরিদ্দারের চাহিদা মতো চা দিতে দিতে মনানন্দে কথাগুলো বলে। বলতে তার ভাললাগে। জিজ্ঞেস করলে নয়ন মিয়ার কন্ঠে কথার খৈ ফোটে।
‘এখন কয়মাস চলিছে?’ একজন খদ্দের হেসে জিজ্ঞেস করলে নয়ন মিয়াও হাসি মুখে বলে, ‘সাত মাস চলিছে। ডাক্তার বেটি বলিছে, ‘সামনের দুই মাস পর ডেট। বউ বলিছে তিন মাস পর ডেট। তোমরা হগলি দোয়া করিও।’
একজন অচেনা খদ্দের অনেকক্ষণ হলো তাদের কথা শুনছিল। লোকজনের ভিড় একটু কমলে সে এগিয়ে এসে নয়নের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা মিয়াভাই, একখান কথা পুছমু?’
নয়ন বলে, ‘পোছেন।’
‘কোন কোবরেজের ওষুধে কাম হইল বলতি পারেন?’
‘তা কেমনে কই?’
‘ধারণা কইরা কন।’
‘ক্যা, এ কথা আপনি পোছেন ক্যা? এই কথা দিয়া আপনার কি কাম?’
‘কারণ আছে মিয়াভাই। আমিও অনেক চেষ্টা তদবির করতাছি। কাম হতিছে না। তাই আপনের কাছে পরামর্শের জন্য পুছতাছি।’ অচেনা খদ্দের এ কথা বলার পর চিন্তায় পড়ে নয়ন মিয়া। সেতো মেলা ধরনের চিকিৎসা করেছে। এখন কার ওষুধে তার কাজ হয়েছে সেটা কিভাবে বলবে? কথাটা বউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বউ ভাল বলতে পারবে। নতুন খদ্দের আবার জিজ্ঞেস করলে নয়ন মিয়া বলে, ‘আপনাকে এই এলাকায় নয়া লাগতেছে। আপনি থাকেন কোনহানে?’
নতুন খদ্দের বলে, ‘আমি ঘাটপাড়ে থাকি। পাটনির কাম করি। আমি আপনাকে চিনি। আমার খেয়া নৌকায় চড়ি ঘাট পারি দিয়া কতদিন আপনি মাল আনতে গঞ্জে গেছেন।’
নয়ন মিয়া হা মুখে তাকায়। বলে, ‘হইতে পারে। আপনাকে পয়লাই চেনা চেনা লাগতেছিল।’
‘আমার নাম বিশু মন্ডল’। বিশু পাটনি বললে ঘাটের ব্যাবাকতে আমারে চেনে।’
‘বুঝছি। আপনে পরে আবার আইসেন। আমি বউয়ের সাথে আলাপ কইরে জাইনা তারপর আপনেরে কমু।’

পাড়ার পোলাপান দল বেঁধে নয়ন মিয়ার দোকানে এসে আব্দার করে, ‘চাচা, মিঠাই কবে খামু?’
নয়ন মিয়া হাসতে হাসতে বলে, ‘খাইও। আগে ছাওয়াল দুনিয়ায় আসুক, তারপর।’ কেউ যদি খোঁচা দিয়ে বলে, ছোয়াল হইবো আপনেরে কইলো কেডা? বেটিতো অইবার পারে।’
‘হ পারে। আল্লাহ কপালে কি লেইখা রাখছে বান্দার কি তা কওনের ক্ষ্যামতা আছে?’
যাওয়ার সময় আরেকটি কথা জিজ্ঞেস করে বিশু পাটনি। বলে, ‘আপনে কি ডাক্তারি পরীক্ষা করছিলেন?’
নয়ন মিয়া বলে, ‘পাগল হইছেননি। ডাক্তারদের কাছে পরীক্ষা করতে যাইয়াম সেটা শরমের কথা না। লোকে শুনলে কি কবে?’
‘নাÑমানে’Ñবিশু পাটনি আমতা আমতা করে। আমগো গাঁয়ে একজন পাস করা ডাক্তার আছে। হেই মিয়া কয়, তোমরা আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করো। তাইলে বুঝতে পারবা, ছাওয়াল কার দোষে হতিছে না।’
‘আমারেও অনেকে কইছে আমি কান দেই নাই। আরে বেক্কল সন্তান দেওনের মালিক আল্লাহ। তয় কারো উছিলা লাগে। পরীক্ষা করতে যাইয়াম কি করতে? তাইলে খোদার উপর খোদগারি অইবো না?’
দোকান বন্ধ করতে করতে মধ্যরাত হয়ে যায় নয়ন মিয়ার। আজ একটু তাড়াহুড়ো করে দোকান বন্ধ করে বাড়ির পথ ধরে। বউয়ের জন্য গরম জিলিপি এনেছে। বউয়ের হাতে জিলিপি দিয়ে বলে, ‘তোমার পছন্দের জিলাপি আনছি। খাও। কতদিন তুমি জিলাপি খাওনের কথা বলিছ। মন ভাল না থাকিলে কিছুই ভাল লাগে নাÑতাই তোমার কথায় সায় দেই নাই। আজ গরম গরম পালাম, তাই নিয়া আলাম। দেরি কইরো না। গরম গরম খাও। জুরায়া গেলে মজা পাইবা না।’
নয়ন মিয়ার বউ রেহানা বেগম লাজুক হাসি ছড়িয়ে বলে, ‘আপনি যে কি! এতগুলা পয়সা নষ্ট করার কি দরকার আছিল?’
নয়ন মিয়া জোর গলায় প্রতিবাদ করে ওঠে। ‘কি যে কও পাগলের মতো। কত পয়সা কতখানে নষ্ট করছি। কত জায়গায় গেছি একটা ছাওয়ালের লাইগা। সেখানে পয়সা নষ্ট অইছে না? আর আজ ভালবাইসা তোমার জন্য তোমার পছন্দের জিলাপি আনলামÑআর তুমি কতি লাগিছ পয়সা নষ্ট করলাম। এইটারে তুমি পয়সা নষ্ট বলিতেছ? ভুল রেহানা, মস্ত বড় ভুল। যে কাম তুমি করিছো, আর কয়দিন পর আমারে বাজান ডাকিবে, সেই ব্যবস্থা তুমি করিছো। তোমারে আমি এটা সেটা খাওয়ামু না? তোমারে আমি দামি দেইখা সোনার বালা বানায়া দিমু। আরো কত কি দিবাম।’
রেহানা যদিও মুখে বলে কি দরকার ছিল পয়সা নষ্ট করার কিন্তু মনে মনে রেহানা ভীষণ খুশি। সে বিছানায় পা নামিয়ে আয়েশ করে বসে জিলিপি খেতে থাকে। একটি জিলিপি আদর করে নয়ন মিয়ার মুখে তুলে দিলে নয়ন মিয়া হেসে মুখ হা করে। রেহানা জিলিপি মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে হেসে নিজে একটা মুখে পুরতে গেলে নয়ন মিয়া রেহানার হাত ধরে জিলিপিটা নিয়ে মর্জিনার মুখে পুরে দেয়। তারপর দু’জন হাসি মুখে জিলিপি চিবোয়। নয়ন মিয়া মাথা নুইয়ে পড়ে রেহেনার ফোলা পেটে কান লাগিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করলে রেহানা লজ্জায় সরে যায়। নয়ন পেছনে পেছনে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেহানাকে। এমনিতে রেহেনার নাদুস-নুদুস শরীর। ফর্সা মুখখানা আয়নার মতো ঝকঝকে। নয়ন মিয়ার আলিঙ্গনে তারও ভীষণ সুখ অনুভূত হয়, ভাললাগে। সুযোগ পেয়ে নয়ন মিয়া বউয়ের সঙ্গে আরো দুষ্টুমি করে। জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। রেহানা আবেশে নিজেকে মেলে ধরে নয়ন মিয়ার কাছে। নয়ন মিয়াও ভীষণ সুখ অনুভব করে।

সকালে দোকানে যাওয়ার সময় ঘর থেকে বেরিয়েছে মাত্র পাশের গ্রামের দুজন চেনা মানুষ তার সামনে এসে সালাম দিয়ে দাঁড়ায়। নয়ন মিয়া বিষয় কি জানতে চায়। জবাবে একজন বলে, ‘কোন কোবরেজের কাছে চিকিৎসা করাইছো তাতে তোমার আশা পুরা হইলো? আমারও তার কাছে যাইতে চাই। যদি আমগো আশাও পুরণ হয়?’
নয়ন মিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কার ছোয়াল হতিছে না?
দুজনের একজন যার দাড়িতে পাক ধরেছে, সেই এগিয়ে এসে বলে, ‘আমি।’
‘কতদিন হয় শাদী হইছে?’
‘মেলাদিন। শুমার করি দেখি নাই। হবে বছর কুড়ি।’
নয়ন মিয়া হাসি মুখে বলে, ‘গেছিতো মেলা জায়গায়। কার উছিলায় এমন সুখবর পাইলাম, তাতো জোর দিয়া কইতে পারছি না।’
‘চিন্তা করি কও।’
নয়ন মিয়া চিন্তা করতে থাকে। তার এখন এইভাবে চিন্তা করে মানুষকে জ্ঞানের কথা বলতে খুব ভাল লাগে। ভাবতে গিয়ে রাতে রেহানার সঙ্গে মস্করা করে কওয়া কথাগুলো মনে পড়ে।
রাতে এই কথাটা রেহেনাকে বার কয়েক জিজ্ঞেস করেছে নয়ন মিয়া। রেহানা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘কেমতে কমু? কার ওষুধ আল্লাহ কবুল করিছে, সেটা সেই জানে, আমি কি তা জানি?’
‘ধারণা কইরে কও।’ নয়ন মিয়া আদর দিয়ে বলে।
রেহানা বিরক্ত মুখে বলে, ‘পাগল নাকি? এ কথা কি ধারণা কইরে কওয়ার জিনিস?’
বিষয়টি নয়ন মিয়াকে ভাবনায় ফেলে দেয়। এত বড় একটি ঘটনা অথচ এই ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই। লোকের কথার কি জবাব দেবে সে?
আগত লোক দুটোকে সে বলে, ‘ভাই, চিকিৎসাতো করাইছি বহুত জায়গায়। কোন চিকিৎসা কামে লাগিছে সেটা জোর দিয়ে কওয়া কঠিন। আপনারা কলাগাছির গুরু বাবার কাছে যাইতে পারেন। তার কথাবার্তা আমার খুব মনে ধরিছিল।’
‘যেমন?’
‘ধরেনÑলোকটা আমার বউয়ের হাত ধরি নাড়ি টিপ মারি কলো, চিন্তা করিস না, তুই মা হবি। লোকটি কথা বলে খুব মিঠে করে। খালি শুনবারই মন চায়। মাশাল্লাহ দেখতেও সোন্দর। জোয়ান। মরদের মতো মরদ। দু’চাইর গাঁয়ে এমন মরদ আমি দেখি নাই। হাসে কুল কুল করি। হাসলে তার চোখজোড়াও নাচে। বড় বড় মায়াভরা একজোড়া চোখ। এমন করে তাকায় মনে হয় পরানটা ভরি যায়। আমার বউতো তার কথা শোনার জন্যে মাঝে মধ্যে গুরু বাবার কাছে যাতি চায়। যাওয়ার জন্য বায়না ধরে। আমিও মানা করি না। বেচারি পোলাপানের মুখ দেখিতে ব্যাকুল। কেমনে মানা করি। গুরু বাবা বউকে আদর করি বলিছে, ‘তুই মা হবি। আমার মন বলিছে, তুই মা হবি।’ সত্যি সত্যি রেহানা মা হতিছে। গুরু বাবার কথা ফলিছে। বেটা খুব কামিল মানুষ। যা বলে তাই হয়।
‘ওষুধ কি দিছিল, তা কি মনে আছে?’ কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা লোকটি জিজ্ঞেস করে গভীর ভাবে তাকায়।
‘গাছগাছালির ওষুধ, ভেজাইলা নাম। মনে রাখা যায় নাকি? তাইলেতো আমি নিজেই গুরু হতাম।’
লোকদু’টো ফিরে যেতে যেতে বলে, ‘সঠিক জবাব পাইলাম না।’
নয়ন মিয়া উল্টো পথে যেতে যেতে বলে, ‘সঠিক জবাব পাওয়া এতই সহজ? কত ঘাটের পানি খাইছি। কষ্টরে কষ্ট মনে করি নাই। আরামরে হারাম কইরা পথে পথে ঘুরছি। আর তুমি এতো সহজেই বাপ হতি চাও? বাপ হওয়া এতো সহজ না। যারা দিন আনি দিন খায় তাগো ঘরে আট/দশটা পোলাপান। আর যাগো খাওন দেওয়ার মুরাদ আছে তারা রাতদিন কাইন্দাও পোলাপান পাতিছে না। আল্লার এই লীলা কি বান্দার বোঝার সামর্থ্য আছে?’

পাটনি বিশু মন্ডল বউ নিয়ে নয়ন মিয়ার বাড়ি আসে। রাতে স্ত্রী পুষ্প রানীকে বিশু মন্ডল বৃত্তান্ত খুলে বলেছে। নয়ন মিয়ার বাড়ি এসে বাইরে থেকে নয়ন মিয়ার নাম ধরে ডাকতে থাকে। রেহানা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে, হাড় জিরজিরে একটা লোক। সাথে একজন মেয়েছেলে। পাতিলের রঙের মতো গায়ের রঙ, কালো। রেহানা চাড়াল পাড়ায় কালি মন্দিরে লাল জিহ্বা বের করা এরকম একটি কালো মূর্তি দেখেছে। তার নাম মা-কালি। হিন্দুদের দেবী। দেখেই ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠেছিল রেহানার। সেইরকম একজন কালি দেবীর মতো মেয়েলোক এসেছে তাদের বাড়িতে। বিশু মন্ডলের ডাকা-ডাকির জবাবে রেহানা বেগম বেড়ার আড়াল থেকে বলে, ‘উনি বাজারে গেছে। ওনারে বাজারে পাইবেন।’
বিশু মন্ডল তার স্ত্রী পুষ্প রানীকে ভেতরে যাওয়ার ইশারা করে নিজে একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে। পষ্প রানী ভেতরে এসে রেহানার সামনে দাঁড়ায়। মা-কালীকে দেখে সেদিন ভয়ে তার আত্মা যেভাবে কেঁপে উঠেছিল। আজ অবশ্য তা হলো না। পুস্প রানীর হাসি বড় সুন্দর। হাসলে কালো চামড়ার ভেতর ফর্সা দাঁত গুলো রূপালি ইলিশের মতো চিক-চিক করে। ভাল লাগে দেখতে। রেহানা বেগম পুষ্প রানীকে উঠোনে টুলে বসতে দেয়। তারপর পুষ্প রানী তার আগমনের বৃত্তান্ত বলে। এবং সে একই কথা ঘুরে ফিরে জানতে চায়। ‘কোন কোবরেজের ওষুধ খাইছেন?’
শাহজালালের মাজারের কথা উঠলে পুষ্পরানী ভেবাচেকা মুখে তাকায়। ‘আমরা যে হিন্দু। ওনার মাজারে কি আমাদের যাইতে দিবি?’
রেহানা বেগম জোর দিয়ে বলে, ‘ওখানে হিন্দু কায়েত চাড়াল নাপিত ধোপা মুসলমান কোন ভেদ নাই। যে যার খুশি মতো মানত করতি পারে। সে এক এলাহি কান্ড। হাজার-হাজার মানুষ সেখানে মানত করতেছে। সেখানে সব ধর্মের মানুষ আছে।’
‘চিকিৎসা কোনে করলেন, সেটা একটু কন।’ পষ্প রানী বলে।
‘চিকিৎসা করছি মেলা জায়গায়। তয় গুরু বাবার কথাটা বেশি মনে আছে।’
‘ক্যা?’
‘সে ভীষণ কামেল লোক। তারা পানি পড়া খাইলেই দিলের মধ্যে খোয়াব তৈরি হয়।’
‘বুঝলাম না।’
‘সব কথা কি ভাইঙ্গা কওন যায়? কিছু কথা আছে বুইঝা নিতে হয়।’
‘একটু ভাইঙ্গা কন না। আমি সব কথা ভাইঙ্গা না কলি বুঝতে পারি না।’
‘গুরু বাবার চিকিৎসা একটু অন্যরকম। সেখানে রাইতে থাকতে হয়। গভীর রাতে সে পানি পড়া দেয়। খাইলে আপনার মনে বেহেস্তের বাতাস এসে লাগবি। মন চাইবে আরো খাই।’
‘তারপর?’
এরপর আর জবাব দেয় না রেহানা। সে ভাবছে। পুষ্প রানী অধীর আগ্রহে চোখ তুলে তাকায়। রেহানা হাসে। মুখে কিছু বলে না। সব কথা কি বলা যায়। বললে মানুষ কি বিশ্বাস করবে?

বিশু মন্ডল গাছতলায় বসে থেকে-থেকে ক্লান্ত। উঠে হাঁটাহাঁটি করে। ‘পুষ্প আসে না ক্যা? এতো দেরি করতিছে ক্যা? খানিক হাঁটাহাঁটি করে বিশু মন্ডল আবার এসে গাছতলায় বসে। নিজে নিজে বলে, ‘গেছে একটা জরুরী কামে। এতো তাড়াহুড়া করলি কি চলে? বিশু মন্ডল আয়েশ করে পা ভাজিয়ে বসে পুষ্পের প্রতীক্ষা করে।

রেহানা কথা বলতে বলতে ব্যস্ত হয়। বলে, ‘এতোক্ষণ ধরি শুধু কথাই বলতেছি। আপনারে কিছু খাইবার দিলাম না। কি খাইবেন কন?’
পুষ্প রানী বলে, ‘আমি কিছু খামু নারে বোইন। আমি খুব পেরেশানির মধ্যে আছি। বিশ বছর হলি বিয়া হইছে একটা পোলাপান দিতে পার নাই। হেতির মন বড় উতলা। সে আবার বিয়া করতি চায়।’
‘চিন্তার বিষয়। আমিতো আপনাকে সবই বলছি বোইন। আপনি এখন ভাইনা দেখেন, এখন আপনি কি করবেন?’
‘আমিতো করার কিছু দেখতাছি না।’
‘আসল কথা বলছেন। আসলে করার কিছু নাই। সব মাবুদের ইচ্ছা।’
‘আপনাদের মাবুদতো আপনাদের কথা শোনে। আমাদের মাবুদ আমাদের কথা শোনে না।’
‘ক্যা?’
‘আমরা ছোটজাত। ছোট জাতের কথা ভগনান শোনে না।’ বলতে বলতে পুষ্প রানী উঠে পড়ে। ‘বোইন আমি তালি উঠি। যাই।’
‘যাইবেন? আবার আইসেন।’

বিশুমন্ডল পুষ্পরানীকে আসতে দেখে উচ্ছ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার মুখ উজ্জল আভায় আলোকিত হয়ে ওঠে। পুষ্প রানী কাছে এলে বিশু মন্ডল ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি কইলো?’
‘আগে চলো। যাইতে যাইতে কই।’ বলেই পুষ্প রানী হাঁটতে থাকে। পেছনে অস্থির ভাবে বিশু মন্ডল হাঁটছে। তার মনে রাজ্যের অস্থিরতা। একটাই ভাবনা। কি বললো নয়ন মিয়ার বিবি? আবার সে পুষ্প রানীকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, কথা কস না ক্যা?’
‘তুমি আমারে শহরের ডাক্তারের কাছে নিয়া যাও। আমি ডাক্তারের চিকিৎসা করতে চাই।’
‘ক্যা? হাতে-নাতে ফল পাইছে তা দেইখাও তোর বিশ্বাস হতিছে না?’
‘না।’
‘ক্যা?’
‘তুমি আসলে একটা বেকুব।’
কিছুদূর যাওয়ার পর নয়ন মিয়ার সঙ্গে দেখা। নয়ন মিয়া বাড়ি ফিরছিল। বিশু মন্ডলকে দেখে নয়ন মিয়া দাঁড়ায়।
‘কি খবর দাদা? এদিকে কোন থেকে আসতিছেন?’
‘ও আমার পরিবার। ওরে নিয়া আপনার বিবির কাছে গেছিলাম।’
‘কিছু কইছে আমার পরিবার?’
পুষ্পরানী মাথা নামিয়ে থাকে। বিশু মন্ডল তাড়া দিয়ে বলে, যা কওনের ওরেই সব বৃত্তান্ত বলিছে। কিন্তু ও আমারে কিছুই বলিতেছে না।’
‘কি কইছে? নয়ন মিয়া জিজ্ঞেস করলে পুষ্পরানী বলে, ‘মেয়েলি চিকিৎসা। আপনারা হুনি কি করবেন?’

 

ইসহাক খান

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top