সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মৃণালিনীঃ এক অভিমানী জলপরীর উপাখ্যান : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫২

আপডেট:
৩০ অক্টোবর ২০২০ ০০:০১

ছবিঃ মৃণালিনী দেবী ও শ্রী অরবিন্দ

 

সে ছিলো এক আশ্চর্য বিবাহ। অনেকটা রূপকথার মত। পাত্র শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, প্রখ্যাত ডাক্তার শ্রী কৃষ্ণধন ঘোষের স্বনামধন্য পুত্র। ১৮৯৩ সালে বিলাত থেকে দেশে ফিরে বরোদা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল।  বয়স ২৮ _২৯ বৎসর।  পাত্রী সরকারী কৃষিবিভাগের অন্যতম উচ্চপদাধিকারী শ্রী ভূপালচন্দ্র বোসের জ্যেষ্ঠা কন্যা মৃণালিনীদেবী। বয়স ১৪বৎসর। ১৯০১ সালের মে মাসে কলিকাতার শিয়ালদহের সন্নিকটে বৈঠকখানা রোডে একটি দ্বিতল বাড়ীতে  বসেছে বিবাহবাসর। সারা বাড়ী দেবদারু পাতা দিয়ে সুসজ্জিত। বিবাহ মন্ডপে সুচারু আল্পনা, তোরণের দুই পাশে জলপূর্ণ মঙ্গল ঘট,কলাগাছ। অন্দর থেকে ঘনঘন ভেসে আসছে শঙ্খধ্বনি ও উলু। কন্যার মাতা গোপালকামিনী দেবী ব্যস্ত জামাই বরণের আয়োজনে। আত্মীয় স্বজনদের ব্যস্ততা...ঠিক যেরকম হয় কোনো হিন্দু বাঙালী বিবাহে।

বাড়ীর পূর্বদিকের একটি কক্ষে বসানো হয়েছে কিশোরী মৃণালিনীকে। বিবাহের মহার্ঘ শাড়ী ও মহামূল্য অলংকারে তাঁকে রাজেন্দ্রানীর মতো লাগছে। কিন্তু তাঁর ভিতরে কি চলছে সে নিজেই জানে না। ভাবী স্বামী একজন স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষিত বলিষ্ঠ রূপবান যুবক। তাঁর কি স্ত্রী হিসাবে মৃণালিনীকে পছন্দ হবে? সঙ্গিনী ও সহপাঠিনী সুধীরা বোস তাঁর গাল টিপে বললেন "ওলো সই ভয় পাস না। তিনি যে তোকে একবার দেখেই পছন্দ করেছেন।"

একথা সত্যি যে তখনকার দিনে এই বিবাহের যোগাযোগ হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্যভাবে। সেইসময় ঘটককুলই ছিলেন বৈবাহিক যোগাযোগের একমাত্র সূত্র। কিন্তু বিলাত থেকে ফিরে এসে প্রথামত ঘটকালি নয় শ্রী অরবিন্দ সাহেবি ফ্যাসানে তখনকার বিখ্যাত কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপনের বিশেষত্ব ছিল যে  তিনি একটি হিন্দু পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করবেন হিন্দু আচার অনুসারে। হিন্দু নারীদের সম্পর্কে শ্রী অরবিন্দের ছিল অতি উচ্চ ধারণা। তাঁর প্রথম যৌবনে প্রত্যক্ষ ভাবে হিন্দু নারীদের সাথে তেমন পরিচয় ছিল না। তাঁর হিন্দু নারী প্রীতি ছিল প্রধানত: বঙ্কিম সাহিত্যের প্রভাব।  বঙ্কিমের লেখনীতে হিন্দু নারীদের যে মাধুর্য, কোমলতা, অবিচল নিষ্ঠা ও ত্যাগ স্বীকার এইসব গুণাবলি অরবিন্দকে মোহিত করেছিল। তদানীন্তন কলকাতা শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের প্রবল প্রভাব জেনেও তিনি হিন্দু নারীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণে আগ্রহী হয়েছিলেন।

তদানীন্তন বঙ্গবাসী কলেজের প্রিন্সিপাল ও মৃণালিনীর পিতা শ্রী ভূপালচন্দ্র বোসের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু শ্রী গিরিশচন্দ্র বসুর এই বিজ্ঞাপণটি পছন্দ হলো। মৃণালিনী তখন কলকাতার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। গিরিশবাবু তাঁর অভিভাবক। তিনি দেখলেন মৃণালিনী শ্রী অরবিন্দের জন্য সবদিক দিয়ে উপযুক্ত পাত্রী হবেন। সেইসময় কলকাতার উচ্চশিক্ষিত মহলে শ্রী অরবিন্দের খ্যাতি স্বনামে এবং বংশগৌরবে ছড়িয়ে গেছে। কালবিলম্ব না করে গিরিশচন্দ্র পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেন। শ্রী অরবিন্দ পাত্রী দেখতে এলেন এবং একবার দেখেই পাত্রী পছন্দ করলেন। ১৯০১ সালে মাত্র একমাসের আয়োজনে কলিকাতায় বিবাহ সুসম্পন্ন হলো। এই বিবাহসভায় উপস্থিত ছিলেন লর্ড সিনহা, জগদীশ চন্দ্র বসু প্রভৃতি বহু দিকপাল মনীষিরা। শিলংয়ের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হওয়া অসাধারণ রূপলাবণ্য ও কোমলতার প্রতিমূর্তি এক কন্যার সাথে বিবাহ সম্পন্ন হলো এমন এক বিরাত পুরুষের যার ও নামের অর্থ পদ্ম। মৃণালিণীর নামেরই মতো।

মৃণালিনী বড়ো হয়েছিলেন অত্যন্ত এক উচ্চশিক্ষিত অভিজাত পরিবারে। শিলং এ কৃষিবিভাগের অত্যন্ত উচ্চতম পদে আসীন ছিলেন তাঁর বাবা। শিলং এ তাঁদের বাড়ীটির বৈশিষ্ট্য ছিল অসাধারণ মনোহর এক উদ্যান যেখানে অনেক দুস্প্রাপ্য ফুল ও ফলের গাছ ছিলো। এই মনোহর উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো গৌরবর্ণ কিশোরীটির সারা মুখে আলো করে থাকত তাঁর স্বভাবজাত কোমলতা ও গোলাপের মত নরম ত্বক। অগ্নিযুগের বিখ্যাত বিপ্লবী দেবব্রত বসুর ভগ্নী শ্রীযুক্তা সুধীরা বসুর সাথে বাগবাজার মহাকালী বালিকা বিদ্যালয়ে একই শ্রেণীতে মৃণালিনী পড়াশোনা করতেন। এই বালিকা বিদ্যালয়ে এন্ট্রান্স ক্লাসে পঠন কালেই তাঁর লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে।

বিবাহের পর জামাই আদর। শ্রী অরবিন্দের প্রিয় সবজি ছিল ফুলকপি। একমাত্র হগ মার্কেটেই গ্রীষ্মকালে ঐসব দুস্প্রাপ্য বস্তুর সন্ধান পাওয়া যেত। জামাইয়ের জন্য শ্বশুরমহাশয় তাঁর এই দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়কে বাজারের সেরা তরিতরকারী সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রতিদিন শ্রী অরবিন্দের জন্য আসত বাজারের সেরা পাঁচ-দশ সেরের রুই মাছের মাথা, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, গাজর, বীট, ঘি মাখন ইত্যাদি। বিভিন্ন ব্যঞ্জণের সাথে সেই প্রকান্ড রুই মাছের মাথা ডুবন্ত তেলে ভেজে প্লেটে করে শ্রী অরবিন্দকে দেওয়া হতো। আহারের সময় উপাদেয় আহার্যগুলি স্বয়ং মৃণালিনী দেবী টেবিলে সাজিয়ে দিতেন। শ্রী অরবিন্দের শ্বশ্রুমাতা, দিদিশাশুড়ি তাঁর খাওয়ার তদারকি করতেন। বিলাত থেকে ফিরে শ্রী অরবিন্দের বাংলা উচ্চারণ তখন নির্ভুল ছিল না। "তুমি"কে "টুমি"বলতেন। শ্যালক শ্যালিকার দল তাঁকে পরিহাস করে ব্যতিব্যস্ত করে দিতেন। ঐসব সময় মৃণালিনী দেবী তাঁর উত্তর প্রত্যুত্তরের কাজে সহায়তা করতেন।
 বিয়ের পর শ্রী অরবিন্দ তাঁর  পত্নীসহ দেওঘরে তাঁর মামার বাড়ী গেলেন। এই বাড়ীতে মৃণালিনী দেবী কিছুদিন স্বামীর সাথে সংসার করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন শ্রী অরবিন্দের কনিষ্ঠা ভগিনী সরোজিনী দেবী। সেখানে কিছুদিন বসবাস করার পর তাঁরা তিনজনে নৈনিতাল হয়ে বরোদায় রওনা দিলেন। বরোদায় একটি বছর  মৃণালিনীর দাম্পত্য জীবনের বসন্তকাল।  তারপর শ্রী অরবিন্দের নির্দেশে তিনি ফিরে এলেন বাপের বাড়ীতে।  শ্রী অরবিন্দ থেকে গেলেন বরোদায়।  এইসময় শ্রী অরবিন্দ মৃণালিনীকে দুই একটা চিঠি লেখেন। মৃণালিনীর বরোদায় ফিরে আসার ব্যাপারে তিনি অসুবিধা জানিয়ে লিখেছেন যে সেখানে অত্যন্ত জলের অভাব, পরিচারিকার আকাল। এইসব কারণে তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন যে মৃণালিনী যেন এখন কিছুদিন দেওঘরে তাঁর মামার বাড়ীতে থাকেন ও স্বামীর আত্মীয়স্বজনদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

শুরু হলো মৃণালিনীর জীবনের এক নূতন অধ্যায় যে অধ্যায়ে তিনি প্রাণপন চেষ্টা করেছেন স্বামীর ইচ্ছানুসারে এক হিন্দু পতিনিষ্ঠা  স্ত্রীর অসম্ভব  আদর্শকে অনুসরণ করার। স্বামীকে তিনি পেলেন না তাঁর দৈনন্দিন জীবনে কেননা সেইসময় শ্রী অরবিন্দ সশস্ত্র রাজনীতি, যোগ সাধনা ও কর্মযোগীও ধর্ম নামক পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই ব্যস্ততা তাঁকে দাম্পত্য ও সাংসারিক জীবন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন করে তুলেছিল। দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তিনি তাঁর শ্বশুরমহাশয়কে এক চিঠিতে লিখেছেন "আমার আশঙ্কা গৃহী হিসাবে আমি কখনোই বড় একটা কাজের হবোনা।  পুত্র হিসাবে, সহোদর হিসাবে এবং স্বামী হিসাবে আমার কর্তব্যের কিছুটা নিস্ফল প্রয়াস আমি করেছি। কিন্তু আমার মধ্যে কিছু একটা রয়েছে যা খুব ই প্রবল এবং আর সবকিছুকে তার অনুবর্তী করে রাখতে আমায় বাধ্য করে।" ১৯০৫ সালে মৃণালিনীকে লেখা একটি পত্রে পরিস্কার বোঝা যায় যে শ্রী অরবিন্দ বৃহত্তর স্বার্থে সাংসারিক দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছেন। "তুমি বোধহয় এর মধ্যে টের পেয়েছ যাহার ভাগ্যের সঙ্গে তোমার ভাগ্য জড়িত সে বড় বিচিত্র লোক। এই দেশে আজকালকার লোকের যেমন মনের ভাব,জীবনের উদ্দেশ্য, কর্মের ক্ষেত্র, আমার কিন্তু তেমন নয়। সব বিষয়েই ভিন্ন, অসাধারণ..." এই চিঠির অন্য অংশে রয়েছে "পাগলকে বিবাহ করিয়াছ সে তোমার পূর্বজন্মার্জিত কর্মদোষের ফল ......তুমি কি কোণে বসিয়া কাঁদিবে মাত্র, না তাঁর সঙ্গেই ছুটিবে, পাগলের উপযুক্ত পাগলী হইবার চেষ্টা করিবে....তুমি হিন্দুর ঘরের মেয়ে, হিন্দু পুর্বপুরুষের রক্ত তোমার শরীরে, আমার সন্দেহ নাই তুমি শেষোক্ত পথই ধরিবে"। এই চিঠিতে তিনি তাঁর তিনটি পাগলামির কথাও উল্লেখ করেন। প্রথম পাগলামি স্বদেশ প্রেম। দ্বিতীয় পাগলামি যে কোনমতে ভগবানের দর্শন লাভ করা আর তৃতীয় পাগলামি দেশবাসীকে শারীরিক বল নয় জ্ঞানের বল দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বেচারী মৃণালিনীর বয়স তখন মাত্র ঊনিশ। তখন ই তিনি আক্ষেপ করছেন "আমার কোনো উন্নতি হল না"। তাঁর দাম্পত্য জীবন ঠিক আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। দাম্পত্য জীবন বলতে আমরা যা বুঝি এবং আমাদের মনে যে সুন্দর ছবি ফুটে ওঠে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি যা অত্যন্ত দু:খের ও বেদনার। একটানা স্বামীসঙ্গ লাভ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি কখনোই। শ্রী অরবিন্দের অনিশ্চিত জীবন, যোগাভ্যাস, সশস্ত্র রাজনীতি, গোপন বিপ্লব ইত্যাদি নানাভাবে তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপণের অন্তরায় হয়ে থেকেছে। এহেন বিশাল কর্মকান্ডের ভার যার কাঁধে স্ত্রীর সাথে তাঁর অবসর বিনোদনের সময় কোথায়? স্বামীর সাথে শান্ত পারিবারীক জীবন উপভোগ করা দূরের কথা তাঁর তৎকালীন পুরো জীবন কেটেছিল একটানা কষ্ট আর মানসিক উদ্বেগের মাঝে যা তিনি নীরবে শান্তভাবে সহ্য করেছেন। বেশিরভাগ সময়ে তিনি দেওঘরে শ্রী অরবিন্দের মাতামহের পরিবারের সাথে অথবা শিলং এ তাঁর পিতামাতার সাথে অতিবাহিত করেছেন কারণ তাঁর স্বামী এমন এক বিরাট ব্যক্তিত্ব যাকে কোনোমতেই কোনো গন্ডীতে বেঁধে রাখা যায় না।
১৯০৬ সালে শ্রী অরবিন্দ মাত্র দেড়শ টাকা মাইনেতে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে কলকাতায় চলে এলেন। মৃণালিনী আশা করেছিলেন যে হয়তো এবার তাঁর স্বামী বিচ্ছেদ দূর হবে। কিন্তু কলকাতায় শ্রী অরবিন্দের কোনো স্থায়ী বাসস্থান ছিল না। বেতন ও অতন্ত্য কম  তার উপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের তিনি পুরোহিত আবার জাতীয় দলের তথা সমস্ত ভারতবর্ষের আন্দোলনের নেতা, বন্দেমাতরম পত্রিকার কর্ণধার, গোপন বিপ্লব ষড়যন্ত্রের নায়ক, ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ। এছাড়াও যোগাভ্যাসে তাঁকে অনেকটা সময় দিতে হয়। কাজেই মৃণালিনীকে প্রায় একাই কাটাতে হতো কলকাতায়। এর মধ্যে শ্রী অরবিন্দ রাজনৈতিক কাজে পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ শেষে ম্যালেরিয়া জ্বর নিয়ে ফিরে আসেন। তখন কলকাতায় তাঁর শ্বশুরবাড়ীতে তিনি কয়েকদিন অতিবাহিত করেন।এ ই সময়ে মৃণালিনী তাঁর সেবা করার সুযোগ পান। এ বিষয়ে তাঁর জেঠতুতো ভাইয়ের বিবরণ থেকে জানা যায়_"সেবাপরায়নতা মৃণালিনী দেবীর এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য ছিল। মনে পড়ে স্কটস লেনে শ্রীযুক্ত ভূপাল বাবুর বাসা। সেখানে শ্রী অরবিন্দ জ্বরাক্রান্ত। কি আবেগভরা উৎকন্ঠায় মৃণালিনী তাঁর শিয়রে বসিয়া মাথা টিপিয়া দিতেছেন। কখনো পদসেবা করিতেছেন আবার পাখা লইয়া হাওয়া করিতেছেন। নিজের হাতে পথ্য রাঁধিয়া না খাওয়াইলে তাঁহার তৃপ্তি নাই। ঠাকুরের হাতে তৈরী পথ্য তিনি শ্রী অরবিন্দকে দিতে নারাজ। যেন মূর্তিমতী করুনা ও মমতা শ্রী অরবিন্দের শয্যাসন ঘিরিয়া আছেন"।

১৯০৮ সালে যখন মৃণালিনী শ্রী অরবিন্দ ও তাঁ ননদ সরোজিনীর সাথে গ্রে স্ট্রীতে বসবাস করছেন, এক গভীর রাতে পুলিশ এসে ঘরবাড়ি তছনছ করে সার্চ করে শ্রী অরবিন্দকে গ্রেপ্তার করলো। যখন তাঁর কোমরে দড়ি পরানো হচ্ছে মৃণালিনী দেবি আর সহ্য করতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আটকাতে গেলেন। তাঁকে সরিয়ে পুলিশ শ্রী অরবিন্দকে ভ্যানে তুলে নিয়ে গেলেন। শোকে মৃণালিনী দেবী জ্ঞান হারালেন।

বাল্যসঙ্গীনি সুধীরা বোস শোকার্তা উদভ্রান্ত মৃণালিনীকে  শ্রীসারদা মায়ের কাছে নিয়ে এলেন মানসিক শান্তির জন্য। সব শুনে সারদামা তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন ঠাকুরের আশীর্বাদে শ্রী অরবিন্দ সত্বর নিদোর্ষ প্রমাণে মুক্তি পাবেন  তবে তিনি সাধারণ লোকের মত সংসার করবেন না। ক্ষুদ্র আমিত্বের সংসার তাঁর জন্য নয়। এরপর শোকস্তব্ধা কন্যাকে বাবামা শিলং এ নিয়ে এলেন। শুরু হলো তাঁর একলা জীবন। মাঝে মাঝে পিতার সাথে আলিপুর জেলে স্বামীদর্শনে আসতেন|ধীর স্থির হয়ে তাঁকে দেখে ফিরে যেতেন।

মৃণালিনী দেবীর এই একলা জীবনের একটি ছবি আমরা পাই জনৈকা ইলা দেবীর লেখায়। ইলাদেবী তখন স্কুলের ছাত্রী। মৃণালিনী দেবীর বাপের বাড়ির পাড়ায় তিনি থাকতেন। তাঁদের কাছে মৃণালিনী ছিলেন প্রিয় মিনুদি। যিনি সবরকম সাজসজ্জা পরিহার করে চওড়া কালোপেড়ে শাড়ি পরে থাকতেন, শিশুদের খেলায় সহায়তা করতেন, নানারকম সুখাদ্য ও মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে তাঁদের ধরে ধরে খাওয়াতেন। ধীর স্থির স্নেহময় নীরব তাঁর প্রতিমূর্তি শিশুদের মনেও সমীহা এনে দিয়েছিল। প্রতিদিন স্নানান্তে বাগানের রকমারী ফুল দিয়ে পূজার ঘরে শ্রী অরবিন্দের ছবি সাজাতেন। সুগন্ধি ধূপ জ্বলত আর  পটচিত্রের সামনে স্থির হয়ে অনেকক্ষন ধ্যান করতেন। দূর দূরান্ত থেকে অনেক লোক আসত শ্রী অরিবিন্দের স্ত্রী হিসাবে তাঁকে প্রণাম করতে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত কুন্ঠা বোধ করতেন। আগে জানতে পারলে সবার সামনে আসতেন না।

একবছর পরে ১৯০৯ সালে শ্রী অরবিন্দ মুক্তিলাভ করেন। সবাই শিলং থেকে কলকাতার বাড়ীতে এলেন। শ্রী অরবিন্দের মুক্তি উপলক্ষে বাড়িতে মহা উৎসব হলো। মৃণালিনী দেবীর প্রাণে শান্তি ফিরে এলো। কিন্তু সেই সুখশান্তি স্থায়ী হলো না। ১৯১০ সালে অপ্রত্যাশিত ভাবে শ্রী অরবিন্দ নিরুদ্দেশ হলেন। বহুদিন পরে মৃণালিনী দেবী জানতে পারলেন যে শ্রী অরবিন্দ নিরাপদে পন্ডিচেরীতে আছেন।  পিতামাতার সাথে আবার তিনি শিলং এ বাপের বাড়ি ফিরে গেলেন।  এরপর আর শ্রী অরবিন্দের সাথে তাঁর বাকী জীবনে দেখা হয়নি। শ্রী অরবিন্দ প্রথম তিন চার বছর তাঁকে আশা দিয়েছিলেন যে কোনো একদিন তিনি আবার ফিরে আসবেন তাঁর কাছে।  স্ত্রীর কাছে তিনি খুব কম ই চিঠি লিখতেন। অবশেষে চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মৃণালিনী দেবী কখনো আশা ছাড়েন নি।  যারা তাঁকে জানত তাঁরা সবাই দেখতো স্বামীর প্রতি তাঁর কি আকুল আকাঙ্খা,গভীর টান। স্বামীকে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ ইষ্ট দেবতা জেনেছিলেন।  শ্রী অরবিন্দ মাঝে মাঝে তাঁকে ইংরাজীতে চিঠি লিখতেন। তার মর্মোদ্ধার করার জন্য তিনি নিয়মিত ভাবে ইংরাজী ভাষার চর্চা করতেন। তিনি ছিলেন সুগায়িকা।  তাঁর পিতার আদেশে তিনি অর্গান বাজিয়ে অসাধারণ সংগীত পরিবেশন করতেন। তাঁর প্রিয় সংগীতের মধ্যে অন্যতম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  "আমার পরান যাহা চায়"। "তুমি সুখ যদি চাও যাও সুখের সন্ধানে যাও/ আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝারে/ আর কিছু নাহি চাহি গো|" গানের লাইনের সাথে হুবহু মিলে যেত মৃণালিনীর হৃদয়। শ্রী অরবিন্দের যারা অনুবর্তী তাঁরা প্রত্যেকেই মৃণালিনীর স্নেহমমতার স্পর্শ পেয়ে ধন্য হয়েছেন।

১৯১০ থেকে ১৯১৮  দীর্ঘ আট বৎসর তাঁর কঠিন তপস্যার জীবন চললো| বাইরের দিক থেকে তাঁর বিবাহিত জীবনের অবসান হল কিন্তু অন্তরের বন্ধন হলো আর ও নিবিড়তর। প্রকৃত হিন্দু স্ত্রীর মতো তিনি স্বামী প্রদর্শিত আধ্যাত্মিক জীবন গ্রহণ করলেন। অবশেষে ডিসেম্বর ১৯১৮ সালে তাঁর কাছে শ্রী অরবিন্দের ডাক এল। মৃণালিনীর পিতা তাঁকে নিয়ে পন্ডিচেরি যাওয়া স্থির করলেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা কলকাতায় এলেন। কিন্তু এইবার বাদ সাধল মহাকাল। ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র আটদিন রোগভোগ করে ১৭ ই ডিসেম্বর ১৯১৮  সালে মাত্র ৩১ বৎসর বয়সে মৃণালিনী দেবী চলে গেলেন।

যেন এক মেঘবিকেলে জলের থেকে উঠে এসেছিলেন এক জলপরী। তাঁর ডানার পালকে লেগে ছিল জলকণা। আবার জলেই বিলীন হয়ে গেছেন সেই জলপরী।  শ্রী অরবিন্দের মত বিরাট মাপের পুরুষের ব্যক্তিত্ব ও জীবনের কাছে মৃণালিনী দেবী ঢাকা পড়ে গেছেন অনেকটাই, রয়ে গেছেন উপেক্ষিতা, অনাদৃতা। স্বামীপরিত্যক্তা তাঁর জীবন অকারণ দু:খের হলেও সেই স্বামীকেই দেবতা মেনে তাঁর উপাসনা করা, তাঁর উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করা এ এক বিরল দৃষ্টান্ত বই কি। শোনা যায় মৃত্যু যখন আসন্ন সেই অচেতনতার মাঝে মৃণালিনী দেবী তাঁর বাবামা ও ভাইদের নিদের্শ দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তম স্বামীর লেখা পত্রাবলী বাক্স বন্ধ করে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করতে এবং সে আদেশ পালন করাও হয়েছিল। 

চেতনার কোন স্তর থেকে তাঁর অভিমানী আত্মা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা আজো অবধি রহস্য ই রয়ে গেছে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ঋষি অরবিন্দের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। নি:শব্দে...নিশ্চুপে মৃণালিনী অনেক দূর ছায়াপথে চলে গেছেন ফেলে রেখে তাঁর নিজস্ব অভিমানী বর্ণমালাদের...


তথ্যসূত্র:

শ্রী অরবিন্দের সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবি/ নীরদবরন
শ্রী অরবিন্দের সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবীর স্মৃতিকথা/ শ্রী শৈলেন্দ্র নাথ বসু

 

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top