সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

লগডাউন গদ্য : স্বপন নাগ


প্রকাশিত:
৭ অক্টোবর ২০২০ ২২:২৬

আপডেট:
৭ অক্টোবর ২০২০ ২২:২৯

স্বপন নাগ

 

'লাভ ম্যারেজ করে বিয়ে করলেই যে তা সুখের হবে, তার কোনো গ্যারেন্টি নেই' -- স্পষ্ট অভিমত পরিমলের।
অথচ বিয়ের আগে কী সব দিন কাটিয়েছে ও আর মল্লিকা !
বিকেল চারটেয় হরিতলা মোড়ের বাসস্ট্যান্ডে দেখা করার কথা। মল্লিকা অপেক্ষা করবে। সেদিন ঘর থেকে বেরোতেই পরিমলের একটু দেরি হয়ে গেছে। মল্লিকা খুব রেগে যাবে। কী করা যায় ! বুদ্ধি করে 'ফুলের হাট' দোকান থেকে সে একটা গোলাপ কিনে নিল। তারপর দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই পরিমল দেখতে পেল মল্লিকা একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন।
গোলাপটি লুকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে একেবারে মল্লিকার মুখোমুখি।
'সরি, দেরি হয়ে গেল !'
 মল্লিকার মুখ ভার।
 পরিমল গোলাপটি নিবেদনের ভঙ্গিতে সামনে ধরে বলল, 'অনলি ফর তোমার জন্য।'
 গম্ভীর মল্লিকার মুখে মুহূর্তে হালকা হাসির ছায়া।
 হাত বাড়িয়ে বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ।'
 রিটার্ন গিফট দেওয়ার মত পরিমল বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ তোমাকেও।'
 'কেন ?' মল্লিকার কৌতূহল।
 'বা রে ! এত সুন্দর হাসলে যে !'

কতদিন আর আগের কথা ! সামান্য একটা গোলাপেই কী সুন্দর মেঘ কেটে যেত। আর আজ ! কারণে অকারণে মুখ ভার। আর মুখ ভার হলে তার মেয়াদ চলবে অন্তত তিনটে দিন। পরিমল কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারে না।
এই আজকের সকালটাই যেমন। ছুটির দিন। দোষের মধ্যে বাজার যাবার আগে পরিমল শুধু বলেছে, 'কী কী আনতে হবে, একটু লিখে দাও।'
প্রথমটায় খেয়াল করেনি। শুনতে পায়নি বোধহয়। কিছু বলল আন্দাজ করে মল্লিকা রাগত জিজ্ঞেস করল, 'কী বললে, আবার রিপিট করো।'
পরিমল পুনরাবৃত্তি করল, 'কী কী আনতে হবে ?'
মল্লিকা তখন রাতের এঁটো বাসন নিয়ে ব্যস্ত। ব্যাস্, তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, 'যা পারো নিয়ে এসো।'
তারপর চুপ। ঠিক চুপ নয়। বাসনগুলো বেজে উঠল মাত্রাতিরিক্ত শব্দে। পরিমল বুঝতে পারল, মেঘ ঘনাচ্ছে। এরপর যে সব বার্তালাপ চলবে তাতে তুমি, তোমার, তোমাকে ইত্যকার সর্বনামগুলো সব গায়েব হয়ে যাবে।
তারপরেও পরিমলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৈববাণীর স্বরে মল্লিকা বলল, 'এখন মনে পড়ছে না। মনে পড়লে মিসকল দোবো। ফোন করে জেনে নিও।'
'কেন, মিসকল কেন ? ফোন করতে কী হয়েছে ?'
'ফোন ? হুঁ ! আমার ব্যালেন্স নেই।'
পরিমল কিছু না বলে পা বাড়াতে যাচ্ছিল, 'শোনো' হুঙ্কারে ঘুরে দাঁড়াল।
'উইদিন আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে কিন্তু। বাজারে গিয়ে আবার আড্ডায় মজে যেও না।'

বিয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় ওদের সম্পর্কটা এতটাই টালমাটাল। অথচ সংসারে মাত্র তিনটেই প্রাণী। ও, মল্লিকা আর পরিমলের অসুস্থ মা। সামান্য একটা কাজ করে বটে, তাতে ভাতকাপড়ের অভাবও নেই। শুধু মল্লিকার মেজাজটাকে কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারে না।
পরিমল খুব দুঃখী। বিয়ের পর ও ক্লাব, বন্ধুবান্ধব সব ছেড়েছে। তাস খেলতে এত ভালোবাসত, সেই তাসও যে শেষ কবে খেলেছে, মনে করতে পারছে না। বাইরের সবকটা জানলা এক এক করে বন্ধ করে একটা বদ্ধজীবন বেছে নিয়েছে পরিমল। কাজের জায়গা আর ঘর এটুকুর মধ্যেই সে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে।
 

পরিমলের গুটিয়ে থাকার বিষয়টা বিপিন জানত। বিপিন ওর বাল্যবন্ধু। এক রোববার বিকেলে বিপিন হঠাৎ হাজির। একরকম জোর করেই পরিমলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বড় রাস্তায় এসে বাস ধরে সোজা মীরপুর বাজার। ওখান থেকে একটা ভ্যান রিক্সায় নেয়ামতপুরের ঝিলের কাছে। একটা জুতসই জায়গা খুঁজে বসে পড়ল দুজন।
'তোর সমস্যা কী বল তো ?' জানতে চাইল বিপিন।
 পরিমল বলল, 'তেমন কিছু না। তবে বলি বিপিন, আর যা-ই করিস, বিয়ে করিস না। আমরণ পর্যন্ত ব্যাচেলার থেকে যাবি, সেও ভালো। এই দ্যাখ্ না, আজ এতদিন ধরে মা বিছানায় শয্যাশায়ী, বৌ সামলাতে গিয়ে মায়ের দিকে ধ্যান দিতে পারছি না।এক এক সময় মনে হয়, নিজে আত্মহত্যা করি।'
একটু থেমে, 'তার আগে লিখে যাব আমার আত্মজীবনী। সেখানে লেখা থাকবে আমার দুঃখের কথা।'
 বিপিন দুঃখী দুঃখী মুখ করে সব শোনে। একটু সময় নিয়ে যথার্থ বন্ধুর মত ডায়ালগ ঝাড়ে, 'দেখ পরিমল, সাপোজ় ধর, তুই সুইসাইড করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলি। ইনকেস যদি তারপরেও তুই বেঁচে যাস, মানে কোনো মীরাক্কেল হয়, কী কেলো হবে, বুঝতে পারছিস ? লোকে তখন তোকে নিয়ে খিল্লি ওড়াবে।'
ওর কথাগুলোয় পরিমল বেশ মনোযোগী হয়ে উঠছে টের পেয়ে বিপিন আরও উৎসাহিত হল। 'অ্যাজ় এ ম্যান হিসেবে আমাদের এই মানুষজন্ম। মনে রাখিস, মানুষজন্ম সবচেয়ে বেস্ট জন্ম। এর চেয়ে আরও বেটার কিছু হতে পারে না। তুই কি ভাবছিস, এ পৃথিবীতে একসেপ্ট্ তুই ছাড়া আর কোন দুঃখী মানুষ নেই ? বেশি না, এই এখান থেকে আপ টু মীরপুর বাজার অব্দি সবকটা ঘরে খোঁজ নিয়ে দেখ্ তো, সবাই সত্যি সত্যি সুখে আছে কিনা !'
পরিমল শোনে, কোনো কথা বলে না। বিপিনই চালিয়ে যায় -- 'আছে, জীবনে দুঃখ যেমন আছে, সুখও আছে। খুঁজে নিতে হয়। আমারও তো প্রাক্তন প্রেমিকা ছিল ! এখন নেই, মানে কি দুঃখে মরে যাব ? অ্যাকর্ডিং টু আয় অনুসারে ব্যয়। ব্যস্, নো টেনসন।খাওদাও মৌজ করো। একেবারে বিন্দাস !'
খানিক থেমে বিপিন বলল, 'এটা অবিশ্যি আমার নিজের ব্যক্তিগত মতামত। মানা না মানা তোর ব্যাপার। মন খারাপ করে জীবনটা নষ্ট করবি কেন ? '

তারপর ওর গায়ে হাত রেখে বলল, 'কী অখাদ্য চেহারাটা বানিয়েছিস বল তো ! তুই এক কাজ কর, রোজ সকালে মর্নিং ওয়াক কর। আর মল্লিকাকে নিয়ে একটু আধটু আউটিঙে বের হ। বিয়ের আগে যেমন রিস্কায় ঘুরতিস, তেমন ঘোর। তোদের কমলপুরের দিকে রাস্তার যা হাল, রিস্কায় চড়াটা একটু রিক্সের হয়ে যাবে অবশ্য !'
বিপিনের পরামর্শ মন্দ লাগেনি পরিমলের। বিপিন আরও বলে, ' দেখ্ পরিমল, ইনক্লুডিং আমিসহ এ পৃথিবীতে আমরা সবাই দুঃখী। দুঃখ কারোর কম, কারোর বেশি, এই যা। একটু পিছন দিকে ব্যাক করে যা, দেখবি সে সব দিনেও আনন্দের সঙ্গে দুঃখও ছিল। হ্যাঁ, তবে দুঃখই শেষ কথা নয়। পরিমল, বাঁচাটা একটা আর্ট, মনে রাখিস। ভুল করে কোনো মিসটেক করে বসিস না। জীবন তো একটা সিঁড়ি রে, স্লিপ খেয়ে হড়কালেই ফিনিশ!'
বিপিন থামছেই না। বলেই চলেছে -- 'মল্লিকার মত মেয়েদের একজন লেডিস হিসেবে তারও মান সন্মান আছে। তার সনমানে লাগে, এমন কোনো কাজ পুরুষমানুষের কাছে অত্যন্ত লজ্জাস্কর ব্যাপার। ম্যানেজ করতে শেখ্। একটু সাধারণ কমনসেন্স অ্যাপ্লাই কর।'
একটানা কথাগুলো বলে বিপিন একটা সিগারেট ধরাল। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট পরিমলের দিকে বাড়িয়ে বলল, 'নে।'
পরিমল সিগারেটে টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে।
ঘোরলাগা পরিমলের পিঠে চাপড় মেরে বিপিন বলে, 'ঠিক আছে তো !'
    

পরিমলের খুব ভালো লাগছে। অনেক দিন পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধুসান্নিধ্য তাকে অন্যরকম স্বস্তি দিচ্ছে।
বিপিন তখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে চলেছে:
'দুঃখ  তুমি  তফাৎ  যাও
এসো হে সুখ, হাত বাড়াও
তোমার হাতে বাঁচার চাবি
বাঁচব সুখে, এ মোর দাবি ....'

থেমে বলল, 'আমার স্বরচিত কবিতা। কেমন ?'

‘পরিমলের ঘোর যেন কাটছেই না। বুড়ো আঙুল আর তর্জনীতে অদ্ভুত এক মুদ্রা দেখিয়ে বলল, 'ব্যাপক !’

 

স্বপন নাগ
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top