সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপি: জীবনের বর্ণিল চিত্রের আয়োজন : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
১০ অক্টোবর ২০২০ ২০:৫৮

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ১২:৪৬

ছবিঃ জীবনানন্দ দাশ

 

রবীন্দ্রবলয়ের প্রভাবমুক্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন অনেক কবিই। প্রথম যুদ্ধের পর ভিন্ন পরিবেশে তিরিশের কবিরা কবিতায় ভিন্ন স্বর সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগই শতভাগ পারেননি। প্রায় সমসাময়িক কাজী নজরুল ইসলাম আলাদা জগত সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তাঁর কবিতার পালাবদল ঘটেছে খুব দ্রুত। নজরুলের দ্রুত মানস পরিবর্তন নিয়ে আলাদা একটা আলোচনার চেষ্টা করব। সুকান্ত, নজরুলের মতো নতুন ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তারপর আর কেউ এমন ধারা চলমান রাখতে পারেননি। কবি জসীম উদদীন পুরাণ-লৌকিকতা থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ লোকজ/দেশিয় উপাদানে কবিতার শৈলী নির্মাণ করে সফল হয়েছেন। পঞ্চপাণ্ডব কবির মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশ সম্পূর্ণ আলাদা নতুন স্বর সৃষ্টি করেছেন। রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত করে কবিতায় নতুন স্বর সৃষ্টিতে কাজী নজরুলের পর জীবনানন্দই সবচেয়ে সফল বলে মনে করি। তারপর শক্তিশালী অবস্থানে কবি জসীম উদদীন। অনেকেই রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত থেকে লিখতে চেয়েছেন; শতভাগ পারেননি। এমনকি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক (১৯২৭) এ নজরুল বা অন্য কবিদের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। এরপর ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)। দ্বিতীয় এ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই আমরা সত্যিকার জীবনানন্দ দাশকে পেতে শুরু করেছি। এরপর বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ তো বাংলাসাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। আর রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য রতন। দেশিয় ও লোকজ শব্দবুননে সাফল্যের মানাংকে পৌঁছানো সব কবিতা স্থান পেয়েছে এসব কাব্যগ্রন্থে।

 

কবি জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডলিপি কাব্যগ্রন্থে ১৭ টি কবিতা আছে। বিতর্কিত কবিতা ক্যাম্পে। অন্যতম আলোচিত বোধ ও প্রেম কবিতাও এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতা। উপমা, চিত্রকল্প ও রূপকল্প নির্মাণে অন্যতা পেয়েছে কবিতাগুলো। বিভিন্ন অলংকার, চিত্রকল্প আর উপমার প্রয়োগের মাধ্যমে গঠনশৈলীতে এনেছেন অনন্যতা।চিত্রকল্পবাদ, প্রতীকিবাদ, পরাবাস্তববাদ, নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদির সম্মিলন হচ্ছে কবি জীবনানন্দ দাশ।তিনি সাহিত্যিক অলংকার ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ভাষা দিয়ে, দেশিয় ও লোকজ উপাদানের বুননে ধূসর পাণ্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো জীবন্ত হয়েছে।এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কথা উঠে এসেছে। একইসঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির দৌরাত্ম ও কালো থাবার কথা তুলে ধরা হয়েছে। গরীব দেশগুলোকে কীভাবে শোষণ করা হয় তা কবি কবিতায় আকার ইঙ্গিতে তুলে ধরেছেন।

 

জীবনানন্দ দেখেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভয়াবহ রূপ লক্ষ্য করেছেন। আর ধূসর পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো যখন লেখেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন;কদর্য রূপে টালমাটাল বিশ্ব ও অর্থনীতি। কবি সময়কে এড়িয়ে যেতে পারেন না। এ কাব্যগ্রন্থের ‘শকুন’ কবিতায় সাম্রাজ্যবাদীতার রূপ পাওয়া যায়।শকুন দৃষ্টি পড়ে এশিয়ায় বা গরীব দেশ ও জাতিগুলোর ওপর। কবিতায় দারুণভাবে তা তুলে ধরেছেন শকু্ন রূপকের মধ্যে। শক্ত উচ্চারণ- ‘মাঠ থেকে মাঠে মাঠে  সমস্ত দুপুর ভরে এশিয়ার আকাশে আকাশে/শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি নিস্তব্ধ প্রান্তর/ শকুনের;…পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চলে যায় যেন কোন্‌ মৃত্যুর ওপারে;যেন কোন্‌ বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষন্ন লেগুন/কেঁদে ওঠে’।

‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি কবিকে বিতর্কিত করে। বলা যায়, কলকাতার কয়েকজন সাহত্যসমালোচক নিন্দা আলোচনায় মেতে ওঠেন। সজনীকান্ত, বুদ্ধদেব বসুরা কবি জীবনানন্দ দাশের এ কবিতায় শালীনতার অভাব দেখেছেন। ‘ঘাইহরিণী’ শব্দের ব্যবহারে আপত্তি তোলেন। সে হিসাবে এখনকার অনেক কবিতাই তো এ পর্যায়ে পড়বে!তবে কবিতায় রূপকার্থে জীবনের বিভিন্ন রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে। উঁচু-নিচু বিভিন্ন শ্রেণির বৈষম্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের অবস্থানকে যে ঘাইহরিণীটির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তা আলোচ্য কবিতার শেষের দিকে পরিষ্কার হয়েছে। সংক্ষিপ্তাকারে কবিতাটি তুলে ধরছি- বিভিন্ন ‘এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;/সারারাত দখিনা বাতাসে/আকাশের চাঁদের আলোয়/এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি—?কাহারে সে ডাকে/…ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জোছনায়/…দোনলার শব্দ শুনি।/ঘাইমৃগী ডেকে যায়,/ আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো/ একা একা শুয়ে থেকে;/বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয়/ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;/যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়/হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে/…এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে—/কোথাও ফড়িঙে—কীটে, মানুষের ভিতরে,/আওমাদের সবের জীবনে’। (ক্যাম্পে, ধূসর পাণ্ডুলিপি)

 

‘প্রেম’ কবিতায় প্রেমের রূপ-রূপান্তর উঠে এসেছে। বলা যায় জীবনের নানা ভাঁজের কথা বলেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কবিতাটি এমন- ‘আমরা ঘুমায়ে থাকি পৃথিবীর গহ্বরের মতো—/পাহাড় নদীর পারে অন্ধকারে হয়েছে আহত—/একা— হরিণের মতো আমাদের হৃদয় যখন!/জীবনের রোমাঞ্চের শেষ হলে ক্লান্তির মতন/পাণ্ডুর পাতার মতো শিশিরে শিশিরে ইতস্তত/আমরা ঘুমায়ে থাকি!— ছুটি লয়ে চলে যায় মন’। কবি প্রেমের রকমফেরের ছবি এঁকেছেন। পারস্পারিক বিস্বাস-অবিশ্বাসের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আকাশের মতো তুমি—আকাশে নক্ষত্র আছে যত—/তাদের সকল আলো একদিন নিভে গেলে পরে/তুমিও কি ডুবে যাবে, ওগো প্রেম, পশ্চিম সাগরে!/জীবনের মুখে চেয়ে সেইদিনও রবে জেগে জানি!/


জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি—/ঘুমন্ত ফুলের মতো নিবন্ত বাতির মতো ঢেলে/মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায়— তুমি তারে জ্বেলে/চোখের তারার পরে তুলে লবে সেই আলোখানি’। প্রেম নিয়ে হতাশ হয়ে বলেন,  ‘এক দিন রয় না কিছুই তবু— সব শেষ হয়—/সময়ের আগে তাই কেটে গেল প্রেমের সময়;/এক দিন এক রাত প্রেমেরে পেয়েছি তবু কাছে!/আকাশ চলেছে তার— আগে আগে প্রেম চলিয়াছে’। মৃত্যু ভাবনাও কবিকে গ্রাস করছে। ধূসর পাণ্ডুলিপিরি কবিতায় মৃত্যু-হতাশার কথা বারবার এসেছে। ‘প্রেম’ কবিতার শেষে বলেন, ‘মৃতেরা আবার জাগিয়াছে!/যে ব্যথা মুছিতে এসে পৃথিবীর মানুষের মুখে/আরো ব্যথা— বিহ্বলতা তুমি এসে দিয়ে গেলে তারে—/ ওগো প্রেম, সেই সব ভুলে গিয়ে কে ঘুমাতে পারে!’

বিবেক বা বোধই মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিবেক না থাকলে মানুষ পরিপূর্ণ হয় না। চারিপাশের বিভিন্ন অন্যায়, অবিচার ও অন্যায্য নিয়ে কবিও চিন্তিত। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় বিভিন্ন কিছু। ‘বোধ’ কবিতায় সহজেই উঠে আসে কবির এমন সব ভাবনা। এ কবিতাটি বাংলাসাহিত্যে আলোচিত কবিতাগুলোর মধ্যে একটি। এ কবিতায় জীবন-প্রেমের প্রকৃতি ও বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে-‘আলো— অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!/স্বপ্ন নয়— শান্তি নয়— ভালোবাসা নয়,/হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!/আমি তারে পারি না এড়াতে’। বারবার ফিরে আসে কী যেন করা উচিৎ! পারছেন না! আবার এড়িয়ে যেতেও পারছেন না! উভয় সংকটে ফেলেছে সংসার পৃথিবী। প্রিয়তমাও এ থেকে রেহাই দিতে পারছে না। সেও সংকট সৃষ্টিতে কম দায়ী নয়। ফলে বললেন-‘কোন এক বোধ কাজ করে/মাথার ভিতরে!/…একদিন;/এই সব সাধ/জানিয়াছি একদিন— অবাধ— অগাধ;/চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে—/ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,/অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,/ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে;/আমার সে ভালোবাসিয়াছে,/আসিয়াছে কাছে,/উপেক্ষা সে করেছে আমারে,/ঘৃণা করে চলে গেছে’। কবিতার শেষে তুলে ধরলেন, মন্তব্যও করলেন এভাবে-‘কালোশিরার অসুখ,/কানে যেই বধিরতা আছে,/যেই কুঁজ— গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে/নষ্ট শসা—পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,/যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে/— সেই সব’।

 

লোকজ ও দেশিয় উপাদানের ব্যবহার কবি জীবনানন্দ দাশের মতো খুব কম কবিই ব্যবহার করেছেন। আজকের আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করলেও কবির উপমাশক্তি বুঝা যায়। কবি বলেছেন, উপমাই কবিত্ব। এর প্রমাণ আমরা তাঁর কবিতায় পাই। জীবনানন্দের কবিতায় একটা জিনিস প্রচুর লক্ষ্য করা যায়;সেটি হচ্ছে ড্যাসের ব্যবহার। চিত্রকল্প নির্মাণে কবি প্রচুর ড্যাসের ব্যবহার করেছেন। দুটি পর্বকে সম্মিলন ঘটাতে তাঁর জুড়ি নেই।  বাড়ির আশেপাশের উপাদান ব্যবহারে কবি সিদ্ধহস্ত। উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশজ উপাদানের কাছে হাত পেতেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে সফলতায় অনন্য হয়েছেন। অনেক শব্দ বা জিনিস আমাদের আশে পাশেই আছে; আমরা হয়তো খেয়াল করি না। অন্য কবিরা সাহিত্যে তুলে আনতে চাননি বা সফল হননি। উপমার বস্তু যে আমাদের দেশেই আছে বা ধারেকাছেই আছে তা কবি কবিতায় প্রয়োগের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন। ধূসর পাণ্ডলিপি গ্রন্থের কবিতাগুলো থেকে অলংকারের প্রয়োগ ও দেশজ শব্দের ব্যবহার তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বন্ধনীর মধ্যে কবিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।  

 

(১) হেমন্তের ঝড়, শিশিরের জল, রাতে—রাতে হেঁটে-হেঁটে (অনুপ্রাসের প্রয়োগ) নক্ষত্রের সনে/তারে আমি পাই নাই, আকাশের তলে কত আলো-কত আগুনের ক্ষয়, নক্ষত্রের মতন হৃদয়, / পড়িতেছে ঝরে, ক্লান্ত হয়ে— মতো শব্দ করে, হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন (নির্জন স্বাক্ষর)


(২) মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে (সমাসোক্তির প্রয়োগ) মেঠো চাঁদ কাস্তের মতো বাঁকা, পোড়ো জমি (মাঠের গল্প)


(৩) অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে, বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা, ঝিমায়েছে এ পৃথিবী, কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর, মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জেগেছিল, নদীটির শ্বাসে সে রাতেও হিম হয়ে আসে, বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা (পেঁচা)


(৪) চড়ুয়ের ভাঙা বাসা, পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা—কড়কড়, শসাফুল, মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা, হিম আকাশের গায় খুদ খেয়ে ইত্যাদি লোকজ উপাদান ও অলংকার ব্যবহার করা হয়েছে 'পঁচিশ বছর পরে' কবিতায়।


(৫) ভেসে যাবে পাথর বাতাসে, তুমি জল—তুমি ঢেউ—সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন, সাগরের জলের আবেগ, জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধূ ধূ জল তোমারে যে ডাকে, উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে, শীতরাতে, মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন (পরাবাস্তবতার একটি উদাহরণ), নিশীথের বাতাসের মতো (সহজ)


(৬) মাটি আর রক্তের কর্কশ স্বাদ, পথের আহত মাছিদের মতো, ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে পায়ে,/ ঘুম ভেঙে যায় বার-বার/তোমার আমার, ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে, এই হাওয়া যেন হা-হা করে/হু-হু করে ওঠে অন্ধকার(অনুপ্রাসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়),  কত রাত ঝ'রে গেছে, ছেঁড়া দেহে—ব্যথিত মনের ঘায়ে/ঝরিতেছে জলের মতন, বাতাসের সিন্ধু—ঢেউ, নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ'রে, সোনার মত্ন ধান, ঠাণ্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপ আমি,গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে,রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে বুকে জাগায় যে-রস, যেখানে ফেনার গন্ধ নাই, অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে, চাঁদ জেগে রয়/তারা-ভরা আকাশের তলে/জীবন সবুজ হয়ে ফলে, মাটি ধুলো কাজ করে,—মাঠে-মাঠে ঘাস (কয়েকটি লাইন)

(৭) গানের সুরের মতো বিকাল, পাখির মতন কেঁপে, হিম চোখ বুজে, নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে,সমুদ্র ভাঙিয়া যায়—নক্ষত্রের সাথে কথা কয়, উষ্ণ আকাশেরে চাই সে জড়াতে, গোধূলির মেঘে মেঘ, বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙখা, একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে, পাখির মতো স্থির হয়ে, নীল আকাশের আলোর গাঢ়তা, নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার, গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা, সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে, হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা ল'য়ে, ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে, হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস,ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি, এইখানে অশান্ত সাগর তোমারে এনেছে ডেকে, প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে ওঠে, সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুক ফুটে, সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে, জোনাকির পথ ধরে, ভোরের মেঘের ঢেউয়ে, আলো-অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছি সিন্ধুর বিপ্লবে, তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়, ব্যথিতের স্বপ্নের মতন গোপনের চোখ, মেঘের মতো হঠাৎ  চাঁদের বুকে এসে, ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে, পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে, দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে,গুহার হাওয়ার মতো বন্দী হয়ে মন তব ফেরে, এলোমেলো আধাঁরের মতো হৃদয়, ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে, বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু,  ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম ক্ষত, মেঘের চিলের মতো—দুরন্ত চিতার মতো বেগে ছুটে যায় (অনেক আকাশ)


(৮) পাথরের মতো শাদা গা, পাষাণের মতো হাত, পদ্মা-ভাগীরথী-মেঘনা-কোন নদী সে, নিবু নিবু জ্যোৎস্না, জমানো ফেনার মতো দেখা, হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতো শুয়ে আছে, ফেনার মতন তারা ঠাণ্ডা-শাদা, ঢেউয়ের মত তারা ঢলে, বরফের কুঁচির মতন মুখ চোখ ভিজে, কাচের গুঁড়ির মতো শিশিরের জল, রূপার মতন চুল ঝিকমিক করে,  মেঘের মতন চুল, ধুপের ধোঁয়ার মতো ধলা পুরীর ভেতর, চোখা-ছুরি যেন ধারালো হাতির দাঁত, যৌবন ছিঁড়েফেঁড়ে যায়, শরীরের ঘুণ, চোখে ঠোঁটে অসুবিধা—ভিতরে অসুখ, পরী নয়—মানুষও সে হয়নি এখনো, কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে,জটার মতো খোঁপা অন্ধকার (পরস্পর)


(৯) প্রথম মেয়ের মতো—পৃথিবীর নদী মাঠ বন, যে পাতা হলুদ ছিল—তবুও হলুদ হতে হয়, অঙ্গারের মতো তেজ কাজ (জীবন)


(১০) সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন, আকাশে আকাশ যাবে জ্বলে, দেহ ঝরে তার আগে ঝরে যায় আমাদের মন, পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই, রাত্রির ঢেউয়ের মতো, আলো অন্ধকারে তোমার পায়ের শব্দ, বালকের মতো এক (১৩৩৩)


(১১) পৃথিবীএ গহ্বরের মতো ঘুমানো,  পাণ্ডুর পাতার মতো শিশির, পায়ের পথের মতো ঘুমন্ত, পুরুষ পাখির মতো,—প্রবল হাওয়ার মতো মৃত্যু, বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন, পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে, বনের শাখার মতো হিম, পাখির শিশুর মতো  প্রেমেরে ডেকে ডেকে, আলোয়ার মতো আলো নিয়ে, অঙ্কুরের মতো তুমি, আশার ঠোঁটের মতো, হ্রদয়ের গন্ধ বা ধূপের মতো জ্বলে, স্নৃতির হাড়ের মাঠে (সুররিয়ালিজম)-(প্রেম)


(১২) মাটির শরীরে তার ছিল যে পিপাসা, রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা, বালকের মতো এক—সমুদ্রের জল, রাঙা রোদ—নারীর মতন, চোখ দুটো ফের ঘুমে ভরে/ যেন তার চুমো খেয়ে, এ দেহ—অলস মেয়ে/ পুরুষের সোহাগে অবশ, ঝুমকো লতার মতো তার দেহ ফাঁসে, প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো চুম্বনের মতো, শস্যের মতো শরীর ছিঁড়ে আহত, আগুনের মতো দুপুরের রাঙা রোদ, লাল আলো—রৌদ্রের চুমুক/অন্ধকার,—কুয়াশার ছুরি, হেমন্তের রৌদ্রের মতো ফসলের স্তন, কীটদের মতো আহত,  লতার মতো চুল (পিপাসার গান)
(১৩) আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর, ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে, রবারের বলের মতো ছোট বুকের জীবন, খেলার বলের মতো তাদের হৃদয় (পাখিরা)

(১৪) পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ, নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতর, সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষা,  হিজলের জানালায় আলো আর বুলিবুলি করিয়াছে খেলা, নির্জন মাছের চোখে, মিনারের মতো মেঘ, বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আসে, বাতাসে ঝিঝিঁর গন্ধ, রাঙা কামনার শিয়র, ধূসর মৃত্যুর মুখ (মৃত্যুর আগে)

(১৫) নিরালা ঢেউয়ের পাশে, গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে,সন্ধ্যা নদীর জল—পাথরের জলের ধারা/আয়নার মতো, আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া, হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী (স্বপ্নের হাতে)

 

উপমার প্রয়োগ বা বিভিন্ন অলংকারের প্রয়োগ, চিত্রকল্প বা রূপকল্প উদাহরণের ক্ষেত্রে জীবনানন্দের কবিতা থেকে প্রায় অবিকল হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।এতে করে পাঠক জীবনানন্দ দাশ কীভাবে অলংকারে ব্যবহার করেছেন তা সহজে পাঠক বুঝতে সক্ষম হবেন। পড়ার সময় কাব্যগ্রন্থে না পড়ে বা  সাহায্য না নিয়েও পাঠক প্রায় মূল কবিতা বা জীবনানন্দ দাশের মনোভাব বা পারঙ্গমতা বুঝতে কঠিন হবে না।

 

জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডলিপি কাব্যগ্রন্থে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের অনুভূতিগুলো উঠে এসেছে। স্থান-কাল ভেদে জীবনের বৈচিত্রময়তাও ধরা দিয়েছে। আমরা এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে বর্ণিল জীবনের নিখুঁত একটা চিত্র পাই। জীবনানন্দ দাশের বিভিন্ন পর্যায়ের অনুভূতিগুলো যেন আমাদেরও। তাই তো তিনি আমাদের মানসপটে ঢুকে গেছেন।বিশ্বময় প্রকৃতি, জীবন, মৃত্যু, সময়-কাল ইত্যাদি জীবন্ত রূপ লাভ করেছে তাঁর কবিতায়। এসব কবিতায় ব্যবহৃত উপমা-উৎপ্রেক্ষাসহ বিভিন্ন অলংকার কবির নিজস্ব। অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত হননি। এক্ষেত্রে নিজের একটা কবিতার আলাদা জগত সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ঝরাপালক কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু ধূসর কাব্যগ্রন্থে আমরা আসল জীবনানন্দ দাশকে খুঁজে পেয়েছি। বলা যায়, ধূসর পাণ্ডুলিপি তাঁর প্রথম পরিণত কাব্যগ্রন্থ। এসম্পর্কে কবির কড়া সমালোচনাকারী বুদ্ধদেব বসুর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, '…জীবনানন্দ দাশকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি মনে করি।…আমাদের মাতৃভাষায় সাহিত্যকে যাঁরা শ্রদ্ধা ক'রে ভালোবাসেন, তাঁরা ''ধূসর পাণ্ডুলিপি'' নিজের গরজেই পড়বেন, কারণ এই বইয়ের পাতা খুললেই তাঁরা এমন একজনের পরিচয় পাবেন যিনি প্রকৃতই কবি, এবং প্রকৃত অর্থে নতুন'। (কবিতা, চৈত্র ১৩৪৩)

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top