সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

অন্তর্ধান : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
১১ নভেম্বর ২০২০ ২৩:১৭

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ০১:৪৯

 

শরতের আলসেমিভরা লম্বা বিকেল। এবার শীতএকটু আগেই আসবে মনে হয়। বাতাসে শীতের নরম আদর।  উঠোনের একধারের বিশাল কাঁঠাল গাছটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিল রোজা। সামনেই টেবিলের  উপরে  বাটিতে পরে আছে আধখাওয়া  টকদই। টকদই খেতে রোজার কখনই ভাল লাগেনা,  নেহায়াৎ  ডাক্তারের আদেশে ওজন কমানো লাগছে তাই এই অখাদ্য বস্তুটিকে গলধাকরনের চেষ্টা।কাঁঠাল গাছটার নীচে শুকনো পাতা জমে আছে। লোক ডেকে পরিস্কার  করাতে হবে। হঠাৎই কোথা থেকে একটা বক উড়ে এসে বসে কাঁঠাল গাছটাতে।এই শহুরে লোকালয়ে বক! একটু অবাক হয় রোজা, ভাবে,'জন্মতক এই কাঁঠাল গাছটা দেখে আসছি, কখনই বক দেখিনি, আগন্তুক, হয়তো পথ ভুল করে এসেছে।

সামনের রাস্তাটা দিয়ে  অনবরত হর্ন বাজিয়ে, ধূলার কুন্ডলী উড়িয়ে  একের পর এক  কাভার্ডভ্যান, পিক আপ, কখনও  মটর সাইকেল ছুটে যাচ্ছে তাদের নাম না জানা গন্তব্যে,   ব্যাস্ত সবাই। কেবল কাঁঠাল  গাছটার  পায়ের কাছে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রানা, এবাড়ির পোষা কুকুর। দেশী জাত,তাই যত্ন আত্তি ঠিকঠাক মত হলেও তেমন কদর নেই। এই ধর, বারান্দা  ছাড়িয়ে  ওর ঘরে ঢোকা বারন, মাকে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে আহ্লাদ দেখানো বারন। তবে কুকুর টাও আছে, রোজ পোষা কবুতর গুলোর সাথে একটানা ঝগড়া করবে, মা উঠোনে নামলে পাশে গিয়ে  দাড়াবে,কাউকে  কিছু খেতে দেখলে হাভাতের মত করুন চোখে তাকিয়ে থাকবে।

সাগরের খুব ন্যাওটা ছিল রানা, সে বের হবার সময় লেজ নাড়তে নাড়তে গিয়ে  গাড়ি  পর্যন্ত এগিয়ে  দিত। আবার সাগরের বাড়ি ফেরার সময়ে  গেটের কাছ ঘাপটি মেরে বসে থাকত,বারান্দা পর্যন্ত সাগরকে পৌঁছে দিয়ে  তারপর তার ছুটি। সাগরও রানার গায়ে মাথায়  হাত বুলিয়ে  দিত, বিস্কুট খেতে দিত, ভায়োলিন বাজিয়ে  শোনাতো। খুব ভালো  ভায়োলিন বাজাতো সাগর, ওর ভায়োলিনের সুরে মুগ্ধ হয়ে কত ভেসেছি আমি ওর জলে! ঢেউগুলো যেমন তীরের গায়ে আছড়ে পড়ে তেমনি আনন্দে, সাচ্ছন্দ্যে সমর্পিত হয়েছি কতবার! কিন্তু একটা মানুষ কি করে এভাবে হারিয়ে যায়!  একটা জলজ্যান্ত মানুষ!

একটা প্রাচীন, স্মৃতিময় সুরেলা হাঁকে সম্বিত ফিরে পায় রোজা, " দাঁতের পোকা ফেলাই, মাজার বিষ নামাই, হাতে পায়ের ব্যাথা সারাই....." এমন মন কাড়া ডাক শেষ কবে শুনেছে ঠিক মনে করে বলা যাবেনা। তবে এর সাথে রোজার শৈশব কৈশোরটা মেশানো,  অনেক স্মৃতি,  অনেক কৌতুহল। রাস্তার দিকে গলা উঁচিয়ে উঁকি মারতেই চোখাচোখি হল তাদের সাথে। সাধারন লাল কালো ছাপার শাড়ি পড়া দুই মহিলা, একজনের অপেক্ষাকৃত বয়স  একটু বেশী, গড়নেও ভারীর দিকে। তিনিই জিজ্ঞেস করলেন 'বুবু আছে নাকি বিষ বেদনা, সাপের খেলা দেখাই..." তাকে উদ্দেশ্য করে দাড়াও বলে দারোয়ানকে ডেকে গেট খুলে ওদের ভিতরে ঢুকতে দিতে বলে রোজা। কোনোমতে দইয়ের শেষ চামচ টা মুখে পুরে নীচে নেমে আসে। 


সাপুড়েরা বারান্দায় পশরা খুলে বসে। সাদা  আর কালো রঙের দুটো সাপ বের হয় ঝুলি থেকে। বাড়ির সব লোকজন চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়ায়। দারোয়ান জামাল সপরিবারে এ বাড়িতে থাকে। ওরাই বউ - জামাই মিলে বাজার, হেঁসেল সামলায়। ওদের দশ বছরের ছেলে নাজমুল সাপ দেখে মা'য়ের আঁচল ধরে দাড়িয়ে। সালমা, দারোয়ানের বউ, সেও হয়তো ভয় পাচ্ছে। ওরা প্রানপনে একে অপরের অভয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোজার হাসি পায় ওদের ছেলেমানুষি দেখে। ছোট সাপুরে সাদা সাপটির মাথায়  স্পর্শ করে বলে
- এইটা হইল দুধরাজ সাপ,  দুধের মত সাদা.... আর উনি হইলেন গোখরা...বেজায় রাগী....

তারপর দুলে দুলে গান করে হাত নাড়ায়, সাপটিও মাথা নাড়ায় হয়তো তালে তালে। কিন্তু সাপ তো কানে শোনেনা, হয়তো আঙুলের ইশারায় মাথা নাড়ায়। রোজার মনে হয়, সাপও মানুষের পোষ মানে, কিন্তু মানুষ! ঘুরে ফিরে প্রতি মুহূর্তে সাগরের কথা মনে হয়। এই তো সেদিনও এবাড়িতে ছিলো ও, কোথায়  হারিয়ে গেল, কেন গেল?এত থানা - পুলিশ  করা হল,  হাসপাতাল, ক্লিনিক চষে বেড়ানো হল,  না কেউ দেখেনি। কোন ফোন এলনা, কেউ মুক্তিপণও দাবী করলো না! শেষ তাকে একটা ইলেক্ট্রনিক গুডসের শো রুম থেকে বের হতে দেখা গেছে। তারপর নিখোঁজ। কোথায় গেল। আজ দুই মাস সাতাশ দিন!

কখন আম্মা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে রোজা খেয়াল করেনি, মায়ের স্পর্শে  তাকায়। সালমাকে চেয়ার দিতে বলে। আম্মা জিজ্ঞেস করে-
- হাঁটুর ব্যাথাটা দেখাব নাকি?
- এদের ঝাড়া ঝাড়িতে কোনও কাজ হয়?
- দেখাই না, খারাপ তো আর কিছু হবেনা
- আচ্ছা

বয়সে বেশী মহিলাটি  তার কালো রঙের থলে থেকে বীন বের করেছে, কৌশলী ভঙ্গিতে  বীন বাজাচ্ছে।  রোজা মুগ্ধ হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভাবে কি সুনিপুণ আর্ট!
সাপ খেলা শেষ হয়। এবার আম্মার হাঁটুর ব্যাথা সারানোর পালা। রোজা জিজ্ঞেস করে-
- তোমরা সম্পর্কে কি হও
-ছোট সাপুরে জবাব দেয়
- সতীন
শব্দটি শুনে রোজা চমকে তাকালেও সাপুড়েদের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। তারা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। থলে থেকে কি সব পাতা বের করে আম্মার  পায়ে, হাঁটুতে বুলায়, বিড়বিড়  করে দুর্বোধ্য সব মন্ত্র আওড়ায়।

সাপুড়েদের  নিজস্ব কথোপকথনে  জানা হয়ে যায়  ছোট সাপুড়ের নাম শেফালি আর বড় জনের নাম রানী।  রোজা খেয়াল করে শেফালির ফর্সা গায়ের রং, লাল ফিতে দিয়ে চুল পরিপাটি করে বাধা,  পায়ে নুপুর,  হয়তো  রূপার, হাতে রংবেরঙের চুড়ি গলায়  পুঁথির মালা, কারুকাজ করা। আর রানীর গায়ের রং কালো ছেঁচা শরীর,  হাতে,  নাকে, কানে গলায়  প্রয়োজনের তুলনায় বেশী গহনা, হাতের ত্রস্থতায় অভিজ্ঞতা স্পষ্ট। শেফালীর মালা দেখে রোজা কৌতুহলী হয়,
- এরকম একটা মালা আমাকে করে দিতে পারবে?
- হ,পারবো। কি কি কালার নিবেন?
শেফালী  তার থলের ভেতর থেকে ছোট ছোট কঁচের কৌঁটায় ভর্তি পুঁথি বের করে। রোজা পুঁথির রং বেছে দেয়।শেফালি একমনে মালা গাঁথে আর গুনগুন গান করে।
রানী হাতের কাজ সেরে পা ছড়িয়ে  বসে। রোজাকে উদ্দেশ্য করে আচমকা বলে ওঠে:
- বুবু যা যায় তারে ছাইড়া দেওয়নই ঠিক। আপনের আইজকা একটা খবর আইব।সামনের চাঁন্দে যেইডা ভালো মনে হয় হেইডা করবেন, দ্বিতীয়বার ভাববেইন না।

রোজা  সাবধানী হয়। মহিলার কোনো বদ মতলব নেই তো? এসব লোকেরা লোক ঠকাতে ওস্তাদ!! হয়তো আগে থেকেই খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে। আগে এরকম ঘটনা বেশ শোনা যেত। কেন, ছোট চাচীর বাড়িতে ঢুকে এরকমই একজন চাচীকে এমন ভাবে পটিয়েছিল যে আরেকটু হলেই কানের সোনার দুল খুলে দিয়ে দিচ্ছিল। পুলিশের মেয়ে, ছোটবেলা থেকেই চোর - বাটপারের গল্প অনেক জানা, তাও কেমন হিপনোটাইজড হয়ে  গেছিলো!  ভাগ্যিস নীলু ফুপু সময় মত এসে পড়েছিল। রোজা নড়েচড়ে বসে।

রানী গম্ভীর মুখে আবার বলে
- সময়  থাকতেই সব কিছু  কইরা ফালাইতে হয়। নাইলে নিজের পায়ে নিজেরই বেড়ি পড়ন লাগে। কিছু  মনে কইরেন না বুবু আমি মাইনষের চেহারার রেখা বুঝি, এইডা আমার নানার গুন ছিল, হের কাছ থাইকা পাইছি। কথা গুলা মনে আইলো তাই কইলাম। বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনের ইচ্ছা।

রানীর কথায় রোজা তেমন পাত্তা দিলনা, পাওনা মিটিয়ে  বিদায় করল। তবে দারোয়ান কে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কোন পারসেল বা চিঠি  এসেছে কিনা। রানীর কথাটা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না কিন্তু সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে  দেয়াও যাচ্ছেনা, রোজা অপেক্ষার প্রহর গোনে, থানায়  ফোন দেয়, যদি কোনও আপডেট! না এবারও না উত্তর  আসে থানার পক্ষ থেকে। রোজা চোখ জ্বালা করে। 'একফোঁটা জল হয়ে ফিরে আস তুমি, সাগর', মনের গভীরের  ইচ্ছাটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে বের হয়। অস্হির লাগে রোজা'র।

কেউ একজন রাস্তায় বাজিয়ে যায়, 'আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো, জ্বালো আরো আগুন জ্বালো, ঢালো আরো ব্যাথা ঢালো'। ছোট বেলার কথা মনে পড়ে রোজার। খুব বাজতো রেডিওতে এই গানটা। রোজার বার বার বার মনে পড়ে রানীর আত্মবিশ্বাসী মুখটা,অথচ নিজের আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিশেঃষ হয়ে যাচ্ছে তার মনের মধ্যে।একটা বিষয়ে খটকা লাগে হঠাৎ।  সাগর শেষমেশ একটা ফ্রিজ দেখতে দোকানে ঢুকেছিল কেন? বাসায়  তো দুটো ফ্রিজ দিব্যি চলছে। অন্য কারো জন্য কিনতে চাইছিল? ভাবতেই একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। রোজার মন বিশ্বাস করতে চায়  রানীর ভবিষ্যৎ বানী,'আইজকা একটা খবর আসব'। রোজা শেষ বারের মত গেটে খবর নেয় কোনো পার্সেল বা চিঠি এসেছে  কিনা।  ইমেইল চেক করে ক্লান্ত চোখে, ফেইসবুক জুড়ে  আমেরিকার ইলেকশনের খবর, অথচ একটা জলজ্যান্ত মানুষ  দিন দুপুরে হাওয়া হয়ে গেল, তার কোন ও খবর নেই।
রোজার মনে কতশত ভাবনা উঁকি দেয়, নিজের সাথে নিজের কথা হয়।বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ, অভিমান, অসহায়ত্ব, প্রেম জমে চোখের কোনে।মনে মনে বলে, প্রতিদিন ঘুমানোর আগে যে প্রার্থনা করি সেটা তোমার নামে - যেন ভালো থাকো,  শান্তিতে থাকো, ভালবাসায় থাকো সবসময়।

ক্লান্তিতে ঘুম নামে রোজার অবসন্ন মস্তিষ্ক বেয়ে, তারপর চোখের গভীরে আশ্রয় নেয়। এরই কোনোও এক অবসরে রোজা’র ছোটবেলার বন্ধু  দেরদুন ফাহাদ এর কাছ থেকে মেসেঞ্জারে একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট  পৌঁছে দ্রুত আত্মগোপন  করে রোজার দৃষ্টির অগোচরে। কে জানে আগামী দিন গুলো হয়তো তার সাথেই সুখে দুখে কাটবে রোজা।

আর ওদিকে সকালের আরো ফোটার পরে রাস্তার পাশে হাত, পা, চোখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় এক বেওয়ারিশ লাশ। কেউ কেউ বলছে, একটু আগেও নাকি বেঁচে ছিল লোকটা। আজ নিশ্চয়ই একটা খবর যাবে রোজার বাসায়।

সমাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top