সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

কামেলার রাত্রি দিন : লিপি নাসরিন


প্রকাশিত:
১৬ নভেম্বর ২০২০ ২১:২১

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৫০

 

কামেলার বিয়ে হয়েছিল গুণে গুণে ঠিক চোদ্দ বছর আট মাসে। সাবালিকা হলেই বাবা বিয়ে দেবার জন্য ঘটক লাগিয়েছিল। কামেলার বাবার গৃহস্থের অবস্থা। মেয়েকে সাধ্যমতো দিয়ে বিয়ে দেবে। আরো একটা বোন আছে কামেলার, একটি ছোট ভাইও। কামেলার মার বিয়ের পর অনেকদিন পর্যন্ত পেটে কোন বাচ্চা দাঁড়াতো  না। শেষে দূর গাঁয়ের এক পীরের দরগা থেকে পানি পড়া খেয়ে আর পেটে পড়া তেল মালিশ করে করে নাকি কামেলা পেটে আসে। সে হিসেবে সে মা-বাবার খুব আদরের। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় কামেল পীরের দরগার পড়া পানি আর পড়া তেলের গুণে মেয়ে এসেছিল বউয়ের পেটে তাই তার নাম রাখা হয়েছিল কামেলা।

শেষমেশ অনেক খুঁজে কাশিনাথপুর গ্রামের আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের জ্যেষ্ঠপুত্রের সাথে আশ্বিনের ১৫ তারিখে কামেলার বিয়ের দিন ধার্য হয়। যথাসময়ে  যুবক আয়নুলের সাথে কিশোরী কামেলার বিয়ে হয়ে যায়।  আয়নুল একটু ক্ষীণকায়, গায়ের রঙ একেবারে আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের মতো। কামেলার সাথে মানিয়েছে বেশ।  চোদ্দ বছর আট মাস বয়সে কামেলা শ্বশুর বাড়ি গেলো ঘোমটা পরে। আয়নুল দুধের ব্যবসা করতো। আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের দুই ছেলে পাঁচ মেয়ে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার আয়েনউদ্দীন মানুষ হিসেবে খুবই মিশুক। পথে চলতে মানুষ ডেকে কথা বলে। বাড়িতে কেউ এলে ঘন দুধের চা বানিয়ে খাওয়ায় আয়নুলের মা। আয়নুল ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয় । ছোট ভাইটা আর একজন বোনের পর। 

আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের মাটির ঘরটা উঁচু ভিতের উপর। চওড়া বারান্দা। ঘর মোটের উপর দুখানা। একটাতে আয়নুল থাকে বউ নিয়ে। বড় দুমেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। আর এক মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। চৌকিদারের চার নম্বর মেয়েটা সবথেকে বেশি দেখতে শুনতে। এই চার নম্বর মেয়েটাও বাবার গড়ন নিয়েছে। এই মেয়েটা এবার মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। বড় দুই মেয়ে কোনরকম প্রাইমারি পাশ করেছে। আয়নুলের দৌড় দশম শ্রেণি পর্যন্ত। ছোট ভাই জয়নুল এবার নবম শ্রেণিতে। ওর মাথা পড়াশুনার ক্ষেত্রে একটু মোটা। অন্য অনেক কাজে বেশ পারদর্শী। জয়নুল আবার বেশ দীর্ঘদেহী, হৃষ্টপুষ্ট। মাসুমা মানে চার নম্বর  মেয়েটা পড়াশুনায় বেশ চৌকস। কিন্তু চৌকিদারের চাকরি করে যে বেতন পায় তা দিয়ে সংসারের তিন বেলা খাওয়ার জোগাড় করতেই তো শেষ লেখাপড়ার খরচ আসবে কীভাবে। মাসুমা পড়াশুনায় ভালো দেখে ইউনিয়ন হাইস্কুল থেকে বেতন মওকুফ করিয়ে নিয়েছে চৌকিদার, তাওতো বইপত্র কেনার খরচটা থেকেই যায়। সেটারও একটা গতি হয়েছে। পড়শিদের কারো মাসুমার উপরের ক্লাস পড়া মেয়ের বইগুলো স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে চৌকিদার মেয়ের জন্য চেয়ে নিয়ে আসে। আসলে সানন্দে মাসুমার  জন্য বইগুলো তারা দেয় দেখে আয়েনউদ্দীন চৌকিদার খুব বেশি দারিদ্র্যের কারণে লজ্জা বোধ করে না।

এ বাড়িতে কামেলাকে কেউ অযত্ন করে না। কামেলা ধীরে ধীরে  সব মানিয়ে নিয়েছে। বাপের বাড়ির তুলনায় এদের গেরস্থপনা একটু কম হলেও তার ভালো লেগেছে শ্বশুর বাড়ি। মাটির মানুষ শ্বশুর, সহজ সরল শাশুড়ি, দেবর ননদরাও ভাইবোনের মতো।

সংসারের কাজ বলতে রান্না, দুটো চাষের গরু আছে তাদের জাবনা কাটা, চাচা শ্বশুরের ঘর আর তাদের ঘরের মাঝে যে একফালি যৌথ উঠোন তার অর্ধেকখানি সকালে উঠে ঝাড়ু দেওয়া এই হলো সারাদিনের কাজ।

আয়নুল বেরিয়ে যায় নটা বাজতে না বাজতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরুর দুধ সংগ্রহ করে সদরে গিয়ে মিষ্টির দোকানগুলোতে যোগান দিয়ে দুপুরে ফেরে। দুপুরে ভাত খেয়ে কোনদিন হয়তো একটু ঘুমায়। দিনের বেলা আয়নুলের সাথে কামেলার দেখা-সাক্ষাৎ প্রয়োজনে সীমা বদ্ধ থাকে। অবসরে দুই ননদের সাথে লুডু খেলে, গল্প করে পার করে। বিকেল হলে হয়তো কোঁচড় ভরে চাল আর কুমড়োর দানা তেল, পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে খায়।

ছমাসেরও অধিককাল হয়ে গেলো কিন্তু কামেলা এখনো লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। শাশুড়ি কতোবার বলেছে, এতো বড় ঘোমটা দিতে হবে না, হাঁটতি  গিয়ে চোখে না দেখলি পড়ে যাবা। কামেলা তবুও লম্বা ঘোমটা টেনে চলে।

শাশুড়ি বোঝে ছোট মেয়ে একটু সময় লাগবে সংসারের সব কিছু বুঝতে।

বৌমা দুকাপ বানাও দিখি, হয়তো কেউ এলে শ্বশুর চা করতে বলবে। আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের বারবার চা খাবার অভ্যাস। বাড়িতে থাকলে তাই সকাল বিকাল চা বানানো লাগে। কামেলা ধীরে ধীরে সব শিখে নিচ্ছে।

ও ভাবি তাড়াতাড়ি ভাত দাও স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে জয়নুল তড়িঘড়ি করে বাঁশের খুঁটি ধরে মাটির বারান্দা থেকে নামে।

রান্না ঘরে পিঁড়ি পেতে বসতে বসতে কামেলাকে বলে, তুমি সবসময় এতো লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকো কেন? এখন তো পুরান বউ তুমি

কামেলা থালায় পান্তা বাড়তে বাড়তে ফিক করে হেসে উঠে।

আমি কি হাসির কথা কলাম নাকি?

কামেলা ভাতের থালায় কুঁচো চিংড়ি, আস্তো  একটা পেঁয়াজ আর একটা বড়সড় কাঁচা মরিচ দিয়ে থালাটা জয়নুলের সামনে দিয়ে শাশুড়ির ডাকে উঠে যায়।

ও ভাবি আমারে একটু চিনি দিয়ে যাও।

পান্তা ভাতের সাথে একটুকরো আখের গুড় বা চিনি জয়নুলের খুব প্রিয়।

দুইঃ

আপনি আজ ম্যালা দেরি করে আসলেন। স্বামী ফিরলে সাইকেল থেকে দুধের  মুখ ঢাকা বড় দুটো অ্যলুমোনিয়ামের পাত্র নামাতে নামাতে বলে কামেলা।

আস্তে নামাও, একটার ভেতর কেজিকানি দুধ আছে। তাড়াতাড়ি জ্বাল দেও নাহলি দুধ কেটে যাবে।

আয়নুল কী জানি ভেবে কামেলাকে দুধের পাত্র নামাতে সাহায্য করতে বারান্দা থেকে নেমে আসে আবার।

আর কদ্দিন আপনি কবা? তুমি কতি লজ্জা করে?

কামেলা ঘোমটার ভেতর থেকে ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসে।

আজ রাইতে বুঝাবানি আপনি কারে কয়।

এই কথায় কামেলার শরীরে শিরশির অনুভূতি জাগে। আনন্দে নাকি ভয়ে কামেলা বুঝতে পারে না। এতোদিন বিয়ে হবার পরও কামেলা প্রতি রাতেই কেমন নাজুক হয়ে পড়ে। স্বামী তাকে খাওয়া, পরা,আদর-যত্নের কোন ত্রুটি রাখে নি, সংসারে সাধ্যমতো আয়নুল দিয়েও ছোট ছোট সঞ্চয় করে নিজের আলাদা একটা সংসারের জন্য। কোন কোনদিন বাড়ি ফেরার পথে কামেলার জন্য সন্দেশ, দানাদার নিয়ে আসে।

ঘরের মধ্যে বউকে আলাদা করে খাওয়ায়।

দিনদুপুরে কিশোরী বউকে নিয়ে আহ্লাদে মেতে উঠে আর সবার নজর এড়িয়ে।

দুএকদিন মাঝরাতে কামেলার শাশুড়ি হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে, বড় ছেলের ঘর থেকে অস্পষ্ট যন্ত্রণার মৃদু ধ্বনি শুনতে পায়। দিনের বেলায় বউকে বিভিন্ন কাজের ছলে বলে, পুরুষ মাইনসেরে  একটু সামলে চলতি হয় বৌমা। তোমার শ্বশুর দেখো না ঘন্টা অন্তর বাড়ি এসে ঘুরে যায়।পুরুষ মানুষ অমনি হয় এট্টু বুইঝে শুনে চলো আস্তে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কামেলা বুঝতে পারে সেসব কথার মানে। চুপ করে হাতের কাজ করে।

আয়েনউদ্দীন চৌকিদার স্কুল থেকে মাসুমার মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে পাঁচ কেজি জিলাপি কিনে খুশিতে বাড়ি আসে। নিজে খুব বেশি না পড়তে পারলেও ছেলে মেয়েকে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।  মাসুমা দ্বিতীয়  বিভাগে আর্টস গ্রুপ থেকে মাধ্যমিক উতরেছে। আশে পাশের দুএক ঘরে কামেলার শাশুড়ি জিলাপি দিয়ে আসে মেয়ের পাশের খবর দিয়ে।

কামেলা হঠাৎ যেন মন খারাপ করে বসে। সেও এমন পাশ দিতে পারতো। আব্বা কেন যে এতো তাড়াতাড়ি আমারে বিয়ে দিলো। আব্বার অবস্থা তো এদের থেকে ভালো তাহলে কেন আমারে পড়াইলো না।

মাসুমার পাশের খবর শোনার পর থেকে এসব চিন্তা তার ভেতর নদীর মাঝখানে হঠাৎ জেগে ওঠা চরের মতো জেগে উঠেছে।

আর সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও আয়নুল বুঝতে পারে একটা কিছু হয়েছে।

তুমি দেখি মন খারাপ কইরে থাকো। বাপের বাড়িততে ঘুরে আসলি ভালো লাগবেন।  তোমারে কাল নিয়ে যাবো।

আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে  মাসুমা আর আয়নুল ঝকঝকে চেহারা, বাবার মতো তবে তেমন দীর্ঘদেহী না। মাঝারি গড়নের।

কলেজে পড়াকালীন এক ধনী পরিবারে মাসুমার বিয়ে হয়ে যায়। পাত্র বাবা-মার একমাত্র ছেলে। তারা এমন সুন্দরী আর গরীব ঘরের মেয়ের খোঁজ করছিল যাতে করে সংসারে বৃদ্ধ বয়সে আরাম আয়েসে দিনানিপাত করতে পারে।

মাসুমার বিয়ে হয়ে গেলে কামেলার দুপুরটা কেমন নিরস লাগে। আয়নুল অধিকাংশ দুপুরে ঘুমিয়ে থাকে। সাইকেল চালিয়ে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কামেলা কোন দুপুরে হয়তো পাশে শুতো, কোনদিন মাসুমার সাথে গল্প করতো। এখন মাসুমা শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে পাশের বাড়ির বউ ঝিদের সাথে হয়তো কোনদিন গল্প করে। শাশুড়ি পুরানো শাড়ি দিয়ে কাঁথা পেড়েছে । দিন দুয়েক সুঁই সুতো নিয়ে কাঁথা সেলাইয়ের ঝোঁক চেপেছিল কিন্তু দুজনের সেলাই ভিন্ন হবে বলে তাতে হাত লাগাতে দেয় নি কারণ এইসব কাঁথা বড়লোক জামাইয়ের বাড়ি পাঠাবে কামেলার শাশুড়ি। কামেলাকে আলাদা কাঁথা পেড়ে দিয়েছে, ও সেটা নিয়ে আজকাল দুপুরটা পার করে।

আয়নুল বাইরে এসে আড়চোখে কামেলাকে ঘরে ডাকে।

কামেলা কাঁথা গুটিয়ে রেখে ঘরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দেয়।

মাসুমা এ বাড়ি আসলে তার গা ভর্তি গহনা, দামি শাড়ি তাকিয়ে দেখে। তার বাবাও তাকে যৎসামান্য অলঙ্কারাদি দিয়েছে কিন্তু তা মাসুমার সজ্জার কাছে যেন ম্লান মুখে তাকিয়ে রয়। মাসুমার জামাই ধনীপুত্র হলেও বেশ মানবিক। বিয়ের পর জয়নুলের পড়া বা ছোট শালির বিয়েতে বেশ সাহায্যে করেছে। তবে এ বাড়িতে কম আসে। অধিকাংশ সময় মাসুমা একাই এসে ঘুরে যায়। সাথে করে কামেলার জন্য হয়তো এটা ওটা, মার জন্য শাড়ি, বাবার জন্য লুঙ্গি ছোট ভাই জয়নুলের জন্য প্রয়োজনীয় ছোটখাট জিনিস আনে।

আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের সেবার খুব একটা অসুখ করলো। বিছানায় পড়ে ছিলো মাস পাঁচেক, সে সময়টা বাবার হয়ে জয়নুলকে দিয়ে কাজ করিয়েছিল পরিষদ।

জয়নুল লেখাপড়ায় আর আগায়নি। আয়েনউদ্দীন বলে কয়ে চাকরিটা জয়নুলের জন্য  করিয়ে নেয়। তাছাড়া আয়েনউদ্দীন একটু চঞ্চল চিত্তের অধিকারী। এসব চাকরি তার ভালো লাগে না কিন্তু সংসারের জ্বালা তো কম নয়। এতোদিন করেছে এখন ছেলেরা বড় হয়েছে। জয়নুলের বিয়ে বাকি। তা সে হয়ে যাবে। আয়নুলের মার সাথে তাই আলাপ করে সেই মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তুমি যে চাকরি করবা না ছেলেরা আমারগা খাতি পরতি দেবে তো? আয়নুলের মার সংসারে বাস্তবতা বুঝ  খুব বেশি। স্বামী আর চাকরি করতে চায় না শুনে ভয় পায় ভবিষ্যতের।

তুমি অতো ভেবো না এট্টা উপায় তখন করে নিবানি।

কী করবা? মেয়ের বাড়ি গে উঠবা?

আরে না কী যে কও না তুমি। পরিস্থিতি বুঝে সামাল দিবানি। এখন আমারে এক কাপ চা দেও। নাতনি রে নিজের চাদরের মধ্যে ঢেকে নিতে নিতে আয়েনউদ্দীন চৌকিদার বলে।

মেয়েটার বয়স দুবছর হতে না হতেই কামেলার আবার মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম মেয়ে তাই খুব করে চাচ্ছে এবার একটা ছেলে হবে। ওর শাশুড়ি, মা শারীরিক লক্ষণ দেখে আগেভাগেই বলেছে এবার বউয়ের ছেলে হবে।

আয়নুলের ছেলে-মেয়েতে কোন মাথাব্যথা নেই। এখন সংসারটা বড় হচ্ছে। তার খাটুনি বেড়েছে। বাড়িতে দুটো দুধেল গাই এসেছে,আছে আরো দুটো এঁড়ে  বাছুর। দুবছর পর যে কোন কোরবানির হাটে বেঁচে দেবে। কামেলার শ্বশুর শাশুড়ি এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

কামেলার আঁতুড়ঘরের সময় ঘনিয়ে আসে। এবার আর বাপের বাড়িতে যাবে না। এ বাড়িতে থাকবে। সে জন্য ওর শাশুড়ি বাড়তি কিছু কাজ আগেভাগেই  গুছিয়ে রাখে।

কিন্তু কে জানে কোন নিয়ম আর বিধির বেড়াজালে মানুষ আটকে যায়। কামেলার এবার জটিলতা দেখা দেয় সন্তান প্রসবে।

সদরে হসপিটালে ভর্তি থাকতে হয় প্রসবের তারিখের পনের দিন আগে। কামেলার মা আর শাশুড়ি পালা করে থেকেছে হসপিটালে। আয়নুল সকাল সন্ধ্যা গিয়ে দেখে এসেছে।

কিন্তু কামেলাকে দেখে আয়নুলের বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। ধুকধুকানি বাড়ে। হসপিটালে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওয়ার্ডে ঢুকলে ওর দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। চারিদিকে মরাগন্ধে গা গুলিয়ে আসতে চায়। বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। কামেলার সাথে হয়তো কোনদিন চোখাচোখি হয়, কোনদিন দুচারটে কথা, কিছু লাগবে কিনা এইসব।

তুমি মেয়েটারে যত্ন করে রেখো।

সে তোমার ভাবতি হবে না, আয়নুল আশ্বস্ত করে কামেলাকে।

দুগ্ধপোষ্য মেয়েটাকে রাতে আয়নুল রাখে। দিনের একসময় মায়ের কাছে নিয়ে আসে। দেখিয়ে নিয়ে বাড়ি যায়।

তবে শেষ পর্যন্ত খুব  বেশি জটিলতা ছাড়াই কামেলা দ্বিতীয়বার কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়।

তিনঃ

লোকে নানান কথা কয়

বিষয়ডা কী?

বলে বাড়িতে সোমত্ত ছেলে, অল্প বয়সি বউ।

আয়েনউদ্দীন গুম মেরে বসে থাকে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে।

ডুকরে কেঁদে ওঠে আয়নুলের মা

আমার সোনার বাবা, কলজের টুকরা কোথায় হারায় গেলো।

কামেলা ঘর থেকে কান্নার শব্দ পায়। বড় মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে, ছোটটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবা একেবারে  নিয়ে যেতে চেয়েছিল সে যায় নি। বলেছিল, খাই না খাই এ বাড়িতে  আমি পড়ে থাকপো আব্বা।

আমি আমার স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যাবো না।

চোখ মুছতে মুছতে কামেলার বাবা ফিরে গিয়েছিল।

আর আজ সে শাশুড়ির মুখে এ কোন কথা শুনছে।

মা, আমি কি এমন কোন খারাপ কাজ করিছি যে মানুষ বদনাম করে।

আয়নুলের মা তখনো মৃদু বিলাপ করছে। আয়েনউদ্দীন চৌকিদার গুম ধরে বসে আছে।

কথাটা বলে কামেলা আবার ঘরে যায়। তার খুব কান্না পায়। তার একার পৃথিবীতে সে যে খুব অসহায় সেটি বুঝতে পারে। চারিদিকের মানুষের নোংরা ইঙ্গিত বুঝতে পারে।

তুমি আমারে এভাবে রাইকে কেন চলে গেলে? এখন কী করবো আমি? আমি কি বাবার বাড়ি চইলে যাবো? আয়নুল কোন উত্তর দেয় না শুধু সে রাতে আয়নুলের সেই গোঙানির মতো শব্দ তার কানে আসে।

শব্দ শুনে ধড়ফড় করে জেগে উঠে সে টর্চ জ্বালিয়ে হারিকেন ধরিয়েছিল। আয়নুলের মুখ দিয়ে ফেনার মতো বের হচ্ছিল । কয়েকবার সে আলিমার  বাপ বলে ডাকে কিন্তু কামেলার ডাকে সাড়া দেবার পরিবর্তে আয়নুলের হাতে পায়ে তখন খিঁচুনির মতো হয়। কামেলা ভয়ে মেয়ে দুটোকে টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে ডাকতে থাকে।

কী যে হয়েছিল কেউ বুঝতে পারেনি। সকালে উঠে দুধ নিয়ে বাজারে গেলো, বাড়ি এলো মেয়েদের কোলে নিলো। সুস্থ মানুষ রাতের বেলা নাই হয়ে গেলো।

কামেলার চোখ বেয়ে অস্ফুট কান্নার ধ্বনি জল হয়ে নামে। বড্ড গরম সে অশ্রু ওর মুখটা যেন পুড়িয়ে ফেলে। কাপড় দিয়ে জল মুছে নেয়। স্বামীর হাতঘড়ি নিয়ে হারিকেনের ঘোলাটে আলোয় সময় দেখে। দশটা শীতকালে অনেক রাত। কেমন অবসন্ন ঘুমে কামেলার চোখ যেন ভেঙে পড়ে।

জয়নুল সংসারের হাল ধরেছে। বড় ছেলে মরে যাবার পর আয়েনউদ্দীন চৌকিদারের শরীর ভেঙে পড়েছে। তেমন কিছু করতে পারে না অথচ তার বয়স তো এমন কিছু হয় নি। এ বয়সে সবাই প্রায় কর্মক্ষম থাকে। কামেলার শাশুড়ি কাজের মধ্য হঠাৎ বারান্দায় বসে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এভাবে ঐ সংসারটির চাকা এগিয়ে চলছিল। কিন্তু বাঁধ সাধে পাড়া প্রতিবেশীদের  কানাঘুষা। সোমত্ত অল্প বয়সি বউ, জোয়ান দেবর একটু হলেও তো ছোঁয়াছুঁয়ি লাগে।

পাড়া প্রতিবেশীরা বলে জয়নুলকে বিয়ে করাতে। তাহলে বিধবা বউয়ের এ বাড়িতে থাকতে আর কোন বাঁধা  থাকবে না।

আয়েনউদ্দীন চৌকিদার কদিন ধরে খুব এ বাড়ি সে বাড়ি করে সবার পরামর্শ নিয়ে  জয়নুলের বিয়ে ঠিক করলো।

আব্বা এ বিয়ে আমি করতি পারবো না, জয়নুলের একটাই কথা।

তাইলে তো বউডারে আমি এ বাড়িতে রাকতি পারবো না বাপ, মেয়ে দুটো জলে ভেসে যাবে।

জয়নুল মাথা নিচু করে থাকে।

আয়েনউদ্দীন ছোট নাতনিটারে ছেলের কোলে বসিয়ে দিয়ে  বলে, এগোরে নিয়ে আমি ছেলের শোক ভুলে আছি। এরা গেওরুলে আমি কেমন করে বাঁচবানি  বল।

জয়নুল ভাইঝিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে ঘরে যায়।

চারঃ

শুক্রবার জুম্মার আগে কামেলার দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয় দেবর জয়নুলের সাথে। আয়নুল  তখন কামেলার জীবনে গীতিময় স্মৃতি। কামেলাও বেঁকে বসেছিল।

ইঠা হয় না মা। আমি কী করে জয়নুলরে বিয়ে করবো,  কাতর কণ্ঠে কামেলা বলেছিল।

যুদ্ধ চলেছিল কামেলার ভেতর। এক মহাযুদ্ধ! বারবার পরাজিত বয়ে উঠে দাঁড়ায় আবার যুদ্ধ করে। সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত তবু মাতঙ্গিনীর ন্যায় যুদ্ধ চালিয়ে যায়। জিততে তাকে হবেই। কিন্তু প্রচণ্ড লড়াইয়ে কামেলা পরাজিত হয় যখন দুসন্তান প্রতিপক্ষের তরবারির নিচে।

তুমি কেন রাজি হলে? আমার না হয় উপায় ছেলো না? তুমি বাড়িততে চলি যাইতে।

বাপ- মা, সকগোলে মিলে আমার কী সর্বনাশটা না করলো।

হা ভালোই শোনাইলে। পুরুষ মানষের আবার সর্বনাশ!

অস্পষ্ট আলোয় এই প্রথম ভালো করে জয়নুল কামেলাকে দেখে। এতোদিন যে চোখে দেখেছে সেই চোখ একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে।কেমন যেন মায়া হয়। ঘুমন্ত দুমেয়ের মুখের দিকে তাকায়। দুজনে একটা প্রভাতের অপেক্ষায় থেকে রাত পার করে।

শীতের শেষে পর্ণমোচী বৃক্ষে নতুন পল্লব সৃষ্টির মতো সংসার আবার শুরু হয় কামেলার। জয়নুলও মায়ার পড়ে মেনে নেয় সবকিছু কিন্তু ভিতরের ফাটলটা কোন ফাঁকে দিনে দিনে যেন আরো হা হতে থাকে। দ্বিতীয় মেয়ে জন্মের সময় কামেলার সন্তান ধারণ ক্ষমতা রোহিত করে নিয়েছিল আয়নুল, সে কথা কামেলা আর আয়নুল ছাড়া সংসারে আর কেউ জানতো না।

জয়নুল এখন নিজের সন্তান চায়। নিজের বীর্যে বংশ চায়। কামেলা তাকে তা কোথা থেকে এনে দেবে? ভয়ে ওর শরীর হিম হয়ে আসতে চায়। যে কথা এতোদিন ছাই চাপা ছিলো তা এখন স্ফুরিত আগুন হয়ে কামেলাকে পোড়াতে চায়।

সংসারটা কামেলার কাছে বিষ মনে হয়। জয়নুল প্রতি রাতে কামেলার কাছে সন্তান ভিক্ষা করে আর কামেলা পাত্র নিয়ে বোবার মতো চেয়ে থাকে।

অনেক দিন হইলো আমি কি বাবা ডাক শোনবো না?

মাইয়া দুইটা তোমারে ছোট আব্বা ডাকে, তারা কি তোমার কেউ না?

তা কি আমি বলিছি? ওরাও আমার সন্তান কিন্তু আমার নিজের একটা চাই। আমারে শুধু একটা ছেলে সন্তান দেও, মেয়ে তো আছেই।

জয়নুলের চাওয়ায় কোন অন্যায় নেই কামেলা তা বোঝে। চুপ করে থেকে এতোদিন পাশ কাটিয়েছে। এবার সে জয়নুলকে জানিয়ে দেবে সব। যে ঝড় আসবেই তার থেকে আর কতোদিন পালিয়ে থাকবে ,তার চেয়ে আসুক।

তোমারে একটা কথা জানান দরকার।

জয়নুল পাশ ফিরে কামেলার দিকে ফেরে

কী কথা?

কামেলা ইতস্তত করে। ঘরের পিছনে পুকুর পাড়ে ঝি ঝি পোকা ডেকে চলে রাত গভীর না হতেই। কামেলা কান পেতে সে শব্দ শোনে।

বুকের মধ্যে এলোপাথাড়ি হাতুড়ি পড়ে।

চুপ কইরে আছো যে? কী কথা বলবা বলো।

আমার আর সন্তান ধারণের ক্ষমতা নাই।

বুঝতি পারলাম না। ক্ষমতা নেই মানে কী?

ছোট মেয়েটার জন্মের সময় আমি আর তোমার ভাই মিলে আর বাচ্চা কাচ্চা নেবো না ঠিক করে সন্তানের নাড়ি ফেলায় এসেছি।

জয়নুল গুম মেরে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, বিয়ার আগে আমারে জানাওনি কেন যে তোমার আর ছেলেপুলে হবে না? আমার বাপের বংশ রক্ষা কী করে হবে? আমার কি নিজের সন্তানের বাপ ডাক শুনতি ইচ্ছা করে না?

কামেলা চুপ করে থাকে কোন উত্তর দেয় না। জয়নুল ঘুমিয়ে পড়েছিল কিন্তু কামেলার সে রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল।

কামেলার শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যাপার টা শোনার পর থেকে মুখ থমথমে করে থাকে। মুখে কিছু না বললেও কামেলা বোঝে এ বাড়িতে তার দিন ছোট হয়ে আসছে। মনের মধ্যে তীব্র ক্ষরণে থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাসে কামেলার দিন কেটে যায়। সারাদিনে জয়নুল ছোটখাটো দুয়েকটি কথাও বলে না তার সাথে। দুপুরে খেতে এসে মায়ের কাছে ভাত চায়। কামেলা ঘরে গেলে জয়নুল ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

রাতে একঘরে বাস হলেও দুজন দুমেরুর বাসিন্দার মতো পরস্পরের কাছে অচেনা হয়ে ওঠে দিনে দিনে।

সংসারের কাজের মধ্য কামেলার সময় কাটলেও রাত যেন আর কাটতে চায় না।

বড় মেয়েটা তেমন বুঝতে না শিখলেও মার মুখের দিকে ক্ষণে ক্ষণে তাকিয়ে থাকে আর ছোটটা তো কিছুই বোঝে না।

 সময় সবকিছু থরে থরে সাজিয়ে রাখে শুধু গতি মাড়িয়ে সে জায়গায় গিয়ে পৌঁছানোটাই বাকি থাকে। কামেলার শাশুড়ি ইনিয়ে বিনিয়ে জয়নুল যে আবার বিয়ের করতে চায় সে কথা শোনায়। কামেলা কখনো মন স্থির করে শোনে কখনো বা  কাজে ব্যস্ততার মধ্যে যেটুকু কানে আসে। প্রচণ্ড মানসিক চাপে ধীরে ধীরে ওর শরীর পাড় ভাঙা নদীর মতো ভাঙতে থাকে। মাঝে মাঝে কথার মধ্যে অসংলগ্নতা দেখা দেয়। কামেলার বাবা আসে নিয়ে যেতে। মেয়ের দিকে দেখে বাবার বুকটায় কাল বৈশাখের মাতম ওঠে।

আমার সঙ্গে  চল মা। আমি বাঁইচে থাকতি তোর মেয়ে দুইডার কোন কষ্ট হবে না।

না আব্বা, আমি তোমারগা বাড়ি গেলি আর ফিরে আসতি পারবো না।

এবারও ভাঙা বুক নিয়ে কামেলার বাবা ফিরে গেছে মেয়েকে রেখে।

কামেলা সবসময় স্বভাবে কোমল। কখনো কারো সাথে ঝগড়াঝাঁটি করেনি আর স্বামীর সাথে ঝগড়া তো দূরে থাক সামান্য কথা কাটাকাটি করতেও তার হাঁপ লাগে। আজকে সে বুক ভরে দম নিয়ে জয়নুলকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি নাকি আবার বিয়ে করতি চাও।

কোন সাড়া না পেয়ে কামেলা পাশ ফেরে।

তা তুমি কি বলতি চাও তোমারে নিয়ে আমি সারাজীবন আটকুঁড়ো অপবাদ মাখপো গায়।

বাপ-মা এক বুড়িরে আমার সাথে বিয়ে দেলো তাও মেনে নেলাম, এখন আবার আমি নিজে বাবা হতি পারবো না। এরপর জয়নুল যা করলো কামেলা তা ভাবেনি।

ধুততরি বলে জয়নুল দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে যায়।

এতো রাতে কনে যাও? কনে যাও? কামেলার আকুতিকে উপেক্ষা করে জয়নুল বেরিয়ে যায়। সে রাতে আর ঘরে ফেরেনি জয়নুল।

কিন্তু কামেলার এবার বাবার বাড়ি ফিরে যাবার পালা। দিনে দিনে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়লো, কথাবার্তা তেমন বলতো না, কাজও করতো না তেমন। অধিকাংশ সময় মাটির বারান্দায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকতো। নিজের সাথে কথা বলতো ঠোঁট নেড়ে নেড়ে। ঘোমটার বহরটাও বেড়েছিল।

একদিন বড় মেয়েটাকে দাদা দাদির জোরাজুরিতে এ বাড়িতে রেখে ছোট মেয়েটাসহ কামেলাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর বাবা এসে। কিন্তু কামেলা আর ফিরে আসেনি শ্বশুর বাড়িতে।

ওর জাগতিক কোন ভাবনাও ছিলো না শেষের দিকে। মেয়েকে আর কাছে নিতো না; সবার মুখের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতো। অবশেষে একদিন দুমেয়ে,বাবা-মা আর  সবাইকে রেখে কামেলা পাখি হয়ে গেলো।

বলাকার সারির সাথে কামেলাও উড়ে গিয়েছিল দিগন্তের ওপারের বিস্তৃত রেখায়।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top