সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব পাঁচ) : শাহান আরা জাকির 


প্রকাশিত:
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:১৪

আপডেট:
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:১০

 

অনেক্ষন বৃষ্টি হয়ে গেলো আজ। মনের সমস্ত গুমোটভাব কেটে গেছে নীলিমার। রাতুল চলে যাবার পর থেকে জীবনটা একেবারেই ভিন্নমুখী মনে হয় তার কাছে!যেন প্রবহমান এক বহতা নদী। কখনো কানায় কানায় ভরে ওঠে মাঝির দরাজ গলার ভাটিয়ালি গান হয়ে। কখনও চারকুল ভেঙ্গে ভয়াল বন্যায় ডুবিয়ে তোলপাড় করে দেয় জীবনের ভয়াবহ পরিণতি।

ভাঙাগড়ার খেলা চলে জীবনভর।

ভাবতে ভাবতেই চোখ চলে যায় দূরের ঐ নীল পাহাড়ে। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে পাহাড়ে ছাউনি দেয়া আকাশটাকে। স্নিগ্ধ নীল সাদা আকাশটা আজ খুব বেশি বৈচিত্রে ডুবে আছে। ঝরঝরে মিষ্টি রৌদ্র। আকাশ  আর পাহাড়ের নীলাবরণ সমস্ত ধরিত্রীকে অদ্ভুত সুন্দর রূপে মোহিনী হয়ে উঠেছে। হঠাৎ বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে ওঠে নীলিমার। এইতো বেশি দিন নয়। বছরখানেক আগের কথা।

রাতুলকে ভুলে থাকতে মনের সাথে লড়াই চলে নীলিমার দিবানিশি সারাক্ষন। এই আকাশ, মেঘ আর নীল পাহাড় তার মনভোলানো চলার সাথী। 

এরকম একটা দিনেই এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছিলো তার জীবনে।

অতীতের নানাকথা এড়িয়ে সেদিন ও আকাশ মাটির খেলা দেখছিল নীলিমা।

হঠাৎ কে এসে পেছন থেকে নীলিমার চোখ দুটো চেপে ধরে।

- বলতো কে নীলু? ঠিক ঠিক বলবি কিন্তু।
- নীলু! এই নামেতো খুব আদর করে আমার ভালোবাসার প্রিয়জন ছাড়া কেউ ডাকেনা! এই নামে খুব বেশি ডাকতো বাবা আর মা!তারপর খুব কাছের বন্ধুরা!
- উহ খুব লাগছেরে। কে তুই মালতি। না হয় মিন্না?
- উঁহু দোস্ত। একজনের নাম বলো।
- তাহলে বেলি!
- হু ۔۔না পারলে তোর চোখ দুটো আমি গলিয়েই ফেলতাম।
- কিন্তু তুই আমার ঠিকানা পেলি কোথায়?আমিতো যখন তখন এখানে ওখানে ছুটে বেড়াই।
- ফেস বুক থেকে তোর সব খবর পাই!তুই জানিস ও না।
- তাই নাকি?
- নিশ্চই তুই অন্য নামে আছিস।
- হ্যা রে, আসল নাম থাকলে, কবে খুন এর খবর হতো আমার।
- কি বলছিস বেলি এসব?

হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বেলি।

- ঘটনা কি খুলে বল বন্ধু! মিরাজ ভাই কেমন আছে? তোর না একটা মেয়ে ছিল?
- এখনো আছে। আমার পুতুল সোনা! ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো নারে নীলু। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা!
- কি হয়েছে ওর?
- তুলকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে নীলু!
- বলিস কি? কেন? আমিতো তোদের হ্যাপি ফ্যামিলি হিসেবেই জানতাম এতদিন!
- হ্যাপি আমি কোনদিনই ছিলামনারে!প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম বাবা মায়ের অমতে, জানিসই তো!
- চল চল ভেতরে চল!

একটু ফ্রেস হয়ে নে। তারপর সব শুনব।

বেলি ওয়াসরুমে চোখে মুখে পানি ছিটোয়। আয়নায় নিজের চেহারায় রক্তের ছাপ দেখে চমকে ওঠে। এতো রক্ত এখনো লেগে আছে চোখে মুখে।

নীলিমা খেয়াল করেনিতো?

তাড়াতাড়ি বেশি বেশি পানি ও সাবান দিয়ে পুরো মুখটা ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলে।

-কি হলো বেলি। গোসল করছিস নাকি?
-নারে! হাতমুখ ধুলোবালিতে ভরা ছিল।

ট্রেনে খোলা জানালার পাশে সিট ছিলতো।

- ট্রেনে আসছিস! ইস ট্রেন জার্নি আমার সবচে প্রিয় জানিস!তোর বাড়িতে আমায় নিয়ে যাবি বেলি?
- আহারে দোস্ত!আমিতো এখন ঘরপোড়া গরু।
- থাক! সমস্যা নেই! আয় চা নাস্তা করতে করতে সবকিছু শুনবো তোর।
- এতবড় বাড়িতে তুই একা থাকিস নীলু । তোর স্ট্যাটাসগুলো পড়ে পড়ে,তোর প্রতি কি যে ভালোবাসা গাঢ় হয়েছে আমার জানিসনা!তোদের সব প্রেমপত্রতো আমাদের বাসার ঠিকানায়ই আসতো।
- হুঁ । তোর ঘটনা বল এখন শুনি।
- আসলে হারামজাদা ছিল এক বিকৃত রুচির মানুষ নামের অমানুষ। নিজস্ব এড ফার্মের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের কাজে আমাকে ব্যবহার করতো। প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি! সাজগোজ পছন্দ করতাম খুব জানিসতো। মিরাজ অনেক দামি দামি শাড়ি, কসমেটিক্স কিনে দিতো! ইচ্ছেমত সেজেগুজে বিজ্ঞাপন করতাম। বুঝতে পারিনি তখন মিরাজের আকাশছোয়া স্বপ্নের কথা। দিনে দিনে তার লোভ তুঙ্গে উঠলো। বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার সাথে যুক্ত হলো। আর আমি হলাম তার উপরে ওঠার হাতিয়ার। বুঝতে পেড়ে নিজের সম্ভ্রম ও চরিত্রকে রক্ষা করতে প্রতিবাদ করলাম। মিষ্টি কথা ও আচরণ দিয়ে নানাভাবে আমাকে কনভিন্সড করার চেষ্টা করলো মিরাজ। এতকিছুর পরেও একদিন সে নিজে নিয়ে গেলো এক পাচঁতারা হোটেলে। গল্প করতে করতেই কখন পিছটান দিল, এক নরপিশাচের হাতে তুলে দিয়ে। ভোর হলে জানলাম, আমি বিক্রি হয়ে গেছি নীলু ! আমি বিক্রি হয়ে গেছি! যৌবন পার হয়েছে এভাবেই আমার। এখন আমার গ্ল্যামার নেই। তাই আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলার মতো ফেলে দিয়ে উর্বসীদের নিয়ে মাতাল থাকে সমাজের উঁচু মাপের মিরাজ চৌধুরী!

এটা দ্যাখ বন্ধু!

- কি ওটা?
- ডিভোর্স লেটার! এতদিন তিলে তিলে সব সহ্য করেছি শুধু আমার কইলজার টুকরা আদরের অরুণিমার জন্যে!ওকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারিনা নীলু!

বেলীকে কি বলে সান্তনা দেবে ভেবে পাচ্ছিলোনা নীলিমা।

হঠাৎ নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে বেলি চিৎকার করে উঠলো ভয়ানক বিকারগ্রস্ত এক অস্বাভাবিক মানুষের মতো।

- নীলু আমি মিরাজকে খুন করেছি! হ্যা হ্যা ۔۔۔এই দেখ আমার সেমিজে রক্ত, হাতে রক্ত শুকিয়ে গেছে!
- বেলি! কি সব আবোলতাবোল বলছিস!
- বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছি একটি সুযোগের জন্য! কিছুতেই পারিনি। লোক লাগিয়ে পাহারা দিয়ে রেখেছে আমায়। মেয়েটাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে আমার সংস্পর্শে রাখেনি। মাতৃত্ব কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। চোখের সামনে অশুচি কীট নিয়ে মাতাল থেকেছে দিনের পর দিন। ৩০ বছর পর আজ নেশাখোর মাতালএর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পেয়েছি। আর এক মুহূর্তও দেরি করিনি ! ঠিক বুক বরাবর চাকুটা ঢুকিয়ে দিয়েছি!
- বেলি, বলিস কি!
- বিশ্বাস করছিস নাতো! ভাবছিস এতো শান্তশিষ্ট লাজুক মেয়েটি এমন হলো কি করে? কেন যেন খুব মনে পড়ছিলো তোকেই! কত সুখী ছিলি তোরা! কিভাবে একা হয়ে গেলি! ভালো মানুষেরা বেশিদিন বাঁচেনারে! তুই ছিলি আমার শৈশবের সুখ দুঃখের খেলার সাথী!তাই ঠিকই খুঁজে বের করেছি ! আমি যাই ۔۔۔আমি যাই বন্ধু--- বাই ۔۔۔۔

একরকম উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়িয়ে গেলো বেলি!

পরদিন সকালবেলা পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হলো দুটি খবর। একটি ۔۔۔'প্রখ্যাত শিল্পপতি মিরাজ চৌধুরী নিজস্ব বাসভবনে রহস্যজনকভাবে  খুন '! আর একটি ۔۔۔'ট্রেনে কাটা পরে শিল্পপতি মিরাজ চৌধুরীর স্ত্রী হোসনে আরা বেলি 'র রহস্যময় মৃত্যু'!

পত্রিকা হাতে নিয়ে বোবা হয়ে গেলো নীলিমা। এসব কি ঘটে যাচ্ছে তার চোখের সামনে। এই প্রশ্ন নীলিমার সারা জীবনের শঙ্কা হয়ে গেঁথে আছে। কেউ জানেনা! কাউকে বলতে পারেনি আজো! কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ঘুন পোকার মতো। স্মৃতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যখন তখন। আর নীলিমার সেই দুঃসময়ের অসহনীয় যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দেয় দূরের ঐ নীল পাহাড়ের চূড়া।

নীলিমা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। আর দুচোখ ভরে পাহাড়ের ঘন নীল এঁকে নেয় তার গভীর কালো চোখ দুটিতে।

চলবে

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top