সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধ বালক বাঘা : প্রণব মজুমদার


প্রকাশিত:
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩৩

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ১২:৫২

 

- গুছিয়া লও! ঢাকায় পাক আরমি নাকি ঢুইক্কা পরছে! বিকালের মদ্যই তমরা কাশিমপুর চইল্লা যাও। এদিকটা আমি দেকতাছি। পরিসথিথি ঠানডা অইলে রবিরে লইয়া আইয়া পরবা!


বাঘার বাবা শহরের নামকরা চিকিৎসক। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি অনেক উদ্বিগ্ন! সকালে ডিসেপন্সারীতে যাবার সময় মাকে তিনি নির্দেশ দিয়ে গেলেন! মা চুপসে যান! মার্চ মাসের শেষ প্রায়। ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে পরীক্ষা শেষ হয়নি। বড় ছেলে বাবুল ও মেজ ছেলে স্বপন বাসায় নেই ক’দিন ধরে। এ অবস্থায় গ্রামের বাড়ী কিভাবে যাবে তা নিয়েও দুঃচিন্তা ! প্রস্তুত নন এমন ভাবনা নিয়ে মা উত্তর দেন।
- তুমি জানলা ক্যামনে ঢাকার অবচতা খারাপ ?
- রেডুতে কইছে! পচিশা মারচের রাইতে পাকিসতানি আরমিরা ঢাকায় অনেক মানুষ মাইরা ফ্যালাইছে! শেক সাবেরে এরেষ্ট করছে। এরেষ্টের আগে কাইল বেসি রাত্রে উনি যুদ্দর এনাউন্সমেন্ট করচেন। অবচতা বালো না!
বাঘাও ভাবনায় পড়ে গেলো! প্রথম সাময়িক পরীক্ষার মাত্র দু’টি বিষয় সম্পন্ন হয়েছে! গণি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণী শিক্ষক রঞ্জিত স্যার অংক করান। দুষ্টু ও সাহসী বলে তিনি ওকে নাম দিয়েছেন বাঘা! অংক পরীক্ষার দিন স্যার বলেছেন, ‘দেখিস বাঘা চতুর্থ শ্রেণীতেও তোর প্রথম অইতে অইবো।’ বার্ষিক পরীক্ষায় অংকেতে তৃতীয় শ্রেণীর মতো একশোতে একশো পাওন লাকবো!’ এ সময় গ্রামের বাড়ী গেলে পড়াশুনার ক্ষতি হবে এমনটাই ভাবছিল ফার্স্ট বয় বাঘা!


দুপুরে মামাতো ভাই সুবলকে নিয়ে চাঁদপুর কোর্ট ষ্টেশনে গেলেন বাবা। লাকসাম লোকাল ৬ ডাউনে বলাখালের সাতখানা টিকিট কেটে অপেক্ষা করছেন তিনি। বড় মনু, ছোট মনু, আবু, ভুতু ও বাঘাকে নিয়ে মা পৌছে গেছেন ষ্টেশনে। বাবার রোগী ও পরিচিত টিটিই মোজাম্মেল কাকা। বাঘাদের সাতজন যাত্রীকে রেলগাড়িতে বসিয়ে দিলেন তিনি।
দূর গ্রামের জিনিস ও গাছগুলো ঘুরছিলো অবিরত! ঝিকির ঝিকির গতিময় শব্দে চলা কয়লার রেলগাড়ি থেকে তা দেখছিলো বাঘাও! গাড়ীর জানালা থেকে সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে খুব আনন্দ পাচ্ছিলো আবু ও ভুতুও। সাহাতলী ষ্টেশনে বিপরীত থেকে আসা ট্রেন ক্রসিংয়ের জন্য অনেকটা সময় অপেক্ষায় ছিলো ওদের গাড়ী। দুই ষ্টেশন পার হয়েই বলাখাল। দেড় ঘন্টা সময় যেন মুহূর্তেই ফুরিয়ে গেলো! মামাতো ভাইকে নিয়ে পায়ে হেঁটে বলাখাল স্টেশন থেকে কাশিমপুরে উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা! ছয় মাইল দূরত্বের পায়ে হাঁটা পথ কাশিমপুর! মাঝখানে রামপুর বাজারে যাত্রা বিরতি। সবাই রোদে হেঁটে ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত! একটা খুপড়ি ঘরের সামনে বেঞ্চিতে বসলো ওরা সবাই। উরপুর গ্রামে বাড়ী বলে নিকটস্থ বাজারটা সুবলের বেশ চেনা। যাত্রাপথের জন্য বাবা সুবলকে টাকা দিয়েছেন। সে টাকা দিয়ে একটি খাবার দোকান থেকে জিলিপি নিয়ে এলো সুবল! বাঘা, আবু ও ভুতু তা পেয়ে বেজায় খুশি! কিন্তু মনুরা তা খাবে না! তাদের আবদার আনতে হবে গুড়ের মুরালি! কথা অনুযায়ী তা আনা হলো। মায়ের প্রিয় ঘন দুধ চা ও একটি বাবুল বিস্কুট আনলেন সুবল। সবার খাবার চাহিদা পূরণ হলো! তা খেয়ে সবার শরীরে যেন শক্তি পেলো! ফের হাঁটা! ক্ষেতের আইল দিয়ে হেঁটে উরপুর, খোদাইবিল, রাজারগাঁও হয়ে কাশিমপুর বাজারে যখন ওরা পৌছলো তখন গোধূলি বেলা।


বাঘাদের গ্রামের বসত বাড়ীটা তিন বিঘা জায়গায় মধ্যে! বাড়ীর প্রবেশ মুখে সারি সারি নারকেল, সুপারি, তাল, তেঁতুল ও চালতা গাছ। ডানপাশে দীঘি এবং বা পাশে পুকুর। বিশাল বৈঠকখানার আগে দুটো গরুর ঘর। সামনে খড়ের মাচা ও গরুর তরল খাদ্যের জন্য মাটির তৈরি নাইনদা। মানে গামলা। চারপাশে বাঁশ দিয়ে তা বসানো! থাকার জন্য পাঁচটি ঢেউ টিনের মাটির ঘর। কয়েকটাতে ধান চালের গোলাও রয়েছে। আছে বসত বাড়ীর পাশে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ ৩৩ ধরনের ফলের বড় বাগান। বাঘারও গ্রামের বাড়ীটা পছন্দ। গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রতি বছর রবি কাকু এ বাড়ীতে নিয়ে আসেন বাঘাদের।
মাটির উঠোনে ঢোকার আগেই মজুমদার বাড়ীতে হৈ হৈ রব পড়ে গেলো! ছুটে এলেন বাঘার বড় কাকী ও ছোট কাকী এবং তাদের ছেলেমেয়েরা। মজুমদার বংশে বউদের মধ্যে বাঘার মা সবার চেয়ে বড়। বাড়ী ও গ্রামের লোকজন প্রায় সবাই ওনাকে ডাকেন বড় ঠাইন। সমীহ করে। অনেকদিন পর সবাই ওনাকে পেয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। বাঘা ও ভাইবোনরা নিচু হয়ে মাথা ছুঁয়ে কাকা কাকীদের প্রণাম জানালো। মা কাপড়ে মোড়ানো খুতি থেকে বাবার বাসার যক্ষের ধন রেডিওটা বের করে আনেন প্রথমে ! তারপর ব্যান্ডিজ ও ডেটল। ছোট কাকীকে ডাকলেন কাছে।
- ধরো মুকুল রেডুটা যত্ন কইরা রাখো। তা দেখে সবার চক্ষুতো চড়ক গাছ!
- আইচ্চা বরদি দ্যান!


দুষ্ট বাঘার অনুসন্ধানী চোখ! চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো সে। ঢুকেই বাড়ীর ভেতর পাকা ঘাটের সিঁড়িতে নামে। খুড়াতো ভাই সমীরকে নিয়ে হাত পা পরিস্কার করে বাঘা! সমীর বাগানের একটি গাছে কোকিলের বাসা রয়েছে সে খবর ওকে জানায়। বাঘা জিজ্ঞেস করে বাড়ীর কয়টা হাঁস ও মুরগী এখন ডিম পাড়ে? বাগানে কি কি ফল পেকেছে! মোম আম গাছে মৌচাকটা কত বড় হলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাঘারা এসেছে খবর পেয়ে পরদিন সকালে বোয়াল বাড়ী, নাপিত বাড়ী, দেওয়ানজী বাড়ী, চৌধুরী বাড়ী, ধোপা বাড়ী ও বকাউল বাড়ীর পড়শীরা এক একে চলে এলো ওদের দেখতে। সমীরের বন্ধু সুধীর,নজরুল সুদীপ ও মামুন বাঘার সঙ্গে খেলতে আসে। গন্তব্য ফলের বাগান। আসার সময় ষ্টেশনে বাবা বলে দিয়েছেন বড়দের কথা শুনবে। পড়াশুনা করবে। পুকুরে যাবে না। গুরুজনদের মান্য করবে। দুষ্টুমি করবে না। গাছে ওঠবে না প্রভৃতি উপদেশ। কিন্তু সব প্রতিপালন করলেও দুষ্টুমি বাদ নেই ওর। গাছে আরোহণ নেই থেমে। অব্যবহৃত মাটির হাঁড়ি কলস ভেঙ্গে দীঘিতে চারা নিক্ষেপের মাধ্যমে জলের ওপর এক্কা দোক্কা খেলা চলছে! রবি কাকু গোয়াল ঘর থেকে তা দেখছিলেন। প্রতুৎপন্নমতি ও নির্ভয় প্রকৃতির বাঘা। সেজন্য ভালোবাসেন খুব কাকুও। ওর কাছে নানান প্রশ্ন কাকুর। দেশের পরিস্থিতি খারাপ কাকুও বুঝেন।
- চানপুরের অবস্থা বালা না বলে? তগো আইতে কষ্ট অয়নিতো বাবা?
- না কাকু ! বেশ আরামেই আচিলাম। তবে হাটতে এট্টু কষ্ট অইচে আর কি !
ক’দিন পর বিকেল বেলা নিকট প্রতিবেশি ছোট বোয়াল বাড়ীর শুভাকাংখী অলিউল্লাহ বকাউল এলেন। বৈঠকখানার সামনে উঠোনে জলচৌকিতে বসলেন। অলি কাকুকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে হলো। বাঘা একটি অ্যানেমেলের থালায় করে চা ও সন্দেশ নিয়ে যায় অলি কাকুর জন্য। আরেক হাতে পিতলের গ্লাস। চা পান শেষে মাকে কাকু জানালেন শহর চাঁদপুর থেকে কিছুক্ষণ আগে তিনি এসেছেন। সারাদেশে আর্মির সাঁজোয়া গাড়ি ঢুকে পড়েছে। দু’ একদিনের মধ্যে চাঁদপুরও আমক্রণ করবে এই শত্রু বাহিনী। মায়ের সঙ্গে গ্রামের বিএসসি পাশ পরোপকারী অলি কাকুর নানান বিষয়ে আলাপ।
- বদি চিনতা কইরেন না ! আমগো গেরামের বরো বোয়াল বাড়ীর জিন্নত, সরদার বাড়ীর শফিক আর আমি চানপুর গেছিলাম। আমগোরে ছোডখাডো একটা ট্রেনিং দিয়া দিসে! আমনেতো চিনেন হাজীগঞ্জ অলিপুরের জহিরুল হক পাঠানেরে? হেয় তো আরমি। পাটান ভাইয়ের কাছেই জুবলি ইস্কুল মাটে আমরা ত ট্রেনিং লইয়া আইলাম। আমড়া যুদ্দ করুম।
নিজের ছেলেরা মানে বাঘার বড়দা মেজদার কথা মনে করে মা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়েন।
- বাবুল স্বপনেরে দেকছো ?
- নাতো ?
- আচ্ছা বদি আমনেরা বলে রেডু আনছেন ?
- তুমিও যানচো দেহি !
- আমগো গেরামে কী এইডা আচে ? বালাই অইলো সনদার সময় আমু সবাই মিইল্লা রেডু হুনতে !
- আইচ্চা ! কোনো সমস্যা নাই অলি !
বাঘা, সমীর ও মামুন মিলে বাঘাদের বৈঠকখানার ঘরে চৌকি, চেয়ার, টেবিল, টুল ও বইপত্র গুছালো । বেড়াতে এলে সমীরের সঙ্গে এ ঘরে শোয় বাঘা।


চাঁদপুর থেকে লোক মারফত চিঠি পাঠিয়েছেন বাবা।
চিঠিটা মার উদ্দেশ্যে লেখা !

 

প্রিয়তমা নীলু, আশা করি তোমরা ভালো আছো।্ দেশের পরিস্থিতি ভালো না! যুদ্ধ শুরু হয়েছে। চাঁদপুর শহরেও আর্মি চলে এসেছে। খুব অত্যাচার করছে ওরা। ছেলেদের জামা কাপড় খুলে পরীক্ষা করে দেখে পাক আর্মিরা। কেউ কলমা না বলতে পারলে নির্ঘাত মৃত্যু! আমাদের চেনা কিছু পড়শী ওদের  কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। সহযোগিতা দেয়। ওদের পক্ষ নিচ্ছে। ওদের কাছে খুবি অনিরাপদ মেয়েরা। আমি ওদের চিকিৎসা দিচ্ছি বলে কিছুটা নিরাপদ। ভালো আছি। ইস্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। খবর পেলাম আমাদের ছেলে বাবুল ও স্বপন কলিকাতা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে চলে গেছে। টেলু ও সাগরীকে মনা মামার বাড়ী পিংরা পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি বিমল বোসের বাসায় রাতে থাকি। আকাশে বিমান মহড়া দিচ্ছে। ওপর থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। অনাথ ও রবিকে বলবে ওরা যেন ঘরের আশেপাশে মাটিতে ট্যাংক করে রাখে। বাঘাটা দুষ্টু অনেক, ওকে নিয়ে ভয় বেশি। ইতি  - আমি


চিঠিটা পড়ে মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অনাথ ও রবি কাকুকে মাটির ট্যাংক খোঁড়ার বিষয়টা জানালেন।
সন্ধ্যে হলেই অলি কাকুর নেতৃত্বে কিছু লোক আসে রেডিও শুনতে। তাদের কাঁধে থাকে রাইফেল! বৈঠকখানার সামনে বিশাল মাটির উঠোন। বিছানো বেতের তৈরি শীতল পাটির মাঝখানে কাঠের টুল পাতা। সবাই গোল হয়ে বসে শোনেন রেডিওর অনুষ্ঠান ও খবর। মাঝে মাঝে হাতে তালি দেন কেউ কেউ। আবার কোনো সময় মন খারাপ হয়ে যায় কারো কারো। অলি কাকুর মতো জিন্নত আলী কাকুও বাঘাকে আদর করেন। বাঘাকে তিনি ডাকেন টিবয়! প্রায় সময়ই তিনি বাঘার জন্য কাশিমপুর বাজার থেকে আনেন গোলাপী রঙের গোল লাঠি লজেন্স। অলি কাকু আনেন তিলের খাজা। যতক্ষণ বাঘাদের বাড়ীতে থাকেন ততক্ষণ ওনাদের সঙ্গ দেয় ও। বাঘা বুঝতে পারে দেশের মধ্যে একটা যুদ্ধ হচ্ছে! গ্লাসে করে জল এনে দেয়া, কেরোসিন তেলের কুপি বা হারিকেন সামনে নিয়ে ধরা, চা ও অন্যান্য খাবার বিতরণ এসব কাজ বাঘা নিজের আনন্দেই করে। অলি কাকু গ্রামের মধ্যে বেশ শিক্ষিত ব্যক্তি। বাঘার প্রশ্নবানে অলি কাকু মোটেও বিরক্ত হন না। তিনিও ওনার কার্যক্রমের অনেক কথা বলেন বাঘাকে। তাতে ও নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করে।


কাশিমপুর গ্রাম অনেকটা নিরাপদ। আর বাঘাদের বাড়ীতে সবার কম বেশি সহযোগিতা করে অলি কাকু ও বন্ধুদের। মায়ের কথায় রবি কাকু তাদের গাছের ডাব পেড়ে দেন। তাদের মধ্যে মা খুঁজে পান বড়দা ও মেজদাকে।  মুড়ি, চিড়া, নাড়–, মোয়া ও নানা ফল ফলাদি এসবও তাদের দেয়া হয়। সবই মায়ের নির্দেশে। অতিথিকে দেবতা মনে করেন মা। বাঘাও এতে খুশী । সেও ভাবে সেবা দেয়া মানুষের উত্তম কাজ।
ক’দিন ধরে অলি কাকুরা আসেন না। এতে বাঘারও মন খারাপ লাগে। মা বুজান বাঘাকে।
- অত চিনতা কী? ওনারা দেসের জন্য লরতে গ্যাচেন। দেখিস আইয়া পরবো !
জোসনাময় রাত! সাদা মেঘ হেঁটে যাচ্ছে আকাশের বুক আকঁড়ে ধরে। উঁকি মারছে সাদা থালার মতো উজ্জ্বল চাঁদ । সমীরকে সঙ্গে করে সারা উঠোন ঘুরে ঘুরেছে বাঘা। মাথা কাত করে ও তাকায় মধ্য গগণে। চোখ সরাচ্ছে না ! এমন সময় চিৎকার শোনা গেলো বাড়ীর প্রবেশ মুখে। লাঠি নিয়ে দৌড়ে গেলো রবি কাকু। পিছু নিলো ওরা। কিন্তু কোন চোর বা ডাকাত নয়। তবে একটি দুঃসংবাদ! জিন্নত কাকু আর্মিদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। ওনার বা পায়ে গুলি লেগেছে। বলাখালে কুমিল্লা - চাঁদপুর সড়কের ঘটনা। গ্রামবাসীরা তোপের মুখে আর্মিরা সরে যায় গাড়ী নিয়ে। গুলি খেয়ে অনেক কষ্টে পাশের বাড়ীতে আশ্রয় নেন জিন্নত কাকু। দু’দিন ছিলো সে বাড়ীতে। বেশ কষ্টে তাকে নিয়ে আসে কাশিমপুর। অলি কাকু, শফিক কাকু ও রবি কাকু মিলে জিন্নত কাকুকে বৈঠকখানায় নিয়ে আসেন। সবাই মিলে চৌকিতে শুইয়ে দেন ওনাকে। রবি কাকু বললেন ‘বালো হ আগে জিন্নত আলী। পরে খবর দিমু তগো বাইত।’ দিনরাত সেবিকার মতো শুশ্রুষা করে যায় বাঘা। ক্ষতস্থানে পাহাড়েলতা পাতা কঁচলে রস লাগিয়ে দেয়। জিন্নত কাকু চিৎকার করে ওঠেন। মার কাছ থেকে ব্যান্ডিজ, তুলো ও ডেটল এনে তা দিয়ে জিন্নত কাকুর পা পরিস্কার করে। পায়খানাও বাঘা ওনাকে ধরে নিয়ে যায়। মুখে খাবার তুলে দেয় অনেক সময়। তিনদিন পর জিন্নত কাকুকে ওনার বাড়ীর লোকজন এসে নিয়ে যান। আর্মির হাতে জিন্নত কাকুর আহত হওয়ার বিষয়টি সবাইকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। সন্ধ্যার সময় রেডিও শোনার আসরে নিস্তব্ধতা লক্ষ্য করে বাঘা। যুদ্ধের নানা বিষয় বাঘাকে গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন করে রাখে। মনে মনে পরিকল্পনা করে সে।


সকালে জল খাবারের পর দীঘির পাড়ে যায় বাঘা। পরিকল্পনা অনুযায়ী নজরুল ও মামুন আসে। জিন্নত কাকুর কাছে শুনেছে গাড়ী চলে যে অবধি সেখান পর্যন্ত আর্মি আসে। রামপুর পর্যন্ত আর্মির গাড়ী আসতে পারে। ওরা তিনজন কাশিমপুর বাজার হয়ে রামপুরের দিকে হাঁটতে থাকে।
বাঘাকে কোথায়? বাড়ীতে রব পড়ে গেলো! এ বাড়ী ও বাড়ী খোঁজ নিলেন কাকুরা। কোথাও সে নেই। বাঘা নিখোঁজ! হারিয়ে যাওয়া বাঘার চিন্তায় মা বিচলিত হয়ে পড়েন। ক’দিন আগে রবি কাকুর কাছে বাঘা জানতে চেয়েছিলো মামাতো ভাই সুবলদাদের বাড়ীর ঠিকানা। কাকু বাঘাকে জানায় রামপুরের পাশে উরপুর যতীন্দ্র সেনের বাড়ী। মাকে রবি কাকু আশস্ত করে বললেন ‘আমি দেকছি বড় বদি! কোনো চিনতা কইরেন না। আমি উরপুর বিদুর বাড়ী যাইয়া দেখি।’
বোন বিদেশীনী সেনের বাড়ী গিয়ে রবি কাকু দেখেন বাঘা জড়সড় হয়ে মাটির ঘরে শুয়ে আছে। গুড় মুড়ি খেয়ে পিসির বাড়ী থেকে আতংকের মধ্যে রওনা দিলো ওরা। বিকেলে হাঁটা পথে যেতে যেতে কাকু উরপুর আসার পুরো ঘটনা জানতে চাইলেন।
- আর বইল্লো না ছোট কাকু! ওরাই তো জিন্নত কাকুরে গুলি করছে! অগরে ছারন যায় কও ? গাড়ী দেইখ্যা ডিল মারছি আমরা! আমগোরে অসরো ওচাইয়া দৌওরানি দিচে । পরে অরা ভাগচে।
- নজরুল ও মামুন কই?
- কইতে পারুম না !
- এইডা ঠিক অইল না বাবা ! আইচকা যদি কিচু অইয়া যাইতো?
কাকুর কথা শুনে মাথা নিচু হয়ে যায় বাঘার। একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় দু’জন। বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বাঘা বলে -
আমারো যুদ্দ করতে অইবো। দ্যাশে শতরু ভইরা গ্যাছে! ছোট মুখে বড় কথা শুনে হাসেন আর মাথা নাড়েন কাকু।

প্রণব মজুমদার
গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও অর্থকাগজ সম্পাদক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top