সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

বীণা দাস: এক অগ্নিকন্যার উপাখ্যান : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:২৭

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৮:৫৩

ছবিঃ বীণা দাস

 

১৯৩২ খৃস্টাব্দের ৬ ই ফেব্রুয়ারি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে বক্তৃতা দিতে উঠেছেন তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার রাজ্যপাল স্যর ফ্রান্সিস স্টানলি জ্যাকসন। সেই জ্যাকসন যিনি ক্রিকেটার হিসাবে কুড়িটা টেস্ট ম্যাচ খেলে ইংল্যান্ডকে অনেক জয়ের মুকুট পড়িয়েছিলেন। পরবর্তীকালে চাচির্ল তাকে গভর্নর অফ বেংগল করে ১৯২৭ খৃ: ভারতীয় উপমহাদেশে পাঠালেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের সমাবর্তন উৎসবে বাংলার রাজ্যপাল তথা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  আচার্য হিসাবে স্টানলি জ্যাকসন তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছেন। বক্তৃতার মাঝে জ্যাকসন ঘোষণা করলেন যে তিনি বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে চার লক্ষ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করেছেন। সবার তুমুল হাততালির মাঝে  পলকের মধ্যে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চুপ করে বসে থাকা এক কুড়ি বৎসরের ছাত্রী ডায়াসের দিকে এগিয়ে এসে গভর্নরের দিকে রিভলভার তাক করে  পাঁচবার পরপর শট নিলেন। চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে গেল।  যদিও প্রতিটি গুলি লক্ষ্যভ্রস্ট হয়েছিল এবং জ্যাকসন সময়মত নিজেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।  কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য  হাসান সুরাবর্দি ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রীটির হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ এসে অবিলম্বে তরুণীকে গ্রেপ্তার করল।

তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি সংবাদপত্রের  শিরোনামে উঠে আসা এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার নায়িকার নাম বীণা দাস। ভারতীয় উপমহাদেশের  সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম  দু:সাহসিক মহিলা বিপ্লবী।

১৯১১ সালে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে তাঁর জন্ম।  যদিও তাঁদের আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম। তাঁর পিতা বেণীমাধব দাস ছিলেন কটকের র‍্যাভেনশ কলেজের শিক্ষক। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ছিলেন তাঁর ছাত্র। মাতা সরলা দেবী। বোন কল্যাণী দাস, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী আরো এক অগ্নি কন্যা। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তাঁর বাবামা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।  বীণা দাসের মা সরলা দেবী ১৯০০ সালে কলকাতায় পুণ্য আশ্রম নামে একটি ছাত্রীনিবাস স্থাপন করেন। গোপনে এই ছাত্রীনিবাসে বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র মজুত রাখা হত। এই ছাত্রীনিবাসের অনেক ছাত্রী গোপনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পিতা বেণীমাধব দাস প্রচুর ছাত্রদের বৈপ্লবিক কার্যকর্মে উদ্দীপিত করেছিলেন।

সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র। শৈশব থেকেই বীণা দাস দেখেছিলেন তাদের বাড়ীতে সুভাষের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সুভাষের রাজনৈতিক বিশ্বাস, ব্রিটিশ বিরোধী নীতি তাঁকে আগাগোড়া প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীকালে বীণা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে শৈশবে তাঁর স্কুলে একবার ইংরেজ ভাইসরয়ের স্ত্রীর স্কুল পরিদর্শন উপলক্ষে স্কুল থেকে মেয়েদের শেখানো  হল ফুল দিয়ে ম্যাডামকে অভ্যর্থনা জানাতে এবং স্কুলে প্রবেশের সময় তাঁর পদতলে ফুল ছড়িয়ে নত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। শোনামাত্র বীণা দাস এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন "অভ্যর্থনা জানাবার এই পদ্ধতি আমার কাছে খুব অপমানজনক লেগেছিল। আমি তাই নীরবে এই রিহার্সাল থেকে বেরিয়ে আসি। ক্ষোভে অপমানে আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। ক্লাসের আরো দুজন মেয়ে তারাও আমার সাথে যোগ দেয়। অত্যন্ত বিচলিত বোধ করে আমরা শপথ নিই যে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করবো। পরবর্তী কালে যখন ই শৈশবের  এই শপথের কথা মনে আসত, আমি মানসিকভাবে অনেক শক্তি ফিরে পেতাম আর উদ্দেশ্য সাধনের পথে অবিচল থাকতে পারতাম।"

আশিরনখ সুভাষচন্দ্র বোসের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী বীণা একবার সুভাষকে প্রশ্ন করেছিলেন দেশ কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করবে? সশস্ত্র আন্দোলন না কি অহিংস নীতি প্রয়োগ?  নেতাজি উত্তর দিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য প্রতিটি দেশবাসীকে প্যাশনেটলি উন্মুখ হতে হবে তবেই স্বাধীনতা আসবে। এক্ষেত্রে অহিংস আন্দোলন বা সশস্ত্র আন্দোলন পথটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

স্কুলজীবন শেষ করে বীণা বেথুন কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯২৮ খৃস্টাব্দে সাইমন কমিশন এর সুপারিশের বিরুদ্ধে অন্যদের সাথে তিনিও গর্জে ওঠেন। এই প্রতিবাদ  জন্ম দিল ছাত্রী সংগঠনের। বীণা দাস, তাঁর ভগ্নী কল্যাণী দাস ও আরো কিছু ছাত্রীদের নিয়ে গঠিত হল ছাত্রী সংঘ সংগঠন। আত্মরক্ষার জন্য এই সংগঠনের সদস্যদের লাঠি চালনা  শেখান হতো। এই সংগঠন গোপনে বিখ্যাত বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের সাথে যোগাযোগ রেখে চলত। কলেজে তাঁর সহপাঠিনী সুহাসিনী গাঙ্গুলি বীণাকে বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ করে দেন। ১৯৩২ খৃস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে বাংলার গভর্নর স্টানলি জ্যাকসনের আসার খবর পেয়ে বীণা মনস্থির করলেন জ্যাকসনকে হত্যা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবেন। তাঁর পরিকল্পনা তিনি বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্তের কাছে খুলে বলেন এবং অস্ত্র যোগাড়ে সাহায্য চান। বিপ্লবী দল থেকে তাঁকে একটি পুরানো বেলজিয়াম রিভলভার কিনে দেওয়া হলো। যদিও বীণা আগে কোনদিন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন নি। তাই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে তিনি নেহাত ই  অনভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু এইসব কোনকিছুই তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠেনি।

বীণাকে গ্রেপ্তার করে লালবাজার নিয়ে আসা হলো। কলকাতায় তাঁর হোস্টেলের রুম সার্চ করে পুলিশ আরো অনেক বুলেট ও বৈপ্লবিক কাগজ পত্রের সন্ধান পেল। তার বাবামা  লালবাজারে তাদের মেয়ের সাথে দেখা করতে এলে ব্রিটিশ পুলিশ জানাল যদি বীণা কোথা থেকে অস্ত্র যোগাড় করেছেন বলে দেন তবে তার লঘু শাস্তি হবে। তাদের এই চাপের কাছে বীণা দাসের পরিবার মাথা নোয়ালেন না। মাত্র একদিনের বিচারে বীণা দাসের ৯ বছরের কারাবাস ধার্য হলো। যখন তাঁকে কোর্টে তোলা হলো বীণা শান্তভাবে বিচারককে জানালেন যে স্টানলি জ্যাকসনের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত কোন ক্ষোভ বা রাগ নেই। কিন্তু তিনি ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধি যে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি মানুষকে অন্যায়ভাবে অত্যাচার  করে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে, তিনি এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মেদিনীপুর জেলে বীণা দাসকে পাঠানো হলো।  জেলে বন্দীদের দুর্দশা দেখে তিনি অনশন শুরু করেন। সাতদিন অনশনের পর জেল কতৃর্পক্ষ তার সব দাবী মেনে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ সাত বছর কারাবাসের পর মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টায় তিনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন।


 মুক্তিলাভের পর বীণা কংগ্রেস পার্টিতে যোগদান করেন ও ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন। এইসময় দক্ষিন কলকাতার হাজরায় তিনি একটি সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। পুলিশ এসে জনসভা ভেঙে দিতে শুরু করলে তিনি বাধা দেন। সেই অপরাধে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে তিন বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। মুক্তির পর ১৯৪৭ সালে বীণা দাস স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীশ ভৌমিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বীণা দাস তাঁর সংগ্রামী মনোভাব থেকে সরে যাননি। উৎপীড়িত শোষিত অসহায় মানুষের পাশে ছুটে গেছেন বারবার।

১৯৫১ খৃ: অমৃতবাজার পত্রিকার কর্মচারী ইউনিয়ন কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ ও বেতন বৃদ্ধির দাবীতে ধর্মঘট শুরু করলে বীনা আগাগোড়া কর্মচারীদের পাশে ও পক্ষে থেকেছেন,তাদের সাহস যুগিয়েছেন। শুধু তাই নয় দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার মধ্যপ্রদেশের দন্ডকারণ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে  বীনা দাস ও তাঁর স্বামী যতীশ ভৌমিক এর প্রতিবাদে সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন প্রত্যাহার করে দেন| বীণা দাস স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর বীণা দাস সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে হৃষিকেশে চলে যান।

১৯৮৬ সালের ২৬শে ডিসেম্বর হৃষিকেশের রাস্তার ধারে একটি মৃতদেহ পড়েছিল। মৃতদেহটি বেশ কয়েকদিন ধরে রাস্তায় পড়ে থেকে অর্ধবিকৃত হওয়ার পর লোকাল থানায় খবর যায়। দীর্ঘ তিনমাস অনুসন্ধানের পর পুলিশ জানতে পারে মৃতদেহটি  ভারতের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী বীণা দাসের। একদা যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ মেনেছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই দেশের মাটিতে তাঁর এই শেষযাত্রা সত্যই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক।

স্বাধীনতার পর কেটে গেছে বহু বছর। শপিং মলে কেনা কাটা, এটিএম  এ টাকা, লং ড্রাইভ, ইন্টারনেট বিবিধ টেকনোলজির ঘূর্ণাবতে ছুটে যেতে যেতে আমরা ভুলেই গেছি এক নক্ষত্রকে...কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক অগ্নিকন্যাকে ইতিহাসের এটাই এক ট্রাজেডি।

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top