সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

বড়দিনের ইতিহাস ও তাৎপর্য : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:১৮

আপডেট:
২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০৩

 

পঁচিশে ডিসেম্বর পালিত হয় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শুভ বড়দিন বা হ্যাপি ক্রিসমাস ডে। বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বব্যাপী যে দিনটাকে সবচেয়ে বেশি মানুষ উদযাপন করে সেটি হচ্ছে বড় দিন।যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন। ফিলিস্তিনের বেথেলহেমে এই দিনে এক জরাজীর্ণ গোয়ালঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এক মহামানব যার নাম যিশু খ্রিস্ট।তখন থেকেই খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটি কে বড়দিন হিসেবে পালন করে আসছে।  দের হাজার বছরের অধিক কাল ধরে পালিত  হয়ে আসছে বড় দিন ।ব্যাপক আড়ম্বরের মাধ্যমে দেশে দেশে এ দিনটি পালিত হয়। সান্তা ক্লজের আবির্ভাব, ক্রিসমাস ট্রি , আলোক সজ্জা , উপহার,কেক , ঘুরাঘুরি,মজার খাবার,  গীর্জায় প্রার্থনা  এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কাটানো হয় দিনটি পরম আনন্দে । এটা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।

    

বড়দিনের ইতিহাস :  ইতিহাস অনুযায়ী রোমান সাম্রাজ্যের সময় ৩৬৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম বড়দিনের উৎসব পালন করা হয়। পোপ জুলিয়াস প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে  যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে বড়দিন উৎসব পালন করার ঘোষণা দেন। সেই থেকে দেশে দেশে এই দিনটি পালন হয়ে আসছে। তবে এর আগে বড়দিনের উৎসব তেমন জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না এবং তা ইউরোপের বাইরে ছড়ায়নি । মূলত মধ্যযুগের পরে একেবারে আধুনিক সময়ে বড়দিনের উৎসব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে । বলতে গেলে অনেকটা ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে । বর্তমানে তা সার্বজনীন উৎসবে রুপ নিয়েছে ।

 

ডিসেম্বর মাসের পঁচিশ তারিখ যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে বড়দিন পালন করা হয় । তবে এদিনটি যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে । খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মতে এই তারিখের ঠিক নয় মাস আগে মা মেরীর গর্ভে এক আলোক জ্যোতির মতো প্রবেশ করেন যিশু । সে হিসেবে ২৫ ডিসেম্বর তারিখটি যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন ধরা হয় । 

খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিস্টের জন্ম ড়য় অলৌকিক ভাবে । খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মতে যিশু খ্রিস্ট পৃথিবীতে মানুষ রুপে জন্ম নেন পৃথিবীর পাপাচার হতে মানুষ কে মুক্তি দিতে । মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে । বড়দিন এখন খ্রিস্টান ধর্ম ছাড়িয়ে সব ধর্ম বর্ণের মানুষের কাছে আবেদন সৃষ্টি করেছে । 

 

অন্য তথ্যমতে  এটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব । পবিত্র বাইবেলে  যিশুর জন্মদিন সম্পর্কে  পরিষ্কার কিছু উল্লেখ নেই ।এর ইতিহাস জানতে যেতে হবে যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে মানব সভ্যতার গোড়ার দিকে । রোম সাম্রাজ্যে ইউরোপের সবচেয়ে বড় উৎসব ছিল তাদের কৃষি দেবতা এবং শনি গ্রহের সম্মানে এক বিশেষ উৎসব । এই উৎসব শীতের মাঝামাঝি সময়ে  ২৫ ডিসেম্বর এর দিকে পালিত হতো ।তখন রোম সাম্রাজ্যে সবকিছু বন্ধ থাকত কয়েক দিন । ধনী গরীব ছোট বড় সবাই ভেদাভেদ ভুলে যেতো ।সে সময় অবশ্য  যিশুর অনুসারীরা  এ উৎসবকে বিধর্মী উৎসব বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল ।তখন ২৫ শে মার্চ কে মহান দিন হিসেবে ঠিক করা হতো । যে দিন স্বর্গ ও মর্তের স্রস্টা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার মহাদূত গ্যাব্রিয়েল কে কুমারী মেরীর কাছে পাঠিয়ে এই সংবাদ দেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও অলৌকিক ক্ষমতায় কুমারী মেরী গর্ভবতী হবেন এবং ঈশ্বরের পুত্র কে গর্ভে ধারণ করবেন । তার নাম রাখা হবে যিশু । কুমারী মেরী গর্ভবতী হওয়ার নয় মাস হিসেবে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন । ৩৩৬ খ্রীষ্টাব্দ হতে রোমান  বর্ষপঞ্জিতে  ২৫ ডিসেম্বর কে বড়দিন হিসেবে উৎযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয় বলে জানা যায় । রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্ট ধর্ম রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলে দিনে দিনে বড়দিন প্রাণ পেতে শুরু করে ।

 

দিন ও  তারিখের মতভেদ থাকলেও  যিশু খ্রিস্টের মাহাত্ম্য স্বমহিমায় উজ্জ্বল । যিশু যে প্রেমের বাণী , মানবতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন তা আজো মানুষের চলার পথের দিশারী হয়ে কাজ করছে । ক্ষমাই ছিল যিশুর মূল প্রেমের বাণী । মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও  যিশু বলেছিলেন ---- পিতা ওরা জানে না ওরা কি করছে , ওরা অবুঝ ও অজ্ঞান । তুমি ওদের ক্ষমা করে দাও । যিশু বলেছিলেন ----- তোমার প্রতিবেশীর জন্য তাই কামনা কর যা তুমি নিজের জন্য চাও । তিনি বলতেন সবাইকে ক্ষমা করো । তিনি বলতেন যতক্ষণ সবাইকে তুমি ক্ষমা করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি স্বর্গে প্রবেশ করবে না । ঈশ্বর তাকেই ক্ষমা করেন যে সবাইকে ক্ষমা করে । জন্মদিন মানে আগের ভুলগুলো শুধরে জীবনকে নতুন ভাবে সাজানো ।যিশুর জন্মদিন যেন প্রত্যেক খ্রিস্টানের জন্মদিন । এদিন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা নিজের এবং সকলের মুক্তি কামনা করে । 

 বিশ্বব্যাপী বড়দিন :   বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বড়দিন উদযাপন করেন নানাভাবে । বর্তমান সময়ে গির্জায় উপাসনায় যোগ দেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । বড়দিনের আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গৃহসজ্জা , আলোকে সজ্জা ,ভোজ , উপহার আদান প্রদান চিত্রশিল্পে যিশর জন্মদৃশ্য ফুটিয়ে তোলার ঐতীহ্য দীর্ঘ দিনের। এই দৃশ্যে মেরী ,যোসেফ, শিশু,যিশু , স্বর্গ দূত ,মেষপালক থাকে । বিভিন্ন দেশে পুতুল সাজানো হয় । সান্তা ক্লজ , ক্রিসমাস ট্রি জিঙ্গেল বেল, মোমবাতি, ক্যান্ডি কেন ইত্যাদি বড়দিনের অন্যতম  অনুষঙ্গ ।

 

 আমাদের দেশে বড়দিন:  আমাদের দেশে বড়দিন আসে জব চার্ণক এর মাধ্যমে । ১৯৬৮ সালে ডিসেম্বর মাসে বিশেষ কাজ উপলক্ষে জব চার্ণক যাচ্ছিলেন হিজলি। হিজলী যাবার পথে  হিজলী যাবার পথে সুতানুটি গ্রামে আসার পর জব চার্ণক দেখলেন ক্রিসমাস এর সময় প্রায় আসন্ন । তখন সেখানেই যাত্রা বিরতি করলেন । প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে প্রথানুযায়ী পালন করলেন ক্রিসমাস উৎসব । সেই থেকে আমাদের এই উপমহাদেশে ক্রিসমাস উৎসব পালনের প্রথা শুরু হয় । 

 

ক্রীসমাস ট্রি: বড়দিন মানেই ক্রিসমাস ট্রি । যে গাছটি বাহারি সব ফুল ফল রঙিন আলোকমালায় সাজানো হয় । ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে যে গাছটি বেশি ব্যবহার হয় সেটা হল ফার গাছ । এটা দেবদারু জাতীয় গাছ । প্রকৃত গাছ ব্যবহার না করে এখনো অনেকে প্লাস্টিকের গাছ ব্যবহার করেন । প্রথম দিকে এটি শুধুমাত্র রাজ দরবারে ও চার্চের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । পরে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে । এই গাছের উপরে বিভিন্ন দ্রব্য এবং একটি তারা বা স্বর্গ দূত বসানো হয় । এই স্বর্গ দূতটি বেথেলহেমে জন্ম নেয়া যিশু খ্রিস্টের প্রতীক । ইতিহাস মতে ষোল শতকে জার্মানি তে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রচলন শুরু করা হয় ।

 

সান্তা ক্লজ: বড়দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুখ সান্তা ক্লজ । যিনি আসেন খুশির বার্তা নিয়ে । রাতে বাচ্চাদের জন্য দরজার সামনে উপহার আর চকলেট রেখে যান । বাচ্চারা তার সাথে নাচ গান করে । সান্তা ক্লজ বাচ্চাদের শুনায় যিশু খ্রিস্টের গল্প । এবার শোনা যাক সান্তা ক্লজ হওয়ার গল্প । সান্তা ক্লজের কিংবদন্তী শুরু হয় সেন্ট নিকোলাস নামক এক সন্ন্যাসী কে ঘিরে । এশিয়া মাইনর বা পাতারা নামক স্থানে ২৮০ সালে তার জন্ম হয়েছিল বলে অনুমান করা হয় । সততা আর দয়ার জন্য সবাই তাকে ভালবাসত । সম্পদশালী এই নিকোলাস গরীব দূঃখী আর অসহায় মানুষদের সাহায্য করতেন । তার মহানুভবতার কথা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে । ১৮৪১ সালে ফিলাডেলফিয়ায় একটা দোকানে মানুষ আকৃতির সান্তা ক্লজ তৈরি করা হয় যা দেখতে দোকানের সামনে  হাজারো মানুষের ভীড় জমে যায় । এর পর থেকে দোকানের সামনে বাচ্চা ও  তাদের মা বাবাদের আকৃষ্ট করতে জীবন্ত সান্তা ক্লজ সাজানো হতো । 

জিঙ্গেল বেল: জিঙ্গেল বেল বড় দিনের সুর বেঁধে দেয় । এই সুর বেঁধে সান্তা ক্লজ ২৪ এর রাতে আসে গিফটের ঝুলি নিয়ে । জিঙ্গেল বেল এক ধরনের সতর্ক ঘন্টা  যা দোকানে দরজায় থাকে এবং ক্রেতার আগমন বার্তা দেয় । জিঙ্গেল বেল ছোট ক্লাসিক ঘন্টার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় । 

ভোজ বা খাবার : বড়দিন উপলক্ষে ইংল্যান্ড এ থাকে পারিবারিক পুডিং । সিসিলি অঞ্চলে ক্রিসমাসের পূর্ব সন্ধ্যায় যে ভোজের আয়োজন করা হয় । তাতে থাকে বারো রকমের মাছ । ইংরেজ সংস্কৃতি সম্পন্ন দেশে বড়দিনের ভোজ সভায় দেখা যায় টার্কি ,আলু, শাক সবজি মিন্স পাই , ফ্রুট কেক। ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে ভোজে মাছের প্রাধান্য থাকে  এবূ সূ ভেড়ার মাংসও থাকে । জার্মান ,অষ্ট্রিয়ি ও ফ্রান্সে হাঁস ও শূকরের মাংস জনপ্রিয় । ফিলিপাইঐ ভোজ সভায় প্রধান খাদ্য হাম । ক্রিসমাস এর বিশেষ মিষ্টি র মধ্যে জার্মূ স্টোলেন , মার্জিনাল কেক উল্লেখযোগ্য । উত্তরের দেশে কমলা লেবু বিশেষ খিদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় । 

 

আলোক সজ্জা : ক্রিসমাসের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আলোক সজ্জা । উজ্জ্বল আলোক সজ্জার মাধ্যমে বাড়ি ঘর , গির্জা সাজানো হয় বড়দিন উপলক্ষে ।

বড়দিন দিন কেন : খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যিশুর জন্ম দিন কে ক্রিসমাস ডে হিসেবে পালন করে । তবে আমাদের এ অঞ্চলে এই দিনটি বড়দিন হিসেবে পালন করা হয় । কেন এ দিনটাকে বড়দিন হিসেবে পালন করা হয় , এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক  ডঃ বিশ্বজিত ঘোষ বলেছেন ...... " মর্যাদার দিক থেকে এটা বড় , যিশু যেহেতু  বিশাল জনগোষ্ঠীর  মধ্যে ধর্ম 

বর্ণ ও দর্শন দিয়ে গেছেন , বিশ্বব্যাপী বিশাল অংশের মানুষ তার দেয়া ধর্ম ও দর্শনের অনুসারী । যিনি এত বড় ধর্ম ও দর্শন দিলেন পঁচিশ ডিসেম্বর তার জন্মদিন ‌ । সে কারনূ এটাকে বড়দিন হিসাবে বিবেচনা করে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা । " তিনি আরো বলেন যে , আঠারো ও উনিশ শতকে আমাদের এ অঞ্চলে ইউরোপীয়রা খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করে । বাঙালি যারা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন তারা মনে করেন যে , যিশু তাকে ধর্ম দিয়েছেন দর্শন দিয়েছেন। তাই তারা সব আবেগ দিয়ে যিশুর জন্মদিনটা পালন করেন । একারণে এ দিনটি বড়দিন হিসেবে বিবেচিত । অন্য মতে বাংলায় ক্রিসমাস কে বড় দিন হিসেবে আখ্যা দেয়ার  কারন হিসেবে বলা হয় যে , ২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ বড় আর রাত ছোট হতে থাকে । বিশ্বাস করা হয় যে ২৫ ডিসেম্বর এসে নাকি দিনটি সবচেয়ে বড় হয় । 

উপসংহার: আজকের দিনে যিশুর ক্ষমার বাণী আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। সারা বিশ্ব ব্যাপী  যে বিভেদের সুর বাজছে তা থেকে বিরত থাকতে এবং বিভেদ বৈষম্যহীন সমাজ  গড়তে যিশুর বাণী আর বড়দিনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা দরকার । 

 
    
এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক
সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top