সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা গানের খাতায় এক অবিনাশী স্বরলিপি-কিংবদন্তী শিল্পী মাহমুদুন্নবী : অশ্রু বড়ুয়া


প্রকাশিত:
৪ জানুয়ারী ২০২১ ২১:৫৬

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:০২

ছবিঃ শিল্পী মাহমুদুন্নবী

 

গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনেই ছিল কিংবদন্তী শিল্পী মাহমুদুন্নবী'র ৮০তম জন্মবার্ষিকী ।


ষাট এর দশকের বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি তিনি। আমাদের আধুনিক গানগুলো যাঁরা করে গেছেন অনেক বেশি সমৃদ্ধ তিনি তাঁদের অন্যতম কণ্ঠশিল্পী। ছিলেন সহজ-সরল, মিষ্টভাষী এবং গানপাগল অভিমানী এক মানুষ। তাইতো জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কেবল গানই লালন করেছেন তাঁর হৃদয়ে। আধুনিক ও চলচ্চিত্রের অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়ে আজও তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মনের মণিকোঠায়।
সে-ই ষাট দশক থেকে এই প্রজন্মের শ্রোতার মুখে মুখে যিনি এক অনবদ্য প্রেরণা। যিনি ভালোলাগা আর ভালবাসার এক দুর্বার অনুভূতি। তিনি আর কেউ-ই নন-প্রয়াত কন্ঠশিল্পী মাহমুদুন্নবী।
বাংলাদেশের বাংলা গানের খাতায় এক অবিনাশী স্বরলিপি-অমর কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুন্নবী। কালজয়ী এ কন্ঠশিল্পীর জন্ম এবং মৃত্যু বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই। বছর পরিক্রমায় আজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের এই দিনেই কিংবদন্তী শিল্পী মাহমুদুন্নবী'র ৮০তম জন্মবার্ষিকী। আজ এদিনে অমর কন্ঠশিল্পীর প্রতি রইল এক হৃদয়ের অসীম শ্রদ্ধা ও অতলান্ত ভালোবাসা।

ইংরেজি উনিশ'শ সাল ষোল ডিসেম্বর। ভারতের বর্ধমান জেলার আসানসোলে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন মাহমুদুন্নবী। আসানসোলে জন্ম নিলেও বেড়ে ওঠেন দাদার বাড়ী কেতু গ্রামে। খুব ছোটবেলায় মাত্র ৭ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন গান পাগল এই মানুষটি।
দেশ বিভাগের পর বাবা বজলুল করিমের চাকরির সুবাদে চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং খুলনায় স্থায়ী হন। তবে বাবার কর্মক্ষেত্র ফরিদপুরেই কেটেছে মাহমুদুন্নবীর শৈশব ও কৈশোর।
খুব ছোটবেলায় গান শুনিয়ে সবার আদর খুঁজে নিতেন মা হারা ছেলেটি...। ঘুড়ি ওড়ানো আর বল খেলা খুব পচ্ছন্দ করতেন মাহমুদুন্নবী। বাড়ি থেকে বই হাতে বেড়িয়ে যেতেন সোজা মাঠে। ডানপিটে আর দূরন্ত স্বভাবের ছিলেন ছোটবেলায় মাহমুদুন্নবী। একদিন কলেজের এক শিক্ষক বললেন- ‘তুই একদিন অনেক বড় শিল্পী হবি...কিন্তু বল খেললে গানের গলা তো নষ্ট হয়ে যাবে’। ফুটবল খেলা মাহমুদুন্নবী'র প্রিয় হলেও গানের জন্য সেই থেকে বল খেলা ছেড়ে দিলেন।
ওই সময় ফরিদপুরে গানের শিক্ষক প্রাণবন্ধু সাহা'র কাছে প্রথম গানের তালিম নেয়া শুরু করেন মাহমুদুন্নবী।
ওইসময় কলকাতা রেডিওতে অনুরোধের আসরে যে গানগুলো প্রচার হতো সেগুলোও শুনতেন আর গলা ছেড়ে গাইতেন নিয়মিত। এভাবেই গান শিখতে গিয়ে টের পেলেন কলেজের পরীক্ষার আর অল্প দিন বাকি। কিন্তু গানই তাঁকে টানছে ভীষণভাবে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ।
শেষতক ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে কিছুকাল চট্টগ্রামে পরে ঢাকায় চলে যান।

ঢাকায় এসে মাহমুদুন্নবী'র সাথে দেখা হয় ওস্তাদ গঁফুর খাঁ-এর সাথে। ওস্তাদ গঁফুর খাঁ-তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন । তখন তাঁর কাছে গান শেখা শুরু করেন মাহমুদুন্নবী। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়ে ধীরে ধীরে শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন মাহমুদুন্নবী। ওইসময় একদিন কার্জন হলে গান গাইতে গিয়ে পরিচয় হয় বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী শেখ লুৎফর রহমানের সাথে। যদিও তিনি করাচীতে থাকতেন তবে ওই সময়টাতে ঢাকায় এসেছিলেন। সেখানেই মাহমুদুন্নবী'র গান শুনে যারপরনাই মুগ্ধ হন তিনি। সে সুযোগে মাহমুদুন্নবী করাচী রেডিওতে গান করার ইচ্ছার কথা তাঁকে জানান।
পরবর্তীতে মাহমুদুন্নবী বাবাকে অনেক বুঝিয়ে তাঁর কাছ থেকে তিনশ টাকাও আদায় করেন করাচী যাওয়ার উদ্দেশে। এরপর দুই'শ বিশ টাকা প্লেনের টিকেট কেটে মাহমুদুন্নবী রওনা হলেন করাচী। সেখানে গিয়ে করাচী কালচারাল সেন্টারে গান গেয়ে বাঙালি মহলে বিশিষ্ট শিল্পী হয়ে ওঠেন তিনি। সেই থেকে শুরু। করাচী বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রচারিত হয় তাঁর গাওয়া প্রথম গান। পরে শিল্পীর আটটি গান নিয়ে আধুনিক গানের একটি লং প্লে রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
করাচী থাকাবস্থায় প্রথম গান গাইলেন ‘জিনে ভি দো’ ছবিতে । এরপর একে একে তিনি গান করেন যেসব ছবিতে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পিয়াসা’, ‘উলঝান’। এছাড়া তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান পরিবেশন করে হয়ে উঠেন অত্যন্ত শ্রোতাপ্রিয় একজন কন্ঠশিল্পী।

ইংরেজি ষাট সাল। সব কিছুর পরও নিজের দেশে ফিরে বাংলায় গান করার তাগিদ অনুভব করতে থাকলেন তিনি। সেই তাগিদেই এক সময় ফিরে এলেন ঢাকায়। মাহমুদুন্নবী ঢাকায় স্থায়ী হন। ওইসময় থেকে ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে মূলত তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ঢাকা রেডিওতে মাহমুদুন্নবী নিজের লেখা ও সুরে প্রথম রেকর্ড করেন-

"কাকনের ঠিনিঠিনি নূপূরের রিনিঝিনি" শীর্ষক গানটি।

তখন থেকেই ঢাকা রেডিওতে নিয়মিত তাঁর গানের সাথে সাথেই বাড়তে থাকে শ্রোতা সংখ্যাও। এভাবে রেডিও টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান পরিবেশন-শিল্পী মাহমুদুন্নবীকে ভীষণ ব্যস্ত করে তুললেন।

ব্যক্তিজীবনে দিনাজপুরে খালাতো বোন রাশিদা চৌধুরী'র সাথে বিবাহবন্ধনে আবহ হন তিনি। মাহমুদুন্নবী ছিলেন গানের রাজা। সেই রাজার ছিলো তিন কন্যা নুমা (ফাহমিদা নবী), নোভা (সামিনা চৌধুরী) ও অন্তরা (তানজিদা নবী)। আর ছিলো এক পুত্র পঞ্চম (রেদোয়ান চৌধুরী)।

লেখালেখির হাতও খুব ভালো ছিল মাহমুদুন্নবী'র। উপন্যাস থেকে রম্যরচনা সব ধরনের লেখা তিনি লিখেছেন। তৎকালীন সময় খবর পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। ‘আর পারিনা’ নামে একটি রম্য রচনা প্রকাশিত হলে বেশ সমাদৃত হয়।
যেমন শিল্পের প্রতি তেমনি সমাজের প্রতিও দায়বদ্ধ ছিলেন শিল্পী মাহমুদুন্নবী।
ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে ছিল তাঁর সম্পৃক্ততা। ওইসময় তাঁর গাওয়া গণজাগরণমূলক বেশ কিছু গান মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে।
১৯৬৯ এ গণঅভ্যুথানের সময় এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বাড়াতে নিজের লেখা ও সুরে অনেক গণজাগরণমূলক গান করেন তিনি।
স্বাধীনতার পরে প্রচুর আধুনিক গানের পাশাপাশি অসংখ্য চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দেন অমর এ কন্ঠশিল্পী। তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গানগুলোর উল্লেখযোগ্য ছায়াছবির নাম হলো– কাগজের নৌকা, বেহুলা, আবির্ভাব, স্বরলিপি, আয়না ও অবশিষ্ট, নাচের পুতুল, দর্পচূর্ণ, ছন্দ হারিয়ে গেল, আলো তুমি আলেয়া, দি রেইন, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, অনির্বাণ, আধুরি দস্তান, পিয়াসা, উলঝান, জিনা ভি মুশকিল, মধুমিতা, হীরা, হারজিৎ।

অনুকরণীয় কণ্ঠশৈলীতে চমৎকার সব গান গেয়ে ষাটের দশকে আধুনিক বাংলা গানে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। মেলোডিয়াস গানের কণ্ঠশিল্পী মাহামুদুন্নবী। সারাজীবন কেবল গানকেই লালন করে গেছেন তাঁর হৃদয়ে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গানগুলোর মধ্যে-তুমি যে আমার কবিতা/ তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো/ ও গো মোর মধুমিতা/ গীতিময় সেই দিন চিরদিন,/ সালাম পৃথিবী তোমাকে সালাম/ খোলা জানালার পাশে একা বসে আছি/ আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে-সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান। যে গানগুলোর
আবেদন এই যুগেও অমলিন।

শিল্পী মাহমুদুন্নবী বেশ কিছু গান গেয়েছেন দ্বৈত কণ্ঠে। সবই ছবির জন্য। যেমন কন্ঠশিল্পী ফেরদৌসি রহমানের সঙ্গে-

- কিছু আগে হলে ক্ষতি কি ছিল
- দেখে যেন মনে হয় যেন তারে চিনি

কিংবদন্তী কন্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর সঙ্গে-

- আমি তো কেবল বলেই চলি

আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে গাইলেন-

- কি আনন্দ দিয়ে এ ভুবন মাতিয়ে
- তুমি যে আমার কবিতা
- এই স্বপ্ন ঘেরা দিন রাখবো ধরে।

মাহমুদুন্নবী তাঁর লেখা ও সুরে আধুনিক গানে গতানুগতিক ধারার বাইরে নিয়ে আসেন কিছুটা পাশ্চাত্য এবং ক্লাসিক্যাল ধারা । এক সময় ‘আধুনিক সংগীত নিকেতন’ নামে একটা সংগীত স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে তাঁর সংগীত অনুরাগীরা তাঁর কাছে গান শিখতো।

১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রোমান্টিক চলচ্চিত্র দি রেইন-এ “আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই” গানটির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ১৯৭৭ সালে ২য় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৫৪ বছর বয়সে বাংলা আধুনিক গানের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাহমুদুন্নবী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

কিংবদন্তি এই শিল্পিকে এক সময় গানের জগত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সত্য সাহার সুরে গাজী মাজহারুল আনোয়ার এর লেখায় তার কণ্ঠে গীত ”আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কেন সৈকতে পড়ে আছি” গানটির জন্য একুশে পদক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে সেই পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
আর এই অভিমানে বাকি জীবন গান থেকে নির্বাসনে ছিলেন মাহমুদুন্নবী। গানের জগতে রাজনীতির শিকার হয়ে তিনি তখন সাংঘাতিকভাবে হতাশ একজন শিল্পী। ঘোষণা দিয়েও কেন তাঁকে একুশে পদক দেওয়া হলো না তা এখনো রহস্যাবৃত।


অশ্রু বড়ুয়া
গীতিকবি, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক
বাংলাদেশ টেলিভিশন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top