সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব আট) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:০১

আপডেট:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:১৯

 

নীলিমা চেয়েই থাকে নীল পাহাড়ের চূড়ায়। আকাশের সবটুকু নীল রঙ ঘুরতে ঘুরতে নীলিমার অদৃশ্য ত্রিনয়নে আবর্তিত হয়। খুব মনে পড়ে আজ সেইদিনগুলোর কথা। নীলিমা ভাবতে থাকে আপনমনে। চোখের পর্দায় নাচন ওঠে। খুব ঘন ঘন ছাদে যেতাম তখন। কারণে অকারণে। আমাদের ফ্ল্যাটের পাশের লাগোয়া ফ্ল্যাটটির ছাদটিও ছিল অপূর্ব। ও বাড়ির ছাদ ছিল নানান জাতের ফল গাছে ভরা। এক পাশে ছিল দারুণ একটি কৃত্রিম পুকুর। সেখানে ছিল ছোট ছোট মাছ আর লাল সাদা শাপলা। কি যে অপরূপ লাগতো!

 

আর আমাদের বাড়ির ছাদে শুধু ফুল আর ফুল। নানান জাতের ফুল। বেশির ভাগ আমার সংগ্রহের। প্রতিদিন বিকেল হলেই ছাদে যাওয়া আমার চাইই চাই। ও বাড়ির ছাদেও প্রতিদিন আসতেন মায়ের বয়সি একজন! তবে সন্ধ্যের কিছু আগে। মাছের খাবার দিতেন আর শাপলাগুলি নেড়ে চেড়ে দেখতেন। আমার তখন মনে হতো, শাপলাগুলি যেন আমিও নাড়ানাড়ি করছি।
------শাপলা ফুল নেবে নাকি একটা নীলু?
নীলু চমকে ওঠে!
-------তোমাদের ছাদে অনেক ফুলগাছ। শাপলা নেই কেন?
তুমিতো খুব ফুল ভালোবাসো। গান গাও, কবিতা লেখো
 ------আন্টি আপনি আমার এত কথা জানলেন কীভাবে?
------ বা রে! পাশাপাশি থাকি। শহরের মানুষ আমরা। এতো কাছে থেকেও কেউ  কাউকে চিনি না! আনন্দ তোমার কত্ত গল্প বলে আমার কাছে। আমার একমাত্র ছেলে। ওর বাবা নেইতো। ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়ে যত মনের কথা আমাকেই বলে মা।
------কিন্তু আমিতো আপনাদের ۔۔۔۔
------কিচ্ছু বলতে হবেনা মা!
আমার মেয়ে নেই। তুমি আমার একটা মেয়ে কেমন?

 

শুরুটা এরকম। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। এর কাছে, ওর কাছে জেনে, আড়ালে আড়ালে দেখেই আনন্দ আমার প্রেমে পড়ে গেল। বুয়েটের সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। এখনো তাই ছাত্রের গন্ধ গা থেকে মোছেনি বোঝা যায়। প্রতিদিন সকালে হাতে একটা ফাইল নিয়ে যেতে দেখতাম জানালা দিয়ে। বোধ করি, বেস্ট স্টুডেন্ট এর কৃতিত্ব জাহির। মনে মনে হাসতাম! ছাদে আসা বেড়ে গেলো। 

আনন্দ ছাদে আসতো আমায় ভালোবেসে। আর আমি যেতাম আমার ফুল পাখিদের ভালোবেসে। কিছুতেই তাকে সে কথাটি বোঝাতে পারছিলাম না। তো মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। পাল্টাপাল্টি চললো আমার প্রেমের অভিনয়ের অভিনব খেলা। কখনো ঢিল ছুড়ে চিঠি বিনিময়। বাইরে ঘোরাঘুরির জন্যে অনেক অনুরোধেও আনন্দের কাজ হয়নি। তারপর আর সে আমায় বাইরে ঘুরতে কোন অনুরোধ করেনি। চিঠিও আর বেশি লিখতে হয়নি। তার দিকে আমি একটু তাকিয়ে থাকলে, আনন্দ এতেই খুশি ছিল।

ছাদে তো দেখা হয়ই। তেমন কোন কথা না হলেও আমাকে দেখেই যেন আনন্দ তৃপ্ত থাকতো। মনে মনে আমি এটাই কামনা করতাম। প্রায় বছর ঘুরে এলো এভাবে। ইতোমধ্যে আনন্দ বড় মাপের একটা চাকরি পেয়ে গেছে। হঠাৎ করেই একদিন আনন্দ বললো, তার মা এখন উঠে পড়ে লেগেছেন একমাত্র সুপুত্রের বিয়ে দেবার জন্য।

খুব চিন্তার বিষয়। দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো আমারও। কি জানি কি হয়। আজকাল আনন্দ খুব টেনশান নিয়ে দু একটা চিঠি ছোড়ে আবার নতুন করে। বিয়ের কথার কোন ধারে কাছে নেই। কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব।

একদিন আমিই গায়ে পড়ে বললাম
۔۔۔۔۔۔۔তা আর কদ্দিন এভাবে চিঠি ছুড়বে আমায়?
এ চিঠির জবাবটা সেদিন আনন্দ চিঠিতে আর দেয় নাই আমাকে। খুব সহজেই ছাদে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে আমতা আমতা করে আমায় বললো,
-----আসলে কি জান নীলু, মা চাইছেন۔۔۔۔
কথাটি শেষ হতে না হতেই রাতুল এসে আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতুল আমার হাতের মুঠি শক্ত করে ধরে নিচে নেমে এলো। সেদিন ছিল আমাদের পালিয়ে আসার দ্বিতীয় বছর।
------ বাহ্ বন্ধু! কি অপূর্ব প্রেমকাহিনী তোমার!
ভাগ্যিস সত্যি সত্যি প্রেম করোনি ঐ ধোকাবাজ নিরানন্দের সাথে! কি ছেকাই না খেতে! নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে আরো একফালি নীল মেঘ নীলিমাকে ঢেকে দিয়ে উড়ে যেতে যেতে বললো।

নীলিমা আবার ফিরে এলো পার্থিব জগতে।

(চলবে)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top