সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

কুইন অফ মিস্ট্রী: আগাথা ক্রিস্টি : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
২৮ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:২৯

আপডেট:
২৮ জানুয়ারী ২০২১ ২০:০৭

ছবিঃ আগাথা ক্রিস্টি

 

১৯২৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর। রাত সাড়ে নটা। শীতের কুয়াশায়  ডুবে আছে বার্কশায়ার শহর। আস্তে করে সিঁড়ি  দিয়ে নিচের তলায় মেয়ের ঘরে নেমে এলেন এক বিদুষী তরুণী। সাত বছরের ফুটফুটে কন্যা রোজালিও তখন অঘোর নিদ্রায় মগ্ন। নীচু হয়ে  মেয়ের  কপালে চুমু খেয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে  নি:শব্দে গৃহত্যাগ  করলেন তরুণী।

পরের দিন লন্ডনের প্রতিটি সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এলো এক বিখ্যাত লেখিকার অন্তর্ধান কাহিনী। এই অন্তর্ধান রহস্যের  দ্রুততম সমাধানের জন্য হাজারখানেক ব্রিটিশ  পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া  হলো। বিখ্যাত লেখিকার হাজার হাজার ভক্ত ও  অনুরাগীর  দল ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামল তাঁর খোঁজে। সারা  দেশ তোলপাড় করা এই অন্তর্ধান রহস্যে  এই  প্রথম  ব্রিটিশ সরকার উড়োজাহাজ ব্যবহার করলেন। সেই  সময়ের দুই  বিখ্যাত রহস্য  উপন্যাস রচয়িতা স্যর আর্থার কোনান ডয়েল  ও ডরোথি সেয়ার্সকে  ব্রিটিশ পুলিশ  অনুরোধ  জানালো তারা যেন অপরাধ বিষয়ে তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এই বিখ্যাত লেখিকার অন্তর্ধান রহস্যের  সমাধান করেন। অকস্মাৎ  নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া এই বিখ্যাত লেখিকার নাম আগাথা ক্রিস্টি। এই অনুসন্ধান তদন্তে পুলিশ খুব   সহজেই খুঁজে পেল তাঁর ফেলে যাওয়া গাড়িটি যা তাঁর বাড়ীর খুব কাছেই একটি পরিত্যক্ত জায়গায় পড়ে ছিল। কিন্তু সেই গাড়ীর ভিতর উধাও হয়ে যাওয়া লেখিকার কোনো চিহ্নই ছিল না। গাড়ীটিও সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ছিল যাতে বোঝা যায় গাড়ীটি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয় নি। কি হলো সবার প্রিয় লেখিকার? অকর্স্মাৎ কোথায় গেলেন তিনি? সারা বিশ্ব তখন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। সংবাদপত্রগুলি একএকদিন একএকরকম খবর পরিবেশন করে কৌতূহল আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এমনকি আশেপাশের লেকের জল সার্চ করে দেখা হলো আত্মহত্যার সম্ভাবনা মাথায় রেখে। কিছুই পাওয়া গেলো না। পুলিশ যদিও আত্মহত্যা করার মত কোনো মোটিভ খুঁজে পায়নি। কারণ সেইসময় তিনি একজন সফল লেখিকা। তাঁর লেখা "দ্য মার্ডার অফ রজার আকরয়েড"হটকেকের মত বিক্রি হচ্ছে সর্বত্র। তবে কি এটা তাঁর কোনো পূর্বপরিকল্পিত পাবলিশিটি স্টান্ট? এই তথ্য ও খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য লাগেনি অনেকের কাছে। কেননা ইতিমধ্যেই তিনি এক জনপ্রিয়তম নাম। ব্রিটেনের ঘরে ঘরে তাঁর বই।

নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পরে খুঁজে পাওয়া গেল আগাথা ক্রিস্টিকে হ্যারোগেটের এক হোটেলে। কিন্তু রহস্যের জট ছাড়ালো না। কেননা লেখিকা নিজেই মনে করতে পারছেন না কেন তিনি বাড়ী ছেড়ে এত দূরে ছিলেন এতদিন? আরো একটি অদভুত ব্যাপার হলো হোটেলে তিনি থেরেসা নিল নামটি ব্যবহার করেছিলেন যা কিনা তাঁর স্বামীর রক্ষিতার নাম। হোটেলে তাঁকে কেউ জনপ্রিয় লেখিকা আগাথা ক্রিস্টি বলে চিনতে পারেনি। কেবল একজন মিউজিশিয়ান চিনতে পেরে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ও তাঁর স্বামী কলোনেল ক্রিস্টি ছুটে গেলে আগাথা ক্রিস্টি তাঁর স্বামীর সাথে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি তাঁর জীবিতকালে  কোনদিন ই মুখ খোলেননি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর অনুলেখক আন্ড্রু নরম্যানের মতে তিনি সম্ভবত: ঐ ১১ দিন কোনো এক সাইকোজনিক ট্রমা বা মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে ছিলেন যা তাঁর ব্যক্রিগত জীবনের কোনো বড় মানসিক আঘাতের ফল। তাঁর মায়ের মৃত্যু ও স্বামীর থেরেসা নিল  নামক মহিলার সাথে পরকীয়া সম্ভবত: তাঁকে সাময়িক স্মৃতিবিলোপের জায়গায় নিয়ে যায়। তবে আগাথা ক্রিস্টি তাঁর স্বামীর এই পরকীয়াকে মেনে নেন নি। ১৯২৮ সালে তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে ১৯৩০ সালে বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যর ম্যাক্স ম্যালোয়ানকে বিবাহ করেন।

আগাথা ম্যারি ক্লারিসা ক্রিস্টি ১৮৯০ সালে ১৫ই সেপ্টেম্বর ডেভনের টর্কের এক স্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফ্রেডারিক আলভা মিলার এবং মাতা ক্লারিসা মার্গারেট মিলার। তিন ভাইবোনের মধ্যে আগাথা ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ছোটবেলায় তাঁর স্কুলে যাওয়া হয়নি। মায়ের কাছে থেকেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। ভাষাশিক্ষার পাশাপাশি তিনি পাশ্চাত্ত্য সংগীতেও তালিম নেন। তবে তিনি তখন এতোটাই নার্ভাস ছিলেন যে কখনো স্টেজে পারফর্ম করতে পারতেন না। মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটলে পরিবারটি আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকে কল্পনাপ্রবণ ক্রিস্টি প্রথম উপন্যাসটি তাঁর বোনের সাথে চ্যালেঞ্জ করে লিখেছিলেন। একাধিক প্রকাশকের কাছ থেকে তাঁর লেখাটি ফেরৎ আসে। তবু তিনি থেমে থাকেননি। লেখা চালিয়ে নিয়ে গেছেন। ধৈর্য ধরে চেষ্টা করেছেন সাফল্যের মুখ দেখার জন্য। তারপর পেয়েছেন সুউচ্চ জনপ্রিয়তা যে জনপ্রিয়তা খুব কম লেখক ই ছুঁতে পেরেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আগাথা এক ওষুধের ডিসপেনসারীতে কাজ করতেন। এখানে  তাঁকে বিষ নিয়ে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছিল। আগাথার মাথায় এলো এর পরের উপন্যাসটি তিনি রহস্য উপন্যাস লিখবেন এবং এখানে খুনটা হবে বিষ দিয়ে। এইসময় রাস্তায় এক বেলজিয়াম ভদ্রলোককে দেখে তিনি স্থির করেলেন যে তাঁর সৃষ্ট  গোয়েন্দা চরিত্রটি হবে হুবহু এই ভদ্রলোকের মত। ছোটখাটো চেহারা, ডিম্বাকৃতি মুখের শেপ, জমকালো গোঁফ আর যিনি উত্তেজিত হলেই অনর্গল ফরাসী ভাষায় কথা বলেন। সৃষ্ট হলো প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন গোয়েন্দা এরাকুল পোয়ারোর। তাঁর প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস "দ্য মিস্টিরিয়াস আফেয়ার আট স্টাইলিশ" ১৯১৬ সালে। দুজন প্রকাশকের কাছ থেকে ফেরত আসার পর তৃতীয় জন উপন্যাসটি ছাপলেন। হু হু করে বিক্রী হলো বই। রহস্য উপন্যাসের পরিমন্ডলে আগাথা ক্রিস্টি নক্ষত্রের মত জায়গা করে নিলেন। তাঁর লেখা মোট চৌত্রিশটি রহস্য উপন্যাসে এরাকুল পোয়ারোরকে আমরা পাই। এরপর আগাথা সৃস্টি করলেন মিস জেন মার্পেল। পঁয়ষট্টি বছরের প্রৌঢ়া, হাতে উল কাঁটা, চোখের নিরীহ দৃষ্টিতে তাকে আপামর নিরীহ দিদিমাই মনে হয় অথচ যাকে দিয়ে আগাথা বারোটি  রহস্য উপন্যাসের সফল অনুসন্ধান করেছেন। এই দুই রহস্যসন্ধানী ছাড়াও তাঁর উপন্যাসগুলিতে রয়েছে কিছু দু:সাহসিক জুটি যারাও রহস্যমোচনে দক্ষ। টমি আর টাপেন্স, বিল আর বান্ডল, ববি আর ফ্রাঙ্কল ইত্যাদি।

কি ছিলো সেই জাদু তাঁর কলমের আগায় যা আপামর সবাইকে টেনে রাখে মন্রমুগ্ধের মত? চারপাশের সমাজ থেকে তুলে আনা এক জমজমাট রহস্য কাহিনী যা তিনি আগাগোড়া বুনে গেছেন ঝকঝকে সহজ ভাষায়, হালকা কৌতুকের পরশ দিয়ে। উপন্যাসে আগাগোড়া যে ব্যক্তিকে সবচেয়ে নিরীহ মনে হয় শেষে আকস্মিক ঘটনার মোড় ঘুরে প্রমাণিত হয় সেই ব্যক্তিই অপরাধী। অপরাধ জগত নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন ক্রিস্টি। তাঁর রচনায় বেশিরভাগ খুন বা অপরাধ অস্ত্র  দিয়ে নয়, বিষপ্রয়োগে। তাঁর গোয়েন্দারাও অস্ত্র নয়, মগজাস্ত্রে ধূলিশায়ী করে দেন অপরাধীদের। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি জানিয়েছেন যে সমাজে বৃশংস লোভী, ক্ষমতালোলুপ লোকেরাই অপরাধী হয় আর এই অপরাধের যোগ্য শাস্তি হলো জনমানবশূন্য প্রান্তরে তাদের নির্বাসন দেওয়া অথবা তাদের গিনিপিগ বানিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় লাগানো যেতে পারে তাহলে নিরীহ মানুষদের উপর তারা যে অপরাধ করে তা খানিকটা স্থালন হয়। তাঁর উপন্যাসে গাড়ীর ড্রাইভার, মালী, কুক, মেড, এমনকি স্কুলের ছাত্রীরাও একটা বড়ো ভূমিকায় থাকে রহস্য উন্মোচনের সূত্র হিসাবে। অপরাধীরা প্রত্যেকেই বাইরে থেকে ভক্ত, শিক্ষিত, মার্জিত আলাপচারিতায় পটু চারপাশের পরিচিত জগত থেকে উঠে এসেছে। সারা জীবনে ক্রিস্টি ইরাক, সীরিয়া, ইজিপ্ট ইত্যাদি বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং তাঁর উপন্যাসের পটভূমিকা হিসাবে এইসব দেশ একাধিবার স্থান পেয়েছে।

আগাথা ক্রিস্টি ৬৬টি রহস্য উপন্যাস, ১৪টি ছোট গল্প সঙ্কলন, ও বেশ কিছু ড্রামা লিখেছেন। তাঁকে কুইন অফ মিস্ট্রী বলা হয়। বিশ্বে রহস্য উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক লেখকদের মধ্যে একজন। তাঁর রচিত নাটক "মাউসট্রাপ" বিশ্বের দীর্ঘতম সময় ধরে (১৯৫২-২০২০) ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৭১ সালে অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারারের ডেন কমান্ডার খেতাব দেওয়া হয়। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের তথ্যানুসারে আগাথা ক্রিস্টি বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের লেখক। পৃথিবীতে  বাইবেল ছাড়া আর কোনো লেখকের এত বই বিক্রী হয় নি। ইউনেস্কোর  বিবৃতি  অনুসারে তিনি একমাত্র লেখক যার রচনা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

লেখকের সৃষ্ট গোয়েন্দারা কাহিনীর রহস্য উন্মোচন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো গোয়েন্দা কাহিনীর লেখকের পক্ষে কি মৃত্যুর পরেও রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব? আগাথা  ক্রিস্টির ক্ষেত্রে সেই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল। তিনি বেঁচে না থাকলেও সেই রহস্য সন্ধানে তাঁকে ৫০% ক্রেডিট দেওয়া হয়েছিল। লন্ডনের একটি হাসপাতালে একটি বাচ্চা কোন এক অজানা রোগে প্রায় মারা যেতে বসেছিল। ডাক্তাররা ধরতে পারছিলেন না বাচ্চাটির অসুখটা কি? ঘটনাচক্রে হাসপাতালের যে নার্স শিশুটির দেখাশোনা করছিলেন তিনি ছিলেন আগাথা ক্রিস্টির ভক্ত। শিশুটির উপসর্গ দেখে নার্সটির আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস "দ্য পেইল হর্স" এর কাহিনীটি মনে পড়ে যায়। উপন্যাসটির একটি চরিত্র থ্যালিম পয়জনে আক্রান্ত হয়েছিল। সেই নার্স অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে উপন্যাসের চরিত্রের রোগের লক্ষণের সাথে হাসপাতালের ওই মুমূর্ষ শিশুটির আশ্চর্য মিল রয়েছে। চিকিৎসকেরা যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, শেষ মূহুর্তের  চেষ্টা হিসাবে নার্সটি বাচ্চাটির থ্যালিয়াম লেভেল পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা করে দেখা গেল শিশুটির শরীরের থ্যালিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় দশগুন বেশি। এরপর শুরু হলো নতুন করে চিকিৎসা। শিশুটি সুস্থ হয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে শিশুটির বাড়িতে নিয়মিত কীটনাশক রাখা হত। সেই কীটনাশকের মধ্যেই ছিল থ্যালিয়াম।

১৯৭০ সাল থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে এবং ১৯৭৬ সালে ১২ই জানুয়ারী ৮৫ বছর বয়সে অক্সফোর্ডশায়ারে তাঁর  নিজের বাড়ীতে আগাথা শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর শেষ রহস্য উপন্যাস "স্লিপিং মার্ডার" তাঁর মৃত্যুর পর অক্টোবর ১৯৭৬ এ প্রকাশিত হয়। এক অসাধারণ সৃজনশীলতা, মনস্তাত্বিক জ্ঞান, তীক্ষ্ণ সংলাপ রচনা দিয়ে রহস্যের জাল বুনে আগাথা ক্রিস্টি মার্ডার মিস্ট্রী নভেলের ক্ষেত্রে এক ঝড় তুলে দিয়েছিলেন, সেই জনপ্রিয়তার ঝড় আজো বিদ্যমান। আগাথা ক্রিস্টি তাই বাস্তবিক অর্থেই কুইন অফ মিস্ট্রী।

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top