সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব নয়) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:২৮

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৩:০৮

 

কি হলো বন্ধু, আজ সাত সকাল বেলাই ফুলের ডালা হাতে নিয়ে আঙিনায় বসে বসে কি ভাবছো এতো!
- আজকের সকালটা ভারি সুন্দর নীল। তোমার চূড়াটায় আজ এতো নীলের ছড়াছড়ি কেন? মেঘেরা দল বেঁধে নাচানাচি করছে। ব্যাপার কি বলতো?
- তোমার হাতে সুগন্ধি ফুলের ডালা রয়েছে যে! নিশ্চই আজ তুমি ভিন্ন কোন কাহিনী শোনাবে আমাদের।
- ঠিক ধরেছো!
- শুরু করো তাহলে।
- একি আকাশের কি হলো? মেঘ করলো নাকি?
- না, না মেঘেরা তোমার গল্প শুনতে কাছাকাছি এসে গেছে, তাই একটু অন্ধকার লাগছে।
- শোনো, তোমাদের মধ্যেও দেখো কেমন একতা আছে। আছে সখ্যতা, ভালোবাসা। কৃত্রিমতা নেই কোন। আকাশ মেঘের সাথে, পাহাড় নদী কিংবা সাগরের সাথে দারুন সখ্যতা। অথচ দেখো আমরা মানুষ জাতটা চরম জঘন্য। পুরুষদের বাড়াবাড়ির শেষ নেই। নারীকে তারা মানুষই ভাবেনা।
- মানে? কোন খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি বন্ধু?
- আজ রাতুল এর স্বপ্ন দেখে মনটা আমার ফুরফুরেই ছিল। হঠাৎ এক বান্ধবির ফোন পেয়ে আর ভালো রইলোনা মনটা ।
- কেন, বান্ধবীর স্বামী মারা গেছেন নাকি?
- তাহলেতো ভালোই হতো। বুড়োকালে আর একটা বিয়ে করেছে গোপনে!
- এখন উপায়?
- উপায় আর কি হবে, তাইতো ভাবছি! এই দেখোনা, আমাদের দেশে নারী পুরুষের ডিভোর্স হলে, কিংবা বৌ মারা গেলে, তার বাবা মা, আত্মীয় স্বজন, এমনকি খুব কাছের  বন্ধুবান্ধবও তাকে আবার বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগে যায়!
- হুঁ, কিন্তু কেন বলতো?
- তাকে কে রান্না করে খাওয়াবে, বাছাধনের জামাকাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করে দেবে কে, অসুখবিসুখ হলে সেবা করবে কে, যৌনচাহিদা মেটাবে কে, বংশের প্রদীপ জ্বালাবে কে! তিনি পুরুষ মানুষ! তার জন্য একজন সেবিকা লাগবেই! কাজেই বিয়ে তাকে দিতেই হবে ! অথচ দেখো যুগে যুগে অনেক উদাহরণ আছে, অনেক অল্প বয়সে বিধবা হয়ে কিংবা তালাকপ্রাপ্ত হয়েও একটি কন্যা সন্তান নিয়ে নারী জীবন কাটিয়েছে! তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একইভাবে একজন নারীর ডিভোর্স বা স্বামী মারা গেলে আবার বিয়ে খোঁজা হয়!
- তার ও কোন কারন আছে নিশ্চই!
- তার কারণ হলো, পরিবারের ভাবনা হয়, এই নারীকে এখন খেতে দেবে কে, এ এখন কোথায় থাকবে, কার সাথে থাকবে, সমাজে কীভাবে ভাল মেয়ে হিসাবে পরিচিতি পাবে, নিরাপত্তা দেবে কে, তাকে পরপুরুষ থেকে রক্ষা করবে কে, ইত্যাদি ইত্যাদি! কাজেই, দেখা যাচ্ছে আসলে বিয়ে জিনিসটা পুরুষরা করে সেবিকা আনতে, আর মেয়েরা করে তার বডিগার্ড আনতে। মেয়ে শিক্ষিত কর্মজীবী হলেও সে স্বামীর আয়ে চলবে ফিরবে ঘুরবে আহামরি ভাব দেখাবে এবং স্বামীর নিরাপত্তার ছত্র ছায়ায়ই সে থাকবে। আবার পুরুষটি যদি নিজে রাঁধতে বাড়তে ও ঘরের কাজ কর্ম করতে জানেও, তবু বিয়ের পর এইসব কাজ সে করবেনা ! দাসী বাদীর মতো বউকেই করতে হবে তার সবকিছু এবং বউ স্বামীর গা পা টেপা থেকে বাচ্চা লালন পালন সব কাজই করবে যেন স্বামী সেবার জন্যই নারী জাতির জন্ম ! পুরুষরা এমনই ভাবে, আজও নারীকে !
- তার মানে কি দাঁড়ালো বন্ধু?
একসঙ্গে মেঘ ও নীল চূড়া ঝাঁপিয়ে পড়লো নীলার ওপর !
- তোমরাই বলো দেখি !
- না না আমরা বিয়ে করিনা বন্ধু। আমাদের বন্ধন আত্মিক বন্ধন। কোন জাত কূল নেই আমাদের। এই দেখোনা মেঘপবন কিংবা চন্দ্রতারা বা আকাশনদী। আমরা সবাই একে অন্যের পরিপূরক।
- কেন, আমরা নারী পুরুষ কি তা হতে পারি না! আমরাওতো একে অন্যের পরিপূরক।
- তাহলে কেন তোমাদের মধ্যে এই বৈষম্য বন্ধু?
- আমাদের দেশে বিয়ে করে, আসলে নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হয় না, তারা হয় একে অপরের সেবিকা ও নিরাপত্তাকর্মী। মানে ঘরের দাসি ও দারোয়ানও বলা যায়। এরা একে অপরের সাথি হবার জন্য বিয়ে করে না। বিয়ে করে শুধুই সার্ভ করতে। অবশ্য ব্যতিক্রম ও আছে! হাতেগোনা। এর ও অনেক কারন আছে। বুঝলে !
- তার মানে, রাতুল ও কি তোমায় এমন ভাবতো ?
- মোটেইনা! ঐ যে  বললাম, ব্যতিক্রম ও আছে। রাতুল ছিল এমনই একজন ব্যতিক্রমী পুরুষ। আসলে কি জানো, আমাদের দেশের প্রধান কারণ নারী পুরুষের একটা অসম ও  অসভ্য শ্রম বিভাজন। আমাদের দেশে এখনো শিক্ষিত মায়েরাও তার ছেলেকে ঘরের কাজ, নিজের কাজ, বাড়ির লোকের দেখাশোনা, মুরুব্বিদের সেবা, ইত্যাদি কিছুই শেখান না! তাই পরিবারের সেই ছেলেটি এসব বিষয়গুলোতে পুরোপুরি ঘরের নারীর উপর নির্ভর করে। হয় বউ, নয়তো মা, নয়তো কন্যা। এক গ্লাস পানিও তারা ঢেলে খেতে চায় না, নিজের খাবারটা গরম করে নিতেও দ্বিধাবোধ করে। জানলেও করেনা! যেন তার আতে বাধে! বহু পুরুষ আলমারির কোথায় নিজের শার্ট আছে, সেটারও কোন খবর রাখে না।
- আর নারীদের কি ঘটে বন্ধু?
- নারীদের ক্ষেত্রে কী হয়? শোন বলছি, নারীদের একটা বড় অংশ বাইরের কাজ- যেমন ব্যাংকের কাজ, বিল দেয়া, ট্যাক্স দেয়া ইত্যাদি, পাশাপাশি ঘরের ইলেক্ট্রনিক্সের কাজ, এটা ওটা সারানো, ইন্টারনেট বা কম্পিউটার চালানো শেখে না। অনেকেই এমনকি বাজারঘাটও করতে জানে না। বাইরে গিয়ে কোনখান থেকে কোন কাজ করতে হবে, এ নিয়ে পুরাই মূর্খ থেকে যায়। ফলে এরা আপাদমস্তক স্বামী, ভাই বা বাপের উপর নির্ভরশীল হয়! কারণ এরা ছোটবেলা থেকেই ঘর থেকে শিখে আসছে যে এগুলো পুরুষের কাজ। এই যে নারী পুরুষের শ্রমের বিকৃত একটা বিভাজন রয়ে গেছে আমাদের দেশে,এতে করে একটি জনগোষ্ঠী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে, যাদের দুটি অংশের কোন অংশই জীবনযাপনের সাধারণ ব্যাপারগুলোতে শতভাগ দক্ষ না। পুরুষ অংশটি গৃহস্থালী কাজে অপারগ। আর নারী অংশটি বহির্বিশ্ব ও অন্যান্য টেকনিক্যাল কাজে পুরোটাই অজ্ঞ বা মূর্খ। ফলে দেশের পুরো জনসংখ্যার দুটি ভাগই অর্ধ পঙ্গু এবং একে অপরের উপর নেতিবাচকভাবে নির্ভরশীল। দেখা যায়, বৃদ্ধকালে বউ মরে গেলে পুরুষের যে  হাড়ির হাল হয়, যতটা না নারীর হয়। বুড়ো মরে গেলেও বুড়ি নিজের খাবার নিজে রান্না বান্না করে খেতে পারে। অন্যদিকে সন্তান রেখে স্ত্রী মারা গেলে বা চলে গেলে, তরুণ শক্তিমান স্বামীটিও ভ্যা ভ্যা করে ঘুরতে থাকেন, কারণ তিনি বাচ্চা সামলাতে শেখেন নাই। এক্ষেত্রে স্বামী চলে গেলেও সন্তান লালনের কাজটি নারী একাই করতে পারেন। কিন্তু যেহেতু তিনি স্বামীর অর্থে চলতেন, সেজন্য তাকে অর্থের জন্য কষ্ট পেতে হয়। হঠাৎ বাইরে গিয়ে ওষুধ কেনা, বাচ্চার খাবার কিনে আনা ইত্যাদি বিষয়ে এতদিন পুরুষের ওপর নির্ভরশীল থাকায়, এক্ষেত্রেও সমস্যায়  পড়েন। এই সমাজে কেউই পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেন না। না নারী না পুরুষ। লিঙ্গ বৈষম্য এজন্যই কুৎসিত। লিঙ্গভেদে কাজ ভাগ করে দেবার সিস্টেমটা খুবই দুর্বল। এতে দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
- এখনতো শিক্ষার মান বেড়েছে বন্ধু!
- হ্যা, সেজন্যই এখন আধুনিককালের বাপ মা যারা সচেতন, তারা ছেলে মেয়ে উভয় সন্তানকেই সমানভাবে দেখেন ও সেইভাবে কাজ শিখান ও দক্ষ করে তোলেন। ছেলে মেয়ের প্রত্যেককে পূর্ণ মানুষ হয়ে আত্মবিশ্বাসি কিরে তোলেন। বিদেশে যেমন জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ- সবই নিজেকে করতে হয়!
-তাহলে বন্ধু মোদ্দাকথা কি দাঁড়ালো?
- ঘর থেকেই সব শুরু করতে হবে ! একজন মা'ই পারেন সমাজ পরিবর্তন করতে! এই আত্মবিশ্বাস পুরুষের থাকতে হবে!
- খুব সুন্দর কথা বলেছো বন্ধু !
- তাতো বললাম তোমাকে বন্ধু! আমি আজ অন্যরকম ভাবছি!
- কি ?
- ভাবছি এবার আমিই বলবো আমার বান্ধবিকে বিয়ে করতে।
- সে কি কথা!
- এরকমইতো হওয়া উচিৎ।
- সবাইতো আর তোমার রাতুল এর মতো নয় বন্ধু ! তুমি অনেক ভাগ্যবান!
- এখন আমার তাই মনে হয় বন্ধু।
- এই যে এখনো তুমি ডালা ভরে ফুল কুড়াও।
- হুঁ, ডালায় ভরা শিউলি ফুলগুলো রাতুল এর খুব প্রিয় ছিল যে।
- বাহ্ ! গল্পে গল্পে কি সুন্দর মালা গেঁথে ফেলেছো বন্ধু !
- নাও নীল, মালাটি তোমাকে দিলাম! তোমার চূড়ায় পড়িয়ে দিও!
- বলো কি বন্ধু !
- ঠিকই বলেছি নীল! আমিতো ওখানেই খুঁজে পাই রাতুলকে!
নীল পাহাড় হাতছানিতে মালাটি পরিয়ে দেয় চূড়ায়!
(চলবে)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top