সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

বাবা ইন্টিকুলুস : ফারুক নওয়াজ 


প্রকাশিত:
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:২০

আপডেট:
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:০৭

 

হি’মাদ্রিপুর। 

ছোট্ট মফস্বল রেলস্টেশন। উত্তরদিকে চলে গেছে ছোটলাইন। ট্রেনের বগিগুলোও ছোট। ঠিক রূপসা থেকে বাহিরদিয়া-ভিতরদিয়া হয়ে বাগেরহাট থেকে যেতে যেমন ছোটলাইনের ট্রেনে চাপতে হতো সেরকম। 

চারপাঁচটা বগি নিয়ে বলে কয়লার ইঞ্জিন। কু ঝিক ঝিক কু...। ঝক ঝক ঝকর ঝকর। ধানক্ষেত। বনবাদাড়। ছোট ছোট ছবির মতো গ্রাম আর হাটখোলা। দু’পাশেল বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে ট্রেনটা যায়। যেন মামাবাড়ি গরুর গাড়ি। দুলে দুলে চলে। দুলুনিতে চোখ জুড়ে ঘুম নামে। 

রাতের ট্রেনটায় উঠে বসলে মজা অন্যরকম। যেন ছায়াপথের ভেতর দিয়ে কোনো অচেনা গ্রহে যাত্রা। মাঝে মাঝে ঘন আঁধার। শূন্য মাঠের ভেতর দিয়ে গেলে দূরের গ্রামে খড়োঘরে নিবু নিবু হারিকেনের আলো জ্বলতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে উড়– উড়– জোনাকিরা জ্বলা-নেভা, সঙ্গে ঝিঁঝিঁর ঝিনঝিন, সেই সাথে কোথাও হুম হুম হুতুমপেঁচাটা ডেকে উঠলে মনে হবে রহস্যময় এক তেপান্তরের অচিনরাজ্য। 

এই হিমাদ্রিপুর থেকে ছোট লাইনের উত্তরের শেষ স্টেশন নিঝুমডাঙা। পাহাড়িকা গ্রাম। নিঝুম-নিশ্চুপ পরিবেশ। সবচেয়ে বড় পাহাড়ের নাম সবুজপাহাড়। মাঝখানে এই সবুজ পাহাড়কে রেখে চারপাশে আরো দশটি ছোট পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। দূরে দূরে পাহাড়ি মানুষের গোল-গোল ছাতার মতো কাঠপাতায় ছাওয়া ঘরবাড়ি। 

এই পাহাড়কে দেবতা মনে করে পাহাড়ের আদিবাসীরা। 
সাঁওতাল, গারো, হাজং, খাসিয়া, চাক-নানা সম্প্রদায়ের বাস এই পাহাড়ের চারপাশে। নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হলেও সবাই যেন এখানে এক জাতি। সবাই পাহাড়ি। 

ওরা পাহাড়ে জুমচাষ করে। ওদের হাতের পরশে পাহাড়গুলো সবুজ দ্যুতি ছড়ায়। 

পাহাড়কে ওরা ভালোবাসে। পাহাড়ও ওদের ঋণ শোধ করতে চেষ্টা করে ফসল দিয়ে, গাছের ফল-ফুল ছায়া দিয়ে, ঝরঝর স্বচ্ছ নির্ঝরের পানি দিয়ে। 

পাহাড়িরা গাছ কাটে না। বরং বর্ষার শুরুতেই নতুন নতুন চারা লাগায়। যেগুলো শুকিয়ে মরে গিয়ে ডালপালা এলিয়ে দেয়, সেগুলোকে ওরা জ্বালানি হিসেবে চুলায় দেয়। 

 

নিঝুমডাঙা মাতিয়ে রাখে নানারঙের পাখির কাকলি। পাহাড়ি বনভূমি ছাপিয়ে রাখে হরেক রকম জীবজন্তু। আছে নীল হরিণ, সবুজ বানর, গোলাপি শেয়াল আর বাদামি কচ্ছপের মতো দুর্লভ বিচিত্রপ্রাণী। 

সাঁওতালপাড়ার মঙ্গু। খাসিয়া কিশোরী ঝুমকা, চাকমা মেয়ে নীলাঞ্জনা। আর হাজংপাড়ার ডাকাবুকো ছেলে, মিঙজঙ, বুবলা, ডুডুং এরা বিকেল হলেই সবুজপাহাড়ের ঢালে বসে গল্পে মেতে ওঠে। কখনো বা কানামাছি আর টিপোটিপো, মানে ছুঁয়োছুঁয়ি খেলে। 

এমন হাসিখুশি সুখ-আনন্দেও ঠিকানা ওদের সবুজ শ্যামল নিঝুমডাঙা। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু যেন উলটপালট হয়ে যায়। 

হাঁও-মাঁও-খাঁও পাহাড়ের গন্ধ পাঁও। এমন গন্ধ পেয়ে দূর বহুদূর থেকে অপাহাড়ি মানুষগুলো পিল পিল করে আসতে থাকে সেখানে। 

হাজং ছেলে ডুডুং আর বুবলার ঠাকুরদা কদিন আগে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নটা হলো এমন

আকাশে কালো মেঘ জমেছে। সেই মেঘের গা ফুটো করে দৈত্যর ভয়ংকর চেহারার কালো কালো অসংখ্য মানুষ তীর ধনুক বাগিয়ে উড়ে উড়ে নামছে সবুজ পাহাড়ের চূড়ায়। 

পাহাড়িপল্লীর সবচেয়ে বয়সী মানুষ ডুডুঙের এই ঠাকুরদা। সবাই উর্ব বুড়ো বলে চেনে। 

বড়রা বলে বুড়োজ্যাঠা। ছোটরা দাদুমশাই। 

এই দাদু আজ পর্যন্ত যা যা স্বপ্ন দেখেছে সবই ঠিক ঠিক ফলে গেছে। 

পঞ্চাশ বছর আগে  একবার এই দাদু স্বপ্নে দেখেছিল সবুজপাহাড়ের দক্ষিণের খাদ বেয়ে রঙধনুরঙ ঝর্ণার ধারা কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। আর সেই ধারা থেকে জন্ম নিচ্ছে স্বচ্ছ জলের একটা সরু নদী। স্বপ্নটা দেখেই ঘুম ভেঙে দাদু গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে, ওরে ওই উল্পি, রঙ্গ, সিলসিলি, বিল্ব তোরা কে কোথায় আছিস? জেগে ওঠ। সবুজ পাহাড় নদী বানিয়েছে। চল...চল...দেখে আসি...।

তখন মাঝরাত। রাতটা ছিল বাসন্তিপূর্ণিমা। চারদিক সোনার আলোয় ঝকমকে। 

দাদুর ডাকে পুরো পল্লী জেগে ওঠে। সবাই ছোটে সবুজপাহাড়ের দিকে। ওরা যেতে যেতে থমকে যায় সারি সারি পাইনগাছের কাছে। 

দক্ষিণে যেন রুপোর ধারা বয়ে যাচ্ছে। সেই রুপোর স্রোতে চাঁদের প্রতিবিম্ব আনন্দে দুলছে। 

হ্যাঁ, এই নদীটা, যেটা এখন পাহাড়িদের আদুরে রজতগাঙ। এই রজতগাঙে বসন্তের প্রথম পূর্ণিমারাতে পাহাড়িদেরও আনন্দস্নান জমে ওঠে। 

বছরে একটি রাত। তখন তীরঘেঁষে মেলা বসে। সে মেলায় আসে কত রঙের মানুষ। রঙ মেখে ওরা রঙিন হয়। কত বাহারী জিনিসপত্র, কত খেলনা। ঘুড়ি, লাটাই, তীর-ধনুক, বেত-বাঁশের হরেক সামগ্রী। আর রাতভর চলে আনন্দ, হাসিখুশি গানের আসর। 

সেই উর্বদাদু আবারও স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু স্বপ্ন আগের মতো সুখের নয়। দুঃখের স্বপ্ন পাহাড়ি মানুষের চোখের ঘুম চুরি করে নিয়েছে। দু’সপ্তাহ ধরে রাতভর জেগে জেগে প্রহর গোনে পাহাড়িরা। 

মনে সুখ নেই। কোন আপদ আবার হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসে কে জানে। এমন করে কাটে আরো একুশ রজনী। 

হঠাৎ একদিন সত্যিই সবুজ পাহাড় ঘিরে গড়ে ওঠে ভিন্ন মানুষের ঘরবাড়ি। আখড়া এ মানুষেরা গাইতি চালায়। পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে শহরে যায় বিক্রি করতে। 

রজতগাঙের রুপোর মতো স্বচ্ছ জল ঘোলা করে তারা। সবুজ পাহাড়ের সবুজ গাছগুলো কেটে নিয়ে যায় সাম্পান ভরে ভরে। 

পাহাড়ি মানুষগুলোর চোখ ভরে কান্না নামে। প্রকৃতির সন্তান তাই প্রকৃতিকে মায়ের মতো ভালোবাসে তারা। পাহাড় ওদের দেবতা, মা, ত্রাণদাত্রী। ওরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে প্রাণাধিক সবুজপাহাড়ের সর্বনাশ। 

না, এটা সহ্য করা যায় না। প্রথমেই সাঁওতাল সর্দার অসন্তোষ তীর-ধনুক বাগিয়ে জেগে ওঠে। তার সাথে যোগ দেয় খাসিয়া তরুণ বিলক্ষণ। জেগে ওঠে হাজং-দলপতি রঙ্গন সর্দার। তাদের মাঝখানে বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে যায় চাক গ্রামপতি প্রমেশ। 

ওরা যুদ্ধ চায়। লড়াই করে ভিনদেশি সর্বনাশের কবল থেকে প্রিয় সবুজপাহাড়কে রক্ষা করবে ওরা। এমন যখন উদ্ধত ওরা তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় উর্ব বুড়ো। 

কাশের মতো সাদা চুলভ্রুর উর্বদাদু ওদের শান্ত হতে বলে। দাদু বলল, তারচেয়ে চলো আমরা গিরিদেবতার কাছে প্রার্থনা করি। গিরি দেবতার নাতি ইন্টিকুলুস আমাদের রক্ষা করবে। লড়াই করে অযথা জীবননাশ আমরা চাই না। জীবহত্যা মহাপাপ। আমরা এই পাপে জড়াতে চাই না। 

সবাই উর্ব বুড়োর কথায় শান্ত হলো। সবাই হাতের বল­ম, তীর-ধনুক, কোচ, ঢাল মাটিতে রেখে দিল।

আষাঢ়ি অমাবস্যার রাত। 

এই রাতটিই ওরা বেছে নিল প্রার্থনার জন্য। 

সবুজপাহাড়ের পুবদিকে বয়ে গেছে রজতগাঙ। গাঙের তীরে সারা পাহাড়পল্লীর ছেলেবুড়ো, নারী-পুরুষ বসে যায় একাগ্র প্রার্থনায়। 

সবাই কণ্ঠ ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনামন্ত্র শুরু করে হে গিরিদেবতার নাতি ইন্টিকুলুস। তুমি আমাদেও বাঁচাও! আমরা ভিনদেশি পাহাড়ঘাতকদের সর্বনাশ থেকে রেহাই পেতে চাই। এসো হে যুদ্ধ ও শান্তির মহান বীর বাবা ইন্টিকুলুস!

এভাবে চলল রাতভর প্রর্থনামন্ত্র, কোরাস। 

তারা গাইতে থাকে

হায়য়ো হা হায়য়ো হা
হায়য়ো বাবা ইন্টিকুলুস
আয়য়ো আ আয়য়ো আ
আয়য়ো বাবা পিন্টিপুলুস... 

তাদের কণ্ঠ থেকে মন্ত্র কোরাস যেন জাদুমন্ত্রের মতো হাওয়ায় ভেসে ভেসে আঁধার আকাশে সুরের ঝাঁজর হয়ে বেজে ওঠে। সেই সুর ছড়িয়ে পড়ে অনেক অনেক দূরে...।

হঠাৎ আঁধারের বুকজুড়ে এক টুকরো বিচ্ছুরণ ঝলকে ওঠে। সেই আলোর ছটার ভেতর থেকে যেন বেরিয়ে এল এক অলৌকিক রুপালি মহাবীর। 

খালি গা, মাথায় পাথরের যুদ্ধতাজ, হাতে বাঁকানো এক অদ্ভুত ভুভুজেলা বাঁশি। বাঁশি বাজাতে বাজাতে নেমে এল সে। নেমে এল একেবারে সবুজপাহাড়ের চূড়োয়। 

ঘন আঁধারের মাঝে পাহাড়চুড়োয় এক স্বর্গীয় রুপের দেবতা। স্পষ্ট দেখতে পেল মানুষ। সে সেই চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে বাঁশিতে সুর তুলল। সে সুর থামে না। বাজে দীর্ঘলয়ে। সেই সুরে সারা পাহাড় কী এক মায়াবী আবেগে কেঁপে কেঁপে ওঠে। 

এক সময় বাঁশি লঘু থেকে লঘুতর সুরে বাজতে থাকে। পাহাড়চুড়ো যে কে বাঁশি মুখেই নেমে আসে সেই রুপালি মহাবীর। যুদ্ধ ও শান্তির সাহসী দেবতা। 

তাকে অভিবাদন জানাতে ছুটে যায় পাহাড়ি ছেলে-বুড়ো, মা-মেয়ে, ছোট্ট খুকিটিও। 

ওরা গিয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে এক অদ্ভুত দৃশ্য। যারা পাহাড়ের সর্বনাশ করতে এই সবুজপাহাড়ের চারপাশে গড়ে তুলেছিল ধ্বংস ছাউনি, তারা ভয়ে হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছে অদ্ভুত বাঁশিঅলা দেবতা ইন্টিকুলুসের কাছে। 

বাঁশিওয়ালা এবার বাঁশি থামিয়ে নির্দেশ দেয়, যাও! তোমরা চলে যাও এই পাহাড় ছেড়ে দূরে তোমাদের নিজস্ব আবাসে। আমি প্রকৃতির দূত। আমি ইন্টিকুলুস। হিন্দুকুশ পার হয়ে বহু বহু ক্রোশ দূর থেকে আমি ছুটে এসেছি এই সবুজ পাহাড়ের বকুচেরা কান্না শুনে। 

ভিনদেশি শহুরে লোকগুলো দেবতা ইন্টিকুলুসের নির্দেশ মতো  ফুট ফুট করে সবকিছু ফেলেছুড়ে ধাওয়া খাওয়া শরণার্থীর মতো ছুটতে থাকে পশ্চিমের আপন ঠিকানায়। 

ওরা চলে যায়। 

ওদের শেষ লোকটি চলে যাওয়ার পর ইন্টিকুলুস মুখ ফেরায় পাহাড়ি প্রিয় মানুষদের দিকে। পাহাড়ের সন্তানেরা মাথা নিচু করে পরম শ্রদ্ধার কৃতজ্ঞতা জানায়। 

‘তোমরা মাথা তোলো!’
ইন্টিকুলুসের গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ওরা মাথা তোলে। 
হ্যাঁ, আমি আছি এবং থাকব। এই পাহাড়ের দক্ষিণে যেখান দিয়ে পবিত্র স্রোতস্বিনী রজতগাঙের জন্মযাত্রা সেখানেই থাকব আমি। আমি ইন্টিকুলুস। 
আমার ধর্ম মানুষের মঙ্গল সাধন। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ইহুদি শিখ ব্রাহ্ম এতসব বুঝি না আমি। আমি শুধু মানুষ বুঝি। 
আমি শান্তির অমোঘ বার্তাবাহক, তবে দুরাচার দুর্বৃত্তদের রুখতে আমি কখনো বা হয়ে উঠি যুদ্ধ ও ধ্বংসের ভয়াল দানব। হয়ে উঠি অনির্বাণ রুদ্র জিয়ো। 
প্রিয় পাহাড়সন্তানেরা শোনো, যারা এসেছিল তোমাদের কান্না ঝরাতে, তারা চলে গেছে। এখন নিরাপদ সবুজপাহাড়। নিরাপদ তোমরা সবাই। 
আমি ইন্টিকুলুস, দুর্জনের কাছে আমি ভয়ার্ত ভয়াবহ। 
আমি আছি তোমাদেরই কাছাকাছি। প্রয়োজনে আবার দেখা দেব। যাই-ইন্টিকুলুস আমি। আমি যাই... প্রিয় মানুষেরা। 
তখন ভোরের আলো পাহাড়ের চূড়োয় আলোর পরশ ছড়িয়ে নতুন দিনের শুভ সূচনা করে। পাখিরা আবারো মেতে ওঠে প্রভাতকাকলিতে। 

সবুজপাহাড়ের ঝর্ণা তান তোলে নতুন নৃত্যের। রূপোলি রজতগাঙ ঢেউয়ের ঘুঙুর বাজাতে বাজাতে চপলা বালিকা হয়ে ছুটে যায় সাগরের দিকে। উর্ব বুড়ো হাসে। হাসে পাহাড়ি শিশুরা। হাসে খাসিয়া, হাজং, সাঁওতাল, চাক পাহাড়ের মাটির মানুষেরা। 

আজ পূর্ণিমা নয়, তবু আজ রাতভর রজতের পাহাড়জুড়ে বসবে আনন্দমেলা। জমবে নতুন উৎসব। হাসিগানে মুখর হবে সবুজপাহাড়। 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top