সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব দশ) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:০৮

আপডেট:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:২৫

ছবিঃ নীল পাহাড় এবং লেখিকা শাহান আরা জাকির পারুল

 

খুব উত্তরি শীতল হাওয়া বইছে আজ! মাঘের শেষ দিক। বেশ ঠান্ডা পড়েছে! বাতাসের শা শা শব্দ। নীল পাহাড়টায় আজ বেশি ঘন নীল নেই। কুয়াশার ঝাপসা সাদা চাদরে যেন চূড়াটা ঢেকে গেছে আজ। আনমনা হয় নীল পাহাড়। বুঝতে পারে বাতাস আজ তোলপাড় করবে খুব। গাছের ডালে ডালে ধাক্কা মেরে এক্কা দোক্কা খেলবে। গাছএর ডালগুলো একে ওপরের গায়ের ওপর নুয়ে পড়বে। অনেক পাতা ঝরে যাবে। নিশ্চই কোন খারাপ খবর আছে। খারাপ কিছুর নিশানা পেলেই বাতাস এমন গুমরে ওঠে আচমকা।

নীল পাহাড়ের প্রস্তুতি থাকে আগে থেকেই। বাতাস তার খুব ভালো বন্ধু। কনকনে ঠান্ডা বাতাস শীত কালেতো হবেই। আবার গ্রীষ্মের দুপুরেওতো বাতাস কত নির্মল বায়ু আর খরতাপ রৌদ্রে মানুষকে শীতল করে দেয়। বসন্তে কি মোহময় হওয়ার দোলনা দুলিয়ে দেয় প্রকৃতিতে। প্রতিটি ঋতুর সাথে বাতাসের গভীর ভালোবাসা আছে যে।

কিন্তু আজ বাতাস এমন উথাল পাথাল করছে কেন। নীল পাহাড় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ এক চিলতে রোদ্র হাসে আকাশটায়! বাতাস ধীরে ধীরে শান্ত হয়। নীলিমা গায়ে শাল জড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। এক কোনে থাকা দোলনায় দুলতে থাকে। এ পাশটায় বেশ খানিকটা রোদ্র পড়ে। আজ তেমন একটা রোদ নেই। নীল পাহাড়ের চূড়ায় ঘন কুয়াশায় ছাইরঙা মেঘ জমে আছে। হঠাৎ ঝলমল রোদ্রের কিছুটা চূড়াটাকে অপরূপ কোরে তোলে।

নীল পাহাড় হাতছানি দেয় নিলীমাকে, বাহ্ চমৎকার নীল চাদর পড়েছো বন্ধু।

- হুঁ, তোমারও তো আজ অনন্য লাগছে নীল।
- কি যে বলো, বাতাস যে ভয়টা দেখালো আজ।
- দেখাবেনা! আজ ভোরেইতো এক রাষ্ট্রদ্রোহী রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর হলো।
- তাই নাকি! এজন্যই তাহলে বাতাস এমন রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছিল।
- ঠিক বলেছো!
- নিশ্চই আজ তাহলে তুমি এই রাজাকারের বৃত্তান্ত শোনাবে বন্ধু। নীল পাহাড় যেন নড়ে চড়ে ওঠে।
নীলিমাও প্রস্তুত হয়।
- হু তা নিশ্চই শোনাবো তোমাকে। কিন্তু রাজাকার এর গল্প শুনতে হলে তোমায় আরো অনেক গভীরে যেতে হবে বন্ধু। ধৈর্য ধরে শুনতে হবে কিছু ঘটনা। তাহলেই এই রাজাকার বৃত্তান্তগুলি পরিষ্কার হবে তোমার কাছে, বুঝেছো?

- প্রয়োজনে নিশ্চই শুনবো। তুমি বলো বন্ধু।
- আচ্ছা। তাহলে শোনো। এই যে আমি প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে মন খুলে গল্প করি, তোমার নীল পাহাড়ের চূড়ার অপরূপ প্রকৃতি স্বাধীনভাবে উপভোগ করি۔۔۔۔এসব এর জন্য এতো স্বাধীনতা কোথায় পেলাম আমরা, কিভাবে পেলাম, তা আগে জানতে হবে। আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমি কিন্তু এমনি এমনি পাইনি। অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষায় আমরা এই ভূখণ্ড পেয়েছি। স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তারই ছোট্ট একটা ঘটনা তোমাদের আজ বলি কেমন।

হঠাৎ একরাশ ঘন কুয়াশা এসে নীল পাহাড়ের গাছগুলি একেবারে ঢেকে দিলো। নীলিমা চমকে গেলো! শীতল দমকা বাতাস এর শিন শিন শীত এ গা জমে যেতে থাকলো যেন!
- ভয় পেওনা বন্ধু। তুমি যে গল্প বলবে আমি তার সাক্ষী। বলতে পারো কালের সাক্ষী আমি। এরকম মাঘের শীতে কত সহজ সরল মানুষকে হত্যা করেছে শত্রুরা। আর এ সবের সহায়তা করেছে ঐসব রাজাকার আর দেশদ্রোহী দালালেরা। তাইনা বন্ধু!
- একদম ঠিক বলেছো কুয়াশা বন্ধু। আজ তোমাদের এমনি এক নারকীয় ঘটনার সাক্ষী, বধ্যভূমির কাহিনী শোনাবো, কেমন?
- হ্যা বন্ধু বলো।
নীল পাহাড় ও কুয়াশা উৎসুক হয়ে বসে। এর মধ্যে সূর্য মামা হঠাৎ উঁকি মেরে হো হো করে হাসতে হাসতে বলে,
- আমিও বাদ যাই কেন?
কুয়াশাকে ধাক্কা মেরে দূরে সড়িয়ে দেয় সূর্য। রোদ ঝিলমিল প্রকৃতি যেন নেচে ওঠে।
- যাক বাবা! রোদ পোহায়ে গল্প করা যাবে।
সবাই খুব খুশি হয়। নীলিমা বলতে থাকে,
- ''বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি'' নামে ঢাকা শহরের মিরপুর এলাকায় একটি বধ্যভূমি আছে। করুন সে ইতিহাস! বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংসতায় ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষ শহীদ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটাই সবচেয়ে বড় গণহত্যা। ১৬ ডিসেম্বের ১৯৭১ এ বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় লাভ করলেও ঢাকার মিরপুর এলাকা হানাদার মুক্ত হয় সবচেয়ে দেরিতে, ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ এ। মিরপুর এলাকা বিহারী অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে হত্যাকান্ডের ব্যাপকতাও ছিল বেশি। মিরপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণক্ষেত্র। বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি শুধু মিরপুরেই নয়, বাংলাদেশের অন্যতম একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা বাঙলা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে অজস্র মুক্তিকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বর্তমান বিন্যাস অনুযায়ী, কলেজের অভ্যন্তরে বড় গেট ও শহীদ মিনারের মাঝামাঝি প্রাচীর সংলগ্ন স্থানে ১৯৭১ এ বিশাল পুকুর ছিল এবং হানাদার বাহিনী এই পুকুরের পাশে মুক্তিকামী মানুষকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত। মূল প্রশাসনিক ভবনের অনেক কক্ষই ছিল নির্যাতন কক্ষ। কলেজ হোস্টেলের পাশের নিচু জমিতে আটককৃতদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হতো। অধ্যক্ষের বাসভবন সংলগ্ন বাগানে আম গাছের মোটা শিকড়ের গোড়ায় মাথা চেপে ধরে জবাই করা হতো, ফলে হত্যার পর এক পাশে গড়িয়ে পড়তো মাথাগুলো, অন্যপাশে পড়ে থাকত দেহগুলো। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই বাঙলা কলেজ ও আশেপাশে নৃশংস হত্যাকান্ড চলেছে, হয়েছে নারী নির্যাতন। কলেজের বর্তমান বিশালায়তন মাঠটি তখন ছিল ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি। বিজয়ের মুহূর্তে তখন এই মাঠসহ পুরো এলাকা ও কলেজ জুড়ে পড়ে ছিল অজস্র জবাই করা দেহ, নরকংকাল, পঁচা গলা লাশ। বিভীষিকাময় গণহত্যার চিহ্ন ফুটে ছিল সর্বত্র। এই হলো একটি বধ্যভূমির চিত্র। এ ধরণের আরো অনেক বধ্যভূমির সন্ধান এখনো পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। বুঝেছো বন্ধুরা।

সব ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো কুয়াশা, সূর্য ও নীল পাহাড়! তাদের দুচোখ ভরে গেল জলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবাই নীরবে অশ্রু মুছলো।
- আজ এটুকুই থাক বন্ধু! আগামীকাল আমাদের এক কিশোর ভাষা শহীদ ভাই এর আত্মত্যাগের কাহিনী শোনাবো তোমাদের কেমন?
- আচ্ছা!

এই ফাঁকে কুয়াশা শোকে ও সূর্যের মিষ্টি তাপে কখন মিলিয়ে গেছে! নীল পাহাড় আরো নীল বর্ণ ধারণ করেছে। সূর্যটা তাপ বাড়িয়েছে। যার যার কাজে তারা মগ্ন হয়। নীলিমা ও গায়ের নীল চাদরটা সড়িয়ে একটু গা'টা মিষ্টি রোদে চাঙ্গা করে ঘরে ফেরে।

(চলমান)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top