সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব এগার) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৩৭

আপডেট:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:৫১

ছবিঃ নীল পাহাড় এবং লেখিকা শাহান আরা জাকির পারুল 

 

স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার আগে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা পোহাতে হয়েছে আমাদের বুঝলে নীলপাহাড় বন্ধু!

- হু ۔۔তাতো তোমার বলা ইতিহাস থেকে সব জানতে পারছি!এখন বলো সেই কিশোর মতিউর এর শহীদ হওয়ার কাহিনী।

- হ্যা বলছি শোন। আজ থেকে ঠিক ৪৮ বছর আগের ঘটনা, যা আজ ইতিহাস। দিনটি ছিল ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি। সেদিন ছিল হরতাল। এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান সরকার বিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় তীব্র এক গণঅভ্যূত্থানে। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্র হয়। পাকিস্তানি শাসকেরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মল্লিক, মকবুল,রুস্তম ও আলমগীর এই চারজন।

- চারজন! বলো কি বন্ধু!

- তাদের রক্তের বিনিময়েইতো স্বাধীনতা পাওয়া।

- আমার খুব কান্না পাচ্ছে বন্ধু। এরপর কি হলো! নীল পাহাড়, সূর্য, বাতাস সবাই চোখ মুছতে মুছতে একসাথে জিজ্ঞেস করলো, নীলিমাও চোখ মুছে বলতে থাকে, 

- এরপর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। বাংলাদেশ এর রাষ্ট্র গঠন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই গণআন্দোলনকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ১৯৬৯-এর সেই ঐতিহাসিক অগ্নিঝরা দিনগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল।

সময়টা ছিল এমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে তখন বন্দী। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনির মৃত্যুর দিন গুনছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেবেন।

সে কারণে শেখ মুজিবকে ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটে আনার পর আবার গ্রেপ্তার করে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলার আসামী হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করা হয়। এই মামলার প্রকৃত নাম ছিল "রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান"। উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ করা। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে জানুয়ারির চিত্র আমূল পাল্টে যায়।  তখন প্রথম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এবং ডাকসুর ভিপি এবং জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন এবং পরে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন-এর একটি অংশ এসে যোগ দেয়। ১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১০জন ছাত্র নেতার সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন সংগঠিত করা হয়! প্রতিবাদে ২০শে জানুয়ারি মিছিল বের করা হলে সে মিছিলের গুলিতে মারা যান ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি।

আসাদের মৃত্যুর প্রতিবাদে পরদিন আবার কলাভবনে কর্মসূচি দেয়া হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে যোগ দেয়। বাদ পড়েননি শ্রমিকরাও। সে সময় আসাদের মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে আরো বেগবান হয়ে ওঠে আন্দোলন। আসাদের গায়ের জামা দিয়ে পতাকা তৈরি করে, তার লাশ শহীদ মিনারে রেখে সবাই শপথ নিয়েছিল, ' "আসাদ তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।"

আসাদের লাশ নিয়ে মিছিল বের করা হলে সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী বিউগলে জানায় 'ডেঞ্জার, ডেঞ্জার ... 

এরপর ২১শে জানুয়ারি পল্টনে ২২ থেকে ২৪শে জানুয়ারি পর্যন্ত পরবর্তী তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেদিন সেখানে মাওলানা ভাসানীও ছিলেন, ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।"

তিনি জানান, "২২ তারিখ এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে কালো পতাকা ওঠেনি। ২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর হয় মশাল মিছিল। তৎকালীন আজাদ পত্রিকায় যার শিরোনাম হয়েছিল 'স্মরণকালের বৃহত্তম মশাল মিছিল'। এরপর ২৪শে জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়। পল্টনে লক্ষ লক্ষ লোক জমায়েত হন।

ঢাকা শহরের সমস্ত মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগুন জ্বলছে। মানুষের স্রোত পল্টনের দিকে। এসময় মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর - এই চারজনকে গুলি করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগরতলা মামলার সাক্ষী, তৎকালীন মন্ত্রী, এমনকি বিচারপতির বাড়িতেও মানুষ আগুন লাগিয়ে দিল। সে ছিল এক বিশাল গণ-অভ্যুত্থান। পল্টন ময়দানে জড়ো হয়েছিল পাঁচ লক্ষ লোকের বিশাল সমাবেশ। জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড আক্রোশ এবং ক্রোধ কাজ করছিল।"

শহীদ মতিউরের জানাযা আদায় করে মিছিল নিয়ে তৎকালীন ইকবাল হলের দিকে চলে গিয়েছিলো! ছাত্র সমাজ, মেহনতি জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের একতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয় এই আন্দোলনকে ঘিরে। আন্দোলন তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়!

জানা যায়, ২৪শে জানুয়ারি নিহত হওয়া নবকুমার ইন্সটিটিউটের ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান এর আগে পল্টনে আসাদের গায়েবানা জানাযাতে অংশ নিয়েছিল। মতিউর এর বাবা বলেন, মতিউরকে আন্দোলন থেকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন!

সে সময় মৃত কিশোর মতিউরের পকেটে হাত দিয়ে একটি চিরকুট পাওয়া যায়, যেখানে লেখা ছিল ------"মা আমি মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি তাহলে মনে করো, তোমার মতিউর বাংলার মানুষের জন্য, শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল, ইতি মতিউর রহমান।"

এই হলো এক কিশোর দেশপ্রেমিকের শহীদ হওয়ার ইতিহাস!বুঝেছো ? একি তোমরা দেখি কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছ একেবারে!তাহলে রাজাকার এর কাহিনী কিভাবে শোনাবো তোমাদের!
- না না আমরা শুনবো বন্ধু!
 ঠিক আছে আজ তাহলে এটুকুই থাক কেমন!
ইতমধ্যে সূর্য গোধূলির আবির ছড়িয়েছে! নীল পাহাড়ের চূড়া ধূসর বর্ণ মেখেছে!বাতাস স্তব্দ হয়ে গেছে!
যে যার জায়গায় চলে যায়! নীলিমা ও ঘরে ফিরে আসে!
(চলমান)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক গবেষক

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top