সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার গর্বিত পঞ্চাশ বছরঃ

মসলিনের সোনালী অতীত ইতিহাসের খোঁজে : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১৩ মার্চ ২০২১ ১৯:১৮

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৪৬

 

এপার বাংলার বালুচরি আর ওপার বাংলার মসলিন-নামটার সাথে জড়িয়ে আছে এক বর্ণময় সোনালী অতীত। ওপার বাংলায় উৎপাদিত ঢাকাই মসলিন  এক সময় সারা বিশ্বে রপ্তানি হত। আসলে  মসলিনের সাথে জড়িয়ে আছে  শত শত বছরের  ইতিহাস। শুধুমাত্র  ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, ইউরোপীয়  ললনাদের অঙ্গেও শোভা পেত মসলিন। ইতিহাস থেকে  জানা যায় যে সম্রাট  নেপোলিয়নের  পত্নী সম্রাজ্ঞী জোশেফিন তার অন্দরমহলে  মসলিনের পর্দা ব্যবহার করতেন। মসলিন  অতিমিহি ও সৃক্ষ্ম কাপড়। ইরাকের টাইগ্রিস নদীর তীরে 'মসূল' নামক জায়গায় একরকম সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি  হত এক সময়ে। এই 'মসূল' নামক শব্দটি থেকেই ওপার বাংলার মাটিতে তৈরি মিহি কাপড়টির নাম হয়ে  যায় মসলিন। এই কাপড়ের একটি বিশেষত্ব হলো,  কাপড় অতি সূক্ষ্ম, কাঁচের মত স্বচ্ছ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এক কুয়াশার মায়াজাল।  ঢাকার  মসলিন ছিল অত্যন্ত  মিহি ও মোলায়েম। ৪০হাত লম্বা, ২হাত চওড়া  মসলিন কাপড় অনায়াসেই একটা  আংটির মধ্যে দিয়ে গলিয়ে  নেওয়া যেত। কথিত আছে যে এক সময় বণিকরা  ঝিনুকের  খোলের ভিতরে  শত শত মসলিন  কাপড় অনায়াসেই আনা-নেওয়া  করতেন। মসলিনের সুতো উৎপাদিত হত ফুটি কার্পাস নামে বিশেষ এক ধরনের  তুলো থেকে। একটা  সময়ে ২৮ রকমের মসলিন কাপড় উৎপাদিত হত--

(১) মলবুম, মলমল খাস,আব-ই-দরোয়ান, জুনিয়র, শবনম, বদন খাস, জামদানি (সেকালের সূক্ষ্ম মসলিনকে জামদানি বলা হত) ।

বাংলাদেশের সুপ্রাচীন কালের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের গৌরবময় স্মারক হলো মসলিন। প্রথম খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকেই রোম সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে অভিজাত রোমান নারীরা ঢাকার মসলিন পরে দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শন করতে ভালোবাসতেন। একই শতকে রচিত ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ শীর্ষক গ্রন্থে মসলিন সম্পর্কে বিশেষ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এতে মোটা ধরনের মসলিনকে মলোচিনা, প্রশস্ত ও মসৃণ মসলিনকে মোনাচি এবং সর্বোত্কৃষ্ট মসলিনকে গেনজেটিক বা গঙ্গাজলী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো—শেষোক্ত ‘গঙ্গাজলী’ বা ‘গঙ্গার জল’ শাড়ির কথা খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে প্রচলিত ‘সোনাই বিবির পালা’তে প্রত্যক্ষ করা যায়, যেমন—‘পরথমে পাইড়াইল শাড়ি ভাইরে/শাড়ি নামে গঙ্গার জল/নুখেতে নইলে শাড়ি/আরও করে টল্মল রে!/পানিতে থইলে গো শাড়ি/শাড়ি পানিতে মিলায়/শুখেনায় থইলে শাড়ি ভাইরে/পিঁপড়ায় টাইন্যা লইয়া যায় রে।’ এখানে প্রথম খ্রিস্টাব্দে ভিনদেশিদের বর্ণিত মসলিনের বিবরণের সাথে বাংলাদেশের মৌখিকরীতিতে প্রচলিত কিস্সাপালার বর্ণনার অসাধারণ সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তার অর্থ মসলিনের দুই হাজার বছরের স্মৃতিসত্তা লোকায়ত বাংলাদেশের মানুষের চেতনায় সজীব রয়ে গেছে। পাশাপাশি মসলিনের ইতিহাস অন্বেষণে প্রাচীনকালের হেরোডোটাস, স্ট্র্যাবো হতে টলেমি, প্লিনি পর্যন্ত অনেক ইতিহাসবিদের রচনায় ঢাকাই মসলিনের উল্লেখ পাওয়া যায়।

গবেষক বার্ড উড প্রমুখ পণ্ডিত গবেষণা করেছেন যে, ঢাকাই মসলিন প্রাচীন এশিরীয় ও ব্যাবিলনে বিশেষ খ্যাতিলাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। উইলফোর্ড মন্তব্য করেছেন—একটি ব্যাবিলিয়ন বস্ত্র ফিরিস্তিতে ঢাকাই মসলিনের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিলাস-ব্যসনেও ঢাকাই মসলিন ব্যবহূত হতো। মিশরের প্রাচীন কবরে বাংলাদেশের নীলে রঞ্জিত ও মসলিনে জড়ানো মমির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইয়েট বলেন—খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ঢাকাই মসলিন গ্রিসে বিক্রি হতো।

মসলিনের সূক্ষ্মতার কথা ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা হতে জানা যায়। যেমন—প্লিনি অভিযোগ করেছেন যে, মসলিনের ক্ষীণ আব্রুর ফাঁকে রোমান সুন্দরীরা দেহের বঙ্কিম রেখা প্রকাশ করত। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার ‘ঝুনা’ মলমল নামের বিশেষ ধরনের মসলিন পরার কারণে গ্রিক যুবকগণ সেখানকার দার্শনিক ও ব্যঙ্গকাব্য লেখক-কবিদের কঠোর সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন। এছাড়া, কুলভা নামের একটি প্রাচীন তিব্বতি গ্রন্থে ঝুনা মলমল পরিহিতা এক ভ্রষ্টা ধর্মযাজিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এমনকি সাত প্যাঁচ আবরোঁয়া মসলিন পরার পরও উলঙ্গ ভ্রমে শাহজাদি জেব-উন্নেছা পিতা বাদশাহ আওরঙ্গজেবের কাছে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশকালের এই সকল ঘটনাবলি মসলিনের সূক্ষ্ম বুননশৈলী ও মিহি কাপড়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দেয়।

বাংলাদেশের মসলিন ও বস্ত্রের সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্য বহু বিদেশি পর্যটককে মুগ্ধ করেছে। খ্রিস্টীয় নবম শতকে আরব পর্যটক ও ভূগোলবিদ সুলেইমান ‘সিলসিলাত-উৎ-তাওয়ারিখ’ শীর্ষক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন—রুমি নামের এক রাজ্যে (খুব সম্ভবত বর্তমান বাংলাদেশ) এমন একধরনের মিহি ও সূক্ষ্ম বস্ত্র পাওয়া যায় যে ৪০ হাত লম্বা ও ২ হাত চওড়া এমন একটি কাপড় একটা ছোট আংটির মধ্য দিয়ে অনায়াসে চালাচালি করা যায়। চর্তুদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে আসেন আফ্রিকার মরক্কো দেশীয় পর্যটক ইবনে বতুতা, তিনি সোনারগাঁওয়ে উত্কৃষ্ট মসলিন তৈরি হতে দেখেন। তিনি তা দেখে চমত্কৃত হয়ে মন্তব্য করেন—এমন উন্নতমানের বস্ত্র হয়তো সারা দুনিয়ায় আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। পঞ্চদশ শতকে চীনা পর্যটক মাহুয়ান সোনারগাঁওয়ে মলমল ও অন্যান্য প্রকৃতির মসলিন তৈরি প্রত্যক্ষ করেন। এরপর ষোড়শ শতকে ইংরেজ পর্যটক রলফ ফিচ, পর্তুগিজ পর্যটক ডুয়ার্টে বারবোসা এবং অষ্টাদশ শতকের ডাচ পর্যটক স্ট্যাভোরিনাস বাংলাদেশের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে মসলিন তৈরি প্রত্যক্ষ করেন এবং মসলিনের সূক্ষ্ম ও মিহি বুননের প্রভূত প্রশংসা করেন। শুধু বিদেশি পর্যটক নন, বাংলাদেশে তৈরি মসলিনের সূক্ষ্ম, মিহি ও দৃষ্টিনন্দন বুননে বিস্ময় প্রকাশ করেন ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম। তিনি খ্রিস্টীয় ১৭৫০ সালে বাংলাদেশে অবস্থান করার সূত্রে মসলিনের বুনন ও ঐতিহ্য প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। তিনি লিখেছেন—‘এমন অবিশ্বাস্য রকমের সূক্ষ্ম কাপড় কী করে যে এখানকার মানুষ তৈরি করতে পারে, তা আমার কাছে একটি ধাঁধা। বিশেষ করে এই কারণে যে, এসব কাপড় তৈরি করতে যেসব যন্ত্রপাতি অপরিহার্য মনে হয়, তা থেকে এরা বঞ্চিত।’ রবার্ট ওরম বাদশা ও তাঁর হারেমের জন্য ঢাকায় যে সকল আশ্চর্য সূক্ষ্ম ও মিহিবস্ত্র তৈরি হতো তাও প্রত্যক্ষ করেন এবং বলেন—এ সকল বস্ত্র এতই উত্কৃষ্ট ছিল যে এগুলোর দাম ইউরোপীয়দের জন্য যে বস্ত্র তৈরি হয় তার ১০ গুণ। ব্যাখ্যায় তিনি জানিয়েছেন, বাংলার তাঁতিদের বিশেষ ধরনের অনন্য দক্ষতার জন্যেই এত উচ্চমানের বস্ত্র তৈরি সম্ভব হয়েছিল। তিনি আরও বলেন—যান্ত্রিক ব্যাপারে এদেশীয় তাঁতিদের দক্ষতার অভাব থাকলেও তাঁদের মধ্যে সার্বিক সংবেদনশীল নমনীয়তা ছিল। এদেশের রাঁধুনির হাত যেকোনো ইউরোপীয় সুন্দরীর হাতের চেয়ে আরও কোমল আর সুন্দর ছিল।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রিপোর্ট থেকে জানা যায়—বাংলার তাঁতিরা কোনো ‘মেশিন’ ছাড়াই নিজেদের উদ্ভাবিত অতি সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও অতিসূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি করে।

প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশে সেকালে মসলিন বা অন্যান্য সূক্ষ্ম-মিহি বস্ত্রের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে সস্তা ও মোটা বা মাঝারি মানের বস্ত্রও তৈরি হতো। সস্তা বা মোটা ও মাঝারি মানের বস্ত্র ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো আসার আগে এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রচুর রপ্তানি হতো। কিন্তু সূক্ষ্ম ও মিহি বস্ত্র রপ্তানি হতো মূলত আগ্রা, লাহোর, মুলতান, পারস্য উপসাগর ও লোহিতসাগর অঞ্চলে। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোও সাধারণ বস্ত্রের সঙ্গে কিছু মিহি সুতার বস্ত্র রপ্তানি করত। তবে, রাজা-বাদশাদের জন্য তৈরি খুব বেশি দামি মসলিন তারা তেমনভাবে রপ্তানি করত না, কারণ তার খদ্দের পাওয়া বেশ মুশকিল হতো।

গবেষকদের মতে, মসলিন তৈরির প্রাচীনতম কেন্দ্র ছিল অধুনা ভাওয়াল জঙ্গলে পরিবেষ্টিত কাপাসিয়া। মধ্যযুগে ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রধান উত্পাদনকেন্দ্রে পরিণত হয় সোনারগাঁও এবং আধুনিক যুগে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাবেষ্টিত ১৯৬০ বর্গমাইল জুড়ে উত্কৃষ্ট মসলিন তৈরি হতো। এই অঞ্চলে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে চার হাজার এক শত ষাটটি তাঁতে মসলিন তৈরি হতো। ঢাকা, সোনারগাঁও, ডেমরা, তিতবদ্ধী, বালিয়াপাড়া, নাপাড়া, মৈকুলি, বাছারক, চরপাড়া, বাশটেকি, নবীগঞ্জ, শাহপুর, ধামরাই, সিদ্ধিরগঞ্জ, কাচপুর প্রভৃতি জায়গাগুলো মসলিন তৈরির প্রধান কেন্দ্র ছিল।

মসলিন তৈরির জন্য প্রয়োজন হতো বিশেষ প্রকারের সূক্ষ্ম সুতা। যা অন্য কোথাও থেকে আমদানি করা হতো না। বরং বাংলাদেশের মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীতীরবর্তী এলাকায় বয়রাতি ও ফুটি কার্পাসের আবাদ করা হতো। সেই কার্পাসের তুলা হতে ষোল থেকে ত্রিশ বছরের মেয়েরা তাঁদের স্পর্শকাতর আঙুলের সাহায্যে মিহি সুতা তৈরি করতেন। তবে, মেঘনা নদীতীরবর্তী ফুটি কার্পাসের তুলা থেকে তৈরি সুতাই ছিল উন্নতমানের মসলিন তৈরির মূল উপকরণ। বয়রাতি কার্পাসের সুতায় অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্টমানের মসলিন তৈরি হতো।

কার্পাসের তুলা থেকে সুতা উত্পাদনের পর সুতা নাটান, টানা হোতান, সানা বাঁধা, নারদ বাঁধা, বু-বাঁধা ইত্যাদি পর্যায় অতিক্রম করার পর মসলিন বোনা হতো। কিন্তু মসলিন বোনার পর আরও অন্তত তিনটি পর্যায় অতিক্রমের মাধ্যমে মসলিন বাজারজাতকরণ হতো। যার মধ্যে ছিল—কাপড় ধোয়া, সুতা সুবিন্যস্ত করা ও রিফু করা এবং ইস্তিরি, রং ও সূচের কাজ। পরিশেষে থাকত কাপড়ের গাঁটরি বাঁধা। মজার ব্যাপার হলো—মসলিন উত্পাদন ও বিপণনের জন্য প্রতিটি ধাপে আলাদা আলাদা পেশাজীবী ছিলেন। প্রতিটি পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বা পেশাজীবী কাজগুলো সম্পন্ন করতেন। তাই মসলিন তৈরি ও বিপণন ছিল মূলত একধরনের সামাজিক পেশাজীবীর কর্ম, যার প্রতিটি স্তরে দক্ষতার সুষম বিন্যাস ছিল।

বিভিন্ন গবেষণায় অন্তত ১৫ প্রকার মসলিনের নাম পাওয়া যায়, যেমন—১. মলবুস খাস, যা সাধারণত মোগল বাদশাহ ও পরিবারবর্গ ব্যবহার করতেন, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে মোগল বাদশাহদের জন্য মসলিন পাঠানো বন্ধ হয়ে গেলে মলমল খাস নামে আরেক ধরনের উন্নতমানের মসলিন তৈরি শুরু হয়। ২. সরকার-ই-আলা (আলি), বাংলার নবাব সুবাদারদের জন্য এগুলো তৈরি হতো। ৩. আব-ই-রওয়ান, প্রবহমান পানির সাথে মিশে যেতে পারত এ ধরনের মসলিন। ৪. ঝুনা, নবাব-বাদশাহ শুধু নয়, ধনী ও বিত্তশালী পরিবারের মেয়েরা ঝুনা ব্যবহার করতেন, তাছাড়া গায়িকা ও নর্তকীরাও ঝুনার তৈরি জামা ব্যবহার করতেন। ৫. শবনম, এত মিহি ছিল যে, ভোরবেলা শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দিলে শিশির আর এই মসলিনের পার্থক্য বোঝা যেত না। ৬. নয়নসুখ বা তনসুখ, সাধারণত গলাবন্ধ রুমাল হিসেবে ব্যবহূত হতো। ৭. খাসা, অত্যন্ত মিহি, সূক্ষ্ম ও ঘন করে বোনার জন্য বিখ্যাত ছিল। ৮. আলাবালি বা আলিবালি। ৯. তনজেব, শরীর বা দেহের সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে এই মসলিনের সুনাম ছিল। ১০. তরন্দাম, অন্যান্য মসলিনের তুলনায় কিছুটা মোটা। ১১. সরবন্দ, ইউরোপের মেয়েরা সরবন্দ দিয়ে তৈরি জামা, রুমাল ও স্কার্ফ ব্যবহার করতেন এবং উচ্চপদস্থরা সরবন্দ মসলিনে তৈরি মাথার পাগড়ি পরতেন। ১২. ডুরিয়া বা ডোরিয়া, সাধারণত ভোগা বা সিরোঞ্চ জাতীয় তুলা থেকে ডোরিয়া মসলিন বোনা হতো, এ ধরনের মসলিন একটু মোটা ছিল বলে তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের জামা বানানো হতো। ১৩. চারকোনা, চারকোণ বিশিষ্ট মসলিনকে চারকোনা বলা হতো। ১৪. জামদানি, যে সকল মসলিনে তাঁতেই নকশা করা হতো সেগুলোকে জামদানি বলা হতো, মোগল বাদশাহদের মলবুস খাস তাঁতখানার একটা বড় অংশে শুধু জামদানিই বোনা হতো। বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, নবাব, সুবাদার ছাড়াও বহু ধনী এবং অভিজাত শ্রেণির কাছে জামদানির বেশ চাহিদা ছিল। ১৫. বদন-খাস, সূক্ষ্ম বুননের বদন-খাস দিয়ে সাধারণ গায়ে পরার জামা তৈরি করা হতো।

ব্রিটেনের কার্পাসশিল্পের ইতিহাসপ্রণেতা বেইন্সকে বাংলার মসলিন এতটাই বিস্ময়ের ধাঁধায় ফেলে দেয় যে, তিনি বলতে বাধ্য হন—‘এগুলি কোনো পরি বা কীটপতঙ্গের বোনা—মানুষের দ্বারা এ বুনন সম্ভব নয়।’ আসলে, মসলিনের সূক্ষ্মতার যে বর্ণনা কালে কালে ইতিহাসের পাতায় গাঁথা আছে তাকে বাস্তব মনে হয় না, রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। কিন্তু তার বাস্তব ইতিহাস বহু দেশের বহু ঐতিহাসিকের তথ্যে প্রমাণ।

সম্প্রতি আমার সৌভাগ্য হয়েছে বাংলাদেশের দুই সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন মসলিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ‘হাওয়ায় ইন্দ্রজাল’ একটি নৃত্যনাট্য রচনার। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশি-বিদেশি উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সামনে সাধনা নামের একটি সংগঠন তা ঢাকা আহসান মঞ্জিল প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ করে। সেই নৃত্যনাট্যে বাংলাদেশের মসলিনের বিবর্তনের ইতিহাস এবং দেশীয় তাঁতশিল্পের গৌরবগাথার সামগ্রিকতা গ্রথিত করতে সক্ষম হয়েছি বলে মনে করি। শুধু তা-ই নয়, আমাদের প্রাচীনতম সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে প্রচলিত মৌখিকঐতিহ্যে প্রচলিত মসলিন প্রসঙ্গ কীভাবে চর্চিত হচ্ছে তার কিছু সূত্র উল্লেখ করেছি। অদূর ভবিষ্যতে মসলিনের সামগ্রিক ইতিহাস নির্মাণে তা সহায়ক হলে আমাদের শ্রম ও স্বপ্ন সার্থক হবে বলে মনে করি।

এই প্রবন্ধ রচনায় যাঁদের গবেষণাকর্ম গৃহীত হয়েছে, তাঁরা হলেন—‘ঢাকাই মসলিন’ রচয়িতা আবদুল করিম, ‘আমাদের প্রাচীন শিল্প’ গবেষক তোফায়েল আহমদ, ‘ঢাকার মসলিন’-এর লেখক মুনতাসীর মামুন, ‘পৃথিবীর তাঁতঘর বাংলার বস্ত্রশিল্প ও বাণিজ্য’র লেখক সুশীল চৌধুরী, ‘জামদানী’র লেখক মোহাম্মদ সাইদুর, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম থেকে প্রকাশিত ‘মসলিন’ শীর্ষক গ্রন্থের লেখক সোনিয়া আশমোর প্রমুখ।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন ফিরিয়ে আনতে গবেষণা শুরু হয়েছে। বিষয়টি বাস্তবে রূপ দিতে কাজ শুরু করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তিন শিক্ষকসহ সাত সদস্যের দল। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা মসলিনের প্রধান উৎস ফুটি কার্পাস তুলার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করে বেশকিছু নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এগুলোর বৈশিষ্ট্য ফুটি কার্পাস তুলার কাছাকাছি বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ তুলার উৎপাদন বাড়াতেও তারা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। সূত্রমতে, এ মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক বায়োটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা হয়েছে। দলের অন্য সদস্যরা হলেন- রাবির অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আলম, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের বুটেক্সের ডিন আলীমুজ্জামান, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের একজন ও তাঁত বোর্ডের দু’জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনে আরও দু-তিনজন সদস্য এ বিশেষজ্ঞ দলে কাজ করছেন।

বিশেষজ্ঞ দল সূত্র আরও জানায়, মসলিন বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ বছর আগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে সোনালি ঐতিহ্যের মসলিন তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এরপর সরকার থেকে ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এ টাকা দিয়েই মূলত গবেষণা কর্মটি শুরু হয়। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয় বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মেয়াদকালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটি এরই মধ্যে পাস হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এখানে সাফল্য পাওয়া গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আবারও তিন বছরের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হবে। বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ও রাবির অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সোনালি ঐতিহ্যের সেই মসলিন কাপড় ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে আমরা বিভিন্ন জাতের তুলার নমুনা সংগ্রহ করে ফুটি কার্পাস তুলার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। কোনো কিছুই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার নয়, আমরা আশাবাদী কোথাও না কোথাও এ ফুটি কার্পাস তুলার সন্ধান পাওয়া যাবে, যা দিয়ে আমরা মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার করতে পারব।

গবেষণা কাজে নেতৃত্ব দেয়া রাবির ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বায়োটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. মনজুর হোসেন বলেন, আমাদের এ গবেষণার সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন আহমেদ গবেষণাটি দেখভাল করছেন। আশাব্যঞ্জক সাফল্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ২০১৯ সালের মধ্যে মসলিন কাপড়ের একটি রুমাল হলেও বানিয়ে দেখানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

 

বাংলাদেশের  প্রধানমন্ত্রী   শেখ  হাসিনা, যিনি বাংলার মসলিনকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন অথচ যেটা গত  পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্র  নেতার মাথায়  আসেনি। ২০১৭ -২০ সাল অত্যন্ত গর্বের দিন উপমহাদেশের   বাঙালিদের কাছে। ঐতিহ্যবাহী  মসলিন কাপড় এক সময় অবলুুপ্তি  ঘটেছিল  দুই বাংলার বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি  থেকে। পরমপ্রাপ্তি আমাদের বাঙালিদের  বেশ  দেরি করে  হলেও   ১৭০ বছর পর আবার বাংলাদেশে তৈরি হল মসলিন কাপড়। বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয়  সরকারের আন্তরিকতা ও  সদিচ্ছা  কারণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার গর্বিত পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে  এ-এক পরমপ্রাপ্তি।  

এই শিরোনামের পেছনে একটি গল্প আছে। সেই গল্পটি  আমাদের অনেকেরই  অজানা। অজানা  বিষয়টি  উন্মোচিত করাই  এই নিবন্ধটি মুুখ্য উদ্দেশ্য। আমাদের ফিরে যেতেই হবে ২০১৪ সালে। গল্পটা  অনেক খানি  এই রকম, অথচ এটাই বাস্তব  সত্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রনালয়ে। নির্দেশ দিলেন, যেভাবেই হোক, গবেষনা করে মসলিন কাপড় আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য যা যা লাগে, গবেষনায় নিযুক্ত গবেষকদের সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্টই দেওয়া হবে। ব্যস… প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।

তাঁদের প্রথম কাজ ছিল,  যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ তথা ফ্রুটি কার্পাস খুঁজে বের করা। আরো দরকার, মসলিনের একটি নমুনা বা স্যাম্পল। মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে।

কিন্তু হাতে কোনো মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোনো চিহ্নও।

ছিল শুধু সুইডিস গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’–এর মতো কিছু বই। ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে,  এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়।

এর মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এটা দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার একটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল–কলেজে প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মাইকিং করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে।

গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু; বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। দেশের অন্য কোনো উৎস থেকে মসলিনের নমুনা না পেয়ে তাঁরা জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেন।

মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসার পরেও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের মসলিনের নমুনা দেয়নি। গবেষক দলটি জাতীয় জাদুঘরের নমুনার আশায় প্রায় আট মাস পার করে ফেলেন। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য তাঁরা ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যান। এই মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়। তাঁদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে–সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না।

ভারতে গিয়ে বিফল হয়ে গবেষক দল হতাশ হয়ে পড়েন। এই খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকাই মসলিন দেখে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের একটু নমুনার জন্য ২০১৭ সালের  চার সদস্যের একটি দল লন্ডনের ওই মিউজিয়ামে যান।

সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য–উপাত্ত তাঁরা পেয়ে যান। লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পেলেন অবশেষে।

তাঁরা নিশ্চিত হন, সেটিই তাঁদের কাঙ্ক্ষিত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’। স্থানীয় আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেওয়া হয়।

তুলা থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। এবার খোঁজ শুরু হয় দেশের কোথায় এখনো তাঁতিরা চরকায় সুতা কাটেন। খবর আসে, কুমিল্লার চান্দিনায় এখনো এই তাঁতিরা রয়েছেন। তাঁরা খদ্দরের জন্য চরকায় মোটা সুতা কাটেন। তবে সেই সুতা কাউন্টের মাপেই আসে না। নতুন করে এই সুতা কাটার জন্য চরকা তৈরি করেন মঞ্জুরুল ইসলাম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আলীমুজ্জামান।

সুতা মিহি করার ব্যাপারটা আসলে তিন আঙুলের জাদু। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হয়।

লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে। সেখানে রাখা ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। ইতিমধ্যে তাঁরা মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করেছেন। একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৫০ বছর। এর আগে পাকিস্তান আমল, তারও আগে চলেছে ব্রিটিশ আমল।

এই দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নেতা নেত্রীর মাথায় এই চিন্তাটি আসেনি যে গবেষনা করে বাংলার এই ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার। নেহেরু আফসোস করে লিখেছিলেন, আজ থেকে ৫০০০ বছর আগের মিশরীয় মমীর শরীরে ভারত বর্ষের মসলিনের দেখা মেলে, অর্থাৎ চার পাঁচ হাজার বছর আগেও উপমহাদেশ থেকে মসলিন কাপড় বনিকের হাত ধরে পৌছে যেতো ফারাও’দের কাছে।

যে মসলিন হারিয়ে গিয়েছিলো। সেই মসলিন আবার ফিরে এসেছে। আন্তর্জাতিকভাবে মসলিনকে এদেশীয় পণ্য হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানান কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার গর্বিত পঞ্চাশ বছর পূর্তির   ইতিহাসে। তার লেগ্যাসি’তে লেখা  থাকবে..

"শেখ হাসিনা,  যিনি মসলিন কাপড় ফিরিয়ে এনেছিল" --  তথ্যসূত্র- বাংলাদেশের আর্কাইভ। প্রথমআলো, বিভিন্ন গবেষণা মূলক পত্রিকা।   

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প, রম্যরচনা  ছোটগল্প ও  ভ্রমণকাহিনীর লেখক
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top