সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিতীয় জীবন : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
১৩ মার্চ ২০২১ ১৯:৩৬

আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২১ ১৯:৫৯

ছবিঃ শাহানারা পারভীন শিখা

 

আমি তখন বেশ ছোট। আমার ছোট বোন কোলের বাচ্চা। কেমন করে যেন একদল হিজড়া টের পেয়ে যায় আমাদের বাসায় ছোট বাবু আছে।হাজির হয়ে যায় সাত সকালে। আসতে না আসতেই ভীড় জমে যায় চারপাশে।

 দুহাত ঘুরিয়ে তালি বাজাতে বাজাতে " দে দে মা, তোর মেয়েটারে একটু নাচিয়ে দি" বলেই ছো মেরে আম্মার কোল থেকে বোনটাকে নিয়ে শুরু করে দেয় নাচ গান।

 নানা ভঙ্গিতে বোনটাকে ধরে গান আর নাচ করতে থাকে। সবাই খুব আনন্দ নিয়ে দেখে। আর ছোটটো এই আমি ভয়ে অস্থির। হাত ফস্কে বোনটা পরে না যায়।

হাত ফস্কে পরে নি। সবাইকে আনন্দ দিয়ে বোনকে আবারও আম্মার কোলে ফিরিয়ে  দিয়ে কিছু টাকা নিয়ে ফিরে যায় ওরা।

এখন সময় পাল্টে গেছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে দেখলে কেউ আর আনন্দ পায় না। বরং ভয় পায়। এড়িয়ে চলে এদেরকে।

জীবনের প্রয়োজনে এদেরকে ও বেছে নিতে হয় অনেক কিছু। অনেকটা জোর করেই এরা আদায় করে নেয় এদের বেঁচে থাকার নূন্যতম প্রয়োজনটুকু।

সমাজের চোখে অবহেলিত এই মানুষগুলোর জন্য কারো মনে এতটুকু সহানুভূতি আসেনি। মেলেনি কোন সুযোগ সুবিধা। যদিও এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা কিছু সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে। সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় খুব নগণ্য।

চিরকাল সুবিধা বঞ্চিত এই মানুষগুলোর জীবনে সুযোগ মেলেনি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আসবার।

অথচ সভ্য সমাজের সভ্য জীবনের অধিকার এদেরও আছে। আছে ভালো ভাবে বাস করবার অধিকার।

তাশনুভা আনান শিশির এবং নুসরাত মৌ - এরা দুজন ট্রান্সজেন্ডার নারী।

চিরায়ত জীবনের বাইরে এরা পা রেখেছে স্বাভাবিক জীবনে।

সুদৃঢ় মনোবল আর দীপ্ত কদমে পৌঁছে গেছে দ্বিতীয় জীবনে।

 

বৈশাখী নিউজ চ্যানেল এই দুঃসাহসিক কাজটি করেছে। এই দুজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর বাড়িয়ে দেয়া হাতকে ফিরিয়ে না দিয়ে বরং হাত ধরে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সমাজের আর দশজন সাধারণ মানুষের পাশে।

 

শিশির আর মৌ এ দুজনের কথা বেশ কয়েকদিন ধরেই শুনছিলাম ওর মুখে। ব্যস্ততার সাথে টেনশনটা টের পাচ্ছিলাম ওর মধ্যে। শুনেছি নারী দিবসকে সামনে রেখে ওদের কর্ম পরিকল্পনার কথা।

প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যম গণমাধ্যমের পাশাপাশি অনেকেই জেনে যায় দুজনের কথা। সাড়া পরে যায় দেশে বিদেশে।

ফোনের পর ফোন আসতে থাকে ওর কাছে। জানতে চায় শিশির আর মৌয়ের কথা।

 পাশে বসে শুনেছি ওদেরকে ঘিরে মানুষের উৎসাহের কথা।

৮ই মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই বিশেষ দিনেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শিশির আর স্বল্প শিক্ষিত মৌ এর জীবন বদলের দিন। শিশির একজন সংবাদ উপস্থাপিকা এবং মৌ নাট্য অভিনেতা হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপিত হবার দিন।

প্রতি নারী দিবসেই আমি বৈশাখীর অফিসে অতিথি হয়ে যাই ওদের আনন্দে অংশী হতে।  এবারের যাওটার মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছিল।

দুপুর বারোটার হেডলাইন পড়ার মধ্য দিয়ে অভিষেক ঘটে তাশনুভা আনান শিশিরের। বাসায় বসেই দেখেছি। প্রথমবারেই বুঝিয়ে দিয়েছে ও পারবে ।

 দেশি-বিদেশি ক্যামেরার সামনে আর শত মানুষের সামনে বসে সাবলীল ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছে একজন সংবাদ পাঠিকা হিসেবে। ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে।

বিকেল চারটায় ছিল মূল খবর পাঠ।

 স্বরণীয় সেই ঘটনার সাক্ষী হয়েছি আমিও। উৎকণ্ঠায় ভরা নিউজ রুম।

 সামনে বসেই দেখেছি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর নতুন জীবনের জয়যাত্রার সেই স্মরণীয় ক্ষণ।

দৃঢ়চেতা শিশিরের দিকে তাকিয়ে বুঝেছি এই মেয়েটা পারবে। পারবে ওদের নিজস্ব সমাজটাকে সভ্য সমাজের মাঝে এনে দাঁড় করাতে।

সংবাদ শেষ হয়। করতালিতে মুখর চারপাশ। সবার শুভেচ্ছায় সিক্ত শিশির হয়ে ওঠে অশ্রু সজল।

এরপর ওদের হাত দিয়েই কাটা হয় নারী দিবসের সুবিশাল কেক। শিশিরের হাতেই খেয়েছি কেক। এরপর ফুলের শুভেচ্ছা আর প্রশংসার জোয়ারে ভেসেছে শিশির আর মৌ। নাচ গান আর আনন্দ আড্ডায় এরা অংশ নিয়েছে একসাথে দ্বিধাহীন চিত্তে।

নারী দিবসের এবারের এই চমক চমকে দিয়েছে সকলকে।

শিশির আর মৌয়ের এই চলার পথ আরো সুদৃঢ় হবে অবশ্যই। বদলে যাবে ওদের জীবন। ওরাও আর দশজন সাধারণ নাগরিকদের মতই স্বাভাবিক জীবনের পথে হাঁটবে। এবং একদিন ওরা ঠিক পেয়ে যাবে স্বপ্নের এই পথ।

আসুন আমরা তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায়। বাড়িয়ে দিই সহযোগিতার হাত। আমাদের হাত দিয়েই জন্ম হোক হাজারো শিশির আর মৌয়ের।

 

শাহানারা পারভীন শিখা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top