সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

কুহক - সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২১ ২২:১৪

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২১ ২২:১৬

 

সকাল নয়টায় লঞ্চ ছাড়ার কথা, আমার বাড়ি থেকে বেরুতেই  আটটা চল্লিশ , ভেবেছিলাম আজ আর লঞ্চ পাবোনা, এ লঞ্চটা না পেলে আমাকে ট্রলারে যেতে হত, সে আরো বিশ টাকা বেশী খরচের ব্যাপার, তবে আমার মত ক্ষুদ্র মানুষেরা পাঁচ টাকা বাঁচাতে এখনও এক কিলোমিটার হাঁটে। আমার জন্য ট্রলারে যাওয়া বড্ড মন খারাপের , পকেট থেকে টাকা বের করে দেওয়ার সময় বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়, সেখানেই ব্যাপারটা শেষ হলেও হত, তা তো নয়, মন খারাপের ভাবটা সন্ধ্যা অবদি বয়ে বেড়াতে হয়। হ্যাঁ হয়তো বলতে পারেন, আগে বের হওনি কেন তাহলে? আরে সকাল থেকে কি আর কম হ্যাপা সামলাতে হয়! একটা ছাত্র পড়াই পাশের গ্রামে, হেঁটে যাই আসি, একটা সাইকেল থাকলে হয়তো সময় বাঁচত,আহা যদি একটা সাইকেল থাকত! মনে মনে সাইকেলের ঘন্টা বাজে, প্যাডেল চলে। তা আমি সাইকেল কই পাব? ভাবছেন এমন হত দরিদ্র আছে নাকি আজকাল? হ্যাঁ আছে, যেমন আমি আছি, বাপ দাদার ভিটে ছাড়া অল্প কিছু জমি আছে তা দিয়ে খোরাকের চালটা আসে, তারপরে আর চলেনা। যাক আজ লঞ্চ ফেল করি নাই, কোনোমতে হাচরে- পিছরে, দৌড়ে উঠে পড়েছি, মনে হয় সিঁড়ি উঠানোর আগে আমিই সর্বশেষ যাত্রী। লঞ্চে উঠেই সোজা দোতালার ছাদে এসে দাঁড়িয়েছি। আমার পাশেই চানাচুর ওয়ালা চানাচুর বানাচ্ছে। তার হাতের যাদুকরী ছোঁয়ায় শুকনো চানাচুরগুলো পিয়াজ কাঁচামরিচ, টমেটো,ধনে পাতায় মাখামাখি হয়ে জিভে জল আনা ঘ্রান ছড়াচ্ছে। পিয়াজের ঘ্রানে মনে পড়ল মা আজ আসার আগে গরম ভাত আর পেঁপে ভর্তা খেতে দিয়েছে, মনে হয় ঘরে আলু শেষ। মা জানে আমি পেঁপে ভর্তা পছন্দ করিনা তাই তেলে পেঁয়াজ মরিচ ভেজে আজ ভর্তা করেছে, তাড়াহুড়োতে গিলেছি শুধু কেমন হয়েছিল মনে করতে পারছিনা। একটু কি ঘি মেখে দিয়েছিল?হতে পারে।মায়ের একটা গরু আর গোটা দশেক হাঁস –মুরগী আছে আর সেগুলো নিয়ে আহ্লাদও আছে। ঘরে ডিম দুধ যতটুকু জোটে তা এদের কল্যানে।এদের নিয়ে মায়ের ও সময় কাটে বেশ।

লঞ্চটি একটা গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের নাম কি? জানিনা।এ গ্রামের পরের গ্রামের নাম পলাশপুর, একটা বিয়ে খেতে এসেছিলাম বাবার সাথে। না আমাদের নিকটাত্মীয় কেউ নয় বাবার বন্ধুর বোনের বিয়েতে, একটা পিতলের কলসি উপহার দিয়েছিলাম আমরা।বাবা মারা গেল তা ও তো কতগুলো মাস! এখন মনে হয় বিয়েতে কেউ পিতলের কলসি উপহার দেয় না, দিলেই বা কি, আমাকে তো কেউ কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াতই দেয় না, বিষাদের হাসি ঠোঁটের কোনায় মিলিয়ে যায়। আপাততঃ গ্রাম দেখায় মন দেই। সবগ্রাম গুলোই আমার কাছে একই রকম মনে হয়। ঐতো নদীর ধারের খেজুর গাছটা, বা ঐ মসজিদটা অথবা ঐ যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ে বিষ্ময়ে লঞ্চের দিকে চেয়ে আছে সবইতো আমার গ্রামের মতন। অমন বিষ্ময় নিয়ে আমিও দাঁড়িয়ে পড়তাম লঞ্চ দেখলে, মনে মনে ভাবতাম কত দূরে যাব!

আজ আকাশের অবস্হা ভালো না, গোমড়া মুখো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশটা। হঠাৎ বৃষ্টি নামতে পারে। যাই ভিতরে বসার জায়গা খুঁজি।যদিও জানি জায়গা
পাবোনা,মানে পাওয়ার কথা নয় আর কি। মেয়েদের কেবিনের সামনা সামনি দুটো সিট পাতা, মাঝখানে কোনমতে পা রাখার চিলতে জায়গা, চার পাঁচজন মহিলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। রুমটির একমাত্র জানালায় দাঁড়িয়ে ইমিটেশনের গলার চেইন, কানের দুল, মাথার ক্লিপ বিক্রি করছে এক ফেরিওয়ালা। খুব জোড়ে বৃষ্টি নামলে মহিলা কেবিনে বসতে চাইলে ওনারা কি কিছু মনে করবেন, কি জানি?  পুরুষদের কেবিনটি চারকোনা, চারধারে ঘিরে বসার জায়গা মাঝখানটা খোলা,বেশ হাঁটাচলা করা যায়। না, আজ পুরুষদের রুমে বেশ চাপ, একটাও সিট খালি নেই, দিনের এসময়টাতে প্রতিদিনই ভীর থাকে, আমার মত অনেকেই রোজ যাতায়াত করেন। পুরুষদের রুমের চিত্র কিছুটা ভিন্ন, নানা রকম শব্দ, গলার স্বর: কেউ লোকাল রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছে,কেউ ফোনে কথা বলছে,কেউ পেপার খুলে বসেছে আর তার পাশের জন সাধ্যমত উঁকি ঝুঁকি মেরে পেপার থেকে পড়ার চেস্টা করছে, কেউ বা আবার নাক ডেকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই মাত্র একজন চা ওয়ালা ঢুকলো। বেশ কয়েকজন পুরুষ যাত্রী তাকে দেখে নড়ে-চড়ে বসলো, চায়ের অর্ডার করলো , আমি রুমের দরজা থেকে সরে আসি। বারন্দার একধারে চিড়ার নাড়ু আর কুড়ানো নারিকেল বিক্রি করছে এক ছেলে, এই আমারই বয়সী, আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার আগ্রহ দেখে আমার দিকে সে সরাসরি তাকায়, আমি চোখ ফিরিয়ে নেই। আবার ফিরে আসি পিছনের খোলা ছাদে, এখানেও দাঁড়ানোর তেমন জায়গা নেই তার মধ্যে দুই জন অন্ধ ফকির গান ধরেছে, "মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়...."। মনটা আজ বড্ড  হাহাকার করছে, আমি কই যাব?

আমি রহমত আলী রনি পটুয়াখালী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ পড়ি, পড়ি বলতে গত বৎসর ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু করোনার কারনে তা আর হয়নি। বাবা পটুয়াখালী শহরের একটা মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন, ছয় মাস আগে মারা গেছেন। আমরা এক ভাই এক বোন, বোনটা ভাল ছাত্রী বি এস সি পাশ করেছে, প্রাইমারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার জোড় প্রস্তুতি নিচ্ছে,  শ্বশুর বাড়িতে থাকে।বাড়িতে আমি আর মা। বাবা মারা যাবার পর থেকে আমি সদর রোডের একটা ডিপার্টমেন্টাল দোকানে কাজ করি। সকাল সাড়ে দশটা থেকে  সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আমার ডিউটি, এর পরে রোজ রাত আটটার শেষ লঞ্চ ধরে বাড়িতে ফিরি। মাসে চার হাজার টাকা বেতন, দুপুরে খাওয়া ফ্রি। তবে এসব দোকানে চাকুরী পেতে জমানত লাগে। আমারও লেগেছে, দশ হাজার, বোনের জামাইয়ের কাছ থেকে কর্জ করেছিলাম। গত চার মাস ধরে প্রতিমাসে পাঁচ’শ করে জমাই শোধ দেব বলে। এছাড়াও বাবার কিছু ঋন আছে হাজার ত্রিশের মত সেটাও জগদ্দল পাথরের মত মাথায় চেপে আছে,কবে যে মুক্তি পাব!

দূর থেকে পটুয়াখালী শহর দেখা যাচ্ছে, দূর থেকে সব কিছু দেখতেই বড় মনোরম লাগে। লঞ্চ থেকে নেমে জোড়ে হাঁটা লাগাই আজ দোকান আমার পরিস্কার করার পালা, দেরী করা চলবেনা, কিন্তু মনে হয় সকালে এদিকে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তাঘাট যা পিচ্ছিল, জোড়ে হাঁটতে সুবিধা করা যাচ্ছে না।

দোকানের সামনে একটা জটলা। ব্যাপার কি ভাবতে ভাবতেই দোকানের সামনে পৌঁছে যাই। আমাকে দেখে মালিকের বড় ছেলে মুখ খিঁচিয়ে বলে, "এই তো আরেক নবাবজাদা আইছে! সব গুলার জামানত কাটমু" একটু পরেই বুঝতে পারি রাতে দোকানে বড় ধরনের চুরি হয়েছে। দোকানের কিছু জিনিসপত্র আর ক্যাশে থাকা ত্রিশ হাজার টাকা খোয়া গেছে। দোকানের দাড়োয়ান জামাল চাচা আর আকবর ভাইকে বেঁধে রাখা হয়েছে, পুলিশ আসছে, আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। জামাল চাচা আর আকবর ভাই ভয়ে কুঁকড়ে আছেন। ওদের কথা আর কি বলব পুলিশের কথা শুনে আমারই ভয় লাগছে, এরমধ্যেই তিনবার প্রস্রাব করে এসেছি, মাথাটাও ঠিকমত কাজ করছে না।

একে একে সবার জেরা হচ্ছে , এবার আমার পালা।
- কি নাম
- রনি
- পুরা নাম কি?
-রহমত আলী রনি
- বাবার নাম
- রুস্তুম আলী
- কি করে?
- জ্বি মরহুম
- এই দেকানে কতদিন কাজ কর?
- ছয় মাস
- নতুন। পড়ালেখা কতদূর
- পলিটেকনিক কলেজে পড়ি....
লক্ষ্য করি পুলিশের চোখ সরু হয়ে যায়। আমার ভিতরে টেনশনও বাড়তে থাকে।
- কাল ডিউটি থেকে কখন গেছ?
- সাড়ে সাতটায়
- দোকান বন্ধ হয় আটটায় তুমি আগে গেছ কেন?
- আমি আটটায় লঞ্চ ধরে বাড়িতে ফিরি। এটাই শেষ লঞ্চ, মালিক জানেন
- তুমি যখন গেছ দোকানে কে কে ছিল?.....

প্রায় আধাঘন্টা ধরে জেরা চলে।

পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে টের পেলাম প্রচন্ড ক্ষুধা পেটে। আজ আর দোকানে যেতে হবেনা, সবার বাড়িতে পুলিশ সার্চ হবে জানিয়ে দিলেন মালিক। মোবাইলে দেখি চারটা বাজে, পরের লঞ্চ পাঁচটায়। অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে কাঁদায় পা পিছলে পায়ের সেন্ডেলটা ছিড়ে গেল, ইস্। এর আগে আরোও তিনবার সেলাই করিয়েছি সেন্ডেল জোড়া, এবার আর নতুন না কিনে উপায় নাই। পকেটে হাত চালাই,একটা পঞ্চাশ টাকার আর দুটো বিশ টাকার নোট বের হয়ে আসে। মাথায় হাত পরে, একজোড়া স্যান্ডেল আর না হলেও দু'শ টাকা। কি করি, খালি পায়ে যাব! ভাবতে ভাবতেই বাটা স্যু স্টোরে ঢুকে পড়ি। আমাকে দেখে ম্যানেজার সাহেব ডাক দেন। দোকান চুরির বিস্তারিত শুনতে চান। সঙ্কোচে স্যান্ডেলের কথা ওনাকে বলি। সব শুনে উনি একশত সত্তর টাকা দামের একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে বলেন টাকাটা যেন আমি ওনাকে
কাল দিয়ে দেই। আমি ঘাড় কাঁত করে সায় দেই। লঞ্চঘাটের পাশের এক ঝুপড়ি দোকান থেকে একটা লাল আটার রুটি আর ভাজি খেয়ে লঞ্চে উঠে পড়ি। পুরুষ কেবিনে জায়গা থাকা সত্বেও সেখানে ঢুকিনা, সোজা পিছনে ছাদে চলে যাই। সারা পথ নদীর স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেই। মনে মনে ভাবি যদি ম্যাজিক জানতাম! যদি চোরটা আজ-ই ধরা পড়তো!যদি একটা ম্যাজিক হয়!

বাড়ির কাছে এসে পৌঁছে গেছি কিন্তু এখনও সন্ধ্যা হয়নি, মা দেখলে নির্ঘাত প্রশ্ন করবে যে এত তাড়াতাড়ি কেন ফিররাম আজ, ভাবতেই বাড়ি যাবার ইচ্ছাটা উবে গেল, সোজা পুকুর পাড়ে যাই, শ্যাওলা পড়া শানের ঘাটে বসে থাকি।পাশের জাম গাছটাতে ওৎ পেতে আছে একটা মাছরাঙা পাখি, আমারই মত ভালো সুযোগের অপেক্ষায়- সেই সুযোগ আর আসেনা, মুহূর্তের উপর মুহূর্ত জমে মহাকাল না হয়ে যায়! নানা চিন্তা মনে উঁকি দেয়- জমানতটা গেল মনে হয়, চাকুরীটাও থাকে কিনা অনিশ্চিত। কিছু ভালো লাগেনা। এভাবে একটু একটু করে মরে যাওয়ার চেয়ে একবারেই চলে যাওয়া মনে হয় ভালো, মরে যাওয়ার বাসনাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, কিন্তু সাহস হয়না। ঝিম ধরে বসে থাকা মাছরাঙা পাখিটা হঠাৎই চঞ্চল হয়, ঝুপ করে একটা আওয়াজ হল, দেখি পাখিটা মুখে একটা মাছ নিয়ে উড়ে গিয়ে একটা উঁচু গাছের ডালে বসলো। কি হল আমার কে জানে, মনের মনে গেয়ে উঠলাম, "মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনা...."চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে, পাশের মসজিদে একটু পরেই মাগরিবের আযান হবে, আমি নতুন কেনা স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে বাড়িমুখো হই। 

 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top