সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব তের) - শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৭ মার্চ ২০২১ ২০:৪৭

আপডেট:
১৭ মার্চ ২০২১ ২০:৫০

 

- জানিসতো আমার বয়সের সাথে আমার বর এর বয়সের ব্যবধান ছিল ১০/ ১২ বছরের ! যদিও দেখলে বোঝা যেতোনা! খুউব ভালোবাসতো আমাকে! পুতুলের মতো আগলে আগলে রাখতো আমায়! আমার সাধ আহ্লাদের কমতি ছিলোনা তার কাছে! কিন্তু কি জানিস নীলু,বিয়ের পর পরই ওদের পরিবার থেকে আমার ভিতরে একধরণের সিস্টেম চালু করে দেয়া হয়েছিল!

- মানে !

- প্রথম প্রথম আমিও ঠিক বুঝতে পারতাম না! আমাদের পরিবারতো এমন গোড়া ছিলোনারে ! শশুর বাড়িতে যেতে না যেতেই শাশুড়ি মা বুঝিয়ে দিলেন, শশুর বাড়ির কোন কথা বা গল্প কখনো কাউকে বলতে নেই নিজের ছায়া ও নাকি সুযোগ পেলে ছাড় দেয়না! উঠতে বসতে শাশুড়ি ননদ এর অনেক কথা খুব গায়ে বিঁধতো! ইচ্ছে হতো সুমনকে বলে দিতে!

- বললেই পারতিস! সুখ দুঃখের কথাতো ভালোবাসার মানুষকেই বলবি!

- প্রথম প্রথম তাই ভেবেছিলাম! পরে আবার কেন যেন মনে হতো, একই রক্ততো ওর শরীরেও! তাই ভয়ে বলতামনা! বুঝে গিয়েছিলাম, শশুরবাড়িতে মেয়েদের আসলেই সব সহ্য করে থাকতে হয়! তাই কোনদিন কোন অভিযোগ করিনি! নাক কান চোখ বন্ধ রেখে চলেছি! মা অনেক সময় জিজ্ঞেস করতেন এটা ওটা ! উল্টোটা বলেছি নীলু! মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন লালন করে, অনেক না বলা কথা জমা করে রাখতাম সুমনকে বলার জন্য! সুমনকে বুঝতে একটু সময় লেগেছে আমার! আসলে সে তার পরিবারে একটু ব্যতিক্রমই ছিল! মন ভার দেখলে কখনো সখনো মায়ের বাধা মানতোনা! আমাকে নিয়ে যেত কোন কফি শপ এ ! ইচ্ছে হতো মন খুলে সুমনকে কষ্টের কথাগুলো বলতে ! বলা আর হতোনা! ঐ একটাই ভয়, যদি রেগে যায়! চারপাশের মানুষগুলো দেখে, তাদের প্রাণ খুলে গল্প বলা, হাসি তামাশা দেখে একসময় বাড়িতে চলে আসতাম! সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমতো সুমন! বিদেশ থেকে আনা টাকা পয়সা খরচ হোত সংসার এ দেধারছে! ছ'মাসের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো! কথা ছিল আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে!সুমন আমাকে ছাড়া যাবেনা !শাশুড়ি বাধ সাধলো! এ সময় দেখলাম,আমার প্রতি সুমন এর কি নিগুড় ভালোবাসা! মায়ের সাথে চরম বাকবিতন্ডা হলো! চিৎকার করে আমার শাশুড়ি বলতে লাগলো ۔۔۔۔۔এই কদিনেই বৌ তোকে জাদু করে ফেলছে! ওমা এ যে ডাকিনি একটা! আমার পুলাডারে আমার বুক থেইকা কাইড়া নিছে এতো তাড়াতাড়ি! চিৎকার শুনে আমার বড় ও মেজো ভাসুর, জা এবং শশুর বাবা বেড়িয়ে এলেন! ঘর জামাই মেয়ে জামাই সবাই বেরিয়ে এল যে যার ঘর থেকে ! দেখলাম সবাই খুব উচ্ছসিত! আমার শশুর খুব বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন ! উনি সুমনকে সাপোর্ট দিলেন ! সুমন এর ছুটি শেষ হয়ে আসছে ! ওতো বিয়ে করে বৌ সাথে করে নিয়ে যাবে, বেয়াই বিয়ানের সাথেতো এমন কথাই আমরা দিয়েছিলাম! তার কথার কোন পাত্তাই দিলোনা কেউ ! দূর থেকে দেখছিলাম আমার বড় জা ও ভাসুর  খুব মজা পাচ্ছিলো!ওরাও চাইছিলনা আমাকে সুমন নিয়ে যাক ! পরে বুঝেছিলাম কারনটা! যাহোক আমার শশুর বাবার কোন কোথাই গ্রাহ্য করলেন না আমার শাশুড়ি! সুমন সে রাতে কিছুই খেলোনা ! আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো! সারারাত আমাকে তাদের পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু জানালো! আমাকে খুব ধৈর্য ধরে এগুতে হবে ! পড়ালেখা করতে হবে!আমি কথা দিলাম সুমনকে! কেঁদে কেঁদে রাত কাটালাম ! পরদিন সকালে শরীরটা খুব দুলছিলো! হঠাৎ গা গুলিয়ে বমি করে ফেললাম! দৌড়ে এলো সুমন! পাঁজা কোলে করে আমায় এক পাক ঘুরিয়ে কি উচ্ছাস তার ! বুঝে গেছে সে আমি প্রেগন্যান্ট! আর কদিন পরেই  সুমন চলে যাবে তার কর্মক্ষেত্রে!ওর সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছিলাম! লাস্ট বারের মতো ব্যাগটা দেখছিলাম সব ঠিক আছে কি না।  হঠাৎ খেয়াল করলাম শাশুড়ী মা রুম থেকে বের হলেন মুখটা ভীষণ কালো করে। আমাকে দেখে আবার ঢুকলেন ঘরে ! সুমন রুমেই ছিল তখন! ক্ষানিক পরে শাশুড়ী মা আবার বের হয়ে এলেন! তখনও মুখটা কালো। তিনি কারো দিকে তাকালেন না! সুমন আমাকে নিয়ে একটু কেনাকাটার জন্য শহরে বের হবে ! বিপত্তি ঘটলো এখানেই ! শাশুড়ি মা আমাদের বাইরে যাওয়ার বিষয়টা অনুমান করেছেন! আমরা বের হবার আগে আমার শাশুড়ি কি যেন সুমন এত হাতে গুঁজে দিলো দেখলাম! গাড়িতে বসে সুমনকে জিজ্ঞেস করলাম

- কি ব্যাপার বলোতো? মা'কে দেখলাম বের হওয়ার সময় তোমার হাতে কি যেন দিয়ে গেল। কোন সমস্যা?

- হুঁ ! সমস্যা আর কি? একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছেন ! কোন প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ে ! তার বিয়েতে যাবেন। স্বর্ণের কিছু দিতে হবে।তার ছেলে বিদেশ এ থাকেন ! সেরা জিনিসটা উপহার না দিতে পারলে তার মান ইজ্জত থাকবেনা! বিয়েতে তাকেও জমকালো শাড়ি পড়তে হবে !

- তার মানে তোমার মায়ের জন্যও শাড়ি কিনতে হবে !

- উঁহু,সবকি আর করা  যায়? আমি একাইবা সবটা করবো কেন? সংসারের প্রয়োজন হত তাও বুঝতাম। 

- এটা কি তাহলে মা তার সাধ পূরণের জন্য করছেন ?

- তা নয়তো কি?

- বড় ভাইয়া, মেজো ভাইয়ার কাছেও গিয়েছিল। পাত্তা পায়নি!

- ওদেরওতো সংসার আছে ! ছেলে মেয়ে না থাকলেও তাদের আলাদা একটা খরচ আছেনা! শুধু শুধু বাড়তি খরচ হলে কে দিবে বলো?

- হুঁ!

- সুমন এর সাথে আর এই বিষয়ে কথা হলো না। টিকেট কাটা হয়ে গেলো !একসময় বিদেশ চলে গেলো সুমন একাকি! ভালো লাগতোনা কিছুই! খুব অসহায়বোধ করতাম! প্রাণ খুলে কাঁদারও কোন উপায় ছিলোনা! সুমন ফোনে বলে দিতো মার কাছ থেকে ঘুরে আসতে! মায়ের কাছেও যেতে দিতেন না দজ্জাল শাশুড়ি! সুমন এর বড় দুইভাইয়ের বিয়ে হয়েছে ! একজনের ও বাচ্চা কাচ্চা হয়নি এখনো! তাই আমার বাচ্চা যদি নষ্ট হয়ে যায়, সেজন্য আমার মায়ের কাছে যেতে দিতোনা! এটা ওটা মা যদি আমার জন্য পাঠাতেন, ডাইনি মহিলা আমাকে তার কিছুই খেতে দিতোনা! সুমন আমার জন্য টাকা পাঠালে তাও আমাকে দিতোনা! এ ছুতা ও ছুতায় নিয়ে নিতো সব !মন খুলে কথাও বলতে পারতামনা সুমনের সাথে টেলিফোনে! টের পেলেই ফোন নিয়ে নিতো শাশুড়ি!

 

চলবে

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top