সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

নৈঃশব্দ্যের গল্প : রোজীনা পারভীন বনানী


প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০২১ ২১:৫৫

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০২:১৪

 

শুরুর কথা:

পঁচিশ বছর পর অন্বেষা আজ আবার এসে দাঁড়িয়েছে সেই প্রিয় ক্যাম্পাসে। যে ক্যাম্পাসে অন্বেষা কাটিয়েছে তার দুরন্ত যৌবনের মোহময় দিনগুলো। এই ক্যাম্পাসকে ঘিরে কত-শত স্মৃতি বুকের গভীরে সুপ্ত হয়ে আছে! বহুবার এর সামনের রাজপথ ধরে চলে গেছে নিজস্ব গন্তব্যে, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছে হয়নি—কেন যেন মনে হয়েছে যৌবনের সেইসব সঙ্গী-সাথীদের ছাড়া এই ক্যাম্পাস একেবারেই নিষ্প্রাণ। আজ হঠাৎ কি মনে করে প্রান্তিকগেটের কাছে এসে ড্রাইভারকে বলে গাড়ীটা ভিতরে ঢোকাতে। বার বছরের মেয়েটা খুশীতে হাততালি দিয়ে ওঠে।ওর খুব শখ ও দেখবে মায়ের প্রিয় ক্যাম্পাস।মায়ের মুখে এত গল্প শুনেছে যে কোথায় কি আছে সবই প্রায় ওর মুখস্থ।

আহ্! সেই উঁচু উঁচু আকাশমণি গাছগুলো এখনও দুধারে রাজসিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, আর নীচ দিয়ে চলে গেছে ছায়া সুনিবিড় পথ। সেই লাল ইটের রাস্তাগুলো আর নেই, সব রাস্তায়ই পীচ পড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাকালীন ছুটি চলছে। তাই চারদিকে শুনশান্ নীরবতা, কি অদ্ভুত প্রশান্তি! একদিনের গমগম করা ক্যাম্পাস এখন প্রায় জনমানবহীন!

দুধারের লাল শাপলা ফোঁটা লেক পেরিয়ে অন্বেষার গাড়ী এসে থামে তার এককালের আবাসস্থলের সামনে। জায়গাটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। হলের সামনের গাছ কেটে একটা চত্বর বানানো হয়েছে। হল গেটের পাশের দেওয়ালের উপর থেকে হলুদ ফুলে ফুলে নুয়ে পড়া অ্যালামেন্ডা গাছটা আর নেই। চারদিকে কেমন জানি ফাঁকা ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগছে। পাশের লেকের ধারে ময়লা আবর্জনা ফেলে জায়গাটা নোংরা করে ফেলেছে। লেকের পানিতেও ময়লা, এসব দেখার কি কেউ নেই? অন্বেষার মন কেমন এক বিতৃষ্ণায় ছেঁয়ে যায়। লেকের পানিতে ভাসছে এখনও কিছু পরিযায়ী পাখি, এ রকম অবস্থা চললে ওরা কি আর আসবে! অন্বেষা মেয়েটার হাত ধরে বলে, চল্, ওদিকে যাই ।

--হ্যাঁ, আম্মু চলো, আমরা মুক্তমঞ্চের দিকে যাই।

অন্বেষার গাড়ি ক্যাফেটরিয়ার পাশের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ডেইরীফার্ম গেটের এদিকটায় তবু কিছু মানুষের চলাচল দেখা যাচ্ছে। অন্বেষা গাড়ি থেকে নেমে মেয়ের হাত ধরে আস্তে-আস্তে মুক্তমঞ্চের একেবারে উপরের সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায়। হঠাৎই একটা দমকা চৈতালী হাওয়া একরাশ ধুলো, শুকনো পাতা, ছেঁড়া পলিথিন উড়িয়ে পাশের মাঠের উপর দিয়ে এম,এইচ হলের দিকে চলে যায়। মুক্তমঞ্চের সিঁড়িতে সিঁড়িতে শুকনো কাঁঠাল পাতার ছড়াছড়ি। মেয়েটা অন্বেষার হাত ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে-দৌড়ে নীচে নামতে থাকে। ওর পায়ের নীচে মচমচ্ শব্দে ভাঙতে থাকে শুকনো পাতা। অন্বেষা ক্রমশঃ ঢুকে যায় স্মৃতির গভীর থেকে গভীরে...

              

একঃ

চারিদিকে কি গভীর নিঃস্তব্ধতা! গভীর কিন্তু অখণ্ড নয়। বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শিরশির শব্দ, দু'একটা নাম না জানা পাখির ডাক, মাঝে-মাঝে শুকনো পাতার মচমচ্ -- এ ছাড়া চারিদিকে শুনসান নিঃস্তব্ধতা। প্রচন্ড নৈঃশব্দ্যে ঢাকা ফাগুনের দুপুর। অন্বেষা অনেকক্ষণ ধরেই বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে হৃদয় দিয়ে নৈঃশব্দ্যের শব্দ শুনছিল। কি ভীষণ মন উদাস করা দুপুর-- সবকিছু থেকেও, কি জানি কি একটা নেই, বুকের ভেতর সে রকমই নিঃস্ব হাহাকার! হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির করুণ সুর অন্বেষার ভাবনার সাগরে আছড়ে পড়ে। 

অন্বেষা আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসে। কপালে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করে জ্বর আছে কিনা-- নাহ্, নেই। কিছুক্ষণ কান পেতে শোনার পর, অন্বেষা দরজা খুলে বাংলোর সামনের দিকের কাঠের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অন্বেষা বোঝার চেষ্টা করে সুরটা কোন দিক দিয়ে আসছে। একটু উঁচু করে তৈরী এই কাঠের বাংলোর সামনের অনেক খানি জায়গা জঙ্গল কেটে সাফ করে সমতল করা হয়েছে। সেই সমতল মাঠের ঠিক মাঝখানে একটা দুধ-শাদা ইউক্যালিপ্টাস গাছ মাথা অনেক খানি উঁচু করে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ মাঠ জুড়ে সুন্দর দূর্বা ঘাস। দেখলে বোঝাই যাচ্ছে এরা এক সময় সবুজ- সতেজ ছিল, কিন্তু শীত শেষে এখন রুক্ষ, শুষ্ক। মাঠের পাশেই ইটের রাস্তা, তার ওপাশেই শাল-সেগুনের ঘন জঙ্গল। না, এদিকে নয় --সুরটা ভেসে আসছে বাংলোর পিছন দিক থেকে। অন্বেষা আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। 

অন্বেষা এবার ভেতরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। আহ্! বিরিয়ানির সুগন্ধে চতুর্দিক ম-ম করছে! বাংলোর পিছন দিকে ছোট একটুখানি একটা কম্পাউন্ড--তার শেষ প্রান্তে ছোট্ট রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরের সামনে ইটের চুলা তৈরী করে অন্বেষাদের জন্যই বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। বাবুর্চি এসেছে ঢাকা থেকে। বাবুর্চির রান্নার হাত অসাধারণ। অন্য সময় হলে বিরিয়ানির সুগন্ধেই অন্বেষার ক্ষিদে পেয়ে যেত, কিন্তু এখন জ্বর থাকায় কেমন জানি গা-গুলিয়ে উঠল। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে অন্বেষা নিচের কম্পাউন্ডে এসে দাঁড়ায়। কেয়ারটেকার এবং দারোয়ান দু'জনকেই রান্নার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অন্বেষা ওদেরকে না ডেকে চুপিচুপি  যেদিক থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসছে, সেদিকে হাঁটা শুরু করে।

তিনদিন হলো অন্বেষারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  শিক্ষা সফরে ময়মনসিংহ এসেছে, আছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে। আজ সকালে নিজেদের রিজার্ভ বাসে,হাইওয়ে থেকে পাঁচ মাইল ভিতরে, মধুপুর গড়ের শালবনের ভিতর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের  এই বাংলোয় এসেছে। ছেলে- মেয়েরা সব স্যারের সঙ্গে বনের ভেতর গাছ-লতাপাতা সংগ্রহ করতে গেছে। গতকাল রাতে হঠাৎ করেই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় অন্বেষা আজ অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে যেতে পারেনি। অন্বেষা একাই আছে বাংলোতে। ঠিক একা নয় -দারোয়ান এবং কেয়ারটেকার আছে; এছাড়াও অন্বেষা পিছনের রান্নাঘর থেকে এক আদিবাসী মহিলাকে বের হতে দেখেছে। সম্ভবত এখানে রান্না করে। এখানকার যিনি কর্মকর্তা তিনিও কি একটা কাজে বাইরে গেছেন। ওষুধ খেয়ে অন্বেষা শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। তারপর কখন জানি ঘুমিয়ে গেছে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল--তারপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে নৈঃশব্দের গান শুনছিল । 

অন্বেষা আস্তে আস্তে হেঁটে বাংলোর পিছন দিকের ঢালু জমি বেয়ে নিচে নেমে এসে দাঁড়ায়। এদিকে অনেক খানি জঙ্গল বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। ঘন জঙ্গল শুরু হয়েছে অনেকটাই  দূরে যেয়ে। সেই পাতলা জঙ্গলের একটু ভিতরে একটা কাটা শালগাছের গুড়ির উপর বসে একটা আদিবাসী ছেলে তন্ময় হয়ে  বাঁশি বাজাচ্ছে। আরও একটু কাছে এগিয়ে যেয়ে অন্বেষা দেখে ছেলেটা তাদেরই সমবয়সী বা দু'এক বছরের বড়  হতে পারে অর্থাৎ ২০-২১ বৎসর বয়স। বেশ লম্বা, গায়ের রং তামাটে, পেটানো স্বাস্থ্য, খালি গা, এক মাথা কোকড়া চুল, পরনে একটা জিন্সের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গোটানো -- ছেলেটা তন্ময় হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। অন্বেষা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে ছেলেটার নাক অন্যান্য গারো ছেলে-মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা, তাকে দেখাচ্ছে অনেকটা বইয়ের ছবিতে দেখা গ্রিক দেবতাদের মতো। অন্বেষা ধীরে ধীরে গুড়ির অপরপ্রান্তে যেয়ে বসে। সেই শব্দে ছেলেটা চমকে উঠে বাঁশি থামিয়ে অন্বেষার দিকে তাকায়। চোখ না সরিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়েই থাকে। 

অন্বেষা দেখে এক জোড়া শাদা, স্বচ্ছ, ঝকঝকে কাঁচের মতো চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্বেষার মনে হলো ঐ চোখের ভিতর নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারছে, পড়তে পারছে চোখের মালিকের মনের কথা--এতটাই স্বচ্ছ একজোড়া চোখ! অন্বেষা কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করে। এই অস্বস্তি কাটাতেই অন্বেষার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়, মনে মনে ভাবে ছেলেটাকে একটু চমকে দিলে কেমন হয়? অন্বেষা ওর দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “প্রিংনাম” ।

 

দুইঃ

একটা দমকা হাওয়ার মতো বাণী ঘরে ঢুকেই অন্বেষার দুহাত ধরে নাচতে শুরু করে ।অন্বেষা হঠাৎ করে কেমন জানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় । তারপর ইশারায় বাণীকে থামতে বলে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে? এরকম পাগলামি করছিস কেন?

--ওমা! পাগলামি করবোনা তো কি করবো! জানিস, আগামী চার তারিখের মুক্তমঞ্চের প্রোগ্রামে কে কে আসছে?
--- নারে জানি নাতো!
---শুনলে তুই একেবারে ভিরমি খাবি।
---ইশ্, এত ভণিতা না করে বলে ফ্যাল।
---সুনীল আসছে রে সুনীল, সুনীল গ-ঙ্গো-পাধ্যা-য়-- --, বাণী অনেকটা টেনে টেনে উচ্চারণ করে।

এবার অন্বেষার বিস্মিত হবার পালা, --সত্যি!
---তার সাথে আরও একজন আসছে, যার নাম শুনলেই তুই হার্টফেল করবি।
---এই বলনা -বলনা কে আসবে?
--- পন্ডিত হরপ্রসাদ চৌরাশিয়া-- the great বাঁশিওয়ালা।

আনন্দে অন্বেষার চোখদুটো চকচক্ করে ওঠে।
---কি এবার যাবিতো মুক্তমঞ্চের রাতের অনুষ্ঠান দেখতে? গত দু'বছর কত সাদাসাধি করেছি.. কিন্তু একদিন ও যাসনি। কিনা, রাতের অনুষ্ঠানে আব্বা যেতে নিষেধ করেছে ..সন্ধ্যার পর হলের বাইরে থাকা চলবে না । সেবার 'সোলস্' এর প্রোগ্রামে সারা হলের সব মেয়েরা গেল, তুই শুধু একা রয়ে গেলি হলে।

---নারে, এবার বাড়ীতে যেয়ে আব্বার পারমিশন নিয়ে এসেছি। এখন সিনিয়র হয়ে গেছি না ... তাছাড়া পারমিশন না থাকলেও এবার যেতাম...আমার প্রিয় কবি এবং লেখক নীললোহিত'দা ...ততোধিক প্রিয় বাঁশিওয়ালা আসছে আর আমি যাবো না ...তাই কি হয়! জীবনে এমন সুযোগ বারবার আসে না!

---তা, তুই এত খবর জানলি কি করে ?

--- কি করে আবার ...মামুন বলেছে.. ওতো এই অনুষ্ঠানের অর্গানাইজিং কমিটি তে আছে।

অন্বেষা এবার প্রমাদ গোনে...মামুন প্রসঙ্গ উঠলেই বাণীকে থামানো মুশকিল। ভার্সিটিতে যারা প্রেম করে, বিশেষ করে ক্লাসমেটদের সাথে তারা প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা একে অপরের সাথে আঠার মতো সেঁটে থাকে। অন্বেষা ঠিক বুঝতে পারে না একটা মানুষকে এতক্ষণ কিভাবে সহ্য করে! তারপর যদি হয় মামুনের মতো কেউ! কি পরিমান ক্যাবলা একটা ছেলে। কথায় কথায় খিকখিক করে হাসবে..আর হাসলে পরে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত দেখা যায় ..ভাবলেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। অথচ বাণী মেয়েটা কত ভালো ...দেখতে  সুন্দর, পড়া লেখায় ও বেশ ভালো, ফ্যামিলিও ভালো ...ও যে কিভাবে মামুনের প্রেমে পড়লো! প্রেম জিনিসটা সত্যিই আশ্চর্য! 

রেহানা এতক্ষন পড়ার টেবিলের সামনে হাতলওলা চেয়ারে দু'পা তুলে বসে ভ্রু কুঁচকে আড়চোখে তাকিয়ে ওদের কথা শুনছে। এরা যে কিসব ছাইপাশ বকে যাচ্ছে রেহানার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সুনীলের নামটা তবু কিছুটা পরিচিত ..অন্বেষা আপার মুখেই শুনেছে ,কয়েকটা বইও দেখেছে। কিন্তু চুরাশিয়া না কি জেন একটা নাম বল্লো, ঐ নাম তো জীবনেও শোনেনি। অন্বেষা আপার কাজই হলো সারাদিন গল্প-কবিতারা বই পড়া-- নিজের পড়ার বই খুব কমই পড়ে, তারপরও এমন দুর্দান্ত ভালো রেজাল্ট কি করে কে জানে ! এই বাণী আপার সাথে যে কি করে অন্বেষা আপার এতটা বন্ধুত্ব হলো রেহানা ভেবে পায়না। দু'জনের চরিত্র একেবারে বিপরীত ....অন্বেষা আপা ধীর-স্থির শান্ত ,আস্তে-আস্তে কথা বলে...আর ওদিকে বাণী আপা যেন একটা ঝড়...জোরে-জোরে কথা, জোরে-জোরে হাসি, ছটফটে চঞ্চল। 

বাণী ওদিকে বকেই যাচ্ছে --কি করে আজ মামুনের রাগ ভাঙালো, কি করে সেধে-সেধে বটতলা নিয়ে গেল বিকেলের চা খাওয়াতে...আরও কত যে সব হাবিজাবি! এই সব প্রেমিক জুটিরা পারেও বটে...বটতলা, কাঠাঁলতলা, প্রান্তিকগেট, ডেইরীফার্মগেট', কলাভবন-ক্যাফেটরিয়ার সামনে-পিছনে, ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল, আড়াল-আবডাল খোঁজার জন্য এরা কত জায়গায় না যায়! 

অন্বেষা বুঝতে পারে রেহানা রেগে যাচ্ছে। এটা ওর পড়ার সময় ..অন্বেষা ঘড়ির দিকে তাকায় ..আটটা বাজে। রেহানা  মেয়েটা এসেছে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে, পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বোঝে না। তাছাড়া ওর বাড়ির আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। সেই কারণে অন্বেষা সব সময়ই ওর লেখাপড়ার দিকে খেয়াল রাখে। বাণীকে আর বাড়তে দেয়া যাবেনা---অন্বেষা এবার বাণীর হাত ধরে টানতে-টানতে বলে--চল্, আমরা টিভি রুমে যাই .. 

আজ ফাগুন পূর্ণিমার রাত। আকাশে ঝকঝক করছে গোল রূপালী চাঁদ। রূপালী  জ্যোৎস্নায় স্নান করছে সমস্ত বিশ্বচরাচর। দু'দিকে উঁচু-উঁচু আকাশমণি গাছ, মাঝখান দিয়ে লাল ইটের রাস্তা। ফাগুনের এলোমেলো হাওয়ায় মিশে আছে হালকা ঠান্ডা। অন্বেষার কি যে ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই একসময়ে পৌঁছে যাবে বালু চিকচিক খোয়াই নদীর তীরে ...ওখানে কেউ একজন ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছে অন্বেষার জন্য। এসব ভাবতেই ভালোলাগায় অন্বেষা কেমন জানি কেঁপে ওঠে। হলের মেয়েরা দল বেঁধে চলেছে সব মুক্ত মঞ্চের দিকে। 

অন্বেষারা মুক্তমঞ্চের সামনের গ্যালারির একদম মাঝামাঝি জায়গায় বসে। কিছুক্ষণ পরেই অতিথিরা সব মঞ্চে এসে বসলেন। প্রথমে মৈত্রেয়ী দেবী, তারপর জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, তারপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সবশেষে বাঁশিওয়ালা। শুরুতেই মৈত্রেয়ী ও জয়ন্তর যৌথ আবৃত্তি ,তারপর জয়ন্তর একক পরিবেশনা। এরপর প্রিয় কবি-লেখক সুনীল। প্রথমেই নিজের মাতৃভূমি, নিজের লেখালেখি সম্পর্কে বললেন ...তারপর আবৃত্তি করলেন নিজের কবিতা। যখন 'নীরার জন্য' আবৃত্তি করছিলেন তখন অন্বেষার মনে হচ্ছিল সেই বোধহয় নীরা...আজন্ম কবি তাকেই খুঁজে ফিরেছেন তাঁর কবিতায় ! সবশেষে এলো সেই কাংখিত মুহূর্ত...বাঁশির সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে। সুর ছুঁয়ে গেল পূর্ণিমার চাঁদ, ঝকঝকে জ্যোৎস্না, লাল ইটের রাস্তা, আকাশমণি গাছ, সুর ছুঁয়ে গেল শাল-তমালের বন....। দূরে কোথাও ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি ...শোনা যায় শুকনো পাতার মচমচ্ শব্দ ....    

 

তিনঃ

অন্বেষা যা ভেবেছিল, ছেলেটা তারচেয়ে ও অনেক বেশী চমকেছে। ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ছেলেটা তার বিস্ময় কাটিয়ে খুব ধীরে ধীরে উত্তর দেয়, -- প্রিংনাম (শুভ সকাল)। যদিও সকাল আরও কিছুক্ষণ আগেই পালিয়েছে। তবু সম্ভাষণ জানানোর জন্য এই শব্দটা ছাড়া অনেষার অন্যকিছু জানা নেই।

অন্বেষা একটু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, -- ন্যাংকোরা ম্যাই মিংচিম (তোমার ভালো নাম কি)? 
-- আংয়া দর্ফন, দর্ফন সাংমা । 

অন্বেষা মনে মনে দুই বার আওড়ে নিয়ে মুখে বলে, --দর্ফন, মানে দর্পন, আয়না?

ছেলেটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। 

--বাহ্! খুব সুন্দর নাম । 

অন্বেষা মনে মনে ভাবে ছেলেটার নামটা একদম সার্থক । স্বচ্ছ আয়নার মতো যার চোখ, তাকেতো এই নামেই মানায় । 

-- আফা, আফনি আচিক ভাষা জানেন? ছেলেটা তার কৌতুহল নিবারণ না করতে পেরে এবার প্রশ্ন করে। 

-- ভাষা বলতে যা বোঝায় তা জানিনা। তবে এখানে আসার আগে দু' একটা বাক্য শিখেছি মাত্র। এর আগে বইতে 'আচিক মান্দি' (পাহাড়ের মানুষ) সম্পর্কে পড়েছি কিছু কিছু। অন্বেষা ইচ্ছে করেই 'আচিক মান্দি' শব্দটা ব্যবহার করে, কারণ এরা 'গারো'র পরিবর্তে নিজেদেরকে এই পরিচয় দিতেই পছন্দ করে ।

--আচ্ছা দর্ফন, এই জায়গাটার নাম কি? 

--আফনি দেখেননি! বাংলোর সামনেই রাস্তার ধারে সাইনবোর্ড আছে, ইজায়গার নাম 'অরুণখোলা'। 

প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে দুজনেই এখন বেশ সচ্ছন্দ। দর্পণের একটু ভাঙা-ভাঙা উচ্চারণের বাংলা শুনতে অন্বেষার বেশ ভালোই লাগছে। ও বলতে পারেনা যে বাসটা যখন বাংলোর কম্পাউন্ডে ঢুকছিল তখন জ্বরের ঘোরে চোখ বন্ধ করে ছিল, তাই দেখতে পাইনি।

অন্বেষা মনে মনে ভাবে, অরুণখোলা-- অরুণ মানে সূর্য, আর খোলা মানে উন্মুক্ত, অর্থাৎ দুটো মিলিয়ে 'উন্মুক্তসূর্য'। বাহ্! কি সুন্দর! এখানেতো সূর্য উন্মুক্তই, সবার জন্য--অরণ্যের গাছগাছালির জন্য, পাখির জন্য, পশুদের জন্য, আদিবাসী এই মানুষগুলোর জন্য--আর সব কিছুকে ধরে রাখা এই মাটির জন্য।

মুখে বলে -- কি অদ্ভুত সুন্দর নাম! দর্ফন, তুমিতো বেশ সুন্দর গুছিয়ে বাংলা বলো, কোথায় শিখেছ? 

অন্বেষা ভেবেছিল এই জংগলে বাস করা আদিবাসীরা নিশ্চয় বাংলা ভালো জানেনা। এখনতো দেখা যাচ্ছে ছেলেটা শুধু বাংলা জানে তাই নয়, পড়তেও পারে। 

অন্বেষা নিজের ব্যবহারে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। তার বয়সী কিংবা তার চেয়েও দু'এক বছরের বড় সম্পূর্ণ অচেনা একটি ছেলেকে কি অবলীলায় তুমি করে বলছে! ছেলেটা কিন্তু তাকে আপনি বলেই সম্বোধন করছে। এর জন্য দায়ী কি এই পরিবেশ, নাকি ছেলেটার সারল্য, নাকি অন্বেষার শহরে বাস করা উন্নাসিক মনোবৃত্তি--যে ধরেই নিয়েছে একটি আদিবাসী ছেলে তার চেয়ে নীচু শ্রেণীর, তাকে তুমি সম্বোধন করাটাই শ্রেয়। 

-- আমি বাংলা শিখেছি স্কুল থেকে, দর্ফন বেশ গর্ব করে উত্তর দেয় । 

-- তাই! তুমি কতদূর পড়াশোনা করেছ? 

-- আমি ম্যাট্রিক পাশ দিয়েছি । 

-- এখানে মাধ্যমিক স্কুল আছে? অন্বেষা একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে । 

-- হ্যাঁ, বনের ভেতর দিয়ে একটু সামনে এগুলেই অরুণখোলা বাজার, উখানটায় মিশনারি স্কুল, কাছাকাছিই আমাদের বাড়ী। 

-- তোমরা রোমান ক্যাথলিক,তাই না? 

দর্ফন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে । অন্বেষা এতক্ষণে খেয়াল করে সেই ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে, দর্ফন কিন্তু তার সম্পর্কে কোন কৌতুহল দেখায়নি । আশ্চর্য! এবার সে নিজেই কৌতূহলী হয়,-- দর্ফন, তুমিতো একবারও জানতে চাইলে না আমি কে ? 

-- আমি জানি, আফনারা আজ সকালে বাসে করে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন। আফনার সাথের অন্যরা জংগলে গেছে, আফনার জ্বর তাই যেতে পারেননি । 

 

-- ওমা, তুমি এত কথা জানলে কি করে? অন্বেষা বিস্মিত হয়। 

-- মার কাছ থেকে। আমার মা ইখানের বাবুর রান্না করে। মাকে লিয়ে ফিরব। দর্ফন বাংলোর দিকে আঙুল তুলে দেখায়।-- আফনারা এসেছেন তাই মার আজ একটু দেরী হচ্ছে।

অন্বেষা এতক্ষণে দর্ফনের এখানে বসে থাকার কারণটা বুঝতে পারে। তাহলে বাংলোর ভিতরে যে আদিবাসী মহিলাকে দেখেছিল সেই দর্ফনের মা। 

 

-- কিন্তু জ্বর লিয়ে আফনি ইখানে এলেন কেন? 

-- তোমার বাঁশি শুনে, তুমি খুব সুন্দর বাঁশি বাজাও। তাছাড়া এখন জ্বরটাও নেই, শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। 

অন্বেষার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে দর্ফন একটু লজ্জা পায়। এরপর দুজনেই চুপ করে যায়। চারদিকের এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। যে নৈঃশব্দ্য নিজেই প্রকৃতির ভাষায় ক্রমাগত কথা বলে চলে--কখনও পাখির শিসে, কখনও শুকনো পাতার মর্মরে, কখনওবা একবুক হাহাকার তোলা চৈতালী বাতাসে। 

 

সেই নৈঃশব্দ্য ভেঙে অন্বেষাই প্রথম কথা বলে ওঠে, -- দর্ফন, তুমি কি একটু বাঁশি বাজিয়ে শোনাবে? 

 

এ কথার কোন উত্তর না পেয়ে অন্বেষা ঘুরে দর্ফনের দিকে তাকায়। দর্ফন অপলক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হৃদয়ের গভীর ছুঁয়ে যাওয়া কি অদ্ভুত সেই দৃষ্টি! 

 

ছেলেটা যেন তার কথা শুনতেই পায়নি এমনিভাবে খুব আস্তে বলে ওঠে, --খুব সোন্দর। 

 

অন্বেষা অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে, --কি? 

 

--আফনি, খুব সোন্দর..ছেলেটা অন্বেষার চোখে চোখ রেখেই কথাগুলো বলে। 

 

অন্বেষা জানে সে দেখতে খুব সুন্দর। তার সৌন্দর্যে কোন উগ্রতা নেই, আছে স্নিগ্ধতা। অন্বেষা বড় হওয়ার পর থেকেই বহু ছেলের মুগ্ধ চোখ দেখেছে, কিন্তু এই দৃষ্টি সম্পূর্ণ অচেনা! দর্ফনের এই তাকানো এবং কথা বলার ভিতর এমন কিছু ছিল অন্বেষার বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। এক অদ্ভুত ভালোলাগা শরীরে শিহরণ তোলে! শরীর-মন দুটোই বিবশ হয়ে যায়। 

 

দর্ফন আর কিছুই না বলে আস্তে আস্তে ঠোঁটে তুলে নেয় বাঁশি। কি করুণ সুর! বাঁশির সুরে যেন মনে হয় সমস্ত প্রকৃতিই কেঁদে ওঠে! অন্বেষার মন এক অচেনা বিষাদে ছেঁয়ে যায়, ভাবে এই রকম পরিবেশে বোধহয় করুণ সুর ছাড়া কিছুই মানায় না! 

 

বাংলোর সামনের দিক থেকে ছেলে-মেয়েদের হৈচৈ এর শব্দ ভেসে আসছে, তারমানে ওরা ফিরছে। এবার ওকেও উঠতে হবে। অন্বেষা আস্তে করে বলে, --এবার আমি যাই। 

 

দর্ফন বাঁশি থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অন্বেষার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, --গ্রংতাইজেন।

অন্বেষা এই শব্দটির অর্থ জানে, কিন্তু প্রতিত্তোরে বলতে পারে না, আবার দেখা হবে। অন্বেষা আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,-- মিতেলা ( ধন্যবাদ )। আমি যাই। 

 

'যাই' বলে আর দেরী না করে বাংলোর দিকে হাঁটা শুরু করে। একটু দূরে যেয়ে অন্বেষা পিছন ফিরে দেখে দর্ফন এদিক পানে চেয়েই দাঁড়িয়ে আছে, অন্বেষা তাকাতেই হাতটা একটু উঁচু করে নাড়ে। 

 

অন্বেষা মনে মনে ভাবে, দর্ফন তোমার সাথে আমার আর কখনও দেখা হবে না, দেখা হওয়া উচিতও নয়-- সভ্যতা আমাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। অন্বেষার মনে হলো ওর শরীর কাঁপিয়ে আবার জ্বর আসছে। বুক কাঁপানো একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শুকনো পাতার উপর মচ্ মচ্ শব্দ তুলে অন্বেষা ধীরে ধীরে বাংলোর দিকে এগিয়ে যায় .... 

 

অন্বেষা, এই অন্বেষা, ধ্যান করতে করতে কি ঘুমিয়ে পড়লি? সবাই প্রায় চলে গেছে, -- বাণী অন্বেষার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয় । 

 

-- অ্যা, বলে অন্বেষা অনেকটা ঘোরের ভিতরে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। 

 

রুপালী জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে সমস্ত ক্যাম্পাস। হাসি-গল্পে মশগুল হয়ে দলে-দলে ভাগ হয়ে ছেলে- মেয়েরা হলে ফিরছে। অন্বেষা যেন সেই দলে থেকেও নেই। আশেপাশের কোন কিছুই তার কানে যাচ্ছে না। বাঁশির সকরুণ সুর তাকে ছুঁয়ে, জ্যোৎস্নালোকিত চরাচর ছুঁয়ে , নাম না জানা পাখির ডাক ছুঁয়ে, শাল-তমালের বন ছুঁয়ে, ক্রমশঃ ঢুকে পড়ছে এক বুক হাহাকার তোলা এক নৈঃশব্দ্যের দুপুরে ....

 

পুনশ্চ:

--- আম্মু, অ্যাই আম্মু, চলো না তুমিও নীচে যাবে, -- মেয়েটা নীচে মঞ্চের দিকে আঙুল তুলে দেখায়।

মেয়ের ডাকে অন্বেষা স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফেরে, একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, ---না, মা আজ আর না। এরপর ঢাকা পৌঁছাতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। 

অন্বেষা মেয়ের হাত ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। নৈঃশব্দ্যের দুপুর ভেঙে আবারও একটা দমকা হাওয়া ওঠে, সড়-সড়্ শব্দে উড়ে যায় শুকনো পাতা, খুব কাছেই কোন একটা গাছে বসে ডেকে ওঠে কোকিল—কু-উ-উ---কু-উ-উ----কু-উ-উ------  

 

রোজীনা পারভীন বনানী
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top