সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব ষোল) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
২১ এপ্রিল ২০২১ ২০:৫৫

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৫:৪৮

ছবিঃ নীল পাহাড় এবং লেখিকা শাহান আরা জাকির পারুল 

 

সেদিন আর নিতুর সাথে কোন কথা হলোনা নীলিমার। দুজনে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

নীলিমার রুম এ পাশাপাশি দুটি বেড।

প্রিয়জন কেউ এলে এতো বড় বাড়িটায় তার রুমেই থাকতে দেয় নীলিমা। নিচতলায় কর্নারের একটা রুম এ থাকে দু ছেলেমেয়ে ও বৌ নিয়ে তার ড্রাইভার করিম।

রাতুল চলে যাবার পর থেকেই এরা তার আশ্রিতা।

তার সবকিছু এরাই রক্ষনাবেক্ষন করে বলা যায়।

পাশের বেডেই ঘুমিয়েছে নিতু। সারা রাত আজ ঘুম আসেনি নীলিমার!দুইতলা বাড়ির উপরতলায় থাকে সে। জানালা দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই দেখা যায় নীল পাহাড়ের চূড়া।

রাতুল এর শেষ পোস্টিং ছিল এখানে পাহাড়ঘেরা এক মনোমুগ্দ্ধ জায়গায়!জীবনের সব স্বপ্ন ঢেলে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল এই বাড়িটি। প্রতিটি ইট পাথরে রাতুল এর ছোয়া।

একমাত্র সন্তান বিদেশে লেখাপড়া শেষ করে ওখানেই সংসার পেতেছে।

প্রতিনিয়তই কথা হয় ফোন এ, ইন্টারনেট এ। এখন প্রযুক্তি কত এগিয়ে গেছে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ভোর হয়ে যায়। এমনই হয় নীলিমার। রাতুল যাবার পর কোন রাত সবটুকু ঘুমিয়েছে মনে পড়ে না। শুধু স্মৃতি স্মৃতি, আর স্মৃতি।

অঘোরে এখনো ঘুমুচ্ছে নিতু। কি মায়ামাখা মুখটা ঘুমন্ত নিতুর। তার এতো কঠিন যন্ত্রনা বিষ ফণা তুলে আছে কে বলবে! দক্ষিণের জানালার মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে নিতুর চোখে মুখে।

অশ্বিন এর শিন শিন ঠান্ডা বাতাস বইছে ঝির ঝির। নীলিমা নিতুর গায়ে পাতলা একটা কাঁথা দিয়ে জানালার পর্দাটা টেনে দেয়।

নিতু আড়মোড়া দিয়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমোয়। অপলক চেয়ে থাকে নীলিমা।

নিতুর এতো সুন্দর মুখটাতে কিসের কালিমা লেপ্টে আছে। চোখের চারপাশ গভীর কালো!ভোরের আলোয় যেন সব পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে।

---- কি ভাবছিস আমাকে দেখে এতো নীলু?

-----কিচ্ছুনা! তুই আর একটু ঘুমো! আমি দেখি নাস্তার কি করছে ওরা।

---- আর একটু বোস আমার কাছে নীলু। সারা রাত তো ঘুমোসনি মোটেই।

চমকে ওঠে নীলিমা!

------তুই জানলি কি করে?

------আমিও যে তোর মতোই ঘুমের ভান করে সারা রাত পাড়ি দেই নীলু। এতো কষ্ট রাব্বুল কেন দিয়েছেন আমাদের বলতে পারিস! সব কিছু পেয়েও আমরা সব হারিয়ে নিঃস্ব! এতো অঢেল সম্পদ, অট্টালিকা! এতকিছু থেকেওতো তুই নিঃস্ব নীলু!

----- জীবনতো এরকমই বন্ধু। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে।

------আপুমনি۔۔۔۔۔নাস্তা রেডি।

----- চল চল নিতু, হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করবি চল!নাস্তা রেডি করেছে ওরা।

 

নাস্তা শেষ করে দুজনে চা নিয়ে বেল্কুনির গা ঘেসে ছোট্ট আঙিনায় লন এ এসে বসলো দুজনে।

-----তারপর বল নিতু তুই এই পাহাড়ঘেরা দেশে কিভাবে এলি।

-----সে আর এক ইতিহাসরে নীলু! কোনটা ছেড়ে তোকে কোনটা বলব বল!

একটা একটা করে সব বলবি নিতু। তোর সব কথা শুনবো। তা তুই এখন কোথায় আছিস সেইটা আগে বল।

------এখন আছি ক'জন মিলে ছোটমোট একটা ফ্লাট ভাড়া করে। এইতো তোর বাড়ির কাছাকাছিইরে নীলু।

------খালাম্মা, খালুজি, ভাইয়া, ভাবি তাদের কি খবর?

-------নীলু দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ কত বছর হিসেব করেছিস?

------হুঁ সেটাই!

------ মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই যে রাস্তায় দেখা হলো তোদের সাথে, সেইতো শেষ দেখা নীলু। ইচ্ছে করেই কারো খোঁজ রাখিনি। রাখার মত কোন হাতিয়ারই যে ছিলোনা আমার। এতবছর পর কত কথাই যে মনে পড়ছে নীলু।

হঠাৎ একফালি কালো মেঘ এসে আঙ্গিনাতে ছায়ায় ভরিয়ে দিলো। মিষ্টি বাতাস বইছে ঝির ঝির।

-------ইস কি মিষ্টি বাতাসরে নীলু। আকাশটাও দেখ হঠাৎ কি ঘন নীল হয়ে চাঁদোয়ার মতো ঢেকে দিলো আমাদের। সকালের রোদটা তাপিয়ে উঠেছিল বেশ। এখন একটা অন্যরকম আবেশ জড়িয়ে গেল। ঐ যে দূরের নীল পাহাড়ের চূড়াটা কি অপরূপই না লাগছে নীলু।

------ওদের প্রেমে পড়েইতো রাতুল আর আমি এখান থেকে সরতে পারিনিরে।

দীর্ঘশাস ঝরে পরে নীলুর বুক চিরে।

তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময় কিভাবে ছিলি বল?

----- সব বলবোরে নীলু। তোকে আমি স-ব বলবো! এ জীবনে যা কোনদিন কাউকে বলতে পারিনি! বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। লুকিয়ে ফিরছি সারাটি জীবন, তা তোকেই বলবো। তোকেই বলা যায় সব। সব কথা সব বন্ধুকেও বলা যায় না। তোকে বলা যায়। জন্মের পর থেকে একই পাড়ায় একই পরিবারের মতো বেড়ে উঠেছি আমরা। সুখ দুঃখের কত কথাই না শেয়ার করেছি আমরা।

জানিস নীলু মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে যাবার একটি ঘটনা এখনো আমাকে পাগল করে তোলে। তোদের সাথে কখন যে গোলাগুলির শব্দে যে যার প্রাণ বাঁচাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। একসময় দেখলাম আমার শশুর বাড়ির সবাই আমরা একসাথে মিলিত হয়েছি। সুমনকে দেখতে না পেয়ে আমার বড় ভাসুর ফেটে পড়লেন রেগে। ঐ পরিস্থিতিতে বলেই ফেললেন ----- অকর্মাটা কোই গেছে? চাকরি ছাইড়া বৌ এর পা চাটতে আসছে! এখন কোই!

আমার শশুর বাবা খুব বিরক্ত হলেন। আসলে উনি সব জানতেন। সুমন তাঁকে জানিয়েছিল, এই জায়গায় আমাদের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হবে। আমাদেরকে নিয়ে তারা তাদের গ্রামের বাড়িতে যাবেন। সুমন একমাত্র ওদের পরিবারে বাবাকেই জানিয়েছিলো, সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। 

সাতমাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে হাঁটতে পাড়ছিলামনা কিছুতেই। যেতে যেতে একটা হিন্দু বাড়ির সামনে এসে গেলাম আমরা!দলে দলে লোক আসছে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মায়ের মত একজন। আমার কষ্ট দেখে দৌড়ে এলে। সিঁথিতে সিঁদুর দেখে মাসিমা বলে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ মাসিমা বলে উঠলেন, কেরে তুই ? নিতু না!

------ আমি চমকে উঠে দেখি সরস্বতীর মাসিমা! তোর মনে আছে নীলু সরস্বতীর কথা?

------- হুঁ, খুব মনে আছে! মনে আবার থাকবে না! পূজোর সময় ঢাকের বাড়ি শুনলেইতো আমরা দৌড় দিতাম সরস্বতীদের বাড়িতে। কত কি যে খেতে দিত মাসিমা। আর মেসোমশাইয়ের গল্পতো ভোলাই যায়নারে।

------সেই সরস্বতীর মাসিমা। কত আদর করেছেন উনি সরস্বতীদের বাড়িতে যখন গিয়েছেন। পরিচয় পেয়ে তোড়জোড় করে আমাদের সবাইকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন!বড় বড় কাঁচাপাকা কয়েকটি ঘর। আমাদের খুব আদর যত্ন করলেন। চিড়া, নাড়ু, মুড়ি মুড়কি দিলেন খেতে। না খাওয়া সবাই হাপুস হুপুস করে খেলাম। খেলোনা আমার বড় ভাসুর অতিভক্ত আল্লাহ ওয়ালা মানুষ। মালাউনের বাড়ির খাবার কিছুতেই খাবেনা। খুব তাড়া দিচ্ছিলো আমাদের চলে আসার জন্য।

মাসিমা তাদের বড় ঘরটির বিশাল বারান্দায় মাদুর পেতে দিয়েছিলেন। সবাই ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছিলেন।

তখন সন্ধে হয়ে গেছে। মাসিমা বললেন, এই দুঃসময়ে তোমাদের একটু আশ্রয় দিতে পারলাম। ঈশ্বর মঙ্গল করুন আমাদের। আজ রাতটুকু তোমরা আমাদের এখানেই থাক কষ্ট কর। সকাল হলে যা হয় করা যাবে।

এরই মধ্যে আরো কিছু লোক এসে পড়লো আমাদের মতোই শহর ছেড়ে। তাদেরকেও দেখলাম বাড়ির লোকজন ভেতরে এনে জলখাবার এর ব্যবস্থা করছে। ঐ কঠিন বিপদে স্বজাতি না হলেও তাদের এই ত্যাগের কথা ভুলবার নয়!

আমার বড় ভাসুর বের হয়ে আসার জন্য জোড় তাগাদা দিতে থাকলেন। বাবা একটু ধমক দিয়েই বললেন, দেখছো আমার মেয়েটা খুব অসুস্থ! সকাল হলে বেরুলে কি অসুবিধা তোমার?

বোঝা গেলো ভাসুর বাবার প্রতি খুব বিগড়ে গেলেন। ভ্রু চোখ কুঁচকিয়ে যেন আগাম জানান দিলেন কোন প্রতিহিংসার চরম মূল্য দিতে হবে একদিন বাবাকে। কটমট করে চলে গেলেন পাশের মসজিদে।

চলবে

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top