সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব সতের) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
২৮ এপ্রিল ২০২১ ২০:৫৫

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১০:১৮

ছবিঃ নীল পাহাড় এবং লেখিকা শাহান আরা জাকির পারুল 

 

এরপর দেখা গেলো আরো একদল মানুষ হেটে হেটে হন্যে হয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে এদিকে আসছে। তখন অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। তারা এসে এ বাড়ির আঙিনায় বড় আম গাছটার নিচে বসে পড়লো সবাই। সঙ্গে বাচ্চাও ছিল!মশার কামড়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে মেসোমশাই ও মাসিমা তাদেরকেও ভেতরে নিয়ে এলেন। এতো মানুষের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন তারা।

বাড়ির উঠোনে ইটের চুলায় রান্না হচ্ছে খিচুড়ি নিরামিষ। পাঁচ ফোরণের নিরামিষ এর গন্ধ বাতাসে মৌ মৌ করতে লাগলো। এক ফাঁকে আমার ভাসুর মশাই ভেতরে এসে এক চক্কর দিয়ে গেলেন। মহা ধুমধাম করে সবাই গোগ্রাসে খিচুড়ি নিরামিষ খেলাম। অচেনা অজানা মানুষগুলি সবাই সেদিন এক হয়ে গিয়েছিলাম। ছিলোনা কোন জাত ধর্মের ভেদাভেদ! মনে মনে ভাবলাম, এ রকম কত মানুষকে যে ইনারা আশ্রয় দেবেন!

রাতে এতগুলো মানুষ এর শোবার জায়গা একটু চাপ পরে গেলো। এ ঘর ও ঘর মিলিয়ে মাসিমা ও বাড়ির সবাই ঠিকই ব্যবস্থা করে ফেললেন!

সবশেষে মাসিমা আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন তাদের পুজোর ঘরে। কি পরিপাটি ঘরটি। একপাশে দেবী রাধা কৃষ্ণের মূর্তি। বাঁশি বাজাতে বাজাতে যেন মিটি মিটি হাসছে ওরা।

মাসিমা মাথা নুইয়ে প্রণাম করলেন!এরপর আমায় আশীর্বাদ করে বললেন ----- নিতু, তোর যেন ভগবান আমার কৃষ্ণের মত একটা সুদর্শন ছেলে সন্তান দেন। আমি আবেগে মাসিমা'কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।

এ ঘরেরই এক পাশে ছোট্ট একটি চৌকিতে আমার বিছানা করে দিলেন মাসিমা। আর তিনি ঘুমোলেন রাধা কৃষ্ণের পাশে মেঝেতে বিছানা করে।

জীবনে ভুলবোনা সেই স্মৃতি। পুজোর ঘরে মুসলিম একটি মেয়ের ঠাঁই। ভাবাই যায়না। তারা তাই করেছিলেন।

দেশের সেই ক্রান্তিকালে এক হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। কোন জাত ধর্ম, বর্ণ বিভেদ বলে কিছু ছিলোনা। সারা রাত ঘুম হলোনা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো সুমনের জন্যে!এভাবেই কেটে গেলো রাত।

মসজিদের আজান শোনা গেল।

ভোরের আলো ফুটে উঠতেই আবার আমার ভাসুর মশাই এলেন চক্কর দিতে!কানে কানে আমার শাশুড়ি দেখলাম আমার পুজোর ঘরে ঘুমোনোর খবরটা দিয়ে দিলেন। রাগে কটমট করে তাকালেন আমার দিকে।

মাসিমা এটা খেয়াল করে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কোনরকম চিড়ে মুড়ি খেয়ে আমরা আমরা রওনা হবো,দেখলাম একটা মোষের গাড়ি আঙ্গিনায়। আমার এই অবস্থা দেখে মেসোমশাই এ ব্যবস্থা করেছেন !আমার তখন বেজায় খুশি। সবার আগে উনি উঠলেন গাড়িতে। এরপর আমরা মহিলারা উঠলাম সবাই। পুরুষরা হেঁটে রওয়ানা হলো।

আসবার সময় মাসিমা লুকিয়ে আমার ওড়নার আঁচলে অনেকগুলো নাড়ূ মুড়কি বেঁধে দিয়েছিলেন। মোষের গাড়ি চলতে থাকলো!গাড়োয়ান দরাজ গলায় গান শুরু করলেন ---- ওকি গাড়িয়াল ভা۔۔۔ই ۔۔!

আমার শাশুড়ি নাক ডেকে ঘুমুতে লাগলেন। আমরা গানে গানে দুলতে দুলতে চুপি চুপি সবাই নাড়ু মুড়ি খেতে থাকলাম। দু তিন ঘন্টার মধ্যে আমরা সুমনের দাদা বাড়িতে পৌঁছে গেলাম।

আসলেই আলিশান বাড়ি। গাছ পালা আর মৌসুমী ফল ফুলে ঢাকা বিশাল বাড়ি!সেই আমলের চিলেকোঠা দেয়া দুইতলা বাড়ি। সামনে বিশাল পুকুর। সান বাঁধানো ঘাট দুই পাড়ে!অযত্নে পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে দীঘির আকার ধারণ করেছে পুকুরটি। আমাদের দেখে ছুটে এলেন গ্রামবাসী! নানান জাতের ফলফলারি ও চিড়ে মুড়ি নিয়ে এলেন একেকজন। আমার দুই ভাশুরই খুব হৈহল্লা শুরু করে দিলেন।

বুঝিয়ে দিলেন, এখানকার শেঠ তারা।

কিছুক্ষনের মধ্যেই লম্বা লম্বা জোব্বা ও আলখেল্লা পড়া বেশ কয়েকজন এসে আমার দুই ভাসুরের সাথে কোলাকুলি করে গেলেন। এ সব দেখে আমাদের পরিবারের সবাই যেন কেমন বিমর্ষ হয়ে গেলেন।

চলমান

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top