সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

ফেরার পথে মেঘ : রোকেয়া ইসলাম


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২৩:২০

আপডেট:
১২ মে ২০২১ ০০:৩৩

 

কথা ছিল মামা সাথে আসবে, হঠাৎ একটা জরুরী কাজে আঁটকে গেল তাই আসতে পারেনি। ওকে একাই আসতে হল। ঠিক একাও নয় সাথে আছে মামার খুব বিশ্বস্ত সহচর মজনু। পায়েল যে গাড়িতে যাচ্ছে সেটাও মামার।

মামা পায়েলের বিষয় নিঁখুতভাবে দায়িত্ব পালন করছে। সেই দায়িত্বে কতটুকু স্নেহ আছে মনে মনে খুঁজতে থাকে। কেন এতো বছর পর ও’ মামার কাছ থেকে স্নেহ খুঁজছে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। রক্তের সম্পর্কের মাঝে স্নেহ খোঁজাটাও কি অপরাধ নয়? স্নেহ মমতার মত অবর্ণনীয় অছোঁয়া অনুভবীয় বিষয়ে খুঁত খোজার প্রয়োজনটাই বা কোথায়? ওর কি খুব বেশী স্নেহ মমতার প্রয়োজন? নিজেকে এতোটা অসহায় মনে করছে কেন ও’ কি নেই ওর? বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশে বসবাস করছে দীর্ঘকাল।

পায়েলের বাবাও ছিল থানা পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা। গ্রামে উত্তরাধিকারী হিসেবে পেয়েছিলেন অগাধ ধানী জমি। তার ছিল প্রচন্ড নাক উঁচু স্বভাব। তার চেয়ে নিচে অর্থবিত্ত এবং সম্মানের মাপকাঠিতে দাঁড়ানো মানুষকে খুবই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। কোন প্রকার সহযোগিতা দূরে থাক, যোগাযোগই রাখতেন না। যোগাযোগ না রাখা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে পায়েলের একমাত্র মামাও ছিল সর্বাগ্রে।

সেদিনের প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাবা বেঁচে থাকলে আজ বোধ হয় মামার সাথেই রাখতেন সবচেয়ে বেশী যোগাযোগ কথাটা মনে হতেই প্রশ্ন জেগে উঠে, ও কেন এতো বছর পর এলো মামার বাড়ীতে?

ওরা তিন বোন- মিতু, কাকলি আর পায়েল। বাবার নাক উঁচু স্বভাব পুরোটাই পেয়েছে মিতু। নিজের চেষ্টায় নিজের ভেতর নাক উঁচু স্বভাবের বীজ বহুগুণে ফলিয়েছে মিতু।

বাছাবাছি করতে করতে মিতুর বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়। কাকলিরও তেমনি অবস্থা। বাবা মারা যাওয়ার পর পায়েল নিজের পছন্দে বিয়ে করে আমেরিকা চলে যায়, স্বামীর চাকুরীসূত্রে। ওর মা পরে মারা যান।

পঞ্চাশ পেরিয়ে বুড়ো হদ্দ বেকার একজনকে বিয়ে করে উঁচু নাক কেটে পুরোপুরি বোঁচা হয়ে যায় মিতু। কাকলির আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি।

বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ দু’বোন নিঃশ্বেষ করে ফেলেছে দীর্ঘদিনে। থাকার মধ্যে আছে শুধু মেইন রোডের উপর ষোল ডেসিমেলের একতলা বাড়ি।

আমেরিকা থেকেই খবর পায় বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বলটুকু দখল করার পাঁয়তারা হচ্ছে। দখল যারা করার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের সামনে মিতু ও কাকলি ঝরা পাতার মত উড়ে যাবে।

আমেরিকাতেই পরিচয় হয় ফিরোজ মৃধার সাথে। ফিরোজ মৃধাই যোগাযোগ করিয়ে দেয় ইমতিয়াজ আহমেদের সাথে। পায়েলও সুদীর্ঘ নিরবতা ভেঙে তার বাবার তরফের দু’একজন প্রভাব প্রতিপত্তিশালী আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে তবেই এবারের দেশে আসা।

মিতু ও কাকলি বিষয়টায় একেবারেই রাজি নয়। হাল ছাড়েনা পায়েল। এই বয়সে মাসকাবারী সংসার খরচের টাকা কত আর টানা যায়? ওর বাবার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বোনদের সাথে আলোচনায় বসে। তারা কিছুটা গররাজি করায়।

পায়েল সময় নষ্ট না করে আহমেদ বিল্ডার্সের কাছে প্লট হস্তান্তর করে, বোনদের সাথে নিয়েই।

এ’কদিনে দিন রাতের পার্থক্যের সমস্যাটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। সব কাজ নির্বিঘেœ মিটে যায়। মাথা থেকে মাখন সর্বস্ব বাড়িটা হাত ছাড়া হবার দুশ্চিন্তা থেকে একেবারে মুক্ত। মিতু এবং কাকলিকে আর টাকা পাঠাতে হবে না। নিজে দেশে এলে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে। সব মিলে নির্ভার মনে সুস্থির ঘুম হয় পায়েলের।

ভোরের আলো তখনও পৃথিবীতে পৌঁছায় নাই। কাকলির চিৎকারে জেগে হুড়মুড় করে দরজা খুলে বাইরে আসে পায়েল। মিতু আর কাকলি খুব করুণভাবে বিলাপ সুরে কাঁদছে, উঠোনের পাশে বকুল গাছটা জড়িয়ে।

পায়েল চিনতে পারে গাছটা। এটা মায়ের হাতে লাগানো গাছ। বাবা মারা যাবার পর লাগিয়েছিল এটা।

দরজা খোলার শব্দে ওরা পায়েলকে দেখে নিষ্পলক বিদ্রæপের চোখে তাকিয়ে থাকে। ওদের শান্ত করার জন্য সিঁড়িতে পা দেবার উপক্রম করতেই কাকলী খেকিয়ে ওঠে, ‘তোর আর ডেভেলপারের মাঝে কোন তফাৎ নেই’। অভিমানে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে নিঃসাড় বসে থাকে পায়েল। অনেকক্ষণ পর মনে হয় এ বাসাটা ওর না। এ শহরটাও নয়। বুকের ভেতরটা প্রচন্ড শুন্য হয়ে যায়, কেন এই ছুটে আসা? কোথায় যাবে, কোথায় যাবে? ভাবতেই মামার কথা মনে হয়।

ব্যাগ গুছিয়ে ডেভেলপারের সই করা কাগজগুলোসহ সোজা মামার বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়।

সারাটা পথ একবারও মনে হয়নি দীর্ঘ অযোগাযোগের পর মামা ওকে কিভাবে গ্রহণ করবে। শুধু মনে হয়েছে কয়েকটা দিন নিজের করে আপন আলয়ে সুস্থির আশ্রয়ের প্রয়োজন ওর। যেটা একমাত্র মামাই দিতে পারবে।

বলরামপুরে নানা-নানীর কবর জেয়ারত করতে চায় শুনে মামার চোখে মুখে চমক থাকলেও তিনি নিয়ে যেতে রাজী হন। হঠাৎ কাজে আঁটকে যাওয়াতে তারই নিঁখুত ব্যবস্থাপনায় পায়েলকে পাঠায়।

-আপা মির্জাপুর পার হয়ে গ্যাস নেব তখন নাস্তা করতে পারবেন।

ড্রাইভারের কথায় চমকে তাকায়।

-সকাল সকাল বাইর হইছি তো তাই জ্যামে আটকায় নাই গাড়ি।

“যানজট” এই বিষয়টার সাথে কোনদিনই পরিচয় ছিল না পায়েলের। দেশে এসে এই বিষয়টার ভয়াবহতা টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। ওর থোক বরাদ্দ সময় থেকে খুচরো খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেকটাই।

-সামনে ভাল একটা রেস্তোরা আছে, থামাবো ঐখানে?

-গ্যাস নিয়ে নাও। খাবার আছে টিফিন কেরিয়ারে।

গাড়ি সি.এন.জি ষ্টেশনে ঢুকতে ঢুকতেই পায়েল শুনতে পায় মজনু বলছে,

-ম্যাডামের সব দিকেই নজর। সবার জন্যই নাস্তা পানি গুছাইয়া দিছে।

পায়েলের বুকের নিবির জলাশয়ের মাঝখানে ছোট্ট একটা ঢিল পড়ে। তরঙ্গায়িত হয়ে শুস্ক পাড় অবধি পৌঁছায় জলের ছোঁয়া।

রাবনা বাইপাসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নাস্তা পর্ব শেষ করে পায়েল। হাতের বাম দিয়ে ঢুকে গেলেই শহর।

মামা বোধহয় মিতু আর কাকলির বিষয়টা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন, মজনুকে তেমনি নির্দেশনা দেয়া।

-আপা, শহরের ভেতর দিয়ে যাবেন না বাইপাস দিয়ে যাব?

-শহর নয়, অন্যপথে চল।

বাইপাসে উঠে যায় গাড়ি। একদম অচেনা পথ। কবে হল এই পথ! মনে হয় বেশ কয়েক বছরের পুরোনো পথ এটা।

পায়েলের বুকের ভেতর অভিমানে আদ্র হয়ে যায়। দু’দুটো মূর্খ আবেগ সর্বস্ব মানুষ। ওদের জন্যই যেতে হচ্ছে এই ঘুর পথে। আরে বোকারাম- শিউলি গাছ, বকুল গাছ, কাঁঠাল গাছ ধুয়ে কি পানি পান করবি? আর সে পানিতে কি পেট ভরবে? বাসায় যে ওয়াসার লাইনের পানি আসে, সেটাই পান কর না। বিল’তো দিতেই হয়। আবার বলে কিনা এই বাড়ীতে ওদের শৈশব কৈশোরের সুবাস উড়ে বেড়ায়। আরে এবার যা হল না তাতে প্রতিটা রুমে নামী কোম্পানীর দামি এসি লাগাতে পারবি। রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে সুবাস নিতে পারবি, যে ব্র্যান্ড চাস সেই ব্র্যান্ডের।

বিকেল পাঁচটায় গ্যাস দেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সাবধানী ড্রাইভার সিলিন্ডার পূর্ণ করে নিতে এলেঙ্গা সি.এন.জি ষ্টেশনের লাইনে দাঁড়ায়। দীর্ঘক্ষণে পায়েলের তলপেট ভারী হয়ে গেছে। ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজেকে ভারমুক্ত করে অনেকক্ষণ ধরে। সুস্থির হয়ে বসে এবার।

ভুঞাপুর বাজারে গিজগিজ করছে লোকজন। সরু রাস্তায় ঠাসাঠাসি যানবাহন আর রাস্তার দু’পাশের ভাসমান দোকানপাটে। সব মিলিয়ে একটা ঘিঞ্জি এলাকা।

ঘন দোকানপাট পেরিয়ে ফাঁকা অবস্থান দেখে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ায়। “রমজান মিষ্টান্ন ভান্ডার” থেকে কিছু দই মিষ্টি কিনে নেয় মামার বাড়িতে যারা আছে তাদের জন্য। দোকান থেকে বেরুবার উপক্রম করতেই চোখে পড়ে স্বচ্ছ প্যাকেটে বাঁধা ময়দা আর চিনির তৈরী গজা। ছোটবেলায় কত খেত মনে হতেই কেনে কিছুটা।

-আপা এই যে বাহাদীপুর রেলষ্টেশন। আপনে যাবার পর এটা হইছে। এলাকার মানুষ যে কি খুশি, কি আর বলবো।

-এ্যাই, থামাও থামাওতো।

গাড়ীটা নিরাপদে সাইড করার পর পায়েল নামে। রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে। কে যেন বলেছিল বাংলাদেশের সব গ্রাম মূলতঃ একই রকম দেখতে। অনেকদিন ও বাংলাদেশকেই দেখার মত করে দেখেনি। নিবিড় গ্রাম দেখা হয়না কতদিন!

সড়কের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে দু’পাশে তাকায়। বহুদূর একই রকম লাগে। কিছুটা ব্যাতিক্রমও চোখে পড়ে। পায়েলের মায়ের নাকি রেললাইন দেখলেই দূরে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করতো।

ও দেশে এসেছে প্রায় তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে একবারও নিবিড় করে মায়ের কথা মনে হয়নি। অথচ ও আশ্রয় নিতে যাচ্ছে মামার বাড়ীতে। আবদ্ধ মনটাকে মুক্ত হাওয়া লাগাতে যাচ্ছে নানার গ্রামে কবর জেয়ারতের উপলক্ষে।

বুকের গভীর অস্পষ্ট একটা ছায়া ভেসে উঠে।

হঠাৎ দূরে চোখ যায় পায়েলের। একটা গাছের ছায়ায় একজন বৃদ্ধা একা একা কথা বলছে। আওয়াজটা কানে আসছে তবে শব্দ অস্পষ্ট। এগিয়ে যায় পায়েল।

-কি গো বড়লুকের ঝি, কি দেখবার আইসুন?

পায়েলের গতি থামিয়ে দেয় বৃদ্ধা। দৌঁড়ে আসে ষ্টেশন লাগোয়া দোকানের কিশোরটি।

-ম্যাডাম, হ্যার কইলাম মাথায় গন্ডোগুল আছে। বেশী কতা কবাইন না য্যান হ্যার লগে।

কিশোরের কথা শেষ হবার আগেই দৌড়ানি দেয় বৃদ্ধা কিশোরটিকে।

-ঐ গুলামের ঘরের গুলাম, ক্যারা কইছে আমার মাথায় গন্ডগুল? তর মাথায় বিজলা কিরা, তর চইদ্দো গুষ্ঠির মাথায় গুয়ের কিরা। তরে তোর মামুয়ে পয়দা করছে।

বলেই হা হা করে হাসতে থাকে।

পায়েল কিংকর্তব্যবিমুঢ় দাঁড়িয়ে থাকে।

-হুনুইন গো মা-সকল, আমার মাথায় কইলাম কুনই গন্ডগুল নাই। অহন কইনচে আপনে এইহানে আইসুন ক্যা। উপুজেলা ভূমি অফিস থে আইসুন?

একটু দম নেয় বৃদ্ধা, মৃদু পায়ে পায়েলের দিকে এগিয়ে আসে।

-র‌্যালপত বানাবাইন, মারকেট বানাবাইন, তাই আমাগো বাপ-দাদার জমি লাগবো?

-রেলপথ, মার্কেট হলে তো তোমাদেরই ভাল। দেশ এগিয়ে যাবে, মানুষের উন্নতি হবে।

-বুঝছি গো বুঝছি, আপনে উপুজেলার হেই বেডি অপিসার। রেজেষটি অপিসের হেই বেডি আপনে। আমার এই বুইড়া আঙ্গুলের ছাপ নিছিলাইন।

-শুনুন, বসুন এখানে। আমার কথা শুনুন।

-কি কবাইন কইন?

-আমি পায়েল, আপনি যাদের কথা বলছেন, আমি তাদের কাউকেই চিনি না। তারাও আমাকে চেনে না।

-হাচা কইতাছুইন তো? কইথথে আইসুন আপনে?

-আমেরিকা থেকে বেড়াতে এসেছি।

বৃদ্ধা তার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে নিরিক্ষণ করতে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে প্রকৃতির শিক্ষা অনেক কার্যকর।

-বসুন, এই আমার কাছে বসুন।

পায়েল আর বৃদ্ধা পাশাপাশি উঁচু ঢিবির উপর বসে। ব্যাগ খুলে ফোন বের করে মজনুকে ফোন দিয়ে খাবারের প্যাকেট আর পানির বোতল দিয়ে যেতে বলে।

খাবারের প্যাকেটটা খুলে বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে দিতেই হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। এবার পানির বোতল খুলে এগিয়ে দেয়।

-রুজা রইছি। আইজ আমার হশুরের মিরিতু দিন। মুন্সি খিলামুনা গো। আমিই রুজা রইছি।

মজনুর হাতে খাবারের প্যাকেট আর পানির বোতল ফিরিয়ে দেয় পায়েল।

বৃদ্ধাকে কারণহীনভাবেই ভাল লাগতে শুরু করে। বৃদ্ধা পায়েলের দিকে তাকায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে অনবরত কথা বলতে থাকে। কোন কথাই বুঝতে পারে না পায়েল। শুধু বাবা শব্দ ছাড়া।

কু ঝিকঝিক, কু ঝিকঝিক শব্দে সাপের মত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে ট্রেন। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে বৃদ্ধা। বড় বড় মাটির ঢেলা তুলে ঢিল দিতে থাকে ট্রেন লক্ষ করে।

-ঐ হারামী টেরেন, আমার হশুরের ভিটা ফিরাইয়া দে। ফিরাইয়া দে, ফিরাইয়া দে.......

ট্রেনটা কাছাকাছি আসতেই বিকট শব্দ লুকিয়ে ফেলে বৃদ্ধার অসহায় আক্রোশের হৃদয় ছেঁড়া শব্দগুলো। দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকে বৃদ্ধা।

-ম্যাডাম হইরা আহুইন। হইরা আহুইন। ক্ষেপছে, পাগলি ক্ষেপছে।

ডাকছে কিশোরটি। লম্বা লম্বা পা ফেলে দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে পায়েল।

-কে এই মহিলা?

কিশোরের বাবা দোকানে বসে আছে। কথা বলে সে-

-পাগলী একহান। এইহানে হ্যার বাড়ী আছিল। জমি আছিল। এ্যাকোয়ারে পড়ছে ব্যাবাক। হেই শুকে মাথা গ্যাছে আউলাইয়া।

-টাকা দেয়নি ওদের?

-দিছে তো, সরকারী রেটে দিছে। হ্যার পোলার ভুঞাপুরে একখান বাড়ী করছে, ভ্যান চালায়, গরু কিনছে। হ্যাগো দিন যায় একভায়। মায়েরেও চালায়।

-তাহলে?

-বুঝলাইন না? ময়া (মায়া) ছুডুকালে বিয়া হইয়া এই বাইত (বাড়ীতে) আইছিল। এইহানেই ব্যাবাকতা। হেই দিন তো এই দিনের নাহাল কডিন আছাল না!

হশুরের ভিটা তো এইডা। হ্যাগো কব্বরও আছিল এইহানে। ট্যাহা দিয়া কি ময়া কিনুন যায়গো।

দোকানী খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বদ্ধ দোকানের ভেতর থেকে।

-বুড়ি মইদ্দে মইদ্দে আহে। হারাদিন গইর পাইড়া কান্দেকাটে, শাপাশাপি করে। হাইঞ্জাকালে ফিরা যায়। কেউ কিছু সাধলেও খায় না।

পায়েল তাকিয়ে থাকে সামনে যেখানে বৃদ্ধ মাটিতে গড়াগড়ি করছে চিৎকার দিতে দিতে।

-আমার হাউড়ির গাছের বাতাস ফিরাইয়া দে, ফিরাইয়া দে। নতুন একটা গাছের নিচে বৃদ্ধা।

পৃথিবীর সব টাকা একত্র করলে কি বৃদ্ধার এই সামান্য চাওয়া পূর্ণ হবে?

ওদের ষোল ডেসিমেলের জমিতে তৈরী হবে মাল্টিষ্টোরিড বিল্ডিং। তিন তলা অবধি মার্কেট, বাকী সাততলা আবাসিক। অত্যাধুনিক জীবন যাপন করবে মিতু আর কাকলি। ওরাও কি এমনি করে কাঁদবে টাইলস্ মেঝেতে গড়াগড়ি করে? একটা বকুল গাছের জন্য?

আহাঃ কত সামান্য চাওয়া! জীবনে সেই চাওয়াটাও কেন পূর্ণ হয় না?!

-ম্যাডাম চলেন, দেরী হইয়া যাইতাছে।

মজনু দাঁড়িয়ে আছে পেছনে।

গাড়ী চলছে দু’পাশের সারিবদ্ধ গাছের ছায়াময় পথের ছায়া ভেঙে ভেঙে। কখনও রোদ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছায়া। আবার কখনও নিরিহ ছায়া চাউর হয়ে বসছে প্রখর রোদের শরীরে।

মিতু আর কাকলির অসহায় অভিমানের সরব মুখটার ভেতরের গভীর বেদনা পায়েলের বোধকে উস্কে দেয়। ওদের চাওয়া কি খুব বেশী? ওরা ওদের স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চায়। এতে পৃথিবীর কার কি ক্ষতি। থাকুক না ওরা ওদের মত। ইমতিয়াজ আহমেদকে জানিয়ে দেবে পায়েল ওর অপারগতার কথা। পরে কোন এক সময় আবার নতুন করে চুক্তি করবে।

আচ্ছা, আপাতত একতলার ছাদে ছোট করে রুম তুলে দিলেও অনেকটাই সমস্যার সমাধান হয়। নিচ তলার ভাড়ার টাকায় কোনমতে দিন পার করতে পারবে।

ইমতিয়াজ আহমেদকে ফোন করবে বলেই ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে। সাথে সাথেই বেজে ওঠে আলমের ফোন নম্বর। পায়েলের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কি করবে এখন............?

গত কয়েকটা দিন ভূমিদস্যু আলমের ফোনের অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে একা একাই। আবার বেজে ওঠে পায়েলের ফোন, কাকলি ডাকছে ওকে।

-হ্যালো

-পায়ের তুই কোথায়? আলম তার লোকজন নিয়ে আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ধমকাচ্ছে। তুই কোথায়? ফোনটা কেটে দেয় পায়েল। এখনও অনেকটা কাজ বাকী।

গাড়ী ছুটছে আলো ছায়ার পথ ভেঙে ভেঙে.............. 

 

রোকেয়া ইসলাম
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top