সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব -১৮) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
২০ মে ২০২১ ২০:০৯

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৯:২৮

 

আমার শশুর বাবার সঙ্গে বাবার খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো ক'দিনেই। আসলে আমার বিয়ের পর এতো কাছাকাছি দুই বেয়াই এর মেলামেশার সুযোগ হয়নিতো!বাবা ও শশুড়বাবা ঠিক যেন ছেলেবেলার বন্ধুর মতো খোলামেলা গল্প, সকাল বিকেল একসঙ্গে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটাহাঁটি,গ্রামের লোকজনদের সাথে ঘুরতে ফিরতে কুশল বিনিময় করে দুজনে বিপুল আনন্দে সময় পাড় করছিলেন।

মুশকিল হলো মা'কে ও দুই ভাবিকে নিয়ে!আমার শাশুড়ি মা কিছুতেই তাদের সাথে খোলামেলা আচরণ করতে পারছিলেন না। কেমন যেন সবসময় ছাড়া ছাড়া ভাব নিয়ে চলছিলেন।

ছোট ভাবী একটু প্রতিবাদী স্বভাবের আগাগোড়াই।

একদিন ভোরবেলা আমাদের সবাইকে নিয়ে শলা পরামর্শ করে একটা তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেললো।

আগে থেকেই কাজের মেয়ে কাজলকে সব বলে রেখেছিলো। সেদিন আমার শাশুড়ি মা ঘুম থেকে একটু দেরি করেছিলেন উঠতে। উঠেই তড়িঘড়ি কোরে ছুটলেন রান্নাঘরে।

কাজলকে ডাকলেন চিৎকার করে।

কোথায় গেলো কাজল।

কোন সাড়াশব্দটি নেই আজ বাড়িতে। কি ব্যাপার কি।

রান্নাঘরে ঢুকেই তো তার মাথা খারাপ অবস্থা।

এই সাত সকালে ভুনা খিচুড়ি ডিম,পরোটা আলুর দম,চা লের আটার চিতই, ছিট্ পিঠা আর শুটকি ভর্তা কি সুন্দর করে রান্না বান্না করে টেবিলে সাজানো।

মৌ মৌ গন্ধে বাড়ি ভরপুর!আমার দুই ভাসুরতো ছুটে এলেন দাঁত ব্রাশ করতে করতে রান্না ঘরের দিকে।

----ওমা, আজ এতো সকালে কি এতো বিরিয়ানী পোলাও রান্না করছো নাকি!আহ গন্ধে যে সাড়া গ্রাম মৌ মৌ করে ফেললে।

-----আমিতো কিছু বুঝতে পারতেছিনা। এই কাজল, কাজলটা গেল কুনখানে।

---- কি হইছে। এইতো এইখানটায় আমি । ব্যাবাক কামতো রেডি। অহন খালি সব্বাই মুখ হাত ধুইয়া খাইবেন গপ গপ কইরা বুঝছেন নি। উহ ম্যালাদিন এমন খাওন হয়না বাড়িত।

----- তুই চুপ করতো। কেডায় এ সবের আয়োজন করলো আমার পারমিশান ছাড়া সেইডা আগে ক কাজল।

-----ক্যা, নিতু ভাবি আর তার দুই ভাবি মিল্যা আমারে যা হুকুম করছে,আমি তাগো আগাইয়া জোগাইয়া দিছি।

------এতো সাহস হ্যাগোরে কেডা দিলো।

চিৎকার চেঁচামেচিতে সকালবেলায় বাড়ি গরম করে ফেললো আমার শাশুড়ি।

হাঁটাহাঁটি শেষ করে আমার শশুর ও বাবা বাড়িতে ঢুকে কথাবার্তা শুনে কিছুটা আচ করে ফেললেন ঘটনাটা।

শশুর বাবা এগিয়ে এসে বললেন, বাহ্ এইসব যুদ্ধ বিদ্রোহের মধ্যে একটু আজ আমরা সবাই মিলে একসাথে সকালটা জমিয়ে তুলবো।

আমার শাশুড়ি রাগে আর শশুর বাবার সাথে কথা না বাড়িয়ে ভেচকি মেরে সরে গেলেন ঘরে।

এ ব্যাপারে সেদিন দেখলাম আমার দুই ভাসুর খুব খুশিই ছিলেন বোধকরি বেশকিছুদিন পর এমন মুখরোচক খাবার পেয়ে।

তারা যখন জানলেন এসব আমাদের কাজ,জোড় সমর্থন দিলেন আমাদের।

শাশুড়ি কারো কাছে কোন পাত্তা না পেয়ে রাগে গজগজ করতে থাকলেন একাই।

একটু অবাক হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমার দুই ভাসুরের খুশি হওয়ার কারণটা পরিষ্কার হয়ে গেলো আমাদের সবার।

 

রান্নার পুরো দায়িত্ব পরে গেলো আমার দুই ভাবীর উপর! শাশুড়ির নজরদারি আর ভাসুরদের নানানপদের রান্নার ফাই ফরমাসে অস্থির হয়ে উঠলো আমার প্রাণ প্রিয় ভাবি দুজন।

আমি কোন সাহায্যই করতে পারিনা তাদের।

আমার তখন বাচ্চা প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসছে।

চারদিকে ভয়াবহ অবস্থা চলছে।

প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে পাক আর্মি টহল দিয়ে যায়!তাদের সাথে আমার দুই ভাসুর হাত মিলিয়ে ফেলেছে। তৈরী হয়েছে রাজাকার,আলবদর আর শান্তিবাহিনী।

আমার বড় ভাসুর শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। আর ছোট ভাসুর রাজাকার এর লিডার এর খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

এসব জানার পর আমার বাবা আর শশুর বাবার সে কি কান্না!আতঙ্কে আমরা তখন দিশেহারা ।

সুমন ও আমার বড় ভাইয়া ও ছোট ভাইয়া মাঝে ভোর রাতে আসতো আমাদের সাথে দেখা করতে। এখন তাও বন্ধ হয়ে গেলো। আর নিরাপদ রইলোনা তাদের এ বাড়িতে আসার।

প্রতিদিন বাড়িতে ঘটা করে খাসি, মুরগি জবাই করে আমার দুই ভাসুর পাক আর্মি ও রাজাকারদের নিয়ে মহচ্ছপ করতে লাগলেন!আর আমার দুই ভাবিকে দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করাতে লাগলেন।

বাড়িতে এইসব শত্রুদের আনাগোনায় আমরা মহিলারা আতংকিত হয়ে পড়লাম। বড় ভাবি ও ছোট ভাবীর মেয়ে দুটি রুম্পা আর শম্পা অল্প বয়সেই বাড়ন্ত হয়ে উঠেছে।

আমার ভাসুরেরা মাঝে মাঝেই ওদের দুজনকে ডাকেন খাবার দাবার আপ্যায়নের জন্য।

আমার বড় ভাসুরের ও দুটি সোমত্ত মেয়ে আছে।

তাদেরকে কখনো ডাকেন না ওদের সামনে।

আমরা সবসময়ই আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকলাম।

এর মধ্যেই আমার প্রসব যন্ত্রনা শুরু হলো।

অবশেষে কন্যা সন্তান এর মা হলাম এই দুর্দিনে।

দুসপ্তাহ পর খুব গোপনে দেখা করতে এলো সুমন। আঁতুড়ঘরে অতটুকুন শিশু বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে সে কি আদর । চুমোয় চুমোয় ভরে দিল তার দুটি গাল।

আর নাম রেখে গেলো জয়িতা।

দিনে দিনে জয়িতা বেড়ে উঠতে থাকলো এক অন্ধকার পৃথিবীতে। ওর বয়স যখন তিন মাস, তখন এক রাতে শেষবারের মতো এসেছিলো সুমন। এরপর সুমন আর কোনদিন আসেনি। অনেক পর জেনেছিলাম, ঐদিন ক্যাম্পে ফিরে যাবার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছিল। বিশ্বাসঘাতকের দল বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে, বস্তায় ভরে আমার সুমনকে যমুনায় নাকি ফেলে দিয়েছিলো।

হাউমাউ করে কাদতে থাকে নিতু।

আকাশ ছেয়ে যায় মেঘে!ঝড় ওঠে নীল পাহাড়ের চূড়ায়!নীলিমা বুকের মধ্যে টেনে নেয় নিতুকে।

----- কাদিসনা বন্ধু! আমরা যে দুঃখের কান্ডারি!সুখ দুঃখ নিয়েও বেঁচে থাকতে হবে আমাদের।

----- দুঃখের কি কোনই শেষ নেই নীলু!

-------নিশ্চই আছে!আমরা তাকে জয় করবো নিতু।

------ আমার পাশে থাকিস বন্ধু!কোন ভাগ্যে তোর দেখা পেয়েছিরে।

------অবশ্যই তোর পাশে থাকবো বন্ধু!নিশ্চই থাকবো।

চলবে

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top