সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নিখোঁজ : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
৩১ মে ২০২১ ২০:১৭

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ২০:৪০

ছবিঃ সায়মা আরজু

 

দূর থেকেই বিলবোর্ড টা দেখা যায়, ষ্টেশনে পৌছানোর অন্তত দশ মিনিট আগে থেকে। যেদিন রাস্তায় জ্যাম থাকে সেদিন আরও একটু বেশী সময় পাওয়া যায় বিলবোর্ডটি দেখার। রবি বিলবোর্ডে তাকিয়ে আছে, যেমন থাকে সে রোজ।দেখতে দেখতে বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনের খুঁটি নাটি সব মুখস্ত হয়ে যায়। খুব বেশীদিন এক একটা ছবি বিলবোর্ডে থাকেনা, মুখ পাল্টায়, কথা পাল্টায়, অনুভূতিও। এই যেমন এখন বেশ কয়েকদিন ধরে নায়িকা পূর্নিমার মশলার বিজ্ঞাপন, কিন্তু কিছুদিন আগেও সেখানে ছিল আরএফ এল এর বালতি,তার আগে আড়ং এর শাড়ী, তার ও আগে চু চু ডায়াপার,নামটা মনে করতেই হাসি পায় রবির। পূ্র্নিমার মুখটায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবির মনে হয় এই বিলবোর্ড টা তার নিজের। কেমন একটা চলে এসেছি টাইপ উত্তেজনা তৈরী হয় এটা দেখা মাত্রই। তা না হলে কই আরও কত বিলবোর্ড রাস্তায় চলাচলের সময় দেখে সে, সেগুলো দেখেতো এমন মনে হয়না। বাস হেল্পার হাঁক দেয়,' এই ষ্টেশন, ষ্টেশন!' রবি ধীরে সুস্থ দরজায় এগুয়,সে জানে এখানে বাসটা দাঁড়াবে কিছুক্ষন, নতুন যাত্রী তুলবে, আর তাছাড়া তারও তাড়া নেই।

বাস থেকে নেমে শীত শীত লাগছে রবির। জানুয়ারি মাস, গায়ের সোয়েটারের ফাঁক গলে হীম গায়ে লেগে যাচ্ছে। গলায় ঝোলানো মাফলারটা দিয়ে কান পেঁচিয়ে, কাঁধের ল্যাপটপের ব্যাগটা জায়গা মত সেট করে হনহন করে হাঁটা দেয়। জোড়ে হাটলে শীত কম লাগে, জানে রবি। রবির গন্তব্য খুব বেশী দূরে নয়।বড় রাস্তা, তারপর সরু গলি, সেই গলি ধরে আগালে আসাদ ভবনের উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের গাঁ ঘেষে দুগর্ন্ধযুক্ত ড্রেন তারই পাশ দিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা ময়লা আবর্জনা অতি সচেতনে পিছে ফেলে, প্রাচীরের উপরের কাঁটা তারের বেড়ার সাথে ঝুলতে থাকা পুরানো ন্যাকড়া, ছেঁড়া পলিথিন, রুটির টুকরা , ব্যবহ্রত স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিচিত্র দৃশ্য দেখতে দেখতে পঞ্চাশ- ষাট গজ আগালেই ডান পাশে ছোট একটা লোহার গেট, লাল রঙের। গলিটার পুরোটাই রবির মুখস্ত, কোথায় খাঁদ খন্দ, কোথায় ম্যানহোলের ঢাকনা একটু উপরে উঠে আছে, কোথায় পলিথিনের প্যাকেট থেকে কাক অনেকটা ময়লা রাস্তায় বের করে রেখেছে... সব।তার পরেও একটা টর্চ রবির হাতে থাকে সবসময়। প্রতিদিনের মত আজও একই পথে হাঁটতে হাঁটতে রবি ভাবছে। তবে আজকের ভাবনাটা হয়তো একটু ভিন্ন। রবি ভাবছে, গলির পরেও তো তস্য সরু গলি থাকে যেখানে কেবল একজন মানুষ কোনোও মতে পার হওয়া যায় তেমন গলির শেষ মাথার ঠিক আগে তার যদি একটা ঘর হত! পুরানো, কালি ঝুলি মাখা। একপাশে ছোট্ট একটা রান্না ঘর, রান্না ঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ, মেয়েলী আওয়াজ। ঘরটার একপাশে একটা বাল্ব জ্বলছে। ঠিক তার নীচে দেয়ালে ঐ যে একটা টিকটিকি এক দৃষ্টিতে বাল্বের সাথে ঝুলে থাকা মাকড়সার জালে আটকে পড়া উলিপোকাদের দেখতে দেখতে চরম অধ্যাবসায়ের পরীক্ষা দিচ্ছে....।

কিন্তু না একটু পরেই সে ঢুকে যাবে তার দু'কামরার বিষন্ন ঘরে। ঘর তবে সংসার নয়। মা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন এটাকে সংসার বলা যেত,কিন্তু মা মারা যাবার পর কেবল এই রাতটুকু পার করার জন্য সে এখানে আসে। এ ঘরে উনুন জ্বলেনা তাও তো প্রায় তিন বৎসর হলো। মা মারা যাবার আগে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিল। সেই যে রান্নার পাট চুকেছে, তারপর থেকে উনুন গুলো বেকার। এতে রবির অসুবিধা হয়না তেমন, দিনের বেলা অফিসে আর রাতে বোনের বাসা থেকে খাবার আসে। ভাবতে ভাবতে রবি গেটের সামনে একটু দাঁড়ায়, এটাও রোজকার নিয়ম, তারপর উপরে উঠে তালা খুলে ঘর ঢোকে। টেবিলের উপর ঢাকনা দেয়া বাটি, তার মানে আপা খাবার দিয়ে গেছে। টেবিলের উপর গ্লাস চাপা দেয়া এক টুকরো কাগজ, রবি তুলে নেয়, আপার চিরকুট। আপা লিখেছে, "তোর সাথে দেখাই হয়না আজকাল,দুপুরে ফোন দিলাম তাও ধরলি না, জরুরী কথা আছে, নীচে একবার আসিস- আপা"।


আপাই রবির একমাত্র কাছের লোক, বন্ধু। রবির কখনও তেমন বন্ধু হয়না। ছোট বেলায় মা আগলে রাখতেন, মিশতে দিতনা তেমন কারো সাথে। তখন তারা মস্ত নানা বাড়ির তিন তলার ডান পাশের ফ্লাটে থাকত। অন্তুদের জানালাটা তাদের বারান্দা বারবর ছিল। অন্তু জানালা দিয়ে যখন তখন ডাক দিত, “এই রবি… আমি অন্তু…তোর বন্ধু অন্তুরে…অন্তু”। তখন ও আসাদ ভবনের প্রাচীর ওঠেনি, মাঝখানের চিকন গলিটাও ছিল অনেকটা প্রশস্ত, নাকি ছোট ছিল বলে সরু গলিটাকেও প্রশস্ত মনে হত? দুবাড়ির ছেলেমেয়েরা একে অন্যের বন্ধু, যেমন রবি আর অন্তু। এখন সেই বাড়ি ও নেই, বন্ধুত্বও। আসাদ ভবন নিজস্ব জৌলুসে আরও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে আর মামারা জমি ডেভেলপারকে দিয়ে দিয়েছে, শুধু বাড়ির পিছনের প্লটটা মামাদের কাছ থেকে রবি কিনে নিয়ে ছোট্ট এই কনসট্রাকশনটা করেছে। বাড়ির সামনের দিকের রাস্তাটা বেশ বড়। মামাদের বিল্ডিং এর সাথে রবির ছোট্ট দোতালা বিল্ডিংটা একই কম্পাউন্ডে , চাইলেই সে সামনের রাস্তা দিয়ে ঢুকতে পারে কিন্তু অফিস ফেরত রবি কখনো সে পথ মাড়ায় না। পিছনের পুরানো দেয়ালের গর্ভ ছেদ করে যে লোহার গেট তার বড় তালাটি খোলার আগে পাশের বকুল আর কদম গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ততঃ মিনিট পাঁচেক।এদিক ওদিক তাকায় কাকে যেন খোঁজে,রোজ খোঁজে, কেউ আসেনা।

সামনের বিল্ডিং এর কাজ শেষে মামারা বলেছেন পিছনের দেয়ালও মেরামত হবে, উঁচু হবে আসাদ ভবনের সমান সমান, ফের তার উপরে কাঁটা তারের বেড়া, যেমন আজীবন বন্ধুত্বের পাশাপাশি একটা সুক্ষ হিংসা কিম্বা প্রতিযোগীতা ছিলো দুই বাড়ির মধ্যে। রবির মনটা কেমন করে, হয়তো একটু বিষন্ন হয়। ভাবে যত বড়, উঁচু দেয়াল উঠুক না কেন তার ঐ লার রঙের গেটটা ওখানে চাই। ঐ গেটটাই একমাত্র ভরসা নইলে আশেপাশের জায়গাসহ বাড়িঘর, মানুষজন পাল্টে গেছে সেই কবে!

রবির মনে পড়ে, ঐ যে গেটের পাশের বকুল গাছটা আর তার পাশের কদম গাছ, কতদিন অন্তুকে সে বকুল ফুল কুড়িয়ে দিয়েছে! তখন বাড়ির কুকুর টাইগার গেটের কাছে বসে থেকে পাহারা দিত। টাইগারও মরে গেল অনেকদিন। এখন কোথা থেকে দুটো কুকুর জুটেছে নিজেরাই রাতে চলে আসে, সারারাত গেট আগলে রাখে, দোতালার জানালা দিয়ে রাতে রবি লক্ষ্য করেছে সেটা। যদিও কুকুর দুটোর জন্য কিছু খাবার আর পানি প্রতিদিন কদমগাছটার পায়ের কাছে রেখে আসে সে, সময় পেলে ওদের সাথে গল্প করে, ছোট বেলার গল্প, অন্তুর গল্প!

আপার চিরকুটটা হাতে নিয়ে রবি বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, কি এমন জরুরী বিষয় হতে পারে, ভাবার চেষ্টা করে। মোবাইলে রাত দশটায় এলর্ম সেট করে, নীচে যেতে হবে আপার সাথে দেখা করতে। কিন্তু কেন যেন অন্তুর কথা আজ বারবার মনে পড়ছে। আচ্ছা আপা যদি বলে অন্তু ফিরে এসেছে! রবি ভাবতে থাকে।

সেবার এইচএসসি পরীক্ষার পর রবিকে মা একরকম জোর করে রাশিয়া পাঠালো ইন্জিনিয়ারিং পড়তে। ওই কয় বছর ছাড়া রবি এই বাড়িতেই আছে। প্রথমে দু' বছর পরে তারপর  প্রতি বছর ছুটিতে এসে অন্তুকে মনে মনে খোঁজ করেছে রবি, পায়নি। অন্তুর মা মারা গিয়েছিলো অনেক ছোট বয়সে। বাবার দ্বিতীয় পক্ষ থাকলেও সেজ চাচীর কাছে থাকতো অন্তু। একদিন চাচীর কাছেই বায়না ধরেছিল উপরে নারকেলের কুঁচি দেয়া আইসক্রিম খাবে। বড় রাস্তার পাশে যে হাইস্কুলটা ওরই গেটে একটা আইসক্রিম ওয়ালা রোজ বিক্রি করত নারকেল কুঁচি দেয়া মালাই আইসক্রিম। সেদিন বাসায় এমন কেউ ছিলনা যে অন্তুকে আইসক্রিম এনে দেয়। চাচীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই যে আইসক্রিম কিনতে অন্তু বের হয়েছিল আর ফেরেনি। তখন বড়রা মানা করতো অচেনা কারো কাছ থেকে কিছু নেবেনা, ওরা ছেলেধরা।অন্তুকে কি ছেলেধরাই ধরে নিয়ে গিয়েছিল, নাকি অন্য কিছু! অন্তুর মনে খুব দুঃখ ছিল, মা নেই বলে, ছোট্ট রবি সেটা ঠিক টের পেত। অন্তু নিখোঁজ হবার পরে এলাকায় মাইকিং হয়েছিল মনে আছে রবির। রবিসহ আশেপাশের বাড়ির বাচ্চারা মাইকের আওয়াজের সাথে গলা মিলিয়ে বলতো, “একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি…. একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি …. অন্তু নামের দশ বছরের একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়াছে…. তার গায়ের রং ফরসা, পরনে ছিল কমলা ছাপার ফ্রক…. যদি কোন সহ্রিদয় ব্যক্তি মেয়েটির খোঁজ পাইয়া থাকেন তাহলে আসাদ ভবনে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা গেল….” । কয়দিন চলল এভাবে তারপর আস্তে আস্তে সবাই একসময় প্রায় ভুলেই গেল অন্তুর কথা। স্হানীয় থানায় অন্তুর নিখোঁজের বিষয়ে একটি ডায়রি  খোলা হয়েছিল তবে মা মরা মেয়ে এ নিয়ে আর খুব বেশি ইনভেস্টিগেশন হোক এই গরজ কারো ছিলনা। তবে মনে হয় মায়ের মুখেই রবি শুনেছে অন্তু বেঁচে আছে, রবি যখন রাশিয়াতে তখন নাকি কে একজন এসে অন্তুকে কোথায় দেখেছে বলে জানিয়েছিল কিন্তু আসাদ ভবনের কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি। তবে অন্তু বেঁচে আছে রবি নিজেও সেটা বিশ্বাস করে।রবির মনে এ নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা, একজন এসে এরকম একটা খবর দিল অথচ সেটা নিয়ে কোনোও রকম খোঁজ খবর হয়নি, থানা পুলিশ হয়নি, এটা কেমন কথা! রবি নিজে অবশ্য স্হানীয় থানায় একবার খোঁজ নিয়ে দেখেছে, না সেখানে এনিয়ে কেউ কোন অভিযোগ করেনি।

অন্তুর ছোট্ট মুখটা এখনও রবির স্পষ্ট মনে আছে। আচ্ছা কত বড় হয়েছে অন্তু এখন? সে কি রবিকে দেখলে এখন চিনতে পারবে? ফোনে এলার্ম বেজে ওঠে, রবির চিন্তার গতি আর বেশীদূর আগাতে পারেনা। তবে রবি মনে মনে চায় অন্তু ফিরে আসুক। জীবন থেকে অনেক হারিয়েছে সে চাইতে আবার না চাইতেও, তবু অন্তত একটা হারানো কিছু ফিরে আসুক তার কাছে! প্রায় প্রতিদিনই রবির মনে হয় আজ হয়তো অন্তু ফিরে আসবে, আর কিছু না চিনুক তাদের বকুল গাছটাতো সে চিনতে পারবে।প্রতিরাতে শোবার আগে নিয়ম করে রবি জানালায় দাঁড়ায়, তার মনে হয় এই বুঝি অন্তু এসে ছোটবেলার মত ডাক দিবে, রবি আছিস, আমি অন্তু, তোর বন্ধুরে, অন্তু!!

সমাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top