সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

অশেষ ত্যাগে পূর্ণ বিজয় : রোকেয়া ইসলাম


প্রকাশিত:
৩ জুন ২০২১ ১৮:২৫

আপডেট:
৪ জুন ২০২১ ০০:২৪

 

সূর্য ওঠার সাথে সাথে উঠে পড়ে ফুলমতি। সাথে সাথে শেফালি লাইলিও। ছেলেরা সারাদিন খেটেখুটে আসে । ওরা ওঠেই গোসল খাওয়া সেরে আবার জীবন জীবিকা সন্ধানে ছুটতে হবে তাই ওরা একটু দেরীতে ঘুম থেকে ওঠে।
এই অবসরে বাসি কাজকর্ম সেরে রান্না গুছিয়ে ভাত বেড়ে ফেলে তিন মায়ে ঝিয়ে।
ওদের কাজ আধা শেষ হয়েছে তখনি ওঠে পড়ে হাফিজ শফি ও রবি।
সরষের তেলের বোতল থেকে হাতের তালুতে তেল নিয়ে তিনভাই মাথায় গায়ে ডলতে ডলতে পুকুর ঘাটে যায়।
এই সময়টুকু ওরা একটু বিনোদনের মতই ব্যাবহার করে। পুকুরময় সাতার কাটে। ঘাটলায় বসে ধুন্দলের খোসায় গা কচলে নেয় আবার ডুবসাতারে গোসল শেষ করে।
পুকুর পাড়ে রাখা লুঙ্গি নিয়ে পড়ে ভেজা লুঙ্গিটা পুকুরের পানিতে কেঁচে উঠোনের দড়িতে শুকোতে দিয়ে ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়াতে যায়। ততোক্ষণে ফুলমতি তিনছেলের জন্য খাবার বেড়ে দেয়।
এটা সারাদিনের মূল খাবার তাই যতটা পারা যায় ততোটাই ঠেসে ঠেসে খায় ওরা।
দুপুরে বাড়ি থেকে নেয়া চিঁড়াগুড় আর ঢকঢক করে গলায় ঢালা পানি দিয়ে সারতে হবে মধ্যাহ্ন ভোজন। আবার রাতে ফিরে তবেই ভাতের দেখা।
ওদের তিনভাইকে খুব অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাই লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি শেফালিকেও লেখাপড়া সুযোগ দিতে পারেনি।ওদের ছোট রেখেই বাবা পরপারে বিদায় নিয়েছে।
শেফালির বিয়ে হয়েছিল সংসার টিকেনি ফিরে এসেছে সংসারের বোঝা হয়ে।
হাফিজের একান্ত ইচ্ছায় লাইলিকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে।
বি এ পড়ছে লাইলি। তিনভাইয়ের আদরের লাইলি লেখাপড়া শিখে ওদের মান সম্মান বাড়াচ্ছে।
হাফিজের আড়তের মালিক মাঝেমাঝেই পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করে যেদিন শুনেছে হাফিজের বোন বি এ পড়ে সেদিন থেকে ওর দিকে সমীহের দৃষ্টিতে তাকায়।
দুর্দান্ত প্রতাপশালী মালিক হাফিজের মত শ্রমিককে গোণায় ধরে সেটা লাইলির লেখাপড়ার জন্য।
খেয়ে বেরিয়ে যায় ফুলমতির ছেলেরা।
এবার দুইমেয়েকে নিয়ে খেতে বসে ফুলমতি।
সংসারের কাজ তো কম নয় তিনজন মিলে হাতে হাতে সেরে ফেলে বলে কিছুটা সুরাহ হয় ফুলমতির।
ওদের খাওয়া শেষ হলে এঁটো ধুয়ে গুছিয়ে সুস্থির নিশ্বাস ফেলে।
লাইলি পড়ার টেবিলে বসে সাথে সাথে ফিরে আসে শফি। একটু পরে সাথে সাথে রবিও।
খবর হলো ঢাকায় আর্মি নেমেছে। বিশ্ব বিদ্যালয় রাজার বাগ পুলিশ লাইন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ। বহু মানুষ মেরে ফেলেছে। শহরে কার্ফু জারী করেছে।
লাইলিকে একটা রেডিও কিনে দিয়েছিল শফি। সেটা নষ্ট। টাকাপয়সার টানাটানিতে আনতে পারছে না মেকারের দোকান থেকে। নইলে সকালেই জানতে পারতো শহরের খবর।
রবি মনে মনে ঠিক করে যেমন করেই হোক কাল মেকারের দোকান থেকে রেডিওটা নিয়ে আসবে।

শফি মালিকের বাসায় দেখা করে এসেছে মালিক অবস্থা বুঝে দোকান খোলার ব্যাবস্থা নেবে।
সারা শহর ভরে গেছে মানুষ আর মানুষ।
আওয়ামী লীগ অফিসে সামনে উপচে পড়ছে নেতা কর্মী। টেলিফোন অফিসের সামনে গিজগিজ করছে মানুষ। নিরালা পুলের উপর মানুষ। ঘ্যাগের দালানের সামনে মানুষ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষ আর মানুষ। কত খবর যে ভাসছে। কথারা হাঁটছে পুরো শহর জুড়ে।
কেউ কেউ দোকান খুলেছে বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। হাফিজ সারা শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে সবার কথা শুনে শুনে বুঝতে চেষ্টা করছে পরিস্থিতি কি হতে পারে।

পাড়ায় বেশিরভাগ ঘরেই থম মারা দমবন্ধ অবস্থা। জটলা আলোচনা খবরের ওড়াওড়ি।
হাফিজ সারা শহরের খবর নিয়ে দুপুরের দিকে মেকারের দোকান থেকে রেডিও সাথে করে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। ওর মন বলেছে এখন রেডিওটা খুব দরকার।
হাফিজরা শ্রমজীবী মানুষ ওদের কাজে যেতে হয় প্রতিদিন। সারাদিন ভয়ে থাকে কখন না জানি কি হয়।
বাড়িতে সারাদিন তিনটে অবলা নারী বাস করে।
লাইলির কলেজ বন্ধ। সারাদিন বাসায়ই থাকে। বই পড়ে খুব। এখন রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর শোনে।

যারা ঢাকায় আঁটকা পড়েছিল। তারা কেউ কেউ ফিরছে। তাদের কাছ থেকেই শোনা যায় কি হয়েছিল সেদিন।
লাইলিদের পাশের বাসার বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ুয়া আনিস পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে।
পাড়া ভেঙে পড়ে সেই বাড়িতে।
লাইলি দৌড় যায় আনিসের বাড়িতে । থৈ থৈ করছে মানুষ।
ভেতরের জানালার কাছে গিয়ে দেখতে পায় মেঝেতে পাটি পেতে শুয়ে আছে বিপদফেরত বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রটি।
পাড়ার মুরুব্বি দুজন তুলা মিয়া ও মীর নূরুল ইসলাম ঘরের ভেতরে ঢুকতেই বাবার কোলে থেকে মাথা তুলে ওঠে বসে। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ছিল আনিস।
আতর্কিত হামলায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছাত্রদের আত্ম চিৎকার আর ঠা ঠা করে গুলির শব্দ। জানালা খুলে লাফ দিয়ে দেয়ালের ওপাশে পড়ে থাকে মরার মত শুয়ে থাকে । গুলির শব্দ আর আত্ম চিৎকার। মাটিতে মুখ গুজে থাকা অনেকের সাথে বেঁচে থাকার অনুভূতি হতেই মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে সমস্ত শহরে আগুন জ্বলে উঠেছে। আকাশ স্পর্শ করা আগুনের লেলিহান শিখা যেন বারবার ছিটকে এসে ওদেরও ছুঁয়ে যায়। মুহূর্মুহু গুলির শব্দ কানে এসে লেগে আত্মায় গেঁথে যায়।
বুঝতে পারছিল ওদের প্রাণের বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপর দানব আক্রমণ করেছে।
পরদিন হলে প্রবেশের পথে সঙ্গীন উঁচিয়ে আর্মি দেখে আর গেট দিয়ে ভেতরে না ঢুকে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে যা দেখে তাতে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে তিনজন প্রিয় প্রাণবন্ত বন্ধু পড়ে আছে প্রাণহীন।
একটু এগুতেই লাস আর লাস। রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। রুমে ঢুকে দেখে ওলট পালট হয়ে আছে সব।
আস্তে আস্তে জানালার পাশে গিয়ে দেয়ালে সেঁটে দাঁড়িয়ে দেখে মাঠে কুকুর শেয়াল আর কাকের হাট বসেছে। মৃতদেহ টানাটানি করছে। ট্রাক এসেছে মৃতদেহ সরিয়ে ফেলার জন্য। আবার লাফ দিয়ে দেয়ালের পাশে মরার মত বেঁচে থাকাদের পাশে পড়ে থাকে একদিন।
শুনতে পায় কার্ফু ওঠে গেছে। প্রাণহীনের মত দলের সাথে গন্তব্যহীন হাঁটতে থাকে।
বাড়ির আড়ালে আবডালে হাঁটতে হাঁটতে শহর ছেড়ে বের হয়ে অনেকটা পথ দৌড়ে এসে শত্রুমুক্ত হয়ে জিরিয়ে জিরিয়ে হেঁটে তিনদিনে ফিরলো মায়ের কোলে।
লাইলি যেন ওর চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছে হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আত্যাচার নিপিড়ন।
ওদের শহরও আস্তে আস্তে খালি হচ্ছে।
লাইলিদের এই বাড়ি ছাড়া আর কোথাও পা রাখার জায়গা নেই।
কোথায় যাবে ওরা। কে খাওয়াবে ওদের ছয়জনপূর্ণ বয়স্ক মানুষকে। এই বিপদে কে আশ্রয় দেবে ওদের।
ছেলেদের সাথে রাতে এই আলোচনাইতে ভোর হয় সুরাহা হয় না সমস্যার ।
লাইলিই পরামর্শ দেয় পাড়ার মুরুব্বি মীর নূরুল ইসলামের মেয়ে জ্যোৎস্নার কাছে যাবার।
জ্যোৎস্নার কাছে ওর বাবার অনেক পরোপকারের কথা শুনেছে। খুব ভালো মানুষ। মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে সবসময়।
বিকেলে ফুলমতি মীর নূরুল ইসলামের সাথে কথা বলে আসে। তিনি নিজেও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। তবুও রাজী হন ফুলমতির কন্যাদের আশ্রয় দিতে।
প্রতিদিন রাতে ফুলমতি লাইলি আর শেফালিকে নিয়ে মীর নূরুল ইসলামের বাসায় রাত্রি যাপন করে ফজরের আজানের সাথে সাথে চলে যায়।
এক দুপুরে লাইলি দেখে চক পাথালি জ্বলছে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও আবদুল কাদের সিদ্দিকী বসত বাড়ি।
একটু পরে দৌড়ে বাড়ি ফেরে রবি। সে জানায় পুরো শহর জ্বলছে। মূহুর্তেই সবাই ঘরে ফিরে আসে। শফিও ফিরে আসে। শুধু হাফিজ ফেরে না। দিন যায় রাত যায় হাফিজ ফেরে না।
পরদিন সকালে জ্যোৎস্নাদের সাথে লাইলি আর শেফালির ওদের গ্রামের বাড়িতে যায়।
ফুলমতি শফি আর রবিকে নিয়ে হাফিজের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে।
প্রতিদিন কমতে থাকে শহরের মানুষের সংখ্যা।
এটা যেন একটা অর্ধমৃত নগরী। মানুস হাসতে ভুলে গেছে। দম দেয়া পুতুলের মত কিছুক্ষণ নড়েচড়ে তারপর বন্ধ হয়ে যায়।
লাইলি শেফালি গ্রামে এসেও দেখতে পায় সড়ক দিয়ে শহর থেকে স্রোতর মত মানুষ আসছে আর আসছে।
তাদের কারো কারো কাছে শুনছে ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনি।
পুত্র স্বামী পিতাকে চোখের সামনে হত্যার বেদনার সাথে ঘর বাড়ি ফেলে নিঃস্ব হয়ে ফিরে এসেছে গ্রামে।
মীর নূরুল ইসলাম প্রতি সপ্তাহে গ্রামে আসে।
তার কাছে জানতে পারে হাফিজ এখনও ফিরে আসে নাই।
শফি প্রতিদিন কাজের অবসরে শহরে হেঁটে হেঁটে ভাইকে খুঁজে বেড়ায় । ফুলমতি মরার মত রাতে পড়ে থাকে জ্যোৎস্নাদের বারান্দায় । সারাদিন রাস্তার পাশে গাছ তলায় বসে কাঁদে, রবিও যেন কোথায় চলে গেছে । সে কথা গোপনে রেখেছে।
শফি মাকে কোনমতে সামলে রাখছে।
গ্রামের পথে একদিন মানুসজনের খুব দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়।
ওরা বাইর বাড়িতে দাঁড়িয়ে দেখে। গয়হাটা সহবতপুর মাইলজানির আকাশ ধোয়ায় আচ্ছন্ন। লাল লাল ধোয়া ওঠছে। মানুষের আহাজারিতে বাতাসও কাঁদে।
যাদের আত্মীয় স্বজন ঔ গ্রামে আছে তারা দুঃচিন্তাগ্রস্থ হয়ে মাটিতে বসে বসে আল্লাহকে ডাকতে থাকে।
নাগরপুরে ক্যাম্প বসে আর্মীদের। নতুন দুঃচিন্তা সুখের বাসা বাঁধে ওদের প্রত্যেকের মনে।
জ্যোৎস্নাদের পরিবারে আরেক উপদ্রব সেটা হলো জ্যোৎস্নার বাবা প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। শহরের চেনা জানা প্রচুর ্লোকজন তাকে মান্নিজ্ঞন্নি করে।
তিনি কাজ করছেন টাংগাইলের সার্কিট হাউজের বাউন্ডারি দেয়ালের। প্রতিদিন কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য যেতে হয়। অবশ্য তার উদ্দেশ্য অন্য।
লেবাররা কাজ করতে চাচ্ছে না আতঙ্কে।
সার্কিট হাউজের ভেতর থেকে আত্যচার সহ্য করতে না পেরে মানুসের আত্ম চিৎকারে গাছের পাতাগুলোও নিরবে ঝরে পড়ে। ডালে বসা পাখিগুলো উড়ে যায়। আর ওরা তো মানুষ।
এখানেই শেষ নয়, প্রতিদিনই পানির ট্যাংকির নিচে নতুন মাটি ফেলা দেখে অজানা আতংকে কেঁপে ওঠে ওদের বুক।
সবমিলিয়ে মীর নূরুল ইসলাম রাতে একা বাসায় থাকতে সাহস পাচ্ছেন না। চারদিক থেকে মৃত্যু সংবাদও সহ্য করতে পারছেন না তিনি আর এখন গ্রামেও আর্মীর আত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনিয়নে ইউনিয়নে শান্তি বাহিনী গঠিত হচ্ছে। কখন কে কোথা দিয়ে নাম ঢুকিয়ে দেয়।
আবার শহরে ফিরিয়ে আনে ওদের।
ঘোড়ার গাড়ির চারদিকে কাপড়ের ঘেরা দিয়ে ওরা ফিরলো মৃত শহরের বাড়িতে।
লাইলি শেফালি মাকে জড়িয়ে অনেক কাঁদে। সত্যি একেবারে ঝরে পড়া ফুলের মত নেতিয়ে গেছে ফুলমতি।
কয়েকদিনের মধ্যে রবি একরাতে দেখা করতে আসে জ্যোৎস্নাদের বাসায়। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র লুকিয়ে রাখে। বেশিরভাগ দিন রান্না করা খাবার খেয়ে নিরবে ঘুমিয়ে যেত। জ্যোৎস্নার বাবার কাছে থেকেশহরের খবর। আর্মিদের গতিবিধির খবর নিয়ে যেত।
ফুলমতির দুঃচিন্তা বেড়ে গেল রবির জন্য। হাফিজও একদিন অস্ত্র হাতে ফিরবে এ আশাটাও জোর পেল।
লাইলি শেফালি রাতে আগের মতই জ্যোৎস্নাদের বাসায় গভীর রাতে ঘুমাতে আসে আর ফজরের আজানের সাথে সাথে ওঠে ওদের বাসায় যায়। ফুলমতি শফিকে নিয়ে নিজের ঘরেই ঘুমায়।
ওদের পাড়ার বেশিরভাগ যুবক মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এ পাড়ার দিকে রাজাকারদের নজর বেশি। পাড়ায় কয়েকজন রাজাকার বাহিনীর সদস্য। শান্তি বাহিনী গঠিত হয়েছে।
সেদিন লাইলিরা মাত্র বাড়ি থেকে বের হয়েছে এমন সময় রাজাকার নাইম এসে উঠোনে দাঁড়ায়।
- ও চাচী ঘরে আছো না অন্য বাড়িতে গেছো ঘুমাইতে। চাচী ও চাচী।
ধড়ফড় করে ওঠে বসে ফুলমতি। দরজা খুলে বাইরে বেরুতেই শফি ঘরে ফেরে।
মনে কুডাক দিতে থাকে। দুই ছেলের চিন্তায় এমনিতেই মনখারাপ থাকে সবসময়। নিজের প্রতি অবহেলায় শরীর ভেঙে গেছে।দুটো মেয়ে নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছে । দেশের পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন জনগণের মত। সবমিলিয়ে ফুলমতি খুবই ভঙ্গুর। এসময়ে যমদূতের মতো নাইম!
- না বাবা ঘরেই আছি। তা কি কইতে এতো রাইতে আইলা।
-বইতে তো দিবেন নাইলে আপনের ভাল-মন্দ জানুম কেমনে।
- কি আর ভাল-মন্দ। দ্যাশের যে অবস্থা।
-দ্যাশের আবার কি হইলো কিছুই হয় নাই। দ্যাশ খুব ভাল চলতাছে। আগে চাইয়াও ভাল। খালি কয়ডা শয়তানের বাচ্চা ফালাফালি করতাছে। মিছা বুঝলা চাচি মিছা। কিছু হইব কিছু পারব শয়তানের বাচ্চারা?
দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলছে এখনও ফুলমতি ওকে বসার জন্য কিছু দেয়নি।
ও সরকার পক্ষের মানুষ ওরে অপমান করতেছে। বিষয়টা ভাল লাগলো না নাইমের।
-চাচী খাড়া করাইয়া রাখবেন না বসতে দিবেন। ভালমন্দের খোঁজ খবর লই।
ফুলমতি চাচ্ছে না এই হাড় বজ্জাতটা ওর উঠোনে বসুক। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বের করার তালে এসেছে এটুকু বুঝতে পারছে। অনিচ্ছায় একটা টুল এনে দিল।
- চাচী হাফিজ ভাইর কুনু খবর পাইলেন?
শেয়ালের চোখে তাকিয়ে থাকে।
-নাগো বাবা পাই নাই। কোনে গেল আমার পুলা কেউ কইবার পারে না রে বাবা কেউ কইবার পারে না।
-চাচী হাফিজ ভাইয়ের নগে কি আগে থিকা কাদের সিদ্দিকী গো খাতির আছিল।
- নাগো বাবা। আমরা গরীব মানুষ আমার পুলারা হারাদিন মাইনসের দুকানে কাম করে। রাইতে আইসা নাইয়া ধুইয়া খাইয়া শুইয়া থাকে। কারো নগেই আমাগো হেরহম খাতিরও নাই কাইজ্জা বিবাদও নাই।
- তাইলে তো রবির নগেও কেরুর খাতির আছিল না তাই না চাচী।
- হগো বাবা আমার পুলাগো এই বাড়িডা ছাড়া আর কিছুই নাই। পিন্ডা খাটাইয়া কামাই করতে হয় হেগো কেউ নগে খাতির করলে কি চলে? আর গরীবের নগে ক্যারা খাতির করে কও দেহি।
- হ চাচি ঠিক কথাই তো কইলেন। তা শফি কামে থে আইলো রবি কো।
- আইব তার মালিক যহন ছাড়বো।
-চাচি বাড়ি এহেবার খালি খালি লাগতাছে।
- আমার হাফিজ নাই রে বাবা। আমার হাফিজ নাই দেইখ্যা বাড়িডা এহেবারে খালিরে। আমার হাফিজরে খুইজ্জা আইনা দেও। ও বাবা আমার হাফিজরে খুইজ্জা আইন্যা দেও।
বলে চিৎকার শুরু করে ফুলমতি।
-ও চাচী থামেন থামেন। ও চাচী চাচী।
শফি ততোক্ষণে পুকুর থেকে গোসল সেরে উঠোনের দড়িতে লুঙ্গি শুকোতে দিয়ে মায়ের কাছে এসে মাটিতে বসে। ফুলমতি আঁছাড়ি পিছারি করে কাঁদতে থাকে।
- লাইলি ও শেফালি বাইরে আসো বইন তুমার মায়েরে ঘরে লইয়া যাও।
শেয়ালের মত করে মুরগীর গন্ধ শুঁকে খোয়াড়ের ভেতর মাথা ঢুকাতে চায়।
- নাইম ভাই আপনে যান ওরা ভেতরেই আছে। মায়ের কাছে আইব নে। যান আপনে।
নাইম ওঠে চলে যায়। শফি পাটশোলায় ঝাপ দিয়ে আউলি বেড়া আঁটকিয়ে দেয়।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে নাইম। লাইলি আর শেফালি যে বাড়িতে নেই এটা ভাল করেই জানে। কিন্তু কোন বাড়িতে গিয়ে রাতে থাকে এটা ধরতে পারতেছে না।
হাড় বজ্জাত মেয়ে দুটো বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে বাঁকা রাস্তা ধরে দুই তিন বাড়ির ভেতর দিয়ে আবার রাস্তায় ওঠে তারপর আবার বাঁকা পথ। তারপর শূণ্য ভিটা পার হয়ে হাওয়া। শূণ্যভিটার পরের বাড়ি মুসলিম লীগের এক পাতিনেতার বাড়ি। সে বাড়িতে কি ওরা থাকে রাতের বেলা।
তাহলে তো মেজর সাহেবের কাছে খবরটা পৌছাতে হয় যে মুক্তির দুই বোনরে নিরাপদে আশ্রয় দিছে নেতা।
দেখা যাবে তখন নেতার জিন্না টুপি পড়ে ধোলাই পাজামা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে মেজর সাহেবের সাথে খাতির কাকে বলে।
নাকি আগে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডারের কাছে খবরটা দেবে।
দোনোমনো করতে থাকে নাইম।
মেজর না কমান্ডার কমান্ডার না মেজর।
ভাবতে ভাবতেই হাফিজের বিষয়টা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
কোথায় যেতে পারে হাফিজ।
হাফিজের মত আলাভোলা মানুষ মুক্তি বাহিনীতে যেতে পারে না।
সে তো যেদিন মিলিটারি টাংগাইলে এলো সেদিন থেকেই হাওয়া। কোথায় হাওয়া হলো? কোথায়? ?
আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে আগুন জ্বললো বাজারে আগুন জ্বললো। সে কি বাজারের আগুন জ্বলেপুড়ে ছাই হলো না।
ওর আড়তের মালিক আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা পয়সা দিতো। রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের ভাষন শোনার জন্য টাংগাইল থেকে বাস ভরে ট্রাক ভরে নেতা কর্মী সাধারণ মানুষ গেল। হাফিজের আড়তের মালিক একাই দুটো ট্রাক ভাড়া করে দিয়েছিল। মিলিটারি এসে প্রথমদিনই ঐ আড়তে আগুন লাগায়। তাতেও পুড়ে ছাই হতে পারে। মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হলো না তো। নাকি মিলিটারির এলোপাতাড়ি গুলিতে মরলো। সব লাস অবশ্য ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে মিলিটারি।
যেভাবেই মারা যাক লাস আর পাওয়া যাচ্ছে না।
নাইমের হঠাৎ খেয়াল সে যে একাএকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আজাদ বাহিনীর কোন বিচ্ছু হারামজাদা যদি দেখে ফেলে খবর আছে নাইমের। বাকু সালাউদ্দিন জাহাঙ্গীর আবুল কালাম আজাদ ওর সারা শহরে এতো সুক্ষ জাল ফেলে রেখেছে যে প্রত্যেকটা পা ফেলতে হয় সাবধানে।" ঐ বেজন্মার জাত তোরা দ্যাশ স্বাধীন করবি কেমনে ক। তগো না আছে যুদ্ধের বিদ্যা জানা না আছে অস্ত্র। খালি মিলিটারি তো অস্ত্র দিয়া আর কতদূর যাবি। আরে শালা তোরা যুদ্ধের কায়দার নাম দিছোস গেরিলা যুদ্ধ। কর দেখি কত গেরিলা যুদ্ধ করবি কর "

নাইমরা সারাদিন কি কি করে সব খবর কেমনে জানি সব খবর কেমনে জানি বাকু সালাউদ্দিন জাহাঙ্গীর বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায় । অথচ এই গেরিলা বাহিনী প্রত্যেক দিন যে অপরেশন করে আগে থেকে কিচ্ছু বুঝতে পারে না ওরা।
কাদেরিয়া বাহিনীর গাব্বুইরা মাইরের কথা স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচার করে অথচ ওদের পাশে আধুনিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়াও ঠেকাতে পারলো না।
পারবে কেমন করে" শালার মুক্তি গো জানের ডর নাই শালারা স্বাধীনতা চায়"।
আরে গাদ্দার স্বাধীনতা কি মুখের কথা।
ওদের নেতা টিক্কা খান ঠিক নামেই ডাকে ওদের। গাদ্দার। শালারা বেজাত বিচ্ছু।
ভাবতে ভাবতে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়।
লাইলিদের কেমনে পায়?
মেজর সাবের লগে কথা কওনের সখ নাইমের কতদিনের। কেমনে কইব ও না জানে ইংরেজি না জানে উর্দু।
ধুর শালা বাংলা একটা ভাষা হইলো। বাংলা ভাষাকে কেমন জানি ছাই ছাই লাগলো। এই ভাষায় জানে বলে মেজর সাহেবের সাথে কথা বলতে পারছে না। কি লজ্জা! কি ল্জ্জা!!
হঠাৎ মনে হয় সন্ধ্যার সময় কমান্ডারে সাথে নিয়ে পাক বাহিনীকে নিয়ে আসতে হবে কাল। লাইলিরা সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হয়।
পরদিন মাগরেবের নামাজ শেষ করে উঠোনে নামতেই আউলি বেড়ার কাছে নাইম ভেতরে ঢুকে।
- আসেন আসেন
বলতে বলতে ফুলমতিকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে সাথে খাকি পোশাক পরা কয়েকজন।
- চাচি তুমার পুলা রবি কই হেইডা জানতে উনারা আইছেন। অহন কইয়া ফালাও।
- তুমহারা বেডা রবি মুক্তি হ্যায়।
- রবির কতা জানি না বাবা মুক্তি কি? ।
- মেরা জানি হি ইজ মুক্তি। দেশকা দুশমন হ্যায়।
- না বাবা আমরা কেরুর দুশমন না। আমরা গরীব। আমার পুলারা খাইট্যা খায়
- লাইলি ও লাইলি বৈনে বাইর হও দেখি।
বলতে বলতে ঘরে ঢুকে টেনে হিচড়ে বের করে আনে লাইলিকে।
- ও বাবা ওতো ঘরে আছে ও মুক্তি না দুশমন না। ও বাবা ওবাবা ওরে ছাইড়া দ্যাও।
লাইলিকে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় নাইম আর সাথে আসা মিলিটারিরা।
বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকে ফুলমতি। তড়িঘড়ি ঘর থেকে বের হয় শেফালি। ও মাচায় ওঠেছিল বলে ওকে দেখতে পায়নি নাইম।
মাকে জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে উঠোনে আসে শফি।
ও বাসার সামনে মিলিটারির গাড়ি দেখে গাছের আড়ালে ছিল ওরা চলে যেতেই সুযোগ বুঝে বাসায় ঢুকেছে।
মাকে নিয়ে ঘরে ঢোকে দুভাইবোন। হাপুস নয়নে কাঁদছে শেফালি। শফি চোখ মুছতে থাকে।
বাড়িতে একমাত্র পুরুষ নিজে। দুটো ভাই হারিয়ে গেছে দেশের তান্ডবে। এখন বোনও গেল। ভাই হারানোর বেদনায় চিৎকার করে কাঁদতে পারতো। দেশের অবস্থা নিয়ে কথা বলতে পারতো দশজনের সাথে কিন্তু লাইলিকে তুলে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা এটা কিভাবে বলবে?
এটা যে বড় লজ্জার কথা অপমানের কথা। শফি জানে ওদের পাড়ার কয়েকজন যুবতীমেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। কেউ কোন কথা বলছে না খালি চুপিচুপি বুক চাপড়ে কাঁদে।
- মা শেফালী শোন আজ থেকে লাইলির কথা কাউকে কইও না। জোরে কাইন্দ না মাইনসে শুনলে ইজ্জত যাইব। মিয়াভাই আর রবির কথা কইয়া যত জোরে পার কাইন্দো। লাইলির কথা কেউ কইলে কইয়ো সে বেড়াইতে গেছে নইলে কইয়ো বিয়া হইয়া গেছে।
কথা শেষ করতে পারে না শফি নিজেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে।
রাত পোহাবার আগে ফুলমতি যায় জ্যোৎস্নাদের বাড়ি। জ্যোৎস্নার মায়ের হাত ধরে কাঁদে। যেমন করেই হোক লাইলিকে ছাড়িয়ে আনুক।
এটা অসম্ভব! কোনভাবেই সম্ভব নয়।
মীর নূরুল ইসলাম দিনের পর দিন দেখছে কি নির্মম যন্ত্রণা নিয়ে মেয়েগুলো দিন কাটাছে। ছেলেগুলো চিৎকার করছে বেয়েনটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ওদের দেহ। ভয়াবহ নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে পানির ট্যাংকির তলায় পুতে রাখছে লাস। স্বাধীনতার আশায় ওরা মরছে। আর এই মেয়েগুলো না পারছে মরতে না পারছে বাঁচতে।
লাইলি অনেকগুলো মেয়ের সাথে একঘরে থাকে সারাদিন। আর রাতে আট থেকে দশজন ওকে নিয়ে যায় জীবন আর মরনের মাঝামাঝি। এতো নোংরা আয়োজন থাকতে পারে যুদ্ধে। নারীর দেহে এতে নৃশংস অত্যাচার হতে পারে। ওর যোনিপথে যেদিন ঋতুস্রাবের নহর বইতো সেদিন ওকে উলঙ্গ করে নিতম্বে হাতের রুলারের ব্যাবহার করতো। পিটিয়ে পিটিয়ে লাল দাগ করে উল্লাসে ফেটে পড়তো জানোয়ারগুলো।
ওদের এক সহযাত্রীর নাম বেনু। তার মাত্র তিনমাস বয়সের শিশুকে ছুঁড়ে ফেলে তুলে এনেছে।
সারাদিন কাঁদতো। স্তনদুটো টইটম্বুর হয়ে যেত স্বর্গীয় সূধায়। অশেষ যন্ত্রণায় আর সন্তান স্নেহে ককিয়ে ককিয়ে কাঁদতো।
আহা তার আবুদা না জানি ক্ষিদায় কত কষ্ট করতাছে। আর তার স্তন থেকে ফিনকি দিয়ে দুধ বের হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।
হাতের তালুতে মাতৃদুগ্ধ নিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদে।
স্তন ভরে ওঠে মাতৃদুগ্ধে। প্রচন্ড ব্যাথায় জ্বর ওঠে শরীরে বেয়ে।
তিনচারদিন জ্বরে ভুগে ভুগে শরীরের স্বর্গীয় সূধা শরীরে শুকিয়ে খুবই দুর্বল শরীরে রাতের আঁধারে পরনের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।
এরপর থেকে ওদের পরনের শাড়িগুলো খুলে নিয়ে নেয়। ওড়না পরতে দেয়া হয় না।
পলা নামের একজনের একটা স্তন কেঁটে নেয় উল্লাসে।
সারারাত সে রক্তাক্ত বেদনায় চিৎকার করে।
লাইলি নিজের যন্ত্রণা ভুলে ওর কাছে বসে থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়।
-লাইলি আমার চৌদ্দগুষ্ঠি তো এই হারামজাদা গো চিনে নাই ওগো সাথে তো আমাদের কোন শত্রুর ছিল না। আমরা তে কোন দল করি না মিছিলে যাই নাই মিটিং যাই নাই। তাহলে আমাদের সাথে এমন করতেছে কেন বল না লাইলি। বল বল।
বলে খামচে ধরে লাইলির বুকের কাছের কামিজ।
লাইলি কি বলবে ওতো নিজেও জানে না এর জবাব।
ওরা তো খুব গরীব। ওদের বাড়িতে একটা ছোট রেডিও ছাড়া আর কোন দামী জিনিস ছিল না।
রেডিওটাতে এখন শফি ভাই স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনছে কি না কে জানে?
"মাগো সেই ময়না পাখির খাচাটা কেন যে আনলে না"
এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র। অথবা খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়।
কোনটা শুনছে শফি ভাই শেফালি আপা।

হাফিজ ভাইয়ের কোন খোঁজ কি পেলো!! রবি ভাই যুদ্ধে গেছে!!
ওরা তো নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল। ন্যায অধিকার নিয়ে লড়ছিল বাঙালি। লাইলি জানে সব বুঝে সব। এটা কি ওর দোষ ?
স্বাধিকার আন্দোলন ছয় দফা।
মিছিল শ্লোগান
তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি।
তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।
সবকিছু মিশে গিয়েছিল আত্মায় মগজে মননে।
তার জন্য এভাবে মূল্য দিতে হচ্ছে ওকে!
হাফিজ ভাই তো সকালে আড়তে চলে যেত ফিরতো রাতে। সে তো এতোকিছু বুঝতো না। তাহলে সে কেন হারিয়ে গেল।!!

এখন কেন প্রতিদিন ও মরছে কেন মরছে।
হাফিজ ভাইয়ের খুব ইচ্ছে ছিল ও লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকরি করবে।
আহা হাফিজ ভাই!!
সেদিন দুপুরে জানালার কপাট একটু খুলে দেখছিল। বাইরের পৃথিবী কতদিন দেখেনা ওরা। শুধু ওদের সীমানার মধ্যেই হাঁটাচলা করে। নাকি দেখাতে চায় না বাইরের পৃথিবীকে! কেমন আছে ওরা?
এ নরক দেখুক বাইরের পৃথিবী এটা ওরা কেউই চায় না। ওরা শুধু প্রতিদিন একটু একটু করে না মরে একেবারে মরে যেতে চায়। হায় জীবন!!
জানালাটা পুরোপুরি খুলে দেয়। এটা এখানকার নিয়ম না। নিয়ম ভাঙার জেদ তাড়িয়ে ওঠে বুকের ভেতর।
হঠাৎ দেখতে পায় মনু ঘোষকে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে দুজন সৈনিক। দ্রুত হাতে জানালা আঁটকে দিয়ে বুক ধরে বসে পড়ে।
কতটুকুই বা বয়স হবে মনুর। দশ কি বার বছর এরচেয়ে বেশি নয়।।
ও আন্দোলনে কি বোঝে? ও যুদ্ধের কি বোঝে!! ও বিন্দু বাসিনী সরকারি বালক বিদ্যালয়ে ফাইভে পড়ে। বিকালে মাঠে খেলে ছুটির দিনে ঘুড্ডি ওড়ানোর সূতোয় মান্জা দেয়। রাতে মায়ের কোল ঘেষে ঘুমায়। এই তো ওর জীবন।
রাতে মনুর আত্মা ছাড়া চিৎকার শুনতে পায়। মনুর চিৎকারে বুঝতে পারে কি অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে কিশোরটির উপর।
লাইলি ছটফট করে ওঠে। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। ভেতরটা নিস্ফল কান্নায় ভেঙে যাচ্ছে।
দূর থেকে ওকে দেখে এক হানাদার সৈনিক খুশিতে ছুটে আসে।
- খুবসুরাত জানানা আজ বহুত খুশ কিয়ে। তুমকো দিল মে আজ মেরা তাসবি দেখতা হায়।
তাকিয়ে থাকে লাইলি শয়তানটার দিকে। কুৎসিত হাসিতে ওর দিকে তাকিয়ে নানারকম বিশ্রি ইঙ্গিত করে হানাদার।
ওকে টেনে নিয়ে যায় ঘরের ভেতর। নোংরা হাতে প্রতিদিনের মত ওকে খুলতে থাকে। ঠিক তখনি মনুর আত্ম চিৎকারে অস্থির হয়ে পড়ে লাইলি

লাইলিকে আজ আটজন ছিঁড়েখুঁড়ে পৌরুষ প্রমাণ করেছে। পাশের ঘরে তেমনি সংখ্যক জানোয়ার মনুর উপর প্রয়োগ করেছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নিষ্ঠুরতা।

দুটো পায়ের ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে বারবার। পেট ব্যাথায় উপুর হয়ে শুয়েছিল। প্রচন্ড নিম্নচাপের বেগে লাইলি বাথরুমে যায়।
ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখতে পায় কিশোর মনু ঘোষকে দুজন হানাদার টেনে নিয়ে যাচ্ছে পানির ট্যাংকির কাছে।
ওকে ফেলে চলে যায়।
লাইলি ভেন্টিলেটর ভেঙে বাইরে আসে। মনু ঘোষের কাছে গিয়ে বসে পড়ে।
অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে ছেলেটিকে। ডান ঠোঁটের কোণ দিয়ে এখনও রক্ত বের হচ্ছে। কালশিটে পড়া মুখটা চেনার উপায় নেই। সমস্ত শরীর ফেটে গেছে রুলারের আঘাতে। হাতপায়ের নখগুলো উপড়ানে।
দেখলে বোঝা যাচ্ছে দুটোদিন কি অমানুষিক অমানবিক বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে ছোট মনুর উপর।
কেউ একজন দেখে ফেলে লাইলি। সাথে সাথে হুইসেল বাজিয়ে সতর্ক করে সবাইকে।
যমদূতের মত তিনজন সেনা হাজির হয়। লাইলিকে ঘিরে ফেলে।
উর্ধতন সেনা কর্মকর্তার হীম শীতল কন্ঠের সুতীক্ষ্ম প্রশ্নে ফালাফালা করে লাইলিকে।
মনু ঘোষের পরিবার কেউ রাজনীতির সাথে জড়িত কিনা? ওরা কেউ মুক্তি বাহিনীর সদস্য কিনা? ওদের কতদিন থেকে চেনে লাইলি?
লাইলির উত্তরে সন্তোষ্ট হতে পারে না সেনা কর্মকর্তা।
লাইলির স্তনদুটো কেটে নেয়।
অসহ্য বেদনায় গা ভরে যায় জ্বরে।
দুদিন পরে ঘায়ে পচন ধরে। পঁচা গন্ধ ছড়ায়। গন্ধে বমি করে লাইলি বারবার।
লাইলির সন্ধান যে রাজাকার দিয়েছে সে জানতে পারে ওর বর্তমান অবস্থা।
নাইম এসে একজনকে বুদ্ধি দেয় লাইলির পেটে রয়েছে পবিত্র পাক বাহিনীর সন্তান। এ সন্তান পৃথিবীতে আসা প্রয়োজন। তাই লাইলির বেঁচে না থাকলে সন্তান পৃথিবীতে আসবে কিভাবে।
লাইলিকে টাংগাইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হলো।
প্রায় পনরদিন ছোট্ট একটা রুমে শুয়ে থাকে।দুবেলা ডাক্তার আসে । নার্স ড্রসিং করে দিয়ে যায়। দরজার সামনে বন্দুক নিয়ে বসে থাকে দুবেলা দুজন।
বিকেলে নার্স এসে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে।
- আজ ব্যান্ডেজ লাগবে না। দুবেলা এই মলম লাগালেই হবে।
লাইলি ভাবলেষহীন চোখে তাকিয়ে থাকে।
-দুপুরের পর থেকে পাহারা নেই আপা।
তাকিয়ে দেখে দরজায় বন্দুক নিয়ে রাজাকার বসে নেই।
হাসপাতালে জুড়ে বেশ চাঞ্চল্য। লাইলি ওঠে দাঁড়াতেই টের পায় ওর যোনিপথ দিয়ে ক্ষীণ রক্তের ধারা আনন্দ নিয়ে ছুটে দুপা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
তবুও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। পাশের সাধারণ ওয়ার্ড থেকে এক বৃদ্ধা এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।
মা! মা!!
দুজন দজনকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদে।
মায়ের কাছে শুনতে পায় রবি মায়ের সাথে দেখা করতে এসছিল। তিনদিন অভুক্ত রবি মায়ের হাতের রান্না খেয়ে ফেরার পথে নাইম ওকে ধরিয়ে দেয়।
আর্মিরা রবিকে পেরেক মেরে সার্কিট হাউজের সামনের গাছে ঝুলিয়ে রাখে তিনিদিন।
গুলি করে লাস শেয়াল কুকুর দিয়ে খাইয়েছে। তবুও ফুলমতিকে লাসটা ফেরত দেয়নি।
তিনটে দিন ফুলমতি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল ছেলেকে দেখার জন্য। পারেনি একনজর ছেলেকে দেখতে।
শোকে দুঃখে নিজেকে নিঃশেষ করে দেবার অদম্য বেদনায় গভীর শীতে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। পরে শফি এনে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে।
মা মেয়ে বিমানের শব্দে আকাশে তাকায়। মনে হচ্ছে হাত তুলে বিমানগুলো ছোঁয়া যাবে। বিমানের ভেতর থেকে পেঁজা পেঁজা তুলোর মত করে মেঘ লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে।
- চিনা সৈন্য আইসা গেছেরে আর ভয় নাই। চীন দ্যাশ থিকা সৈন্য পাঠাইছেরে।
- তুমাগো নিগা যুদি চিনা সৈন্য আইব তাইলে রেজাকারগুনা কাপড় খুইল্লা নৌড় দিতাছে ক্যা। আর গাড়ি বুঝাই কইরা বেদিশা হইয়া মেলেটারি ঢাকা মুখী ছুটছে ক্যা।
হাসপাতালে নানাজনের নানামতে কান পেতে থাকে লাইলি।
আকাশ জুড়ে বৃষ্টির মত তুলোর ফুল ঝরছে বিমান থেকে।
ইন্ডিয়ান আর্মি ইন্ডিয়ান আর্মি গুঞ্জন প্রবল হয়ে ওঠে। ছত্রী সেনা ছত্রী সেনা!!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে লাইলি।
চারদিকের মুখর কথায় কান পেতে থাকে।
সড়ক পথে ব্রীগেডিয়ার ক্লেএর নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী এসে যোগ দিয়েছে মুক্তি বাহিনীর সাথে। গত রাতে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়েছে ইছাপুরে ।
আজ কাদের সিদ্দিকীর যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসাবে পুংলীর কাছে মুক্তিবাহিনী আর ছত্রী সেনা একত্রিত হচ্ছে।
সম্মিলিত শক্তি শহরে প্রবেশ করছে।
কত কত নাম সাহসের সাথে ভালবাসার সাথে ভাসছে আনন্দ বাতাসে।
আনোয়ার উল আলম শহীদ সবুর খান ফজলু, বুলবুল খান মাহবুব, আবু এনায়েত করীম, মাহবুব সাদিক, আরজু, আঙুর, হুমায়ুন, হাবীব, বেনু, । আরো কত নাম।
লাইলি আর ওর মা কান পেতে থাকে হাফিজের নাম শোনার জন্য।
আনন্দে সাহসে ভালবাসায় ভেসে থাকা নামগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হাফিজ নাম পায় না।
বুকের ভেতর থম মেরে থাকে। হাফিজ! হফিজ!
একবার মাত্র একবার শুনতে চায় হাফিজের নাম।
সন্ধ্যায় জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে মুখর হয় সারা শহর।
হাসপাতালেও ছড়িয়ে পড়ে আনন্দ ধ্বনি।
লাইলি হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়ায়।
শীতের সন্ধ্যারাত উষ্ণ হয়ে ওঠে মূহুর্তেই।
সবার আনন্দ দেখে বুঝতে পারে ওরা মুক্ত হয়ে গেছে।
পুত্রহারা মা দুহাত দিয়ে কন্যা লাইলিকে জড়িয়ে ধরে রাখে
লাইলি অজান্তেই ওর শূন্য বুকে হাত দিয়ে ককিয়ে ওঠে। ক্ষতটা এখনও শুকায়নি।
তবুও মাকে জড়িয়ে ধরে
প্রচন্ড চিৎকার জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে মুখর করে দু মা মেয়ে।
এই শ্লোগান এই আনন্দ ধ্বনি এতোদিন ওর বুকের ভেতরে ফুঁসছিল। আজ টাংগাইল মুক্তদিনে ছড়িয়ে দেয় আকাশে বাতাসে।
এই শ্লোগান এই আনন্দের জন্য কতটা মূল্য দিতে হলো ওদের....

সমাপ্ত

 

রোকেয়া ইসলাম
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top