সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

প্রবিষ্ট হওয়া (রম্যগল্প) : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
৭ জুন ২০২১ ১৯:৫৯

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৪৪

ছবিঃ : রহমান তৌহিদ

 

“প্রবিষ্ট” শব্দটার নতুন ব্যঞ্জনা পেলাম এক প্রখ্যাত রম্য লেখকের লেখা। তিনি লিখছেন, “আমি যখন সরকারি চাকরিতে প্রবিষ্ট হলাম ... ”

মনে পড়ে গেল আমার সরকারি চাকরিতে যোগদানের কথা। আমি এখনও যোগদানই বলি। কারণ, সে দিনটি আমার জীবনের শুভদিন হলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে শুভ দিন ছিল না। সেদিন বিরোধী দলের ডাকা হরতালের মধ্যে আমাকে কিছু পথ হেটে, কিছু পথ ভয়ে ভয়ে রিকশায় চড়ে কর্মস্থলে সত্যিকার অর্থেই যোগদান করতে হয়েছিল।

তবে, ক’দিন পর অফিসের মোটরগাড়ি চালক মালেক মিয়ার সুবাদে নতুন শব্দের সাথে পরিচয় হল। মালেক মিয়ার হাত ও পায়ের সাথে মুখ না চললে গাড়ি ঠিকমতো চলতো না। গাড়িতে এক সাথে কয়েকজন থাকলে বিশেষ করে মালেক মিয়ার ভাষায় “বড় স্যার” থাকলে মুখ বন্ধ থাকে, কিন্তু তখন প্রায়ই গাড়ি এদিক ওদিক চলে যায়। আর যখন গাড়িতে একজন মাত্র অফিসার থাকে , তার কান ঝালা পালা না করে মালেক মিয়া ছাড়বেনই না। একবার এক বদরাগী অফিসার ধমক দিলে মালেক মিয়া নাকি গাড়ি আইল্যান্ডের উপর উঠিয়ে দিয়েছিলেন। গল্প হতে পারে তবে এরপর থেকে গাড়ীতে একা থাকলে আর কেউ তাকে ধমক দেয় নি। তো যা বলছিলাম, মালেক মিয়ার গল্পের শুরুটা আদি ও অকৃত্রিম : স্যার অত  সালে এই পোড়া চাকরিতে ভর্ত্তি। কত স্যার দেখলাম কিন্তু অমুক স্যারের মত স্যার পেলাম না। এই আপনার মত লম্বা চওড়া ( আরোহী স্যার লম্বা চওড়া হলে) আর কি কলিজা ... স্যারের কাছে পাইছি ইনসাফ।

মালেক মিয়ার গতানুগতি কথা আমার কানে ঢুকলেও যেটা মনে ধরলো তা হল, ভর্ত্তি হওয়া। মানুষ স্কুল কলেজে ভর্ত্তি হয়, চাকরিতে কিভাবে ভর্ত্তি হয়?

এবার “প্রবিষ্ট হওয়া”, “যোগদান করা” আর “ভর্ত্তি হওয়া “বিষয়টি আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। ঘটনা একই, কিন্তু তিনজন তিনভাবে প্রকাশ করছে। “যোগদান করা” হল স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোন চাকুরিতে প্রবেশ করা। আর “ভর্ত্তি হওয়া”র  বিষয়টি আমি এখনও পরিষ্কার না।

কিন্তু, প্রবিষ্ট হওয়ার বিষয়টি ভাবতে গিয়ে আমার যেটা প্রথমেই মনে হল তা হল, সিলিন্ডিারের ভেতর পিস্টন প্রবিষ্ট হওয়া। বিষয়টা অনেকটা যান্ত্রিক। কিছুটা জোর-জবরদস্তি করে প্রবেশ করা কি? সম্প্রতি বিভিন্ন দপ্তর অধিদপ্তরে নিয়োগ নিয়ে যে সব খবর প্রকাশিত হয়েছে পত্র পত্রিকায় তাতে দেখা যায়, তদবির (রাজনৈতিক, এলাকাভিত্তিক, অর্থনৈতিক ও আত্মীয়তাসূত্রে) একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। সেই তদবিরের মাধ্যমে যারা চাকুরিতে প্রবেশ করে তাদের বিষয়টি “প্রবিষ্ট হওয়া” হিসেবে গন্য করা যায় কিনা ভেবে দেখা যায়।

প্রখ্যাত রম্য লেখক যখন সরকারি চাকুরিতে প্রবেশ করেছিলেন তখন তদবির এত ডালপালা গজায়নি আর তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি যে এ কায়দায় প্রবিষ্ট হননি, তা আমি হলফ করে বরতে পারি। এই লেখা তাঁর চোখে পড়বে না আশা করি, পড়লে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তিনি হয়ত রম্য করেই চাকরিতে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন।

যাহোক এ রকম এক প্রবিষ্ট হওয়া প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষার ঘটনা বলি।

ভদ্রমহিলার জন্য সভাপতির কাছে আগেই উপর মহলের তদবির এসেছে। সভাপতির ভাষায় į হেভিওয়েট প্রার্থী İ। সভাপতি সাহেব সদস্যদের বলে দিলেন, “পরবর্তী প্রার্থীর জন্য উপরের চাপ আছে। চাকরি দিই বা না দিই কেউ রুঢ় ব্যবহার করবেন না। বোঝেনই তো, দিনকাল ভাল না।”

প্রার্থী ঢুকলেন। প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষে দেখা গেল সদস্যরা কেউ কোন প্রশ্ন করছে না। এবার সভাপতি সাহেব নরম সুরে প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কি বিবাহ হয়েছে?”

প্রার্থী : জী স্যার হয়েছিল। একটা সন্তানও আছে। স্বামীর চরিত্র খারাপ। ডিভোর্স দিয়ে দেব, শুধু চাকরি পাচ্ছি না, তাই সহ্য করছি।

সভাপতি : ঠিক আছে, ঠিক আছে। মাথা ঠান্ডা করেন। দেখি আমরা কি করতে পারি।

প্রার্থী বিদায় নিলে সদস্যগণের সাথে বসলেন সভাপতি।

সভাপতি : কি বলেন আপনারা, প্রার্থীকে সর্বোচ্চ নম্বর দিই।

সদস্য ১ : স্যার, ওর চাকরি হলে একটা সংসার ভাঙবে। ভেবে দেখেন।

সদস্য ২ : আরে ভাই,  বলল না স্বামীর চরিত্র খারাপ। দেন স্যার, বেশি নম্বর দেন।

সদস্য ৩ : চাকুরি ওকে দেন স্যার, আমার আপত্তি নেই। আর আপত্তি করেও লাভ নাই, হাই ভোল্টেজ তদবির। তবে, স্যার আমি হলফ করে বলতে পারি চাকরি পেলে উনি  আর স্বামীকে ডিভোর্স দেবেন না।

সভাপতি : ইন্টারেস্টিং, ইন্টারেস্টিং। ঠিক আছে তাহলে, চাকরি পেলে উনি  স্বামীকে ডিভোর্স দেন কিনা এটা দেখার জন্য আমার তাকে চাকরিটা  দিচ্ছি।

সদস্যবৃন্দ (একযোগে) : আপনি তো এ অধিদপ্তরে আছেন স্যার। আমাদের আপডেট জানাবেন।

চাকুরিতে প্রবিষ্ট হওয়া প্রার্থী কি করেছিলেন, সে রহস্য রহস্যই থাক।

সবাই তো আর প্রবিষ্ট হতে পারে না, অনেকেই বেকার থাকে। একরম এক বেকার যুবককে  পাশে বাসার চাচা   একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু হলো?

বেকার যুবক: আসলে চাচাজান, আমার কোন চাকরি যে আমার জন্য যথার্থ হবে তা ঠিক করতে পারছি না। বন্ধু বান্ধবকে দেখছি কারও চাকরি ভাল লাগছে না।

চাচা : একবার চাকরি পেয়েই দেখ। নিজের চাকরি ছাড়া দুনিয়ার সকল চাকরি তোমার পছন্দ হবে।

ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, যোগদান করুন আর প্রবিষ্ট হোন, একবার যখন চাকরিতে ঢুকেই পড়েছেন, তখন পিস্টনের মত সিলিন্ডারের মধ্যে উঠানামা করতে থাকুন, তাতে বেতন নামক ইঞ্জিনের চাকা ঘুরতে থাকবে -  এতেই প্রভূত সুখ।

 

রহমান তৌহিদ
রম্য লেখক
লেক সার্কাস, কলাবাগান, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top