সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

একজন সব্যসাচী লেখক ইন্দু সাহার সমাজমূল্য : প্রণব মজুমদার


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২১ ১৮:৪৭

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৫১

ছবিঃ ইন্দু সাহা এবং লেখক প্রণব মজুমদার

 

ফেসবুক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে হালনাগাদ খবরের উৎস হিসেবে। বিরাজমান অতিমারির সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির সামাজিক এ মাধ্যম নিয়ে আজকাল শংকিত থাকি! কারণ একটাই - আচমকা মৃত্যু এবং প্রিয়জনের স্বাস্থ্যগত সংকটাপন্ন সংবাদ! সংসার, সমাজ, দেশ বিদেশের স্বনামখ্যাত ব্যক্তি এবং সৎ মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
কাল বিকেলে লেখিকা এবং সাহিত্য সংগঠন জিগীষার সাধারণ সম্পাদক মনিরা আক্তার ম্যাসেঞ্জারে জানালো, প্রগতিমনস্ক মানুষ এবং বিশিষ্ট কবি ইন্দু সাহা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন দুপুরে। সংবাদটি জানার পর কিছুক্ষণ মৌণব্রত হয়ে পড়ি! স্মার্টফোনের কিবোর্ডে তর্জনী আঙ্গুলের মাথার স্পর্শে কবি ইন্দু সাহাকে নিয়ে স্মৃতির বাক্স থেকে অক্ষর সাজাচ্ছি। এরমধ্যে লেখার ৫০৯ শব্দ তৈরি হয়ে গেছে। সচারাচর ফোন করেন না এমন একজন প্রিয়জন সাহিত্য ও ইতিহাস গবেষক অনুজপ্রতিম দীনেশ মাহাতোর শব্দময় কল। সানন্দে ধরি। পরামর্শ  চাচ্ছেন গবেষণার বিষয়ে। প্রায় ২৮ মিনিট ফোনালাপের পর কম্পোজ করা পাঁচ শতাধিক অসঞ্চিত লেখাটি ফেসবুক থেকে হারিয়ে গেল! অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার হল না!
রাতের আহার শেষ করে যখন শোবার ঘরে এসে বসছি তখনি নোটিফিকেশনের শব্দ পেলাম। ফোনসেট পরখ করে দেখি! যমুনা টেলিভিশনের ক্রীড়া সাংবাদিক বন্ধু রানা হাসানের সংক্ষিপ্ত পোস্টে কথাশিল্পী ও প্রবীণ সাংবাদিক ফিউরি খোন্দকারের আকাস্মিক মৃত্যুর খবর।  দু'জন প্রিয় মানুষের চলে যাওয়ার বিষয়টি ভাবায় আমাকে গভীর রাত অবধি। মাসিক কিশোর বাংলার এবারের ঈদ সংখ্যায় ফিউরি খোন্দকার ছোট গল্প - অপার্থিব প্রকাশিত। আর আমিও ৪২০ পৃষ্ঠার বিশেষ এ সংখ্যাটিতে লিখেছি প্রবন্ধ - শিশু মনের রবীন্দ্রনাথ । দু'জন গুণীজনই আমার ফেসবুকের তালিকাভুক্ত বন্ধু।
কবি ইন্দু সাহা ৩ বছর ধরে কিডনিসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে বিছানায় শয্যাগত। কাল দুপুর আড়াইটায় অমর্ত্যলোকের উদ্দেশ্যে চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলেন। ষাটের দশকের বিপ্লবী কবি ও প্রগতিশীল মানুষ ইন্দু সাহা কলকতায় বেলঘরিয়াতে সম্পূর্ণ অদৃশ্যমান হয়ে গেলেন। বয়স হলেও হঠাৎই চলে গেলেন কথাসাহিত্যিক ফিউরি খোন্দকার। তাঁর অন্তিম যাত্রা কর্কট রোগে।
লেখালেখির সুবাদে কবি ইন্দু সাহার নাম জানতাম। কিন্তু পরিচয় ছিল না। বাম নিষিদ্ধ রাজনীতির  কারণে হুলিয়া নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন কয়েক যুগ আগে। কিন্তু জন্মভিটা ও দেশের জনগণের টানে ফিরে আসার তাড়না ছিল তাঁর। ২০১৭ সালে দেশে আসেন তিনি। রাজধানীকেন্দ্রিক সাহিত্য সংগঠন জিগীষার সভাপতি কবি ও গল্পকার ইলিয়াস ফারুকীর (ইলিয়াস পারভেজ) মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে  পরিচয় নয়াপল্টনে। পরে সাধারণ সম্পাদক লেখিকা মনিরা আক্তারের মাধ্যমে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় আলোকপাত প্রকাশনের সম্পাদক কবি ইন্দু সাহা লিখিত প্রবন্ধ, ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস মিলিয়ে বেশ ক'টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়! পুরো মেলায় সে সময় তিনি আলোকপাতের স্টলে সক্রিয় ছিলেন। স্টল থেকে সনেট সমগ্রসহ তাঁর লেখা ৪টি বই কিনি। বেশ খুশি হয়েছিলেন তিনি। দেখা হতো। বিশদ জম্পেশ আলোচনা হতো। হতো রসঘন নানা গল্প। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী চিন্তাশীল ব্যক্তি। আড্ডায় ধর্ম আলোচনায় বলেছিলেন নাস্তিক ব্যক্তিরাও মানুষ। সমাজ ও রাষ্ট্রে জ্ঞানীরা অবদান রেখে যান তা তো অস্বীকার করা যায় না ! ধর্মের নানা মতের আচরণ যে কারোরই ব্যক্তিগত আরোধ্য বিষয়! তাঁর মতে - বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, রামমোহন রায়, কার্ল মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং নাস্তিক ছিলেন বলে এই মনীষীগণ তো অমানুষ ছিলেন না!

সৎ ও উদার মনের আলোকিত মানুষটিকে দেখেছি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে সহায়তা করছেন জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা, বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে। কবি, প্রাবন্ধিক, কথাশিল্পী, গীতিকার, সংগঠক, বাম রাজনীতিবিদ ইন্দু সাহার সরাসরি সম্পাদনায় সেবার মেলায় আলোকপাত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় অন্যান্যের মধ্যে ৩টি বইও। কবি জামিল জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ - ভালোবাসার ক্যারাভ্যান, মনিরা আক্তারের প্রথম গ্রন্থ প্রবন্ধের বই - নন্দিত জীবনের সন্ধানে, গল্পকার ও কবি শামীম আরার প্রবন্ধ - কতো রুধিরাক্ত স্বাধীনতা কতো তিতিক্ষার ফলশ্রুতি। যদ্দুর জানি বইগুলোর নামকরণ থেকে শুরু করে পাণ্ডুলিপি পরিবর্তন, পরিমার্জন, সম্পাদনা এমন কি বাক্য ও বর্ণ সংশোধনের কাজও সম্পাদন করে দিয়েছিলেন তিনি।
তরুণ কবি অনুশ্রী রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিষাদ পেরিয়ে গ্রন্থের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলা  সাহিত্যের নানা শাখায় প্রকাশিত ১২৭টি গ্রন্থের সব্যসাচী লেখকের পাণ্ডিত্য ছিল বিস্ময়কর! এতো বড় অবদান সে তুলনায় কোন সম্মান বা পুরস্কার তিনি পাননি । ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলস্থ হোটেল ঈশা খাঁ  ইন্টারন্যাশনালে জিগীষা সাহিত্য পুরস্কারের জমকালো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে তাঁকেও সম্মাননা দেয়া হয়। এই অনুষ্ঠানের তিন মাস পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যান। সেই যাওয়া আর ফিরতে পারেননি। মনিরার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ওর কাছ থেকে নম্বর  নিয়ে ফোন করে কথা বলেছি কবি ইন্দু  সাহার সঙ্গে একাধিকবার।
জীবনের অবশিষ্ট সময় আশি উত্তীর্ণ সব্যসাচী লেখক ইন্দু সাহা দেশপ্রেমের কারণে ছুঁটে এসেছিলেন বাংলাদেশে। বিপত্নীক ইন্দু সাহা ছেলে মেয়ের অবহেলায় একাই ছিলেন সে সময় । পশ্চিমবঙ্গে থাকতেন বোনের কাছে। চরম অর্থ কষ্ট ছিল তাঁর । ভাইপো গৌতম রায় ও প্রগতিশীল লেখক কবি তমাল মজুমদারের পোস্টগুলোতে তাঁর সে অভিমান, ব্যক্তিত্ব ও সততার সত্যতা মেলে।
কলকাতার কবি তমাল মজুমদার ২৭ মার্চ ফেসবুকের তাঁর ওয়ালে লিখেছেন কবি ইন্দু সাহাকে নিয়ে । কবি ও আপোষহীন বাম-মনষ্ক মানুষ ইন্দু সাহাকে দেখতে গেছিলাম। আগের থেকে একটু ভালো আছেন। ব্যক্তিগতভাবে ওনাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। প্রচুর ওষুধ ও পথ্য চলছে। উনি আমাকে কিছু কথা লিখতে বললেন। আমি আমার মতো করে লিখছি, ভুল হলে ক্ষমা করে দেবেন।
উনি (ইন্দু সাহা) কারও কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সাহায্য নেবেন না। এমন কি আমার কাছ থেকেও। ওনার পরিস্কার বক্তব্য যেসব প্রকাশকের কাজ করেছেন এবং যেসব প্রকাশক ওনার বই ছেপে মুনাফা করেছেন, তাঁদের কাছে ওনার ন্যায্য অনেক টাকা পাওনা আছে। সেই সমস্ত টাকা তাঁর এই দুঃসময়ে দেন তাহলে খুব উপকৃত হবেন।
তিনি (ইন্দু সাহা) দীর্ঘদিন ধ'রে বাংলাদেশের নামকরা প্রকাশন আলোকপাতে কাজ করেছেন এবং সেই প্রকাশনা তাঁর বহু বই ছেপে ও বিক্রি করে লাভ করেছেন। সেই আলোকপাত প্রকাশনার মালিকের কাছ থেকে এখনও দুই লাখ টাকা পাবেন। মতান্তর থাকতেই পারে। কিন্তু এই দুঃসময়ে মানবিকতার খাতিরে যদি টাকাটা তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়, তাহলে যিনি টাকা ফেরত দেবেন তাঁর মানবিকগুণের পরিচয় দেশ তথা বিশ্ব জানতে পারবেন।
কোলকাতায় দু'টি প্রকাশন ১। অক্ষর প্রকাশন এডুকেশন ফোরাম ( নামটা ভুল হতেও পারে) এবং ২) দেশ প্রকাশন। এদের কাছে বেশ কিছু টাকা উনি পাবেন। যখন কোলকাতায় খ্যাতিমান লেখক শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সুনীল একচেটিয়া লিখছেন, তখন তাঁর লেখা উপন্যাস ''লম্পট'' যেটা অক্ষর প্রকাশন এডুকেশন ফোরাম ছেপেছিল ও বেস্ট সেলার হয়েছিল। এই দুই প্রকাশকের কর্ণধারদের কাছে অনুরোধ এই সময়ে তাঁর ন্যায্য পাওনা টাকাটা দিলে খুবই ভাল।
পুনঃ আর কিছু কথা লিখতে বলেছিলেন, রাজি হইনি। তখন তিনি কাঁপা হাতে দু'চার কথা লিখেছিলেন এবং বারবার অনুরোধও করলেন। তাই অনিচ্ছা থাকলেও তাঁর অনুরোধে হুবহু লিখলাম -
'অসংখ্য প্রতারকের মাঝে এমন একজন প্রকৃত বামমনষ্ক মানুষ যার সাথে হাসপাতালে প্রথম দেখা হয় তার নাম .............(মাফ করবেন নিজের নাম লেখাও এক ধরণের ভণ্ডামী)। ঘোলাজলে বহুদিন পর আসল মাছের সাধ পেলাম। আরও ক'টা দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে।'
(ব্যক্তিগতভাবে আমি সবকিছু জানি না, মানবিকতার খাতিরে উনি যা লিখতে বললেন তাই লিখলাম। কাউকে ব্যক্তিগত আঘাত দিইনি।)

কবি ইন্দু সাহার ভাইয়ের ছেলে পশ্চিমবঙ্গের গৌতম সাহা! লেখক মনিরা আক্তারকে ট্যাগ করা গৌতমের একটি লেখা পোস্ট এখানে হুবহু তুলে দিলাম। উপ শিরোনামও ঠিক রাখলাম।


কবিতাও কবির সঙ্গে হেঁয়ালি করে


একজন কবি ইন্দু সাহা। দ্রোহে যার আগুন। ইন্দু সাহা নামটি মনে হলেই আমি তাঁর ভিতর স্ফুলিঙের দাবানল দেখতে পাই। আমি তখন খুব ছোট। দেখতাম একজন সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবী পরা স্নিগ্ধ ও শুদ্ধ মনের মানুষ। ঢাকা থেকে এসে যখন শহরে নামতেন তখন অনেক মানুষকে দেখতাম, তার চারপাশ ঘিরে থেকেছেন। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা মানুষটিকে দেখে কিছু মানুষ মুগ্ধ হয়ে যেতেন। অবাক হয়ে তাঁর কথা শুনেছেন।
কাব্য তাঁর রক্তের ভিতরেই ছিল। বাবার মুখে শোনা, ১৯৬৩/ ১৯৬৪ খ্রিঃ সময়ে রেডিও পিকিং থেকে বাংলা অনুষ্ঠানে কবি ইন্দু সাহা’র নবান্ন কবিতাটি পাঠ করা হয়েছিল।
তখন এতটাই ছোট যে সব স্মৃতি এখন মনে করতে পারিনা। ২১ ফ্রেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ খ্রিঃ। শুক্রবার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে আমাদের বাড়ি ভাংচুর হয়। সেইদিন ক্রিমিন্যাল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট আজাদের উপস্থিতিতে কবির মায়ের (আমার ঠাকুমা) উপর লাঠি চার্জ করা হয় ও তিনি লাঞ্চিত হন। বড় ভাই বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক রামকৃষ্ণ সাহাকে শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। সেই দৃশ্য আমার কাছে এখনও ছবির মত মনে হয়।
কবি’র বিকাশটাই ছিল অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। শোষণ মুক্তির লড়াইয়ে প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার অগ্রসৈনিক ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ খ্রিঃ সময়ে বেকার নিকেতন নামে তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন তিনি পাবনার জেলার অন্তর্গত কদিম মালঞ্চি নামক গ্রামে আমাদের সঙ্গে দীর্ঘসময় অতিবাহিত করেন। ঐ সময়ে দেখা আমাদের পাশে থাকা একজন ধর্মপরায়ণ মানুষ এজন ব্যাপারীর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান দেখে তিনি ‘এজন মুন্সীর পোস্টার’ নাটক লিখে ফেলেন। পরে তার সফল মঞ্চায়নও হয়। মুক্তিযুদ্ধের আবহ ও মুক্তচিন্তার বার্তা নিয়ে লিখে ফেলেন ‘পলাশ কামিনী’। পরে তা নিয়ে সিনেমা তৈরী হয় ‘পলাতক’। কবি ইন্দু সাহা আমাদের গর্ব তো বটেই। তাঁর ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যাও কম নয়।
মানুষমাত্র কেউ ভুলের উর্দ্ধে নয়। তারপরও তার এই জীবনে ১২৭ টি কবিতা, উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ আমাদের প্রাণে নতুন আবেগ সঞ্চার করে।স্বাধীনতা উত্তরকালে ‘পোস্টার কথা কয়’ নামক কাব্যগ্রন্থটি অনেকের মনেই ব্যাপক সাড়া জুগিয়েছিলো। অসংখ্য নাটক লিখেছেন ও নিজেই তার শিল্পনির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন এজন মুন্সীর পোস্টার, ফুলবানু ও মানচিত্র, টুনি তাল সেনাপুর যাচ্ছে ইত্যাদি। গানের জন্যে তাঁর প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মত লেখা এখনও অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল সেগুলিকে প্রকাশ করার।
বাংলাদেশ তাঁর প্রাণ। সাহিত্যে যা কিছু যতটুকু তিনি করতে পেরেছেন। জন্মভূমি ছিল তাঁর শক্তির উৎস। ছোটসময়ে তখন অনেক ছোট থাকায় ভয়ে তাঁর সংস্পর্শে যাওয়া হত না। বছর পাঁচেক আগে কি করে যেন তাঁর খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিলো। পিতা- পুত্রের মধ্যেও যে একটা বন্ধুত্ব হয় সেটা ঘনিষ্টভাবে তাঁকে কাছে পেয়ে বুঝেছিলাম। কত গোপন ব্যথা তাঁকে কাঁদায়। একমাত্র মানবিকতা ছাড়া তিনি কারও কাছে মাথা নত করার মত মানুষ ছিলেন না। আদর্শের কাছে ছিলেন ভীষণ কঠিন। আমাকে বলতেন- গৌতম তুই লিখে যা! লেখার জন্যে মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হবে। একটা ভাল লেখা মানুষকে মৃত্যুর পরও বাঁচিয়ে রাখে।
সেই দৃঢ়চেতা মানুষটি আজ বয়স ও অসুখের ভারে অসহায়। মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে নিজেকে সবসময় দূরে রাখতেন। যে কারণে নিজের পরিবার থেকেও কবি একসময় বিচ্ছিন্ন হ’য়ে পড়েন। তাঁর রক্তজাত সন্তান আমরা। আমি, আমার সজ্জনদের উদ্দেশ্যে বিনীতবাবে বলতে চাই। প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করতে নাই পারেন। একদিন কবি ইন্দু সাহা আমাদের মাথার মুকুট ছিলেন। বলতে কোন দ্বিধা নেই। আমরা অনেকেই ইন্দু সাহা’র নামেও পরিচিত। আমাদের মধ্যে অনেকেই অনেক টাকা ও সম্পদের মালিক হয়েছেন ঠিক কিন্তু কবি ইন্দু সাহা সাহিত্যে মুকুট হয়েই সারাজীবন বেঁচে থাকবেন।
ঢাকা থেকে তাঁর অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী ও বন্ধুরা যোগাযোগ রেখে চলেছেন। তন্মধ্যে নাট্যফৌজ-এর জনাব তোফাজ্জল হোসেন দিদার, বিশিষ্ট লেখিকা মনিরা আক্তার, আলোকাপাত প্রকাশন এর কর্ণধার মশিউর রহমান। কবির অনেক ঘনিষ্টজন রুহি দাসসহ আরও অনেকে। ঢাকা থেকে তারা গিয়ে দেখাও করে এসেছেন। কোন অজুহাত নয়। আমি এখনও যাওয়ার সুযোগ করতে পারিনি। চেষ্টা করে যাচ্ছি যোগাযোগ রক্ষা করতে।
প্রয়োজনের সীমানায় নয়, অন্তরের তাড়না থাকলে এই মূহুর্তে কবিকে একবার দেখা উচিৎ। তাঁর মনে সাহস জাগানো উচিৎ। মৃত্যু তো হবেই! মৃত্যু কতটা কঠিন! অসাহায়ত্ব তার থেকেও কঠিন। একজন সন্তান হিসেবে এই দায় আমি কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারিনা। পিতা যত ভুল করুক। তাঁর স্থান ঈশ্বরের সমান। তাঁর অন্তিম মূহুর্তের এই যন্ত্রণাকাতর মুখ যেন আমাদের কাউকে অপরাধী ক’রে না তোলে।
স্বজনদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন। পারলে তাঁর পাশে দাঁড়াবেন। কবি আমাদের প্রাণ।
কতো স্বার্থপর আমরা! জীবদ্দশায় গুণীজন ও প্রিয় মানুষগুলোর জন্য আত্মচিৎকারে সমাজ অঙ্গন সবর রাখি। যেমন আমি লিখছি এখানে। দুর্ভাগ্য, বলতেই হয়, জীবিত আত্মার চেয়ে মৃতপ্রাণ আমাদের কাছে অধিক মূল্যবান। আর সে বাস্তবতা নির্মম হবেই বা না কেন? সমকালে কবি ইন্দু সাহার মতো সৃজনশীল ব্যক্তিদের যথার্থ মূল্য দিতে তো আমরা ভুলে গেছি।

প্রণব মজুমদার
লেখক গল্পকারকবিপ্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
শান্তিনগরঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top