সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ: বাংলা কবিতায় একটি অনিন্দ্য শিল্প : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২১ ১৯:৩১

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৬:২০

 

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)। তাঁর পুরোনাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। গত কয়েক দশকে তাঁর কবিসত্তার যে শৈল্পিক বিস্তার ঘটেছে, তাঁর সৃষ্টিকর্ম যে কালোত্তীর্ণ হয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ কমই। আল মাহমুদের অমর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’ সমকালীন বাংলা কবিতার একটি বাঁকের নাম। এ কাব্য গ্রন্থে মোট ৪১টি কবিতা রয়েছে। এরমধ্যে ১৪টি সনেটের সমন্বয়ে ‘‘সোনালি কাবিন’’ কবিতা।  তিনি যদি শুধু এই একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতেন, তাতেও বাংলা কবিতাজগতে আলোচিত হয়ে থাকতেন। আল মাহমুদের প্রথম পরিচয় কবি। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তবে তাঁর কাব্য প্রতিভার কাছে অন্য সব পরিচয় ফিকে হয়ে যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও ভঙ্গিতে সমৃদ্ধ করেছেন। এই জনপদে পাকিস্তানি শাসকদের অনাচার আর নিপীড়নের কারণে পঞ্চাশের দশকে বাংলাসাহিত্যে বড় এক মোড়বদল হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে, কবি আল মাহমুদের কবিতাতে প্রবল রাজনীতি, দেশপ্রেম, দ্রোহ আর সমাজতান্ত্রিক ভাবনার ছাপ আসে।

আল মাহমুদের নিজের একটি লেখা থেকে জানা যায়; তিনি বলেন, ‘প্রথমে এক টানে আমি সাতটি সনেট লিখে ফেলি। এরপর লিখি আরও সাত-মোট ১৪টি। কিন্তু পরে অনেক চেষ্টা করেও ‘‘সোনালি কাবিন’’ সিরিজে এই ১৪টির বেশি সনেট লিখতে পারিনি। তখন আমার মনে হয়েছিল, এটা হয়তো কোনো দৈব ব্যাপার’। তিরি আরও বলেন, ‘প্রথমে কলকাতা থেকে ‘‘সোনালি কাবিন’’-এর ১৪টি সনেট নিয়ে একটি ছোট পকেট বই বের হয়। এটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিল। পরে ওই ১৪টি সনেট এবং আরও কিছু কবিতা দিয়ে সোনালি কাবিন নামেই আমার তৃতীয় বই বের হয় ১৯৭৩ সালে। সনেটগুলো প্রকাশ হওয়ার পরই যে আলোড়ন তুলেছিল তা নয়, কিছু দিন পর শুরু হলো আলোচনা। তখনকার সেরা পত্রপত্রিকায় এ সনেট নিয়ে আলোচনা হতে লাগল। মনে হয়, আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা হলো: সোনালি কাবিন’।-(প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯)

 

‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত  দুটি’-এক নম্বর সনেটটি। ‘‘সোনালি কাবিন’’ কবিতাটির শুরুই হয়ে কি সুন্দর শব্দাবলির পঙক্তি দিয়েই। নারী প্রেমিকা; নারী শক্তির উৎস। নারীকে নিয়ে ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতাংশ-

(১) ‘বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই/দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,/লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই/হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।/...এ-বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক/নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।/রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,/শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভঙে ছল ছল/আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে/ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল।’-(সোনালি কাবিন-১৪)

(২) ‘এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,/মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,/ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি/কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।/কবির কামনা হয়ে আসবে কি, হে বন্য বালিকা-(সোনালি কাবিন-৪)

(৩) ‘নদীর সিকস্তী কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ/যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,/হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও/...নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষাণ/যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাই অধিকার তার,/...ঝড়ের কসম খেয়ে বলো নারী, বলো তুমিকার?’-(সোনালি কাবিন-১২)

 

মানুষ যেমন গল্প শুনতে আগ্রহী তেমনি সে তার ঐতিহ্য অনুসন্ধানেও আগ্রহী। মানুষের ঐতিহ্যসন্ধান মূলত তার অস্তিত্ব অনুসন্ধান করা। মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। সমাজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশও নিয়েই গড়ে ওঠে তার সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে তার লৌকিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনাচরণ। কবি আল মাহমুদও ব্যতিক্রম নয়। সাহিত্যিকরা এমনই। কবি আহসান হাবীব আধুনিক বাংলাসাহিত্যে লোকজ উপাদান ব্যবহারের সূচনা  করেন। তবে  তাতে  ব্যাপকতা দান করে পূর্ণতা দিয়েছেন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। শহরনির্ভর কবিতা হতে বের হয়ে এসে তিনি সৃষ্টি করেছেন আধুনিক পল্লীনির্ভর কবিতা। ‘‘সোনালি কাবিন’’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতাংশ- (১) ‘হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার/এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;/প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার/তার চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।/... মনে হয় ডাক দিলে সে-তিমিরে ঝাঁপ দিতে পারি/আচঁল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ।’-(সোনালি কাবিন-২)

(২) ‘অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল/লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,/আর কোনদিন বলো, দেখবো কি নতুন সকাল?/উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।’-(সোনালি কাবিন-৮)

(৩) ‘যে বংশের ধারা বেয়ে শ্যাম শোভা ধরেছো, মনিনী/একদা তারাই জেনো গড়েছিলো পুণ্ড্রের নগর/মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জনিনি/কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।/আমারও আবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে/পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টীকেরা পুরীর গৌরব,/রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে/ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।’-(সোনালি কাবিন-৯)

(৪) ‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত/হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,/এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত/তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।/...পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,/এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’-(সোনালি কাবিন-১০)

 

জীবনের শেষপর্যায়ে কবি আল মাহমুদ বিতর্কিত হয়েছেন। কবির প্রথমপর্যায়ে রয়েছে ‘‘সোনালি কাবিন’’ কাব্যগ্রন্থ। ‘‘সোনালি কাবিন’’ আল মাহমুদকে পূণর্তা দিয়েছে। বেশকিছু ধর্মীয় শব্দাবলির ব্যবহারের পরেও ‘‘সোনালি কাবিন’’ কবিতার সনেটগুচ্ছ কবি হিসাবে আল মাহমুদকে শক্তিশালী করেছে। লোকজ ও দেশীয় উপাদানে জনপ্রিয় হয়েছে। শিল্পমানে উত্তীর্ণ হয়েছে। ‘কাবিন’ শব্দটি নতুনমাত্রা পেয়েছে। কবি হিসেবে খ্যাতির জন্য একটি কবিতাই অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট হতে পারে। ‘‘সোনালি কাবিন’’ তেমনই একটি কবিতা। যা এখন বিশ্বসাহিত্যেরই অমূল্য দলিল।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top