সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব একুশ) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২১ ২০:১৮

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৯:২২

 

নিজেকে বীরাঙ্গনা ভাবতেই দেহটা খলবোলিয়ে ওঠে নীলিমার! বীরাঙ্গনার সাথেতো 'বীরাঙ্গনা মাতা’ নামটি আমাদের স্বাধীনতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এদের আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অংশ।

এইসব বীর রমণীর অনেক সাহসিকতার জন্য অনেক কাজ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যুগিয়েছে এবং এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর।

তবে দুঃখজনক বিষয় হলো আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত এই বীর মাতাদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

অনেক সভা-সেমিনারে রীবাঙ্গনা মাতাদের সংখ্যা দুই লাখ বলা হলেও বিভিন্ন অনুসন্ধানে এটি চার লাখেরও বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর এতো বছরেও বীর মাতাদের কোন হিসেবে না থাকাটা লজ্জার বলে মনে হয় নীলিমার।

২৬ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় মহান বীরাঙ্গনা দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে (২৬ ফেব্রুয়ারি, শনিবার) বাঙালি জাতির জনক মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, “আজ থেকে পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাঁদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাঁদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, “আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা মেয়ের পিতা হয়েছেন।”

এ ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেসব নারী লাঞ্ছিত, অপমানিত ও ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সতীত্ব বা সম্ভ্রম হারিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের 'বীরাঙ্গনা' উপাধিতে ভূষিত করেছেন। রাতুল একদিন পত্রিকায় দেখিয়েছিলো নীলিমাকে, স্বাধীনতা অর্জনের কিছুদিন পর সম্ভ্রমহারা কয়েকজন নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কী?’

জাতির জনকের এই ঘোষণার পর থেকে বীরাঙ্গনা শীর্ষক সম্মানসূচক উপাধি প্রবর্তনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এই ঘটনাটি সেদিন লোকলজ্জা ও মানসম্মানের ভয়ে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা গোপন রেখেছে। তারা তাদের অসহায় অবস্থার কথা রাষ্ট্রকে জানাতে আসেননি। যেসব নারী নিজ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সহানুভূতি পায়নি তাদের এক দল আত্মহত্যা করে সম্ভ্রমের সঙ্কট থেকে মুক্তি নিয়েছে, আরেক দল জনস্রোতে হারিয়ে গেছে, আর শেষ দলটির কেউ বাঁচার অদম্য স্পৃহা থেকে, কেউ প্রতিবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে, কেউবা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যকে বাঁচার অবলম্বন বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাপান ও ভারতীয় চিকিৎসকদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের স্থাপিত গর্ভপাত কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। এসব গর্ভপাত কেন্দ্রে কিছু কিছু পরিবারের পক্ষ থেকে অভিভাবকরা তাদের নির্যাতিত ও গর্ভবতী স্ত্রী বা কন্যাদের নিয়ে গেলেও অনেক নির্যাতিত মা-বোনই গর্ভপাত ঘটাতে অস্বীকার করেন। অথবা গর্ভপাতের সময় অতিক্রম করে অনাগত সন্তানটি প্রসবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ায় তারা সন্তান কামনা করেন। পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখার পর এই নবজাতক সন্তানদের নাম হয় যুদ্ধশিশু। নানা তথ্যের সমাহার থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের সংখ্যা আড়াই লাখের উপরে। এরা এখন কোথায়? আমরা কেউ কি জানি ! কিন্তু ইতিহাস জানে!!

আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে তাদের অবদানের পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে। আর তা না হলে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বীর মাতাদের অবদান আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে গুরুত্বহীন হয়েই থাকবে।

তবে কিছুটা খুশির খবর ---- 

স্বাধীনতার চার দশক পরও একাত্তরে ধর্ষণের শিকার সব নারীরাই  ছিলেন সমাজে অবাঞ্চিত। লাঞ্ছনা, ধিক্কার ও তিরস্কারের শিকার হয়ে আসছিলেন তারা। কিন্তু গত কয়েকবছরে অনেকটাই বদলে গেছে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বাঙালিদের মনোভাব। বেসরকারিভাবে অনেক সংস্থা-সংগঠন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মার্চ ও ডিসেম্বরে নানাভাবে সম্মাননা দিয়ে আসছেন। সবশেষ বীরাঙ্গনাদের সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে অনেকটা ভেঙ্গে গেছে সমাজে বীরমাতাদের তিরস্কৃত হওয়ার ধারণা। এখন অনেক বীরাঙ্গনা নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে লজ্জার নয়, বরং গর্বের।

এ সব সনদ কিংবা সাহায্য সহযোগিতা কিছুই নিতে দেয়নি তাকে রাতুল!যে সমাজ তাকে গ্রহণ করেনি, 

এতটুকু ঠাঁই দিতে দ্বিধাবোধ করেছে,অপাঙতেয় অচ্ছুতি বলে ঘৃণা করেছে, সেই সমাজতো রাষ্ট্রেরই গড়া মানুষের।

যেখান থেকে ধিকৃত হয়ে রাতুল বাধ্য হয়েছিল তাকে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের স্মরণাপন্ন হতে !

এরপর কতইনা পঙ্কিলতা সামলাতে হয়েছে নীলিমার!

নারী পুনর্বাসনে থাকার কিছুদিন পরই আস্তে আস্তে নীলিমা অনুভব করতে থাকে, তার শরীরে আরো একটা অস্তিত্ব অংকুরিত হচ্ছে!সে সময় স্থাপিত সরকারি গর্ভপাত কেন্দ্র থাকলেও কেউ পেটের অবাঞ্চিত শিশুটিকে নষ্ট করতে রাজি হয়নি!

নীলিমা প্রস্তুত ছিল ! কিন্তু রাতুল জানার পর কিছুতেই তার গর্ভপাত ঘটাতে দেয়নি!

এক বিস্ময়কর মানুষ ছিল রাতুল!

পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে,বন্ধুদের সহযোগিতায় রাতুল আমাকে বেলি ফুলের মালা পড়িয়ে বিয়ে করেছিল!এরপর আমার নিরাপত্তার জন্যই আবার রেখে আসে পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

আমার একটা ফুটফুটে ছেলে শিশু হলো!রাতুলই তার নাম রাখলো 'আনন্দ'।

বাচ্চা হবার পর প্রায় বছরখানেক পর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর আমাকে নিয়ে এসেছিলো এই নিরিবিলি পাহাড়ি এলাকায়। ভালো একটা চাকরির সুযোগ পেয়েছিলো সরকারিভাবে। এখানে আশপাশের কেউই জানতোনা আমার কোন ঘটনা । কেউ বুঝতেই পারেনি আনন্দ যুদ্ধ শিশু।

আমার সাথে বিয়ের খবর জানাজানি হবার পর রাতুলকে কে তার পরিবার থেকে ত্যাজ্য কোরে দেয়।

চলবে

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top