সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মহর্ষির উপাখ্যান : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২১ ২০:৪০

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৭:০২

ছবিঃ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

সে ছিল এক পূর্ণিমার রাত। অবিরাম ঝরে পড়া গলানো রূপালি জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে সমগ্র চরাচর। স্থান নিমতলার গঙ্গাতীর, সন১৮৩৮। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মহাশয়ের মাতৃদেবী অলকাসুন্দরীর  গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে|নিমতলা ঘাটে গঙ্গাতীরে কয়েকদিন ধরেই মরণাপন্না গঙ্গাযাত্রীর কাছে জোর নামসংকীর্তন চলছে তৎকালীন রীতি অনুসারে। কাছেই নিমতলাঘাটে একটি চাটাইয়ের উপর স্থির হয়ে বসে আছেন এক অনিন্দ্যকান্তি রূপবান যুবক। তাঁর পরনের আচকান, মাথার পাগড়ি, পায়ের জুতো সবকিছুতেই লেগে আছে এক অভিজাত স্পর্শ। উদাসভাবে, নিস্পলক নেত্রে তিনি তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। চারপাশের কোনো কিছুই যেন তাঁর মনোযোগ ভাঙ্গতে পারছে না। খুব মৃদু কলতানে জ্যোস্না মেখে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গানদী। তাঁর মনে হলো সুখ, ভোগ,স্বাচ্ছন্দ্য, ঐশ্বর্য এইসবের কি আদৌ কোনো মূল্য আছে?  এই নদী.. এই জ্যোস্না... এই রাত্রির নীরব সৌন্দর্য.. সবকিছু মিলিতভাবে  যে এক অভূতপূর্ব আনন্দ  এনে দিল তাঁর মনে সেতো অমূল্য|যেন এক বিশাল মুক্তি  তাঁকে ডাক দিয়ে গেল বার বার। শ্মশানের উদাস পরিবেশে এক আনন্দজ্যোস্না রাত্রি তাঁর মনে চিরস্থায়ী প্রভাব রেখে গেল।
যুবকের নাম বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রথম সন্তান। ১৮১৭খৃ: কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম| শৈশবে পিতামহী অলকাসুন্দরীর স্নেহে যত্নে তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন। ১৮২৩ সালে হাতেখড়ির পর চন্ডীমন্ডপের পাঠশালায় দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষা শুরু হয়। রাজা রামমোহন রায়ের অনুরোধে দ্বারকানাথ পরবর্তীকালে পুত্রকে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত আংলো স্কুলে পাঠালেন। রামমোহন রায়  এই বন্ধুপুত্রটিকে বিশেষ ভাবে স্নেহ করতেন। দেবেন্দ্রনাথ ও রাজা রামমোহন রায়ের আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের অনুরাগী ছিলেন। রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে দেবেন্দ্রনাথ ১৮৩০সালে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হলেন। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি ও পারসি ভাষা শেখার জন্য দ্বারকানাথ  তাঁর জন্য শিক্ষক নিয়োগ করেন। একটু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁকে শিখতে হয়েছিল ব্যায়াম, সংগীত ও পিয়ানো। তৎকালীন পারিবারীক নিয়ম অনুসারে মাত্র সতের বছর বয়সে যশোরের দক্ষিণডিহির রামনারায়ন রায়চৌধুরীর কন্যা শাকম্ভরী বা সারদাসুন্দরীর সাথে তাঁর বিবাহ দেওয়া হলো। সেই বছরেই দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথকে ইউনিয়ন ব্যাংকের তহবিলের হিসেবপত্র মেলানোর কাজ শেখার জন্য পাঠান। ধনী পিতার রূপবান ছেলের জন্য বিলাস ব্যসনের প্রাচুর্য দেবেন্দ্রনাথকে ঘিরে ধরেছিল। কলকাতা শহরে তাঁর 'বাবু' খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর বেশভূষা, আচার আচরন সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করতো। দেবেন্দ্রনাথ নিজেও খুব শৌখীন ছিলেন। কলকাতা শহরের সব সন্দেশ ও গাঁদাফুল দেবেন্দ্রনাথ কিনে নিয়েছিলেন তাঁর সরস্বতী পূজার জন্য। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করে নানারকম গীত বাদ্য আমোদ প্রমোদে প্রতিমা নিরঞ্জন হতো| বিলাসী হলেও দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন মার্জিত রুচির অধিকারী। কথিত আছে একবার শোভাবাজার রাজবাড়ীর এক অনুষ্ঠানে ধনী ব্যক্তিরা নানান রকম মূল্যবান অলংকার ও জরিখচিত মহার্ঘ পোশাক পড়ে সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের পরনের ধবধবে  শ্বেতবস্ত্রে কোন জরি বা চুমকি ছিল না, কিন্তু তাঁর পায়ে ছিল মহার্ঘ মুক্তা বসানো দামী জুতো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন "শ'বাজারের রাজামশাই ছিলেন কর্তাদাদামশায়ের বন্ধু... তিনি তখন... কর্তাদাদামশায়ের পায়ের দিকে ইশারা করে বললেন, "দেখ তোরা দেখ, একবার চেয়ে দেখ এদিকে, একেই বলে বড়লোক| আমরা যা গলায় মাথায় ঝুলিয়েছি ইনি তা পায়ে রেখেছেন।"
বিলাস বৈভবের এই জীবন আকস্মিকভাবে বাঁক নিল পিতামহী অলকাসুন্দরীর অন্তর্জলিযাত্রায় কাটানো গঙ্গাতীরের শ্মশানের সেই রাত্রিতে। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি ব্যক্ত করেছেন সেই রাত্রির অভিজ্ঞতা "ধর্ম কি, ঈশ্বর কি, কিছুই জানি নাই, কিছুই শিখি নাই। শ্মশানের সেই উদাস আনন্দ, তৎকালের সেই স্বাভাবিক সহজ আনন্দ, মনে আর ধরে না।.... এই ঔদাস্য ও আনন্দ লইয়া রাত্রি দুই প্রহরের সময় আমি বাড়িতে আসিলাম। সে রাত্রিতে আমার আর নিদ্রা হইল না। এ অনিদ্রার কারণ আনন্দ। "পিতামহীর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন নিত্যদিনের বিলাসবহুল জীবনযাপণে সেই আনন্দ আর নেই। তাঁর সব শৌখীন বিলাসী সামগ্রী তিনি কল্পতরু হয়ে দান করে দিলেন। কিন্তু মনের অস্থিরতা দূর হলো না। একদিন প্রাতে ব্যাঙ্কে যাবার সময় তাঁর সামনে ঊড়ে এলো বইয়ের একটি ছেঁড়া পাতা। তাতে একটি সংস্কৃত শ্লোক লেখা ছিল। দেবেন্দ্রনাথ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশকে ডাকলেন শ্লোকটির  পাঠোদ্ধারের জন্য। তিনি শ্লোকটি দেখেই  জানালেন এটি ঈশোপনিষদের শ্লোক,
"ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ/তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা মা গৃধ: কস্যস্বিদ্ধনম"
ঈশ্বরের দ্বারা সমগ্র জগতকে আচ্ছন্ন করো, তিনি যাহা দান করিয়াছেন তাহাই উপভোগ করো, পর ধনে লোভ করিও না|"
উপনিষদের এই শ্লোকটি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসিকতায় এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। তিনি পার্থিব সুখ, বিলাস থেকে সব আগ্রহ হারিয়ে ঈশ্বরের  রহস্য সন্ধানে ব্রতী হলেন। তাঁর মনে হলো জাগতিক সুখ দু:খের উর্ধ্বে  গিয়ে ঈশ্বরের উপর দৃঢ বিশ্বাসে সত্যিকারের ব্রহ্মানন্দের স্বাদ পাওয়া যাবে। তিনি মহাভারত, উপনিষদ, বেদ ও যাবতীয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শন গ্রন্থপাঠে নিমগ্ন হলেন। ১৮৩৯ খৃ: বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের আলোচনা ও উপনিষদের সত্যধর্ম প্রচারের জন্য তিনি তত্ত্বরঞ্জিনী সভা প্রতিষ্টা করলেন। সেই সঙ্গে সাধারন মানুষের  মধ্যে উপনিষদের সহজবোধ্যতার জন্য কাঠোপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তত্বরঞ্জিনী সভার নাম পরিবর্তন করে তত্ববোধিনী সভা নাম রাখেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ। ১৮৪২খৃ: দেবেন্দ্রনাথ তত্ববোধিনী সভা এবং রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব নিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রচার তার আগে তেমন ছিল না। এই সমাজের সাথে যুক্ত গুটিকয়েক মানুষ অবহিত ছিলেন ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে। দেবেন্দ্রনাথের অর্থানুকূল্যে এবং অক্ষয় কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এই পত্রিকায় নিয়মিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হলো সাধারন মানুষের বোধগম্যের জন্য। এছাড়াও ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিটি সভায় বেদ পাঠ  দেবেন্দ্রনাথ আবশ্যক রীতি করলেন। সেই সময় ইংরেজি শিক্ষায় মত্ত বাঙ্গালী ছাত্রদের মনে স্বদেশী শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শন সম্বন্ধে অনাগ্রহ ছিল। তারা পাশ্চাত্ত্য ধর্ম ও দর্শনকেই অনুকরনযোগ্য বলে স্থির করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদক্ষেপ দেশের যুবশক্তিকে স্বদেশী  শাস্ত্র সম্বন্ধে এক সঠিক দিশা দেখালো। ১৮৪৩খৃ: রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর দুই ভাই ব্রজেন্দ্রনাথ এবং গিরীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিতদের জন্য হিন্দুদের পৌত্তলিক উপাসনা নিষিদ্ধ করলেন। এর পরিবর্তে ব্রাহ্মসমাজের জন্য মাঘোৎসব, নববর্ষ, দীক্ষাদিন ইত্যাদি উৎসব চালু করলেন। নিজ পরিবারে পূজা পার্বনে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ভাইদের সাথে উপস্থিত থাকতেন কিন্তু পুতুল প্রতিমার সামনে মাথা নত করতেন না।
বিষয়ের প্রতি দেবেন্দ্রনাথের আসক্তি ক্রমশ: কমে আসছিল। তিনি বেদ উপনিষদ, ঈশ্বর অনুসন্ধান ও ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বৈষয়িক তদারকির ভার তিনি কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করেছিলেন। তার ফলে  ১৮৪৬ সালে যখন দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রয়াত হলেন, ঠাকুর পরিবার বিরাট আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হলো। ঋণশোধের জন্য দেবেন্দ্রনাথ অনেকগুলি বাড়ি. শৌখীন সামগ্রী, সম্পত্তি বিক্রয় করে ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করলেন। এইসময়  বিক্রি হয়ে যায় দ্বারকানাথ ঠাকুরের অতি প্রিয় বাগানবাড়ি বেলগাছিয়ার ভিলা। দেবেন্দ্রনাথ আসলে মুক্তি চাইছিলেন বিষয় সম্পত্তির শৃঙ্খল থেকে। ব্যক্তিগত জীবনযাত্রাতেও তিনি বিলাসমুক্ত সাধারন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনোনিবেশ করলেন ব্রাহ্মধর্মের সংস্কারের দিকে।  দ্বারকানাথ ঠাকুরের  পারোলৌকিক ক্রিয়া  তিনি ব্রাহ্মমতেই করেছিলেন। এবার কন্যা সুকুমারীর বিবাহ দিলেন ব্রাহ্মমতে শালগ্রাম শিলা বর্জন করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপনয়ন হলো ব্রাহ্মমতে। রক্ষণশীল তদানীন্তন হিন্দুসমাজ থেকে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছিল কিন্তু তিনি  সমাজ ও পরিবারের কোনো বাধার কাছে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন নি। তাঁর আমলে ব্রাহ্ম সমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম বহু যুবশক্তিকে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ১৮৬৭ সালে তাঁকে মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেন। রাধাকান্ত দেব তাঁকে জাতীয় ধর্মের রক্ষক বলে অভিহিত করেছিলেন।
মহর্ষি  তদানীন্তন অবিভক্ত ভারতের বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপেও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৫১ খৃ: তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। দরিদ্র কৃষকদের উপর  ব্রিটিশ সরকারের চৌকিদারী কর মকুবের জন্য তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চিঠি পাঠান। নীলচাষিদের উপর ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের কথা শুনে তিনি নিজের জমিদারিতে নীলের চাষ বন্ধ করেদিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রতিরোধের তিনি একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। নারীশিক্ষার জন্য বেথুন স্কুলে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা সৌদামিনী ও ভাইঝি কুমুদিনীকে বেথুন স্কুলে পাঠিয়েছিলেন সমাজে অনান্য নারীদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। সামাজিক উন্নয়নের জন্য দরাজ হাতে দান করেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, কুষ্ঠাশ্রম, অনাথ আশ্রম, ব্লাইন্ড ফান্ড, মূকবধিরদের বিদ্যালয়ে, জাতীয় কংগ্রেসের জন্য, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে। সমগ্র জীবন ধরে মহর্ষি ভারতের বিভিন্ন  অঞ্চলে বিশেষত: হিমালয়ের অনেক দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এগারো বছর বয়সে মহর্ষি তাঁকে নিয়ে হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বিশ্বকবির জীবনে  পিতার সাথে এই হিমালয় যাত্রা গভীর প্রভাব ফেলেছিল। শেষ জীবনে তারাপীঠ মহাশ্মশানে সাধক ব্যামাক্ষ্যাপার সাথে সাক্ষাৎ হলে বামাক্ষ্যাপা তাঁকে ভুবনডাঙ্গার হদিস দেন। ভুবনডাঙ্গার মাঝে এক বিশাল ছাতিমগাছ দেখে মহর্ষির খুব পছন্দ হলো। তাঁর মনে হলো এই ছাতিম গাছের নীচে ধ্যানে বসলে তিনি পরম শান্তিলাভ করবেন। অতএব  রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ন সিংহের কাছ থেকে কুড়ি বিঘা জমি কিনে  শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠা হলো। পারিবারিক জীবনে দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ও রাশভারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। পুত্রদের সাথে তাঁর কন্যাদের ও পুত্রবধূদের তিনি  লেখাপড়া এবং নানান রকম আদবকায়দা শিক্ষার সুযোগ দিয়েছিলেন। তৎকালীন বঙ্গসমাজের যুবসম্প্রদায় যখন পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার অনুকরণ, বিলাসিতা ও নানা ভ্রস্টাচারে মগ্ন, সেই পরিবেশে ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সন্তানরা বাংলা শিল্প, সাহিত্য, চারুকলায় সারা বিশ্বে আলোর বার্তাবহ হয়েছিলেন।
১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারী মহর্ষি লোকান্তরিত হন। তাঁর শেষ জীবন কেটেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় আমরা তাঁর শেষ মূহুর্তের ছবি পাই "৬ই মাঘ সকালবেলায় তিনি আর উঠতে পারলেন না, ঘরেই বিছানায় শুয়ে রইলেন। বাবা তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্রমান্বয়ে উপনিষদের মন্ত্রপাঠ করতে লাগলেন।.... শুনতে শুনতে দুপুরবেলায় তিনি শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল একটি পরম আনন্দ ও পরম শান্তি। "নিমতলার শ্মশানঘাটে সাদা ফুলে সজ্জিত মহর্ষিকে ব্রাহ্মমতে শেষ বিদায় জানালেন পরিবার ও অসংখ্য দেশবাসী।

পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

গল্প ও সাহিত্য

 

মহর্ষির উপাখ্যান

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়

 

ছবিঃ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

সে ছিল এক পূর্ণিমার রাত। অবিরাম ঝরে পড়া গলানো রূপালি জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে সমগ্র চরাচর। স্থান নিমতলার গঙ্গাতীর, সন১৮৩৮। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মহাশয়ের মাতৃদেবী অলকাসুন্দরীর  গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে|নিমতলা ঘাটে গঙ্গাতীরে কয়েকদিন ধরেই মরণাপন্না গঙ্গাযাত্রীর কাছে জোর নামসংকীর্তন চলছে তৎকালীন রীতি অনুসারে। কাছেই নিমতলাঘাটে একটি চাটাইয়ের উপর স্থির হয়ে বসে আছেন এক অনিন্দ্যকান্তি রূপবান যুবক। তাঁর পরনের আচকান, মাথার পাগড়ি, পায়ের জুতো সবকিছুতেই লেগে আছে এক অভিজাত স্পর্শ। উদাসভাবে, নিস্পলক নেত্রে তিনি তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। চারপাশের কোনো কিছুই যেন তাঁর মনোযোগ ভাঙ্গতে পারছে না। খুব মৃদু কলতানে জ্যোস্না মেখে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গানদী। তাঁর মনে হলো সুখ, ভোগ,স্বাচ্ছন্দ্য, ঐশ্বর্য এইসবের কি আদৌ কোনো মূল্য আছে?  এই নদী.. এই জ্যোস্না... এই রাত্রির নীরব সৌন্দর্য.. সবকিছু মিলিতভাবে  যে এক অভূতপূর্ব আনন্দ  এনে দিল তাঁর মনে সেতো অমূল্য|যেন এক বিশাল মুক্তি  তাঁকে ডাক দিয়ে গেল বার বার। শ্মশানের উদাস পরিবেশে এক আনন্দজ্যোস্না রাত্রি তাঁর মনে চিরস্থায়ী প্রভাব রেখে গেল।
যুবকের নাম বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রথম সন্তান। ১৮১৭খৃ: কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম| শৈশবে পিতামহী অলকাসুন্দরীর স্নেহে যত্নে তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন। ১৮২৩ সালে হাতেখড়ির পর চন্ডীমন্ডপের পাঠশালায় দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষা শুরু হয়। রাজা রামমোহন রায়ের অনুরোধে দ্বারকানাথ পরবর্তীকালে পুত্রকে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত আংলো স্কুলে পাঠালেন। রামমোহন রায়  এই বন্ধুপুত্রটিকে বিশেষ ভাবে স্নেহ করতেন। দেবেন্দ্রনাথ ও রাজা রামমোহন রায়ের আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের অনুরাগী ছিলেন। রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে দেবেন্দ্রনাথ ১৮৩০সালে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হলেন। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি ও পারসি ভাষা শেখার জন্য দ্বারকানাথ  তাঁর জন্য শিক্ষক নিয়োগ করেন। একটু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁকে শিখতে হয়েছিল ব্যায়াম, সংগীত ও পিয়ানো। তৎকালীন পারিবারীক নিয়ম অনুসারে মাত্র সতের বছর বয়সে যশোরের দক্ষিণডিহির রামনারায়ন রায়চৌধুরীর কন্যা শাকম্ভরী বা সারদাসুন্দরীর সাথে তাঁর বিবাহ দেওয়া হলো। সেই বছরেই দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথকে ইউনিয়ন ব্যাংকের তহবিলের হিসেবপত্র মেলানোর কাজ শেখার জন্য পাঠান। ধনী পিতার রূপবান ছেলের জন্য বিলাস ব্যসনের প্রাচুর্য দেবেন্দ্রনাথকে ঘিরে ধরেছিল। কলকাতা শহরে তাঁর 'বাবু' খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর বেশভূষা, আচার আচরন সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করতো। দেবেন্দ্রনাথ নিজেও খুব শৌখীন ছিলেন। কলকাতা শহরের সব সন্দেশ ও গাঁদাফুল দেবেন্দ্রনাথ কিনে নিয়েছিলেন তাঁর সরস্বতী পূজার জন্য। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করে নানারকম গীত বাদ্য আমোদ প্রমোদে প্রতিমা নিরঞ্জন হতো| বিলাসী হলেও দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন মার্জিত রুচির অধিকারী। কথিত আছে একবার শোভাবাজার রাজবাড়ীর এক অনুষ্ঠানে ধনী ব্যক্তিরা নানান রকম মূল্যবান অলংকার ও জরিখচিত মহার্ঘ পোশাক পড়ে সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের পরনের ধবধবে  শ্বেতবস্ত্রে কোন জরি বা চুমকি ছিল না, কিন্তু তাঁর পায়ে ছিল মহার্ঘ মুক্তা বসানো দামী জুতো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন "শ'বাজারের রাজামশাই ছিলেন কর্তাদাদামশায়ের বন্ধু... তিনি তখন... কর্তাদাদামশায়ের পায়ের দিকে ইশারা করে বললেন, "দেখ তোরা দেখ, একবার চেয়ে দেখ এদিকে, একেই বলে বড়লোক| আমরা যা গলায় মাথায় ঝুলিয়েছি ইনি তা পায়ে রেখেছেন।"
বিলাস বৈভবের এই জীবন আকস্মিকভাবে বাঁক নিল পিতামহী অলকাসুন্দরীর অন্তর্জলিযাত্রায় কাটানো গঙ্গাতীরের শ্মশানের সেই রাত্রিতে। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি ব্যক্ত করেছেন সেই রাত্রির অভিজ্ঞতা "ধর্ম কি, ঈশ্বর কি, কিছুই জানি নাই, কিছুই শিখি নাই। শ্মশানের সেই উদাস আনন্দ, তৎকালের সেই স্বাভাবিক সহজ আনন্দ, মনে আর ধরে না।.... এই ঔদাস্য ও আনন্দ লইয়া রাত্রি দুই প্রহরের সময় আমি বাড়িতে আসিলাম। সে রাত্রিতে আমার আর নিদ্রা হইল না। এ অনিদ্রার কারণ আনন্দ। "পিতামহীর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন নিত্যদিনের বিলাসবহুল জীবনযাপণে সেই আনন্দ আর নেই। তাঁর সব শৌখীন বিলাসী সামগ্রী তিনি কল্পতরু হয়ে দান করে দিলেন। কিন্তু মনের অস্থিরতা দূর হলো না। একদিন প্রাতে ব্যাঙ্কে যাবার সময় তাঁর সামনে ঊড়ে এলো বইয়ের একটি ছেঁড়া পাতা। তাতে একটি সংস্কৃত শ্লোক লেখা ছিল। দেবেন্দ্রনাথ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশকে ডাকলেন শ্লোকটির  পাঠোদ্ধারের জন্য। তিনি শ্লোকটি দেখেই  জানালেন এটি ঈশোপনিষদের শ্লোক,
"ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ/তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা মা গৃধ: কস্যস্বিদ্ধনম"
ঈশ্বরের দ্বারা সমগ্র জগতকে আচ্ছন্ন করো, তিনি যাহা দান করিয়াছেন তাহাই উপভোগ করো, পর ধনে লোভ করিও না|"
উপনিষদের এই শ্লোকটি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসিকতায় এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। তিনি পার্থিব সুখ, বিলাস থেকে সব আগ্রহ হারিয়ে ঈশ্বরের  রহস্য সন্ধানে ব্রতী হলেন। তাঁর মনে হলো জাগতিক সুখ দু:খের উর্ধ্বে  গিয়ে ঈশ্বরের উপর দৃঢ বিশ্বাসে সত্যিকারের ব্রহ্মানন্দের স্বাদ পাওয়া যাবে। তিনি মহাভারত, উপনিষদ, বেদ ও যাবতীয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শন গ্রন্থপাঠে নিমগ্ন হলেন। ১৮৩৯ খৃ: বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের আলোচনা ও উপনিষদের সত্যধর্ম প্রচারের জন্য তিনি তত্ত্বরঞ্জিনী সভা প্রতিষ্টা করলেন। সেই সঙ্গে সাধারন মানুষের  মধ্যে উপনিষদের সহজবোধ্যতার জন্য কাঠোপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তত্বরঞ্জিনী সভার নাম পরিবর্তন করে তত্ববোধিনী সভা নাম রাখেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ। ১৮৪২খৃ: দেবেন্দ্রনাথ তত্ববোধিনী সভা এবং রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব নিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রচার তার আগে তেমন ছিল না। এই সমাজের সাথে যুক্ত গুটিকয়েক মানুষ অবহিত ছিলেন ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে। দেবেন্দ্রনাথের অর্থানুকূল্যে এবং অক্ষয় কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এই পত্রিকায় নিয়মিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হলো সাধারন মানুষের বোধগম্যের জন্য। এছাড়াও ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিটি সভায় বেদ পাঠ  দেবেন্দ্রনাথ আবশ্যক রীতি করলেন। সেই সময় ইংরেজি শিক্ষায় মত্ত বাঙ্গালী ছাত্রদের মনে স্বদেশী শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শন সম্বন্ধে অনাগ্রহ ছিল। তারা পাশ্চাত্ত্য ধর্ম ও দর্শনকেই অনুকরনযোগ্য বলে স্থির করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদক্ষেপ দেশের যুবশক্তিকে স্বদেশী  শাস্ত্র সম্বন্ধে এক সঠিক দিশা দেখালো। ১৮৪৩খৃ: রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর দুই ভাই ব্রজেন্দ্রনাথ এবং গিরীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিতদের জন্য হিন্দুদের পৌত্তলিক উপাসনা নিষিদ্ধ করলেন। এর পরিবর্তে ব্রাহ্মসমাজের জন্য মাঘোৎসব, নববর্ষ, দীক্ষাদিন ইত্যাদি উৎসব চালু করলেন। নিজ পরিবারে পূজা পার্বনে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ভাইদের সাথে উপস্থিত থাকতেন কিন্তু পুতুল প্রতিমার সামনে মাথা নত করতেন না।
বিষয়ের প্রতি দেবেন্দ্রনাথের আসক্তি ক্রমশ: কমে আসছিল। তিনি বেদ উপনিষদ, ঈশ্বর অনুসন্ধান ও ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বৈষয়িক তদারকির ভার তিনি কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করেছিলেন। তার ফলে  ১৮৪৬ সালে যখন দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রয়াত হলেন, ঠাকুর পরিবার বিরাট আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হলো। ঋণশোধের জন্য দেবেন্দ্রনাথ অনেকগুলি বাড়ি. শৌখীন সামগ্রী, সম্পত্তি বিক্রয় করে ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করলেন। এইসময়  বিক্রি হয়ে যায় দ্বারকানাথ ঠাকুরের অতি প্রিয় বাগানবাড়ি বেলগাছিয়ার ভিলা। দেবেন্দ্রনাথ আসলে মুক্তি চাইছিলেন বিষয় সম্পত্তির শৃঙ্খল থেকে। ব্যক্তিগত জীবনযাত্রাতেও তিনি বিলাসমুক্ত সাধারন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনোনিবেশ করলেন ব্রাহ্মধর্মের সংস্কারের দিকে।  দ্বারকানাথ ঠাকুরের  পারোলৌকিক ক্রিয়া  তিনি ব্রাহ্মমতেই করেছিলেন। এবার কন্যা সুকুমারীর বিবাহ দিলেন ব্রাহ্মমতে শালগ্রাম শিলা বর্জন করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপনয়ন হলো ব্রাহ্মমতে। রক্ষণশীল তদানীন্তন হিন্দুসমাজ থেকে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছিল কিন্তু তিনি  সমাজ ও পরিবারের কোনো বাধার কাছে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন নি। তাঁর আমলে ব্রাহ্ম সমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম বহু যুবশক্তিকে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ১৮৬৭ সালে তাঁকে মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেন। রাধাকান্ত দেব তাঁকে জাতীয় ধর্মের রক্ষক বলে অভিহিত করেছিলেন।
মহর্ষি  তদানীন্তন অবিভক্ত ভারতের বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপেও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৫১ খৃ: তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। দরিদ্র কৃষকদের উপর  ব্রিটিশ সরকারের চৌকিদারী কর মকুবের জন্য তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চিঠি পাঠান। নীলচাষিদের উপর ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের কথা শুনে তিনি নিজের জমিদারিতে নীলের চাষ বন্ধ করেদিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রতিরোধের তিনি একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। নারীশিক্ষার জন্য বেথুন স্কুলে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা সৌদামিনী ও ভাইঝি কুমুদিনীকে বেথুন স্কুলে পাঠিয়েছিলেন সমাজে অনান্য নারীদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। সামাজিক উন্নয়নের জন্য দরাজ হাতে দান করেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, কুষ্ঠাশ্রম, অনাথ আশ্রম, ব্লাইন্ড ফান্ড, মূকবধিরদের বিদ্যালয়ে, জাতীয় কংগ্রেসের জন্য, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে। সমগ্র জীবন ধরে মহর্ষি ভারতের বিভিন্ন  অঞ্চলে বিশেষত: হিমালয়ের অনেক দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এগারো বছর বয়সে মহর্ষি তাঁকে নিয়ে হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বিশ্বকবির জীবনে  পিতার সাথে এই হিমালয় যাত্রা গভীর প্রভাব ফেলেছিল। শেষ জীবনে তারাপীঠ মহাশ্মশানে সাধক ব্যামাক্ষ্যাপার সাথে সাক্ষাৎ হলে বামাক্ষ্যাপা তাঁকে ভুবনডাঙ্গার হদিস দেন। ভুবনডাঙ্গার মাঝে এক বিশাল ছাতিমগাছ দেখে মহর্ষির খুব পছন্দ হলো। তাঁর মনে হলো এই ছাতিম গাছের নীচে ধ্যানে বসলে তিনি পরম শান্তিলাভ করবেন। অতএব  রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ন সিংহের কাছ থেকে কুড়ি বিঘা জমি কিনে  শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠা হলো। পারিবারিক জীবনে দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ও রাশভারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। পুত্রদের সাথে তাঁর কন্যাদের ও পুত্রবধূদের তিনি  লেখাপড়া এবং নানান রকম আদবকায়দা শিক্ষার সুযোগ দিয়েছিলেন। তৎকালীন বঙ্গসমাজের যুবসম্প্রদায় যখন পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার অনুকরণ, বিলাসিতা ও নানা ভ্রস্টাচারে মগ্ন, সেই পরিবেশে ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সন্তানরা বাংলা শিল্প, সাহিত্য, চারুকলায় সারা বিশ্বে আলোর বার্তাবহ হয়েছিলেন।
১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারী মহর্ষি লোকান্তরিত হন। তাঁর শেষ জীবন কেটেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় আমরা তাঁর শেষ মূহুর্তের ছবি পাই "৬ই মাঘ সকালবেলায় তিনি আর উঠতে পারলেন না, ঘরেই বিছানায় শুয়ে রইলেন। বাবা তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্রমান্বয়ে উপনিষদের মন্ত্রপাঠ করতে লাগলেন।.... শুনতে শুনতে দুপুরবেলায় তিনি শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল একটি পরম আনন্দ ও পরম শান্তি। "নিমতলার শ্মশানঘাটে সাদা ফুলে সজ্জিত মহর্ষিকে ব্রাহ্মমতে শেষ বিদায় জানালেন পরিবার ও অসংখ্য দেশবাসী।

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top