সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

একথালা ভাত : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
১৭ জুলাই ২০২১ ২২:২১

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ০৯:০৬

 

খুব সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গলো জয়নালের; এখনও বাইরে আলো ফোটেনি। জয়নাল শুয়ে থেকেই পাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকায়। শেষরাতে বৃষ্টি হয়েছে মনে হয়, শীত শীত লাগছে তার।পেটের মধ্যে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে, নিজের উদাম পেটে হাত বুলাতেই মনে পড়ে পড়শু দুপুরের পরে আর তেমন কিছু খাওয়া হয় নি। খাওয়া হয়নি মানে রোজ রোজ খেতে কে দেবে, কাজ নেই, টাকা নেই, বাপের এই ভিটে টুকু ছাড়া কিছু নেই। আর সে ভিটে? একটুকরো জমির ওপর ছোট্ট পাতার ঘর এ পর্যন্তই। জয়নাল আর  তার মা এতকাল এখানে থেকেছে। মা’র বয়স হয়ে গেছিল তেমন কিছু কাজ করতে পারতো না, তাও আশেপাশের বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যেই ডাক পড়ত খই, মুড়ি ভাজা, ডাল ভাঙ্গা, পীঠা বানানো ইত্যাদি কাজে। জয়নাল রোজ দিন হিসেবে কামলা খাটত। বাড়ি থেকে দশ বারো কিলো দূরত্বে শহর, রোজ শেয়ারের অটোতে পাঁচটাকা ভাড়া দিয়ে সকাল সকাল শহরে চলে যেত। শহরে সকালে না পৌঁছুলে কাজ পাওয়া মুশকিল। তবে তার কাজের কোনো ঠিক ঠিকানা ছিলনা, যে দিন যে কাজ: একদিন রাজমিস্ত্রির জোগাল তো তার পরের দিন বাঁশের বেড়া বোনা, আবার হয়তো তার পরের দিন মাটি কাটা বা ঠেলা বয়ে নিয়ে যাওয়া।কিন্তু সেটাও এখন অতীত, করোনার কারনে কাজ পাওয়া যায়না তেমন, তাছাড়া গত বিশ-বাইশ দিন আগে মা মারা গেছে। মাকে শহরের হাসপাতালেও রাখতে হলো কয়েকদিন, বেশ ধার কর্জও হয়ে গেছে তাতে। জয়নাল সাধ করে একটা মোবাইল কিনেছিল কয়েকমাস অগে, বেশ রেডিও শোনা যেত, সেটাও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। জয়নাল বিছানা ছেড়ে উঠে বসে, কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে, খালি পেটে আর কতক্ষন! বিছানা ছেড়ে উঠে জয়নাল হাড়ি কুড়ি হাতায়, কোথাও কিছু খাওয়ার মত আছে কিনা। যদিও গত সাত দিনে অসংখ্যবার সে এগুলো হাতিয়ে দেখেছে, তলা শূন্য, তবুও অভ্যাস বশতঃ একই কাজ করে। বেড়ার সাথে বাঁধা দড়িতে ঝুলানো প্যান্টটা পরতে গিয়ে দেখে সেটা কোমর ছেড়ে নেমে যাচ্ছে, তাই দড়িটা দা দিয়ে কেটে কোমড়টা শক্ত করে বেঁধে নেয়।বেড়ার দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে তার হাসি পায়, মনে মনে ভাবে কেন সে দরজা আটকাচ্ছে চোর তো দূরের কথা, বিড়াল, কুকুর নষ্ট করার মতও কিছু নেই এখানে।

জয়নাল হাতে দা টা নিয়ে হাটতে হাটতে বাগানের দিকে যায় কোনো কিছু পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজে। বাগানটা জয়নালের বাপ চাচাদের ছিল একসময়। অভাবের তাড়নায় সে সব বিক্রি হয়েছে অনেকদিন। বাগানের মালিক সুপুরির দিনে বাগানে পাহাড়া বসায়, এজন্য ওদিকে খুব একটা যায়না কেউ। জয়নাল পুকুর পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় উপরে তাকায় কোনও গাছে কিছু পাওয়া যায় কিনা। একটা জংলি জাম গাছ থেকে একথোকা পাকা জাম ছিড়ে মুখে দেয়। 'ইস্ কি কষ!' মুহূর্তে মুখ বিকৃত হয় তার। থুক করে ফেলে দেয়। বাদাম গাছ দুটোর তলায় বাদুরে খাওয়া বাদাম পড়ে আছে বেশ অনেকগুলো, কোমরের গামছা খুলে কুড়িয়ে নেয় কিছু, তারপর বাগান পেরিয়ে মোল্লাদের ধান ক্ষেতের আল ধরে কিছুদূর হেঁটে শান বাঁধানো একটা টিউব ওয়েলের পাশে বসে বাদাম গুলো কাটে। টিউব ওয়েল থেকে পানি খেয়ে মোটামুটি পেট ভরে নিয়ে পাশের সিরিষ গাছের তলায় বসে বাদাম গুলো খেতে খেতে আকাশে চেয়ে থাকে। শ্রাবন মাস চলছে কিন্তু এবার বৃষ্টি তেমন হয়নি। গাঢ় নীল বর্নের পরিষ্কার আকাশ। দুটো চিল পাখা মেলে দিয়ে বাতাসে ভাসছে নিশ্চিন্তে। অন্য সময় হলে জয়নাল চিলের ডানায় ভাসতে ভাসতে কোথা থেকে কোথায় চলে যেত কিন্তু আজ চোখের সামনে বারবার কেবল একথালা ভাতের ছবি ভেসে উঠছে, কতদিন পেট পুরে খাওয়া হয়নি! একটুকরো মাছ, ডাল, শুটকি ভর্তা মনে করতেই তার জিভে পানি আসে। না আর বসে থাকলে চলবেনা,একথালা ভাতের জোগাড় আজ করতেই হবে। জয়নাল উঠে শহরের পথে হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূর গিয়ে পাশের গ্রামের মিজানের সাথে দেখা হয়। মিজান ভ্যানে করে কাঁঠাল নিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে। জয়নাল ডাক দেয়,


- মিজান কই যাইস?
- সরকারি কলোনীতে। কাঁঠাল দিয়া আসতে হইব
- আমারে একটু ভ্যানে নিবি

মিজান এক মুহূর্ত কি চিন্তা করে, ভ্যান ওয়ালাকে থামতে বলে পাশে সরে বসে জয়নালকে বলে,


- আয়। হুনলাম তর মায়ে মরছে।
- হ
- কাজ কাম কিছু করতাছোস?
- না এহনো শুরু করি নাই। আইজ দেহি কিছু পাই কিনা….

শহরে ঢুকে নিউমার্কেট ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে জয়নালকে নামিয়ে দেয় মিজান। জয়নাল উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে। এদিকটাতে দোকান পাট তেমন খোলা নাই, লেকজনও কম। জয়নালের পেটে ক্ষুধাটা আবার জানান দেয়। সামনে একটা মুদির দোকান, খোলা। অনেকক্ষণ ধরে দোকানে কোন ক্রেতা নাই।দোকানের ভিতরেওতো মনে হয় কেউ নাই। দোকানের পিছনে একটা বড় বাড়ি , বেশ ক’টি দোতালা টিনের ঘর। জয়নাল সাহস করে সামনে এগিয়ে যায়। ভাবে, না দোকান খালি ফেলে রেখে দোকানদার বেশী দূরে কোথাও যাওয়ার কথা নয়, হয়তো আশে পাশেই কোথাও আছে। দোকানদার থাকলে তার কাছ চাইলে হয়ত একটা কিছু ঠিকই পাওয়া যেত। জয়নালের চোখ কলার কাঁদিতে আটকে যায়, ক্ষিদের বোধটাও ফিরে আসে। সে দোকানের সামনের দিকে ঝুলানো বিচি কলার ফানা থেকে দুটো কলা আর একটা মুরির টিন নিয়ে যেই সরে পরবে অমনি পাশের কোনও এক বাড়ি থেকে শুনতে পেল,


- বিকালে তোর ট্য়াকা লইয়া যাইস। আর শোন বাজারে গেলে কেরেস তেল নিতে ভুলিস না
- আইচ্ছা...


জয়নাল উঁকি দিয়ে দেখলো দোকানটা কাঠের পাটাতনের উপরে, যদিও এপাশে বেশ কিছু হাগড়া, আর কাঁটা বেগুন গাছ তবে নীচটা শুকনো। জয়নাল আর দেরী করলোনা। মুরির টিন, কলা সমেত দোকানের পাটাতনের নীচে ঢুকে পড়ল। গাছ গুলোর জন্য ঢোকার সময় একটু অসুবিধা হলেও জয়নাল মনে মনে খুশীই হল। "যাউক বাইরে থেকে দেহা যাইতেছে না।" সময় নষ্ট না করে জয়নাল মুড়ির টিন খুলে বসল। মাত্র দুই মুঠ মুখে পড়েছে অমনি দোকানের মধ্যে থেকে আওয়াজ আসলো,


- খচ খচ করতাছে কি? ইন্দুর হানলো নাহি?


জয়নাল উপরে এটা ওটা নাড়ার আওয়াজ পেল কিছুক্ষন, তারপর সব চুপ। জয়নাল আবার খাওয়ায় মন দিল। মুড়ির টিনে হাত ঢুকালেই শব্দ হচ্ছে। জয়নাল যথাসম্ভব আস্তে শব্দ না করে মুড়ি বের করতে লাগল। কিন্তু শুকনো মুড়ি হঠাৎই জয়নালের শ্বাস নালিতে আটকে গেলে জয়নাল বেকায়দায় পরে গেল, কয়েকটা কাশি দিতে বাধ্য হল। এতক্ষনে দোকানদার জয়নালের অবস্থান টের পেয়ে গেছে। দোকানের নীচে উঁকি দিয়ে যখন সে জয়নালকে দেখল জোরে জোরে চোর চোর বলে চিৎকার করতে লাগলো। জয়নাল দোকানের নীচ থেকে বের হয়ে দৌড় দেবার চেষ্টা করতেই লোকটা জয়নালকে জাপটে ধরে ফেলল। এর মধ্যে লোকজন জমা হয়ে গেছে সেখানে। জয়নালের গায়ের উপরে চড় থাপ্পর, লাথি পড়তে লাগলো বিরতিহীন। কেউ কেউ গালি দিতে লাগলো, "শালা চোর, দিন দুপুরে চুরি, কত্ত সাহস! আর কি কি নিছোস, কই রাখসোছ, ক’ শিগ্গির”। একটা মোটা কালো মত লোক একটা চ্যালা কাঠ ভাঙ্গল জয়নালকে পিটিয়ে। জয়নাল কযেকবার বলার চেষ্টা করেছে, সে চোর না,একান্ত পেটের দায়ে কয়টা মুড়ি আর একটা কলা খেয়েছে এখনো একটা কলা আর মুড়ির টিন টা দোকানের তলায় পরে আছে , কিন্তু এখানে কে কার কথা শোনে। মারের চোটে জয়নালের হাত পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে কিন্তু এদের কারো মনে একটু দয়া হচ্ছেনা। হঠাৎই কেউ একজন বলল, "সুঁই লইয়া আয়, আঙ্গুল ফুডা করমু, কইব না আবার, পেডের কথা সব ভরভরাইয়া বাইর হইব। ওই জাহাঙ্গীর কলা পাতাও আনিস..."। একটু পরে একটা পনের ষোল বছরের ছেলে সুঁই আর কলাপাতা নিয়ে হাজির হল। জয়নালের ভিতর সুঁই দেখেই কাঁপুনি উঠল। মোটা লোকটা খেঁকিয়ে উঠল,


- ওই জাহাঙ্গীররা তোরে একটা সুঁই আনতে কইছি? যা আরও পাঁচটা লই আয়।  


জাহাঙ্গীর নমের ছেলেটি যেদিক দিয়ে এসেছিল আবার সেদিকে দৌড়ে গেল। জয়নালের ছেলেটির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মোটা লোকটি জয়নালের সামনে দুটো ইট রেখে তার উপরে কলা পাতা বিছিয়ে দিয়ে জয়নালের উদ্দশ্যে বললো


- হাত রাখ
- মাফ করেন ভাই, আর করুম না
- করুম না কি? হাত থুইতে কইছি থো
- পারুম না ভাই, মইরা যামু
- ওই সত্তার, হেরে চাইপ্পা ধরতো


সত্তার এসে জয়নালের হাত ইটের উপর চেপে ধরে, মোটা লোকটা জয়নালের মাঝের আঙ্গুলের নখ বরাবর সুঁই ঢুকাতে যায়, জয়নালের গগনবিদারী চিৎকারের সাথে কয়েক ফোঁটা তাজা রক্ত কলাপাতায় গড়িয়ে পড়ে। জয়নালের কাছে নিজের শরীরটা হালকা মনে হচ্ছে এখন, কোনও ব্যাথার বোধ নাই,কিন্তু একটু আগেও জ্বালা হচ্ছিল সারা গায়ে ।জয়নালের মনে হল, সে জ্ঞান হারাচ্ছে, চোখ বন্ধ করতে করতে এতগুলো মানুষের মাথা ছাড়িয়ে একফোঁটা মুক্ত আকাশে  তাকালো সে। আকাশের মেঘগুলো কেমন ভাতের থালার মত দেখাচ্ছে, মায়ের মুখটাও বেশ ফুটে উঠলো আকাশের গায়ে। থালা ভর্তি ভাত নিয়ে মা বসে আছে,ভাতের পাশে শাক, মাছের সালুন, ডাল...।জয়নাল মাকে বলে "মা একথাল ভাত খামু, খুব ক্ষিদা লাগছে। " জয়নালকে বিড়বিড় করতে দেখে মোটা লোকটা তার মুখের কাছে কান পাতে, কপাল কুঁচকে, চোখ ছোট করে বিশেষ ভঙ্গি করে শোনার চেষ্টা করতে করতে বলে,


- এইতো কইতাসে, কইছিলাম না কতা বাইর হইব


হঠাৎ কি যেন হয়, জয়নালের চোখের সামনে সব আলো একসাথে মিলে গিয়ে একটা বিন্দুতে পরিনত হয়, জয়নাল মাটিতে ঢলে পড়ে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top