সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

কুড়ি কুঁড়ির কেরামতি : স্বপন নাগ


প্রকাশিত:
২৪ জুলাই ২০২১ ২২:১৯

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৪

ছবিঃ : স্বপন নাগ


[একটি মাত্র চন্দ্রবিন্দু যোগে একটি শব্দ কেমন পাল্টে ফেলে তার অর্থ, তার উদাহরণ বাংলা ভাষায় বড় একটা কম নেই। চন্দ্রবিন্দু শিরোধার্য করে পাজি হয়ে যায় পাঁজি, চাপা হয়ে যায় চাঁপা... শুধু উচ্চারণের অনুনাসিক বৈচিত্র্যই নয়, তৈরি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক একটি শব্দ। পো-পোঁ, চাই-চাঁই, গায়ের-গাঁয়ের এমনতর কত শব্দই বাংলায় আছে, একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে চন্দ্রবিন্দু- ভূমিকাটিকে হেলাফেলা করা দূরের কথা বরং মন তাকে সমীহ করতেই চায়। নিটোল কোনো গল্প নয়, শব্দে শব্দে চন্দ্রবিন্দুর কেরামতিতে ভোল পাল্টানো এরকমই বেশ কিছু শব্দকে নিয়ে লেখা নিছকই একটি রম্যগদ্য ]

প্রভঞ্জনবাবুর মত শৌখিন লোক এ তল্লাটে খুব বেশি নেই। তার চালচলনের বৈশিষ্ট্যই তাকে বিখ্যাত করেছে। কেউ কেউ আড়ালে তাকে পাজি লোকও বলে। আমি অবিশ্যি তার মধ্যে তেমন কিছু দেখিনি। কতটা শৌখিন, একটু দিনচর্চার বিবরণ দিলেই স্পষ্ট হবে। সকালে নিয়মিত মুগুর ভাঁজার অভ্যেস এখনও বজায় রেখেছেন তিনি। প্রতিদিন দাড়ি কাটা, ব্যবহারের জন্য রুমাল নিজহাতে কাচা, সকাল সকাল ড্রইং রুমে মশা তাড়ানোর জন্য সুগন্ধি ধূনোর ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেওয়া তার রোজকার রুটিন। গত কুড়ি বছর ধরে কোনো বাধায়ই তার এই রুটিনে দাঁড়ি পড়তে দেখিনি। ভাজা নয়, ব্রেকফাস্টে ভেজানো ছোলা খাওয়া একেবারে ধরাবাঁধা। তারপর লালবাজার থেকে কিনে আনা দামি চায়ের লিকারে তৃপ্তির চুমুক। 

স্বল্পাহারী প্রভঞ্জনবাবুর শখ মাছ ধরার। ধরেন, কিন্তু খান না। তবে রবিবার নিয়ম করে তিনি সকাল সকাল ফোন করেন ফয়জানকে, 'আটটার মধ্যে গর্দানের এক কেজি পাঠা।' ফয়জানও জানে, প্রভঞ্জনবাবুর পছন্দ খাসি নয়, কচি পাঁঠা। সেইমত প্রতি রোববার প্রভঞ্জনবাবুর বাড়িতে সকালেই এক কেজি পাঁঠার মাংস পাঠাতে কখনো ভুল হয় না ফয়জানের। 

বাগানবাড়ির গাছপালা ঘেরা বড় পুকুরে সপ্তাহের একটা দিন শুধু মাছ ধরার শখেই ব্যয় করেন তিনি। এই দিনটিতে তার সঙ্গী হয় টোকেন। তার গাঁ অন্য, বেগমগঞ্জ। মাইল সাতেক দূর। টোকেন হেঁটেই আসে। এতদিন ধরে আসতে আসতে এইটুকু হাঁটা তার গা সওয়া হয়ে গেছে।

টোকেনের কাজ আগের দিন, মানে শনিবার ছিপ ফেলার পরিবেশকে শান্ত ও নির্বিঘ্ন করতে পুকুর পাড় ও আশপাশ সরেজমিন তদন্ত করা। দরকার মত যত্রতত্র কাঁটাঝোপ কাটা, কেটে সাফ করা। ছিপ নিয়ে বসার জায়গাটিকে যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করা। পশ্চিম কোণে একটা চাঁপা গাছের গোড়ায় ছিপ ফেলার আসনের মজবুতির উইকলি ইন্সপেকশন করা। তারপর পুকুরের চারপাশে তিন পাক প্রদক্ষিণশেষে ঈশাণ কোণে সামান্য পুজো আচ্চার আয়োজন করা। উপকরণও যৎসামান্য। কুড়িটি আকন্দ কুঁড়ি, অল্প মাছের আঁশ, কাঁচা হলুদ আর আঘাটার একদলা কাদা-পাঁক। মেছো ভূতেদের থেকে নিষ্কৃতি পেতে পুকুরকে আগের দিন থেকেই মন্ত্রপূত করে রাখার সামান্য আয়োজন। বহুদিন ধরে টোকেন এ কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে আসছে। জনশূন্য পুকুর প্রদক্ষিণ করতে করতে টোকেন নিচুস্বরে ছড়া কেটে মন্ত্র পড়ে -

'পোঁ ধরেছে ভূতের পো
কী জ্বালাতে জ্বলি গো
যদি তোরা নিতে চাস
মাছ নয়, নে মাছের আঁশ
ছাড় এখুনি নাছোড় গোঁ
হেই ভূত হেই ভূতের পো !'

মন্ত্র পড়া হলে আকন্দ কুঁড়ি আর মাছের আঁশ একটা কাগজে মুড়ে টোকেন যত্ন করে পুকুরে ভাসিয়ে দেয়।

এই টোকেনের নাম টোকেন কেন কেউ জানে না। সে প্রভঞ্জনবাবুর দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত সাগরেদ। সপ্তাহের দুটো দিন বাদে টোকেনের সঙ্গে অবশ্য প্রভঞ্জনবাবুর কোনো যোগ থাকে না। বাকি দিনগুলো বেগমগঞ্জে টোকেন মুক্ত বিহঙ্গ। সকাল সন্ধেয় মদেই ডুবে থাকে। শনি আর রবিবারের টোকেনকে দেখলে কে বলবে সে একটা পাঁড় মাতাল ! এই দুটো দিন সে একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা। তাকে নিয়ে কোনো কৌতূহল দেখালে বেশ টনটনে জবাব দেয় সে -- 'খাঁটি মানুষ, টাকাপয়সার খাঁই নাই, খাটি আর খাই, ব্যস্ !' টোকেনের চেহারাও আজব রকমের। কোনো ছিরিছাঁদ নেই। হাত-পা সরু সরু। মাথাটা বিভৎস রকমের বড়। তার ওপর ঝাঁকরা চুলে ভরা। গায়ের রংটাও অতি শ্যাম। তাকে নিয়ে গাঁয়ে অনেক রকম গল্পগাথা চালু আছে। কমবয়স থেকেই রাতের তিন প্রহর থেকে ছাদে উঠে টানা দুতিন ঘন্টা শীর্ষাসন করার শখ ছিল তার। বারোমাস। সেই শখের খেসারতেই নাকি তার এই আজব চেহারাপ্রাপ্তি।

তাতে কী ! এই টোকেনের ওপর প্রভঞ্জনবাবুর অগাধ ভরসা। পাঁজি দেখে শুভ লগ্ন নির্ধারণের অবিশ্বাস্য বিদ্যে টোকেনের। তার সেই গুণকে প্রশ্নাতীত সমর্থনের ব্যাপারে প্রভঞ্জনবাবু একটু গোঁড়া। ঠিক কটা বেজে ক' মিনিটে মাছের জন্য প্রথম টোপখানি জলস্পর্শ করবে, তার নিদান দিত টোকেন। মোক্ষম রেজাল্ট পেয়ে প্রভঞ্জনবাবুও এতদিন ধরে আশ মিটিয়ে ছিপ ফেলে আসছেন এবং দিনের শেষে অব্যর্থভাবে মাছ শিকার করছেন।

আজ কী হলো ! সূর্য ডুবে বেলা শেষ হতে চলল, বঁড়শিতে মাছ গাঁথা তো দূর অস্ত্, ফাৎনা নড়ারও লক্ষণ নেই। ক্লান্ত অবসন্ন হতাশ প্রভঞ্জনবাবু টোকেনকে ডাকলেন, 'টোকেন।'

টোকেন অপরাধীর মত নতমস্তকে চাপা স্বরে বলল, 'আজ্ঞে।'

রাগ নয়, অভিমানের স্বরে, পরাস্ত কন্ঠে প্রভঞ্জনবাবু বললেন, 'টোকেন, এমন তো কোনদিন হয়নি। আজ কেন হলো, তার কারণটা জানা চাই।'

কুড়িটি কুঁড়ির কেরামতি ফেল করায় টোকেন বিপন্ন বোধ করল। কিছু জবাব না দিয়ে সে কাঁদতে শুরু করল।

প্রভঞ্জনবাবু সান্ত্বনা দিলেন, 'এটা কাঁদার সময় নয়। যদি কোন ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, আমাদের জানা দরকার সেই ষড়যন্ত্রের চাঁই কে !'

এবারেও কিছু বলল না টোকেন। বলবেই বা কী ! ভীতচোখে প্রভঞ্জনবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকল শুধু।

প্রভঞ্জনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে তুলে নিলেন চাদরখানা। তার সারা শরীর জুড়ে হেরে যাবার শিথিলতা। বললেন, ' ভাবছি পুকুরটা এবার বেচে দেব টোকেন। বেঁচে থাকতে এই অপমান আর দ্বিতীয় বার সইতে চাই না।'

ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। শিরীষ গাছের মাথায় দেখা যাচ্ছে এক ফালি চাঁদ। একটা তারা জ্বলছে চাঁদের কাছাকাছি। দুয়ে মিলে চন্দ্রবিন্দু। একবার উদাসভাবে সেদিকে তাকিয়েই প্রভঞ্জনবাবু ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। পেছন পেছন টোকেন।

 

স্বপন নাগ
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top