সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়া (পর্ব তেইশ) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
২ আগস্ট ২০২১ ২০:৪৭

আপডেট:
২ আগস্ট ২০২১ ২৩:১৭

সে সময় রাতুলকে হারিয়ে খুব অস্থির হয়ে পরে নীলিমাস। আনন্দ ও নেই কাছে। সময় যেন এক একটাদিন হাজার দিনের সময় মনের হয়। খুব বই পড়ার অভ্যাস ছিল রাতুলের। নানা বিষয়ের ও মুক্তিযুদ্ধের কত যে বই রয়েছে বিশাল বুক সেলফে থরে থরে সাজানো। এখন এই বইগুলি হয়েছে নীলিমার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দর্শন এর এক বিশাল হাতিয়ার।

রাতুল বলতো, 'কখনো অতীতকে টেনে মনে কোন কষ্ট পেওনা। বই পড়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জান । একদিন আমরাও ইতিহাস হয়ে যাব নীলু। কেউ না জানলেও, তুমি আমিতো জানি, হয়তো কেউ লিখবেনা তোমার আমার কথা ! কিন্তু এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, তুমি আমি মুক্তিযুদ্ধের কালের সাক্ষী হয়ে থাকবো জেনো!'

রাতুল চলে যাবার পর থেকেই নীলিমা এসব ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে। নিতু আসার পর থেকে আরো প্রকট হয়ে উঠেছে এই অদম্য ইচ্ছেটা। নিতু ও নীলিমা দুজনেই রাজাকারদের শিকার।

দুজনের মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত একটা সামঞ্জস্য। নিতু হয়তো আজো জানেনা নীলিমার প্রকৃত ঘটনা। নীলিমাও জানেনা নিতুর পুরো কাহিনী। তবে এটা জানে যে, তারা দুজনেই রাজাকারদের শিকার!

বুকশেলফ থেকে এক এক করে মুক্তিযুদ্ধের বই বের করে ঘাঁটাঘাঁটি করে নীলিমা। রাজাকারদের ইতিহাস জানার চেষ্টা করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে শব্দটি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ক্ষোভ ও ঘৃণা ছড়িয়েছে এবং এখনও ছড়াচ্ছে, সেটি হলো 'রাজাকার'। 'রাজাকার' শব্দটির সাথে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে ১৯৭১ সালেই।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন এর গবেষণা গ্রন্থ থেকে নীলিমা জানতে

পারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য ১৯৭১ সালে খুলনার খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন এর রাজাকার বাহিনী প্রথম গঠন করা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ বাহিনীর জন্য সদস্য সংগ্রহ করা হয় এবং তারা প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় রাজাকার বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতা এ কে এম ইউসুফ, যিনি পরবর্তীতে দলটির নায়েবে আমির হন। মানবতা-বিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে আটক করা হয়েছিল এবং পরে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং খুলনায় শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। তার অধীনে রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস্ বাহিনী গঠন করা হয়।

এই ফোর্সের অধীনে বাঙালীরা যেমন ছিল, তেমনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত উর্দুভাষীদের অনেকে তাতে যোগ দেয়। পাকিস্তান বাহিনী তাদের হাতে অস্ত্রও তুলে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে, রাজাকার বাহিনী ছিল শান্তি কমিটির আওতাধীন। ১৯৭১ সালের জুন মাসে জেনারেল টিক্কা খান রাজাকার আইন জারি করেন। ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীতে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য ছিল, যারা মাসিক ভাতা পেতেন।

 

ওই সময় প্রতি মাসে রাজাকার বাহিনীর একজন সদস্য দেড়শো' রুপির মতো ভাতা পেতেন বলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে অংশ নিতো, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতো,মেয়েদের ধরে আনতো, হত্যা করতো কিংবা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতো।

সে সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে রাজাকার এর পাশাপাশি আরো কয়েকটি বাহিনী বা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এগুলো হচ্ছে - শান্তি কমিটি, আল-বদর এবং আল-শামস।

গবেষকরা আরো বলছেন, যুদ্ধের সময় শান্তি কমিটি গঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জামায়াত ইসলামীর নেতা গোলাম আযম এবং মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন।

অন্যদিকে আল-বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর আমির হন। মানবতবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরে মি. নিজামীকে ফাঁসি দেয়া হয়।

এই ঘৃণ্য রাজাকারদের সূত্রপাত জানার পর বুকের মধ্যে তান্ডব শুরু হয় নীলিমার! আকাশ ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়। ক্ষীণ আলোতে দেখতে পায় নীলিমা তার বীভৎস অতীতকে।

১৯৭১ সাল।

নীলিমাদের আশ্রিত গ্রামে গড়ে উঠেছিলো শত শত রাজাকারবাহিনী। ভাতা পাওয়ার প্রলোভনে যোগ দিয়েছিল অনেক নিরীহ বুভুক্ষ সাধারণ মানুষ। পেটের দায়ে ও প্রাণ রক্ষার ভয়ে অনেকে ঘরের বউকেও তুলে দিয়েছে পাকিদের হাতে। ঐসব নরপশুর দল চারপাশে শকুনের মত খুঁজে বেড়াতো যুবতী মেয়েদের। সেই শকুনের একজন ধরিয়ে দিয়েছিলো তাকে। গ্রাস করেছিল তাদের সোনার সংসারটিকে। আত্মরক্ষার জন্য গ্রামে পালিয়ে এসেও শেষরক্ষা আর হয়নি।

হু হু করে কাঁদতে থাকে নীলিমা।

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। বিদ্যুৎ চমকায়। জানালার কার্নিশে মুখ বাড়িয়ে দেয়। বাতাসে বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দেয় সারা মুখ।

রাত হয়ে গেছে।

আলো আধারিতে দূর পাহাড়টা কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে কানে কানে বলে ۔বন্ধু আমরাতো তোমায় ভালোবাসি। আমার সব নীল ই যে তোমায় ঢেলে দিয়েছি তোমার দুচোখের তারায়। তোমার সকল সুখ দুঃখের ভাগি আমর ۔۔এই আকাশ, বাতাস মেঘ ও নীল পাহাড়ের চূড়া।

নীলিমা চোখ মুখ মুছে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে নিতু দাঁড়িয়ে আছে।

তোকে কিছু না জানিয়েই ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করে ভুনা করেছি। আর মুগডাল এর খিচুড়ি। তুইনা খুব পছন্দ করিস নীলু। সেই ছোটবেলার কথা এখনো মনে আছে তোর।

হ্যারে। আমার সব মনে আছে বন্ধু। তুই মাকে বলতিস। মা রান্না করলেই তোকে ডাকতে বলতেন।

নিতুর চোখদুটি জলে ভরে যায়।

কোথায় হারিয়ে গেলো আমাদের সেই স্বপ্নের দিনগুলো।

ডুকরে কেঁদে ওঠে নিতু।

দুজনে দুজনকে জড়িয়ে কেঁদে বুক ভাষায়।

ড্রাইভার করিম এসে ডাক দেয়-

আপু মনিরা খাইবেন না । টেবিলে সব দিয়া দিছি। খুব সুন্দর ঘ্রান বাইর হইতাছে।

নিতু ও  নীলিমা করিমের কথা শুনে এর মধ্যেও হেসে ফেলে দুজনেই।

চলবে

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top