সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব চব্বিশ) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:৪৮

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৭:২০

 

ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সেড়ে নীলিমা ও নিতু হারিয়ে যায় নিজ নিজ জীবনের গল্পে! ঠিক মন খুলে কেউই কথা বলতে পারেনি দুজনেই! আজ নিতুর অফ ডে! মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ছে আজ কেন যেন!

- তোর মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিস!
- নারে!
- কি করে!
- আমি কিছুই জানিনারে! আমিতো একটা অকর্মন্য মা!শশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসে সুমন এর এক বন্ধুর মাধ্যমে চাকরিটা পাই! মেয়েটাও গ্রাজুয়েশান করে ভালো একটা চাকরি করছে! এটুকুই জানি! দূরে দূরে থাকি! মায়ের অতীত যেন না বুঝতে পারে তাই বুঝি পালিয়ে থাকা! বুঝিসইতো সব নীলু! জানিস ওরা বাবা মাকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে! মাঝে মাঝে ছেলেটা তার বাবা সম্পর্কে খুব বেশি জানতে চায়! জবাব দিতে পারিনা!
- হু ۔۔তুই ও আমার মত নিতু!
- এতো বছর পর দেখা আমাদের! কেউ কারো কিছুই তেমনভাবে জানিনা নীলু! তোকে আর আমাকে রাব্বুল এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছেনরে! আমার আনন্দ ও যে অমন প্রশ্ন করে পাগল করে তুলেছিলো আমাদের! কি জবাব দেব বল!সব কথার যে জবাব হয়না ওরা তা বুঝতেই চায়না! ওরা ওদের মনের কথা শেয়ার করে অন্যভাবে!যা তুই আমি পারিনা!শুধু চোখের জলে বুক ভাসাই!

কথা বলতে বলতে ফোন পেয়ে নীলিমা ঘরে যায়!

করিম আজকের পেপারটা এনে দেয় নিতুকে!

নিতু পেপার পড়তে পড়তে সাহিত্য পাতায় 'মন খুলে কথা বলুন' বিষয়টা খুব মন দিয়ে পড়তে পড়তে একটি লেখা পড়ে থমকে যায়!

 চাইলে বিয়ে করা যায়, ছাড়াও যায়। আবার জীবনভর স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে, একে-অপরে বিপরীত মেরুতে বসবাস করা যায় এবং যাবতীয় প্রেমমোহ থেকে মুক্ত হয়ে শুধুমাত্র সন্তান নামক অবিচ্ছেদ্য 'সেতু'টির জন্য ঝুলে থাকতে হয়। কিন্তু যারা এর কোনটিতেই নেই, তারা কেমন থাকেন!

এই আমার কথাই ধরা যাক, একেক বয়সে একেক ধরনের প্রশ্নে আমার মন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ‘মেয়ে তো মায়ের মতো সুন্দর হয়নি, ফুপুদের চেহারাও পায়নি, এমন হলো কেন!’  আমাকে যেন স্বতন্ত্র চেহারা নিয়ে দুনিয়ায় আসতে নেই! শৈশব-কৈশরের লম্বা সময় কেটেছে মানুষের বিস্মিত চোখমুখ দেখে। 

বয়সভেদে উৎসুক জনতার প্রশ্নের ধরন পাল্টে গেছে। এরপরের ধাপের প্রশ্ন অনেক বছর ধরে আটকে আছে এক জায়গায়। 

বিয়ে করছো না কেনো? অথবা আর কতোদিন একা থাকবে? এই প্রশ্ন শুধু আমাকেই না আমার পরিবারের সব সদস্যকেই স্থান কাল ভেদে শুনতে হয়। পাড়ামহল্লায়, পারিবারিক-

সামাজিক যে কোনো অনুষ্ঠানে, অফিস-দোকান-বাজার বা যে কোনও আড্ডা...কোথাও ছাড় নেই। আব্বা আম্মাকে অহরহ শুনতে হয় বিয়ে দিচ্ছেন না কেনো? ভাইবোনসহ কাছের আত্মীয়দের বলা হয়, ওকে ধরে একটা বিয়ে দিয়ে দাও।

বা অনেকদিন পর দেখা হওয়া কারোর প্রশ্ন- তোমার ছেলেমেয়েরা কতো বড়ো হলো, কি পড়ে? নিতান্তই নির্দোষ প্রশ্ন। কিন্তু বিয়েই করিনি শুনে প্রশ্নকর্তার খাবি খাওয়ার দশা।

আবার এও শুনি বিয়ে না হওয়ার বা না করার কারণ হলো আমার ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনরাত একাকার করে কাজ করাই নাকি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, প্রফেশনটাও রেহাই পায়নি। 

একজন মানুষ একটা বয়সের পর নানা কারণেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটা তার একান্ত নিজের ইচ্ছে বা অনিচ্ছের ব্যাপার হতে পারে। হতে পারে পরিবার থেকে সময়মতো উদ্যোগী না হওয়ার মাশুল। কেরিয়ারিস্ট মানসিকতা, অন্যের প্রতি বিশ্বাসে চিড় ধরা বা একক জীবনে সাংঘাতিকভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। অথবা সবকিছুর ওপর ভীষণ বিরক্তি,বিতৃষ্ণা। কিম্বা কারোর ওপর জমাটবাঁধা অভিমান, যা ভেঙে বেরিয়ে আসা অসম্ভব।

কাজী সাহেব রাগে গড়গড় করে বলেন-আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে না, থাকুক আমার কাছে। ভাইয়া মন খারাপ করে বলে, থাক না, ভাগ্যে থাকলে হবেই। আমার বর্তমান-ভবিষ্যতের চিন্তায় কেঁদে আকুল হয়ে ভাসায় ছোট আর মামণি (আমার মেঝ ও ছোট ফুপু)। সামান্যতেই খুশি হওয়া আম্মা দিনকেদিন হচ্ছেন ভাবলেশহীন। অন্য কারোর বিয়ের খবর শুনে ফেলেন দীর্ঘশ্বাস। মহামারি শুরুর পর আম্মা বলেই বসলো, ভালোই হলো, এই করোনার মধ্যে লোকজনের সঙ্গে দেখা হবে কম, কেউ আর প্রশ্ন করবে না....সামাজিক নিগ্রহের অনেক ধরন, অনেক। সবটা চোখে দেখা যায়না।

কিন্তু বিয়ে না করাই মানে একা থাকা, বিবাগী হয়ে জাগতিক সকল দায় দায়িত্ব কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকা, বিষয়টি সত্যি নয়। সামাজিক শিষ্টাচার মেনে একজন মানুষ যে ধরনের জীবন বেছে নিতে চান তাকে সেভাবেই থাকতে দেয়া যায় কিন্ত। অহেতুক পরামর্শসুলভ খোঁচায় তার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা খুব কি প্রয়োজন!

আমাদের সৎ থাকতে কষ্ট হয়, পরিশ্রম করতেও ভীষণ আপত্তি , নিয়ম ভাঙতেও আমরা বিশেষ পারদর্শী। কিন্তু অন্যের জীবনের সুবিধা-অসুবিধা প্রসঙ্গে একেবারেই আগাগোড়া না জেনে উপদেশ দিয়ে বিব্রত করতে সিদ্ধহস্ত। 

না, আমি আমার বক্তব্য একপেশে করতে চাইনা। সবাই যে কষ্ট দিতেই এ প্রসঙ্গ তোলেন সেটাও ঠিক নয়। খুব কাছের স্বজন বা সত্যিকারের শুভাকাঙ্খীরা ভালোবেসে বা দু:শ্চিন্তা থেকেও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। উদ্যোগী হয়ে উঠেপড়ে লেগে যান পাত্র খুঁজতে।  

এখন অফিস শেষে বাসায় ফিরে এবং কাজ শেষ না হওয়া সংসারের কাজ শেষ করার অহেতুক চেষ্টা করে, আমার এক চিলতে ঘরে ছোট্ট খাটে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে ক্লান্তি তাড়ানোর চেষ্টা করি। 

আম্মা এসে চেয়ারে বসে আস্তে আস্তে বলে, ‘এভাবে কি দিন চলে? ঝগড়া করতেও একজন মানুষ লাগে পাশে, তুই কি সত্যিই ভালো আছিস!’

উৎকণ্ঠায় ডুবে থাকা মায়ের সঙ্গে তর্ক চলে না। যে কোনো যুক্তি তার কাছে খেলো। আম্মার হাতটা ধরে স্পর্শ বার্তায় মনে মনে বলি ‘ঝগড়ার বা ভালোবাসার মানুষটির কাছে পৌঁছুতে না পারার সমস্ত অক্ষমতাই আমার। তোমরা আমাকে নিয়ে ভালো না থাকলেও তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি ভালো আছি, সত্যিই ভালো আছি। সন্তানমাত্রই স্বার্থপর, আমিও এর ব্যতিক্রম নই।" (সূত্র : ফেস বুক)

পড়তে পড়তে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে ওঠে নিতুর! মেয়েটার কথা খুব বেশি মনে পড়ে  যায়! আবার সান্তনাও পায়, এই ভেবে যে, পৃথিবীতে শুধু সে ই নয়! ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব পরিবারেই এমন হতভাগী মেয়েরা ধুকে ধুকে পথ চলে সমাজের নানা কটাক্ষ উপেক্ষা করে!

 

নীলিমা ফোন এ কথা শেষ করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে এসে নিতুকে জড়িয়ে ধরে!

- আমার আনন্দ আসছেরে নিতু এই মাসেই!জানিস আমার আনন্দ বিয়ে করেছে! বৌ নিয়ে আসবে!

তুই কিন্তু থাকবি আমার কাছেই!

- না না নীলু, তা হয়না!
- কেন হয়না!
- দেখ নীলু, আমি একটা অগোছালো দুঃখী মানুষ!
- বাজে কথা বলিসনাতো নিতু! তারপর বল, তোর ছেলের কি খবর!
- এখন থাক নীলু! অন্যসময় বলবো কেমন?
- আচ্ছা!

(চলবে)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top